"একজন অমুসলিমের চোখে মুসলিম জামায়াতের সলাত"
লিখেছেন লিখেছেন আবু সাইফ ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১১:০৩:১৮ রাত
. . . . . .
হাজী সাব একটি ছড়ি ভর করে পায়চারী করতেন, কারণ, তিনি ছিলেন বাতের রোগী, আর তাঁর হাঁটু গিয়েছিলো ফুলে, ওদের মধ্যে এক রকম সর্দার ছিলেন তিনি-।
দেখতাম, ওরা কোনো আপত্তি না করেই ওর কথা শুনছে। দিনে কয়েকবার তিনি ওদেরকে জমায়েত করতেন সালাতের জন্য, আর বৃষ্টি না হলে ওরা খোলা জায়গায়ই সালাত আদায় করতো।
ওরা সব ক’জন একটিমাত্র লম্বা কাতারে দাঁড়ায় এবং তিনি ওদের ‘ইমাম’ হিসাবে দাঁড়ানের ওদের সম্মুখে। সালাতে নিখুঁৎ অংগ সঞ্চালনের দিকে দিয়ে ওরা যেনো সৈনিক, ওরা একই সংগে মক্কার দিকে মুখ করে মাথা নীচু করে, আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে এবং জমিনের উপর কপাল ঠেকায়।
মনে হতো ওরা যেনো ইমামের মুখের অশ্রুত শব্দগুলি অনুসরণক করছে,- ইমাম, যিনি সিজদা থেকে উঠে আবার সিজদায় যাওয়ার আগে নগ্ন পায়ে দাঁড়ান জায়নামাজের উপর, তাঁর চোখ বোঁজা, হাত দু’টি ভাঁজ করে বুকের উপর রাখা, নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়ছেন, স্পষ্টই তনি গভীর ধ্যানে সমাহিতঃ আমি দেখতাম, তিনি তাঁর সমগ্র আত্মা দিয়ে প্রার্থনা করছেন!
এ ধরনের একটি প্রকৃত প্রার্থনার সাথে, প্রায় যান্ত্রিক অংগ সঞ্চালনের যোগ দেখে আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করি এবং একদিন ‘হাজী’ সাবকে, যিন কিছু ইংরেজি বোঝেন, জিগগাস করিঃ
-‘আপনারা কি সত্যি বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ চান আপনারা বারবার নুয়ে হাঁটু গেড়ে সিজদা করে তাঁর প্রতি আপনাদের ভক্তি দেখাবেন?
এর চেয়ে কি নিজের দিকে তাকানো এবং নিজের অন্তরের নিভৃতে তাঁর প্রতি প্রার্থনাই উত্তম নয়?
আপনাদের এ ধরনের অংগ সঞ্চালনের কারণ কি?
কথাগুলি মুখ থেকে বের হবার সাথে সাথেই আমার অনুশোচনা হলো, কারণ, এই বৃদ্ধ লোকটির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার ইচ্ছা আমার ছিলো না।
কিন্তু ‘হাজী’ সাবকে মোটেই আহত মনে হলো না।
তাঁর দন্তহীন মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো, তিনি বললেনঃ
-‘তাহলে, এ ছাড়া আমরা আর কীভাবে আল্লাহর ইবাদত করবো?
তিনি কি দেহ আর আত্মা, দু’ই এক সংগে সৃষ্টি করেননি?
শুনুন, আপনাকে বলছি, আমরা মুসলমানরা যেভাবে প্রার্থনা করি কেবল, সেইভাবেই প্রার্থনা করে থাকি, অন্যভাবে করি না।
আমরা কাবা’র দিকে মুখ করে দাড়াই, মক্কায় অবস্থিত আল্লাহর পবিত্র ঘরের দিকে, এ সত্য উপলব্ধি করে যে দুনিয়ার সকল মুসলমানেরই মুখ- সে যেখানেই থাকুক না কেন- প্রার্থনায় এই ঘরের দিকেই ফেরানো হয়, আর আমরা সকলে মিলে একটি মাত্র দেহের শামিল এবং আল্লাহ হচ্ছেন আমাদের ধ্যান-ধারণার কেন্দ্র।
প্রথম আমরা সরল সোজা হয়ে দাঁড়াই এবং পাক কুরআন থেকে তিলাওয়াত করি, একথা মনে রেখে যে, এ হচ্ছে তাঁরই কালাম, মানুষকে দেয়া হয়েছৈ যাতে সে জীবনে সরল, ন্যায়পরায়ণ ও অটল হতে পারে, তারপরে আমরা বলি, আল্লাহ মহান, সর্বশ্রেষ্ঠ।
এর দ্বারা আমরা নিজেদের একথা স্মরণ করিয়ে দিই যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই যে আমাদের উপাস্য হতে পারে।
একথা বলার পরে আমরা গভীরভাবে নুয়ে পড়ি, কারণ আমরা তাঁকে সম্মান করি সকলের উপরে এবং তাঁর শক্তি ও মহিমার প্রশংসা জ্ঞাপন করি।
এরপর আমরা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে জমিনে কপাল ঠেকাই, কারণ, আমরা উপলব্ধি করি যে, তাঁর সম্মুখে আমরা ধূলিকণা মাত্র এবং আমরা কিছুই না- আর তিনি আমাদের স্রষ্টা, লালন-পালনকর্তা।
এরপর আমরা জমিন থেকে আমাদের মাথা তুলি আর স্থির হয়ে বসি, আর প্রার্থনা করি, যেনো তিনি আমাদের পাপ ক্ষমা করে দেন, আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, আমাদের সোজা-সরণ পথে পরিচালনা করেন; এবং আমাদেরকে স্বাস্থ্য ও রিযিক দেন-
তারপর আবার আমরা সিজদায় যাই, এক আল্লাহর মহিমার সম্মুখে ধূলিতে আমাদের কপাল ঠেকাই।
এরপর আবার স্থির হয়ে বসি, আর প্রার্থনা করি যেনো তিনি, নবী মুহাম্মদﷺ, যিনি আল্লাহর বানী আমাদের কাছে এনে দেন তাঁর প্রতি রহমত করেন, যেমন তিনি রহমত করেছিলেন পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদেরকেঃ
আমরা প্রার্থনা করি, যেনো তিনি আমাদেরকে এবং যারা সত্য পথে চলে তাদের সকলকে রহমত করেন;
আমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করি যেনো তিনি আমাদেরকে ইহজগতের কল্যাণ এবং পরকারের কল্যাণ- দু’ই দান করেন।
সবার শেষে আমরা আমাদের মাথা ডানদিকে এবং বামদিকে ঘুরাই- এবং বলি, তোমাদের সকলের উপর আল্লাহর শান্তি আর রহমত বর্ষিত হোক, এবং এভাবে যাঁরা সৎকর্মপরায়ণ, যেখানেই তাঁরা থাকুক না কেন তাঁদের সকলের প্রতি আমরা জানাই অভিবাদন।
এভাবেই আমাদের রাসূল (স)ﷺ সালাত আদায় করতেন এবং এভাবেই সর্বকালে সালাত সম্পাদনের জন্য তিনি তাঁর উম্মতকে শিখিয়েছেন, যাতে তারা স্বেচ্ছায় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে, আর ইসলামের অর্থ এ-ই এবং এভাবেই তাঁর সংগে শান্তিময় সম্পর্ক স্থপন করতে পারে আর তাদের নিজেদের নিয়তির সংগেও।
অবশ্য বৃদ্ধ লোকটি হুবহু এই শব্দগুলি ব্যবহার করেননি- কিন্তু তিনি যা বলেছিলেন তার অর্থ হলো এ-ই এবং এভাবেই আমি এগুলি স্মরণ করে থাকি।
কয়েক বছর পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম ‘হাজী’ সাব তাঁর এই ব্যাখ্যা দ্বারাই ইসলামের দরোজা পয়লা খুলে দিয়েছিলেন আমার জন্য।
তা সত্ত্বেও আমি, ইসলাম আমার নিজের ধর্ম হয়ে উঠতে পারে এ চিন্তা আমার মনে প্রবেশ করারও বহু আগে এক দীনতা অনুভব করতে শুরু করেছিলাম- যখনি দেখতাম, যেমন দেখতাম প্রায়ই-
একজন লোক নাঙ্গা পায়ে দাঁড়িয়ে আছে তার জায়নামাযের উপর, কিংবা খড়ের মাদুরের উপর-
বুকের উপর হাত দু’টি ভাঁজ করে রেখে,
মাথা নীচু করে সম্পুর্ণভাবে নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে,
তার চাপাশে যা ঘটছে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে-
সে মসজিদের ভেতরেই হোক,
অথবা কর্মব্যস্ত কোনো রাস্তার ফুটপাতেই হোকঃ
একজন মানুষ
যার নিজেকে নিয়ে কোনো নালিশ নেই-
শান্ত এবং তৃপ্ত!
* * * * * *
উতসঃ মক্কার পথ (The Road of Mecca)
মুহাম্মদ আসাদ : শাহেদ আলী অনুদিত
* * * * * *
বিষয়: বিবিধ
৯৫৭ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"মক্কার পথ" বইটিতে অনেক শিক্ষনিয় ঘটনা আছে।
যথার্থ বলেছেন, সহমত
বইটি যষ্টিমধুর মত- যত চিবুবেন তত মিষ্টি!
তাই মনোযোগী সচেতন পাঠক না হলে অনেক কিছুরই স্বাদ পাবেননা!
প্রথম মন্তব্যের জন্য মোবারকবাদ, জাযাকাল্লাহ
এখানে আছে, পিডিএফ বা ওয়ার্ডটেক্সট- যেটা খুশী নিতে পারবেন,
একদম ফ্রী, তবে দোয়ার ভিখারী
দোয়া করি যেন শীঘ্রই আপনার সুযোগ হয় পড়ে নেবার!
জাযাকাল্লাহ..
আল্লাহু আকবর, উৎস আপনি যেখানেই পান এই লেখাটির উপস্থাপনা হূদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছে।
আপনি লিখেছেনঃ তিনি কি দেহ আর আত্মা, দু’ই এক সংগে সৃষ্টি করেননি।
সত্যিই অসাধারণ দুই লাইন লেখার উৎসে আপনার উপস্থাপনা অসংখ্য ধন্যবাদ।
সেরা ব্লগ নির্বাচকদের কাছে অনুরোধ রাখছি এই লেখাটি মাসের সেরা তালিকায় যুক্ত করতে।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ইসলাম ও আরব বুঝতে বইটি খুব সহায়ক!
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকুমুল্লাহ..
"..কোথা সে মুসলমান.."
নিজ ক্বওমের মাঝেও সংখ্যালঘু
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ..
লেখাটা কিন্তু আমার নয়-
আল্লামা মুহম্মদ আসাদ-এর
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
শেয়ার করার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
বইটা বার বার পড়তে মন চায়!!!
যতবার পড়ি- নতুন কিছু পাই!!
জাযাকাল্লাহ..
সুন্দর অনুবাদ হয়েছে, জাযাকাল্লাহু খাইরান
অনুদিত বইটা এখানে আছে
দোয়া করি/চাই, জাযাকাল্লাহ..
http://www.icsbook.info/2033
ভুলে গেছেন বোধ হয়-
আমি কিন্তু "সাইফ"এর বাবা
লিংকটি এবার ঠিক আছে। অনেক অনেক শুকরিয়া।
এমন ভুল দেখতে ও শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি
দাওয়াত কবুল করে রাখলাম, তবে এবারে সম্ভব হবেনা!
এবারে আমার ঈদ হবে মদীনা প্রদেশের ইয়ানবু শহরে ইনশাআল্লাহ
ফেবু- Abusaif Rahman
ফী আমানিল্লাহ
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
নাহ্, তা হবেনা!!
একটা আমের ঘ্রাণ শুঁকে যতটুকু খাওয়া হয় ততটুকুও হবেনা!!
দোয়া করি,
ঝটপট পড়ে ফেলুন
মন্তব্য করতে লগইন করুন