ইমাম আহমাদ ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.)
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:০৩:৩০ রাত
বিস্মৃত মহামানব- ইতিহাসের আড়ালে চলে যাওয়া মহান পুরুষদের অসামান্য জীবনী
Forgotten Heroes- A tribute to the greatest men on earth.
পর্ব -০৬
শাইখুল ইসলাম হযরত আবুল আব্বাস ত্বকীউদ্দিন আহমাদ ইবনে আব্দুল হালিম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.)
"কাহা মুজাহিদ-ই-তুর্কনে মুঝসে বাদ-এ-নামায
তাওয়িল সাজদা হ্যায় কিঁউ ইস কাদার তুমহারে ইমাম
উয়ো সাদা মার্দ-এ-মুজাহিদ উয়ো মোমিন-এ-আযাদ
খাবার না থি উসে ক্যায়া চিজ হ্যায় নামায-এ-গুলাম
হাযার কাম হ্যায় মার্দান-এর-হুর কো দুনিয়া মে
ইনহিকে যাওক্ব-এ-আমাল সে হ্যায় উম্মাতোকে নাযাম
বাদান গুলাম কা সওয-এ-আমাল সে হ্যায় মেহরুম
কে হ্যায় মুরোর গুলামোকে রোজ-এ-শাব পে হারাম
তাওয়িল সাজদা আগার হ্যায তো ক্যায়া তা'জ্জুব হ্যায়
ওয়ারায়ে সাজদা গারিবো কো আওর ক্যায়া হ্যায় কাম
খুদা নাসিব কারে হিন্দকে ইমামো কো
উয়ো সাজদা জিসমে হ্যায় মিল্লাত কি জিন্দেগি কা পাইয়াম। "
২রা রমাদ্বান, ৭০২হি। সিরিয়ার সাকহাব প্রান্তরের একদিকে সিরীয় ও মিশরীয় যৌথ বাহিনী, অপরদিকে জগৎকুখ্যাত তাতারী বাহিনী যুদ্ধংদেহী অবস্থায় দন্ডায়মান। সংখ্যাধিক্য স্বত্ত্বেও যৌথ বাহিনী মনে তাতারীদের যুদ্ধকৌশল, বর্বরতা ও নৃশংসতার ভীতি সঞ্চার করেছে, যা একদিকে যেমন তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে, অন্য দিকে তাদের মনোবল ও সাহসেও চীর ধরিয়েছে। তথাপি রমাদ্বানের রোজার কারণে কিছুটা হলেও শারীরিক দূর্বলতা তো ছিলই। বোঝাই যাচ্ছিলো এ অবস্থায় তাতারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে পরাজয় নিশ্চিত। এমন সময় এক দামেস্কী আলেম খোলা তরবারী হাতে যৌথ বাহিনীর প্রতিটি কাতারে, প্রতিটি তাবুতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সৈন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে খাদ্য গ্রহণ করতে লাগলেন এবং বললেন “হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- আগামীকাল শত্রুপক্ষের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হবে, সিয়াম ভঙ্গের মাধ্যমে তোমরা অধীকতর শক্তিশালী হবে। সুতরাং হে সৈনিকগণ! তোমরা পানাহারের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় কর এবং আল্লাহর উপর আস্থা রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়। বিজয় তোমাদের সুনিশ্চিত।” তাঁর উৎসাহব্যঞ্জক ও উদ্দীপনামূলক কথায় সৈন্যরা হৃত সাহস ও মনোবল ফিরে পেল।
অবশেষে শুরু হলো ভীষণ যুদ্ধ। সৈন্যরা অবাক হয়ে দেখছিলো সেই আলেম, যিনি সর্বদা কিতাব, দরস আর ইবাদতে মশগুল থাকতেন, আজ “আল্লাহু আকবার” নিদানে সিংহবিক্রমে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের লন্ডভন্ড করে দিচ্ছেন। অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে এবং উক্ত আলেমের উৎসাহ ও প্রত্যক্ষ অবদানে দুর্জয় তাতারী ফৌজ পরাস্ত হলো। সকলেই এই জয়ের পেছনে উক্ত আলেমের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান আকুন্ঠ চিত্তে স্বীকার করে নিলেন। সিরীয়াবাসী তাদের নায়ককে যথাযথ সম্বর্ধনা জানিয়ে শহরে নিয়ে গেল।
এই আলেম ব্যক্তিটি ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ, আরবী ভাষাবিদ, দার্শনিক, যুক্তিবিদ, মুজতাহিদ আলেম, সর্বোপরি একজন মুত্তাক্বী মুজাহিদে ও দাঈ’ ইলাল্লাহ তক্বীউদ্দিন আহমাদ ইবনে তাইমিয়াহ (রহি.)।
যুগে যুগে দুনিয়ার মানুষের হেদায়েতের জন্য, হক্বের প্রতিষ্ঠা ও বাতিলের সর্বনাশের জন্য আল্লাহ তাঁর খাস মুজাদ্দিদ ও ওলীদের প্রেরণ করেন। ইবনে তাইমিয়াহ (রহি.) ৮ম হিজরী শতাব্দিতে তেমনি একজন মুজাদ্দিদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি যেমন মানুষকে সঠিক দ্বীনের পথে আহবান করেছেন, সে পথে চলার তরিকা বাতলে দিয়েছেন, তেমনি তিনি এমনই বিরল মুজাহিদ আলেমদের একজন যারা বাতিলের শুধু মুখোশ উন্মোচনেই ক্ষান্ত হননি, বরং প্রত্যক্ষভাবে স্বশরীরে তাদের বিরুদ্ধে জীহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন।
এই দূর্লভ গুনবান মনীষির জন্ম ৬৬১হি. ১০ই রবিউল আউয়াল, সোমবার সিরীয়ার হাররান প্রদেশের বিখ্যাত তাইমিয়াহ খান্দানে। এই খান্দানের উর্ধ্বতন মহীয়ষি, বিদূষী ও বাগ্মি মহিলা তাইমিয়ার নামানুসারে খান্দানটি আসিরাত-ই-তাইমিয়াহ (তাইমিয়ার বংশধর) নামে পরিচিতি লাভ করে। এই খান্দানটি জ্ঞান, বিদ্যা ও দ্বীনদারির জন্য পুরো দেশজুড়ে বিখ্যাত ছিলো। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার দাদা মাজুদ্দিন ইবনে তাইমিয়াহ (রহি.) তাবাকাতে হাম্বালিয়ার একজন বিখ্যাত আলেম ও ইমাম ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত রচনা হাদীস শাস্ত্রের কিতাব “মুনতাক্বিউল আখবার”। শাইখুল ইসলামের পিতা শিহাবুদ্দিন আব্দুল হালীম ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ আলিম, মুহাদ্দিস ও ফিক্বহে হাম্বলীর ইমাম। তিনি অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন, এমনকি হাদীসের দরস প্রদানকালে কিতাবাদি ও মুতাআলা ব্যতীতই নিজ স্মৃতি হতে দরস প্রদান করতে পারতেন।
ঐ সময়টি ছিলো ভয়ঙ্কর তাতারী ফৌজের কাল। তাদের অতর্কিত আক্রমনের ভয়ে সকলেই শঙ্কিত থাকতো। বিশেষ করে ইরাক ও জাজিরাতুল আরবে তাদের তান্ডব ছিলো মারাত্মক। নিজেদের সম্ভ্রম ও আবরু রক্ষার্থে শেষমেষ শাইখ আব্বা দামেশকে হিজরত করেন। এই দামেশকই ছিলো শাইখুল ইসলামের শিক্ষাভূমি ও কর্মভূমি।
ইবনে তাইমিয়াহর (রহি.) প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গৃহেই আরম্ভ হয়। প্রথমে তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। অতঃপর পিতার নিকট আরবী ভাষা, ব্যাকরণ, অলঙ্করণ শাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, হাদিস, ফিক্বাহসহ দ্বীনি ইলমের সবগুলো শাখার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে জামী উমাইয়্যা ও দারুল হাদীস আস-সুকরিয়ায় নিয়মিত দরসে উপস্থি হতে লাগলেন। তৎকালীন সিরিয়া ছিলো জগৎবিখ্যাত আলেমে দ্বীনদের আবাস ভূমি। ফলে সহজেই তিনি যোগ্য শায়েখের সাহচার্য লাভ করেন ইলমের সবগুলো শাখায় অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেন। ইবনে আব্দুল হাদীর মতে, শাইখুল ইসলামের শুধু হাদীসের উস্তাদ ছিলো ২০০’র বেশী এবং তাঁর া সকলেই ছিলেন ইবনে আবু দাইম আল মাকদিমী ও সবগোত্রিয় মুহাদ্দিস। আল্লাহহ পাক তাঁকে অসামান্য মেধা ও স্মৃতি শক্তি দান করেছিলেন। যে কোন কথা মাত্র একবার দেখে /শুনে তাঁর মুখস্থ হয়ে যেতো। এবং তিনি মুখস্থকৃত কালাম কখনো ভুলতেন না। এভাবেই মাত্র ২০ বছর বয়সের মেধ্যই তিনি ইলমের সবগুলো শাখায় ব্যাপক বুৎপত্তি লাভ করেন।
৬৮২হি. ইমামের পিতা ইন্তেকাল করেন। পরের বছর ২রা মুহাররাম তারিখে তিনি পিতার স্থলবর্তী হিসেবে দারুল হাদীষ আস-সুকরিয়ায় হাদীসের দরস প্রদান আরম্ভ করেন। একই বছর ১০ই সফর হতে তিনি পিতার স্থলে উমাইয়্যা মসজিদে তাফসিরের দরস প্রদান শুরু করেন। অল্পদিনেই তাঁর দরসের প্রশংসা দেশব্যপী ছড়িয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন প্রান্ত হতে অগণিত ছাত্র ও আলেম তাঁর দরসে উপস্থিত হতে আরম্ভ করেন। ৬৯২হিজরীতে খ্যতনামা হাম্বলী শাইখ যাইনুদ্দিন ইবনে মুনজী ইন্তেকাল করলে ত্দবীয় স্থলে ইমামকে হাম্বলীয়া মাদরাসায় সদরুল মুদাররিস পদে নিযুক্ত করা হয়। একই সাথে সিরিয়া সহ সমগ্র আরব ও সুদূর আযম ভূখন্ডে তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যের চর্চা মুখরিত হতে থাকলো।
শেখ সালেগ তাযুদ্দিন বলেন, “আমি নিয়মিত ইবনে তাইমিয়্যার দরসে হাজির হতাম। তিনি সয়লাবের মতো উদ্দাম হয়ে ছুটতেন, খরস্রোতা নদীর মতো প্রবাহিত হতেন। উপস্থিত শ্রোতা চোখ বন্ধ করে ভীত সন্ত্রস্ত ও স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতো। দরস শেষ হলে তিনি ছাত্রদের সাথে খোশ মেজাজে কথা বলতেন। মনে হতো দরসের সময় তিনি কোন এক অদৃশ্য রহস্যলোকে হারিয়ে গিয়েছিলেন, এখন পুনরায় তিনি দুনিয়ার বাস্তবতায় ফিরে এসেছেন। ”
শাইখ সিরাজ উদ্দিন আবু হাফস আল বাযযার বলেন, “মনে হতো ’ইলম’ তাঁর শিরা-উপশিরা, অস্থিমজ্জা ও শরীরের প্রতিিট রক্ত কণিকায় মিশে গেছে। ” এমনকি ইমামের জীবদ্দশায় তাঁর সাথে বহু বিষয়ে মতানৈক্য থাকা স্বত্ত্বেও সমসাময়িক অপর বিখ্যাত আলেম আল্লামা কামালুদ্দিন তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “আল্লাহ তাঁর (ইবনে তাইমিয়্যার) জন্য ইলমকে এমন সহজ করে দিয়েছেন, যেমনটি তিনি দাউদ (আঃ)-এর হাতে লোহাকে নরম করে দিয়েছিলেন।”
ইমাম তার পুরোটাই সময়ই দরস প্রদান, ওয়াজ-নসিহত, ইবাদাত-মুজাহাদার মধ্যে নিমগ্ন থাকতেন। আল্লাহ তা’আলা নিজ অপার অনুগ্রহে ইলমের সবগুলি শাখাতেই ইমামকে অসাধারণ পান্ডিত্র ও দক্ষতা দান করেছিলেন। সেই সাথে দান করেছিলেন অভূতপূর্ব বাগ্নিতা, সুক্ষèাতিসুক্ষè বিষয়ে তিনি এমনভাবে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করতেন যে উপস্থিত শ্রোতাদের তা বুঝে উঠতে কোন বেড়ই পেতে হতো না। যে কোন বিষয়ই তিনি এত সুগভির ভাভে বিশ্লেষন করতে পারতেন যে, উপস্থিত শ্রোতার মনে হতো তিনি হগয়তো এই বিষয়েই অভিজ্ঞ। বিশেষতঃ হাদীস শাস্ত্রের উপর ইমামের অগাধ পান্ডিত্য ও দক্ষতা ছিলো সময়ের শ্রেষ্ঠতম। তিনি কোন পর্যায়ের মুহাদ্দিস ছিলেন, তা বোঝার জন্য সেই একটি উক্তিই যথেষ্ঠ যা সর্বস্তরের আলেম-উলামার মুখে মুখে ফিরতো- “ইবনে তাইমিয়্যাহ যেটিকে হাদীস হিসেবে জানে না, তা আসলে হাদীসই নয়।”
ইমামের আরেকটি গুন ছিলো, তিনি যা ভূল বা বাতিল বলে মনে করতেন, তার সাথে কোন আপোষ করতেন না। বিশেষভাবে গ্রীকবাদী মুতাকাল্লিমিন, বাতেনী সম্প্রদায়, শীআ ও রাফেজি , জাহমিয়া, হাকিমিয়া ফেরকা, শরীআ বিমুখ সুফি ও দরবারী আলেমদের বিরুদ্ধে তাঁর জবান ও কলম সদা সোচ্চার ছিলো। এবর ফলে এই দলের লোকগুলো তাঁর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিলো এবং তাদের মধ্যে যারা শাসকদের প্রিয়পাত্র ছিলো তাদের মাধ্যমে চক্রান্তের জাল বিছাতে লাগলো।
এতদিন সবকিছু সাধারণ নিয়মেই চলছিলো। ৬৯৮হি. সালে ইমামের একটি ফাতওয়াকে কেন্দ্র করে ইমামের শত্র“পক্ষ, যারা ইমামের খ্যাতি ও জ্ঞানের প্রতি ঈষাণ্বিত, আর যাদের ইমাম খোলাখুলি সমালোচনা করতে, তারা ইমামের বিরুদ্ধে এবার প্রকাশ্যে মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে গেলো। ইবনে কাসিরের ভাষ্যমতে, ৬৯৮হি সিরিয়ার হেমা শহরের কিছু লোক ইমামের কাছে ”রাহমান আরশের উপর অধিষ্ঠিত” “অতঃপর তিনি আসমানে অধিষ্ঠান করলেন”, ”আদম বংশধরের হৃদয়গুলো রাহমানের অঙ্গুলিসমূহের ভিতত দুটি অঙ্গুলির মাঝে অবস্থিত”, “প্রবল পরাক্রমশালী আল্লহ জাহান্নামের মাঝে পা রাখলেন” ইত্যাদি আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যা এবং আল্লাহর গুনাবলী সম্পর্কে আহলে সুন্নাত উলামাগণের মত ও পথ সম্পর্কে জানতে চেয়ে পত্র লেখেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) উপযুক্ত দলীল ও এতদ্বসংক্রান্ত বিষয়ে সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.)Ñ তাবেঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, মুতাকাল্লিমিন মত, পথ ও বাণির মাধ্যমে সঠিক বিশ্বাসটি উল্লেখ করেন। পাশাপাশি ভারতীয় ও গ্রীক দর্শন প্রভাবিত মুতাকািিল্লমিন , বাতিল উদ্ভট আক্বিদা ও যুক্তিসমূহ খন্ডন করে উপযুক্ত জবাব প্রদান করেন (এই জবাবটি নামক ৫০ পৃষ্ঠার একটি কিতাব হিসেবে কায়রোতে প্রকাশিত হয়েছে)। ইমামের উক্ত ফাতওয়াটি আহলে সুন্নাত আক্বিদায় বিশ্বাসি উলামায়ে কিরামদের নিকট সমাদ্রিত হলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে লুকিয়ে থাকা আশআরি ও ভ্রান্তদ মুতাকাল্লিমিনদের বুকে সেলের মতো বিদ্ধ হয় তারা স্থানীয় আমিরের কাছে ইমামের বিরুদ্ধে বিকৃত আক্বিদা প্রচারের অভিযোগ তোলে। আমিরের অনুরোধে কাজী ইমামউদ্দিন শাফির মজলিসে ইমাম তাঁর ফাতওয়ার ব্যাখ্যা প্রদান করেন ও উত্থাপিত প্রশ্নসমূহের উত্তর প্রদান করেন। উপস্থিত উলামায়ে কেরামগণ ইমামের মতামতকে শুদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেন এবং আমির তার উপর উত্থাপিত অভিযোগ নাকোচ করে দেন।
৬৯১হিজরীর শুরু থেকে কুখ্যাত তাতারী বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ আসতে থাকে। চারদিকে আতঙ্ক, ভীতি ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়। কিছুদিনের মধ্যে সংবাদ আসে মিশরের সুলতান মালিকুন নসর মুহাম্মাদ ইবনে কালাউন তাতারিদের দমনে সসৈন্য রওয়া দিয়েছেন। ২৭ই রবিউল আউয়াল তারিখে তাতারি শাসক কাজান ও মামলুক সুলতানের সৈন্য মুখোমুখী দন্ডায়মান হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ সুলতানের সৈনবাহিনী শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় এবং বিজয়ী তাতারি সৈন্য দামেস্ক অভিমুখে রওনা করে। এই খবরে দামেস্কের লোকজনের মধ্যে আরো ভয় ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সাধারণ লোক তো বটেই, এমনকি রাষ্ট্রিয় বড় বড় কর্মকর্তারাও শহর পরিত্যাগ করতে শুরๆ করে। এমতাবস্থায় স্থানীয় কিছু সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের অনুরোধে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) তাতারী সুলতান কাজানের সাথে সাক্ষাত করে তাকে বুঝিয়ে দামেস্ক আক্রমন থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্ঠা করতে সম্মত হন। ১৩রা রবিউস সানি তারিখে ইমাম সঙ্গী-সাথীসহ কাজানের সাথে সাক্ষাত করেন। ইমাম এই সময় কাজানকে কুরআন হাদিসের আলোকে আদল ও ইনসাফ সম্পর্কে হুকুম আহকাম শুনাতে থাকেন। শাইখ কামালউদ্দিন ইবনুল আনজা বর্ণনা করেন, এই সময় ইমামের আওয়াজ ক্রমেই উচু হচ্ছিল। তিনি কাজানকে সরাসরি বললেন, “তুমি নিজেকে মুসলমান দাবি কর, আবার মুসলমানদের উপর আক্রমনও কর; অথচ তোমার বাপ দাদা কাফির হওয়া স্বত্ত্বেও এমন কাজ করা থেকে বিরত ছিলেন।” এমন সুস্পষ্ট ও কঠোর বাক্য উচ্চারণ স্বত্ত্বেও কাজান মনোযোগের সাথে শুনছিলেন। ইতোমধ্যে উপস্থি তসকলের জন্য খাবার আনা হয়। সকলেই খাবার গ্রহণ করলেও ইমাম হাত গুটিয়ে নেন। জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “গরিব মুসলমানদের ভেড়া বকরির গোশত, সাধারণের বৃক্ষের ডালপালার জ্বালানী দিয়ে রান্না করলে খাবার আবার জায়েয হয় কবে থেকে!” খানা শেষে কাজান দু’আ আবেদন করলে ইমাম হাত উঠিয়ে বলেন, “হে আল্লাহ! যদি তুমি মনে করো কাজানের এই যুদ্ধের পেছনের উদ্দেশ্য তোমার বাণিকে পৃথিবীতে বুকে সমুন্নত করা এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা তাহলে তুমি তাকে সাহায্য কর। আর যদি; তার উদ্দেশ্য হয় রাজ্য লাভ এবং দুনিয়ার লোভ, তাহলে তার সঙ্গে তুমিই বোঝাপড়া কর।” কাজী আবুল আব্বাস বলেন, “একদিকে ইমাম এই দুআ করছেন, অন্য দিকে আমাদের অবস্থা এই যে আমরা কাপড় গুটাচ্ছি এই ভয়ে যে, এখনি ইমামের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে আর রক্তের ছিটা যে আমাদের গায়ে না লাগে। আশ্চর্যের বিষয় স্বয়ং কাজান ইমামের দুআর সাথে আমিন আমিন বলছিলো। অনন্তর যঙার মনে গায়রๆল্লাহর ভীতির কোন রোগ নেই, কেবল তিনিই পারেন এমন সাহসিকতা দেখাতে।
ইমামের ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত কাজান দামেশকে হামলা না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও আশপাশের এলাকাগুলো তাতারীদের তান্ডব থেকে রেহাই পায় না। শত শত লোক নিহত হয়, হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে ক্রিতদাস বানানো হয়। দোকান পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুন্ঠিত হয়, এমনকি কুতুবখানা লুন্ঠন করে বহু মুল্যবান ও দুস্প্রাপ্য কিতাব সের দরে বিক্রি করে দেয়া হয়। অবস্থাদৃষ্টে ইমাম পুনরায় কাজানের সাথে সাক্ষাত করতে রওনা হলেন। কিন্তু দুই দিন অপেক্ষা করা স্বত্ত্বেও তাকে সাক্ষাত করতে দেয়া হয় না। ফলে এবার ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসতে হলো ইমামকে। অপরদিকে কাজান ৬০হাজার সৈন্য সিরিয়া সীমান্তে রেখে ইরাক অভিযানে রওনা হয় এবং শীত মৌসুমে সিরিয়া আক্রমণের হুমকি প্রদান করে যায়।
অবস্থাদ্রষ্টে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) নিজ উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টহলদারীর ব্যবস্থা করেন। শাসকবিহীন দামেস্কের তখন বেহাল অবস্থা। তার উপর তাতারীরা স্থানে স্থানে শুড়িখানা খুলে মদের ব্যপক বিক্রি চালু করে। ইমামের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী প্রত্যেকটি শুড়িখানা ভেঙ্গে দেয় এবং সেখানে অবস্থান করা মদ্যপ লোকগুলি, যারা বিভিন্ন সময় অরাজকতা সৃষ্টি করতো, তাদেরকে শাস্তি দেয়। পাশপাশি রাজ্যের নায়েব জামালুদ্দিন আকুশেরসাথে জরদ ও কিসওয়ান পাহাড়ে বসবাসকারী অবাধ্য খ্রিস্টান ও শিআদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এই লোকগুলো স্থানীয় মুসলমানদের উপর নানা প্রকারের জুলুম, হত্যা, ছিনতাই ও ডাকাতি করতো এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাতারীদের সর্বপ্রকার সহযোগীতা করতো। অভিযানের ফলে এদের নেতৃস্থানীয়রা ইমামের সাথে সাক্ষাত করে পূর্বকৃতকর্মের জন্য তওবা করে ভবিষ্যতে পুনরায় এরূপ কাজ না করার অঙ্গীকার করেন।
৭০২হি. রজব মাসে নির্ভরযোগ্য সূত্রে তাতারীদের আক্রমনের খবর আসলো। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ) নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে তৈরি হলেন। মিশরের সুলতানও সসৈন্য তাতারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নিমিত্তে এসে পৌছালেন। ইমাম সমস্ত আমীরদের নিকট হতে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার শপথ আদায় করলেন।
ইতোমধ্যে সিরিয়ায় পবিত্র রমাদ্বানের চাঁদ দেখা গেল। শহরবাসী তারাবীহর প্রস্তুতি নিতে থাকলো। এরই মাঝে প্রশ্ন উঠলো যে, সাওম পালন করা অবস্থায় দুর্বল শরীরে শত্রুর সাথে মোকাবিলা করা তো আত্মহত্যারই শামিল। এমতাবস্থায় সিরিয়াবাসী কিভাবে তাতারীদের সামনে দাঁড়াবে? ইমাম সাথে সাথে কুরআন, হাদীস, আসারে সাহাবা ও তাবেঈন-এর আলোকে ফাতওয়া জারী করলেন যে, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তাদের জন্য সাওম না রাখার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, মিশরীয় ও সিরিয় বাহিনী যেন সাওম ভঙ্গ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
২রা রমাদ্বান তারিখে সাকহাব প্রান্তরে উভয় পক্ষ সম্মুখ সমরে দন্ডায়মান হলো। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) পুনরায় নিজের ফাতওয়া প্রচার করলেন যে, মুজাহিদ বাহিনী সিয়াম ভঙ্গের মাধ্যমে যুদ্ধের শক্তি অর্জণ করতে পারবে। তিনি নিজে প্রতিটি ছাউনিতে গেলেন। তাঁর হাতে থাকতো খাদ্যবস্তু, সকলকে দেখিয়ে তিনি খাদ্য গ্রহণ করতেন এবং হাদীস শুনাতেন রাসূল (সাঃ) “আগামাীকাল দুশমনের সঙ্গে তোমাদের মোকাবিলা হবে। সিয়াম ভঙ্গের মাধ্যমে তোমরা অধিক শক্তিশালী হবে।”
যুদ্ধ শুরু হলো। সিরিয় বাহিনী পঙ্গপালের শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সুলতান স্বয়ং নিজের ঘোড়ার পা শিকল দিয়ে বেঁধে দিলেন যাতে পালানোর পথ না থাকে। সিরিয়াবাসী অবাক হয়ে দেখছিলো কিভাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) সিংহবিক্রমে শত্রুদের আক্রমণ করছেন। যে হাত সর্বদা কলম ও আর দুআর জন্য উঠতো, আজ সে হাতে তীক্ষè তরবারীর চাকচিক্য শত্রুদের চোখ ধাঁধিয়ে তাদের মস্তক দেহ হতে ছিন্ন করছে। আর সে রূধির ধারায় তরবারীর চাকচিক্য ম্লান হয়ে আসছে। পরনের সাদা জামায় রক্তের ছিটা পড়ে এক ভয়ংঙ্কর সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। এ যেন স্বয়ং শেরে খোদা আলী (রাযি.) যুলফিক্বার হাতে ফিরে এসেছেন।
অবশেষে ভীষণ যুদ্ধের পর অজেয় তাতার বাহিনীর পতন হলো। শতশত তাতারী নিহত হলো, হাজারো হলো বন্দি। বিজয়ী মুসলিম ফৌজের তাকবির নিদানে সাকহাব প্রান্তন কেঁপে কেঁপে উঠলো। ৪ঠা রমাদ্বান ইমাম নিজ শহরে ফিরলেন। দামেশকবাসী ব্যাপক আড়ম্বর, অভ্যর্থনা ও মুবারকবাদ জানিয়ে বীর মুজাহিদকে বরণ করে নেয়।
দামেশকে ফিরে এসে ইমাম নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। দারস-তাদরীস, ওয়াজ-নসীহত, ফাতওয়া প্রদান চলতে থাকে নিয়মমাফিক। তিনি শুধুমাত্র সামজিক প্রেক্ষাপটে শরঈ হুকুম প্রচারেই ক্ষান্ত থাকতেন না, বরং বাস্তবায়নের ও সর্বদা সচেষ্ঠ থাকতেন। তিনি ও তাঁর শাগরেদগণ সমাজে প্রচলিত গইরে শরঈ কর্মকান্ড উচ্ছেদের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন। তাদের কাজ ছিলো শুঁড়িকানা, জুয়া খানা ইত্যাদি উৎখাত করা, বিদআত ও গোমরাহীতে মগ্ন লোকদের শুধরাতে তাবলিগ করা, দ্বীনের দাওয়াত সর্বস্তরে পৌছে দেয়া ইত্যাদি। ইমাম তাঁর এ বাহিনীর নাম দিয়েছিলেন ”حسبة الله ” । ইমামের এ তৎপরতা সমস্ত তার বিরোধীপক্ষকে ভাবিয়ে তুললো এবং তারা ইমামকে অপদস্থ করার সুযোগ খুঁজতে থাকলো। তাদের হাতে সুযোগ এসেও পড়লো।
ইমাম বরাবরই “ওয়াহদাতুল উজুদ”[১] মতবাদের প্রকাশ্য সমালোচনাকারী ছিলেন এবং তৎকালীন সময় এ সংক্রান্ত বাড়াবাড়ি যকণ চরমে পৌছেছিলে া তখন তিনিও খোলাখুলিভাবেই তাঁর সমালোচনা ও মতামত প্রকাশ করতে শুরু করলেন। ৭০২হি. এ মতবাদের অন্যতম প্রচারক শাইখ আল মুনজির কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি“ওয়াহদাতুল উজুদ” ও এসংক্রান্ত শাইখ ইবনে আরাবী, সদর রূমী, তিলিমসানী ও ইবনে সাব’ঈন-এর মনোভাবকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন এবং সেখানে ভুলগুলো চিহ্নিত করেন। পরবর্তীতে চিঠিটি প্রকাশ পেয়ে গেলে চারিদিকে শোরগোল শুরু হয়্। সে সময় এ মতবাদের অনুসারীর সংখ্যা নিতান্তই কম ছিলো না। সালতানাতের বড় বড় কর্মকর্তা এ মতবাদের অনুসারি ছিলো। এমনকি উজিরে আজম স্বয়ং এ মতের শক্ত অনুসারী ও শাইখ আল মুনজির শীষ্য ছিলেন। শাইখ আল মুনজির অনুরোধক্রমে উজিরে আজম ইমামকে মিশর ডেকে পাঠায় এবং এবং প্রহশনমূলক বিচারের মাধ্যমে ইমামকে কারাগারে প্রেরণ করে।
ইমামের বন্দিত্বের খবর যখন মিশরের হক্কানী উলামা ও কাজীদের নিকট পৌছায় তখন তারা ইমামের মুক্তির জন্য সুলতানের কাছে সুপারিশ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে ইমামের মুক্তি প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু শর্তগুলো শুনে ইমাম স্পষ্ট ভাষায় সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, “এই শর্ত মেনে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) অসন্তুষ্টি কামাতে রাজি নই।“ তিনি কারাবরণকেই আল্লাহর ইচ্ছা মেনে নিলেন।
ইমাম যখন কারাগারে প্রবেশ করলেন তখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন মিশরের নামকরা খুনি, চোর, ডাকাত, বদমাশদের আড্ডাখানা সেখানে। কিন্তু ইমাম যে ভিন্ন ধাতুতে গড়া! তিনি আফসোস করতে লাগলেন, “দ্বীন থেকে মাহরূম হয়ে লোকগুলো দু’হাতে গুনাহ কামিয়ে নিচ্ছে।” এবার কারাগারে শুরু হলো তাঁর দাওয়াত, তাবলীগ, মুজাহাদা, দরস ও আধ্যাত্মিক রাহবারি। তাঁর মুবারাক সংস্পর্ষে অপরাধপ্রবণ লোকগুলো খাস দিলে তাওবা করে ঈমানের পথে ফিরলো। জুব কারাগার ক্রমেই আলিশান খানকায় পরিণত হলো। ৪ াস পর আমির মুহিন্না ইবনে ঈসার অনুরোধে ইমাম কারাগার হতে মুক্তি লাভ করলেন।
মুক্তি লাভের পর তিনি প্রথমে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলেও মিশরের তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি, সর্বদিকে শিরক-বিদআতের ছড়াছড়ি তাকে দেশে ফিরতে দিলেন না। তিনি মিশরের মানুষকে দ্বীনি হেদায়েত দান করতে মিশরে রয়ে গেলেন এবং সেখানে অবিরত দরস,ওয়াজ নসিহত জারি করলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অগণিত মানুষ “সিরাতুল মুস্তাকিমের ” পথে ফিরলো। ইমামের জনপ্রিয়তা শত্রুপক্ষের চোখের শুলের মতো ফুটতে লাগলো। দিন দিন ইমামের মুরিদ বৃদ্ধি পেতে লাগলো আর শত্রু পক্ষ তেলে বেগুনে জ্বলতে থাকলো। অবশেষে তারা পুনরায় সুলতানের নিকট অভিযোগ পেশ করলো। এ প্রেক্ষিতে মিশরের সুলতান নাসির ইবনে কালাউন ইমামকে নিজ প্রাসাদের দারๆুল আদলে উপস্থিত হতে বললেন এবং আনিত অভিযোগের জবাব তালাশ করলেন। ইমাম কুরআন, সুন্নাহর আলোকে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন। উপস্থিত কাজী ও উলামাগণ ইমামের জবাবকে শরীআর আলোকে সহীহ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তথাপি বিরোধীপক্ষের চিৎকার-চেচামেচি ও উজিরে আজমের চাপে সুলতান ইমামকে তিনটি সিদ্ধান্তের একটি বেছে নিতে বলেন- (১) তিনি নিজ দেশে ফিরে যাবেন, অথবা (২) তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রস্থান করবেন, তবে উভয় ক্ষেত্রে কিছু শর্ত মেনে নিতে হবে; অন্যথায় (৩) তাকে কারাগারে যেতে হবে। ইমাম কারাগারে গমনকেই পছন্দ করলেন। হুকুমাত ইমামের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ তাঁর সাথে আগন্তুকদের দেখা করার অনুমতি ও অধ্যয়ন জারি রাখার অনুমতি দিলো।
কারাগারে পৌছে তিনি পুনরায় বন্দিদের শরঈ ও আত্মিক দিক নির্দেশনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কারাগার সর্বক্ষণ তিলাওয়াত, যিকির, আযান ও দরসে মশগুল থাকলো। দীর্ঘ ৪ মাস কারাগারে অবস্থান করার পর কাজী বদরুদ্দীন ও আমির হুসামুদ্দিন মুহিন্নার অনুরোধে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
(বাকীটুকু আগামী কিস্তিতে ইনশাআল্লাহ)
.........................................................................
টিকাঃ
১। ওয়াহদাতুল উজুদ(وحدة الوجود)- শাইখ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী এ মতবাদের প্রবক্তা। বিষয়টি অতি সূক্ষ্ম ও জটিল হওয়ায় উপযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিত এ সংক্রান্ত আলোচনা বা বিতর্কে অংশগ্রহণ জমহুর উলামাগণের নিকট অপছন্দনিয়। আগ্রহীগণ এ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি দেখে নিতে পারেন। পাশাপাশি ইমামের এতদ্বসংক্রান্ত গবেষনা ও মতামত তাঁর বিখ্যাত কিতাব “আর রদ্দুল আকওয়াম আলা মা ফি ফুসুসিল হিক্বাম” গ্রন্থটিতে দেখতে পারেন। সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. রচিত “তা’রিখে দাওয়াত ওয়া আাজিমাত“ গ্রন্থটির ২য় খন্ডে এ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল আলোচনা করা হয়েছে)
-------------------------------------------------------------
(কৈফিয়তঃ বিস্মৃত মহামানব (ফরগটেন হিরোস) সিরিজের পর্ব - ০৫ শেরে মাইসুর সুলতান নাসিবুদ্দৌলা ফাতিহ আলী খান বাহাদুর টিপু সাহেব পাদিশাহ (রহ.) অসমাপ্ত রেখেই ৬ষ্ঠ পর্ব পোস্ট করতে হলো। ৫ম পর্বটা বড় হওয়ায় দুই কিস্তিতে দেয়ার ইচছা করেছিলাম, যার প্রথম কিস্তি আলহামদুলিল্লাহ দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তি কম্পোজ করার সময় একদিন হঠাৎ করেই খসড়া লেখা খাতাটা আর খুঁজে পেলাম না। পুরো লেখাটা, তথ্যসূত্র সহ সেখানেই ছিলো। বাধ্য হয়ে পুরো জিনিসটা আবার সাজাতে হবে। ইতোমধ্যে ৬ষ্ঠ পর্বের লেখায় হাত দেয়ায় এটাই আগে শেষ করার নিয়ত করলাম। আগামী ২/১দিনের মধ্যে বাকিটুকু পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ। আর ৫ম পর্বের শেষ কিস্তিটাও শীঘ্রই পেশ করার ইচ্ছা আছে। আল্লাহ তাওফিক দিন।
===================================
ফরগটেন হিরোস সিরিজের অন্য পর্বগুলো-
১. প্রথম পর্ব : শাহ সৈয়দ আহমাদ বেরলভী শহীদে বালাকোট (রহ.)
২. দ্বিতীয় পর্ব : শাহ সূফী নুর মুহাম্মাদ নিজামপূরী (রহ.)।
দ্বিতীয় পর্ব : শাহ সূফী নুর মুহাম্মাদ নিজামপূরী (রহ.)।
৩. তৃতীয় পর্ব: সাইয়্যেদ মীর নিসার আলী (তীতুমীর)
৪.চতুর্থ পর্ব: মাওলানা গাজী ইমামুদ্দিন বাঙ্গালী (রহ.)
৫. পর্ব - ০৫ শেরে মাইসুর সুলতান নাসিবুদ্দৌলা ফাতিহ আলী খান বাহাদুর টিপু সাহেব পাদিশাহ (রহ.)
বিষয়: বিবিধ
৩৯৪২ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সেখানেই তাতারীদের কোমড় ভেঙে যায়।
তাতারীরা মিসরেই পর্যদুস্ত হয়।
উম্মাহের অন্যতম শ্রেষ্ঠসন্তান।
বেশ পরিশ্রমি পোষ্ট ধন্যবাদ রইলো!
ইমামের দ্বিতীয় কারাবাস থেকে মুক্তি লাভের পর মিশরের মসজিদে প্রায় ৩ঘন্টা ব্যাপি শুধুমাত্র "إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ"এর তাফসির পেশ করেছিলেন। সেটি পরবর্তীতে মিশর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। পড়ে দেখবেন। আমার অবস্থা এই যে, একদিকে আল্লাহর ভয়ে যেন কলিজা মোচড় দিয়ে ছিড়ে যাচ্ছে, আমার নিজের বদ আমলের ও নাফরমানীর আফসোসে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না।
সত্যিই এমন পোষ্টের অপেক্ষায় দিনগুজরান করা যায়।
জাজাকাল্লাহ
আপনার মতো পাঠকের জন্যই তো আমরা কলম ধরার প্রেরণা পাই। তবে আপনার লেখাও কিন্তু অনেক দিন দেখছি না, মিস করছি বেশ।
জাযাকাল্লাহ খইর।
ভাই; উনি কি পির ছিলেন?
ভাই পীর বলতে কি বোঝেন?
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
জাযাকাল্লাহু খইর।
প্লিজ, কারো দিকে আর তাকিয়ে থাকা নয়, কেউ আসুক অথবা নাই আসুক, আপনি আসছেন, লিখছেন, ভালো কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করছেন, এটাই নিশ্চিত করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন