সেই প্রথম অনুভূতি
লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ০৩ মার্চ, ২০১৫, ০১:৫৮:৩০ রাত
বাবার দেয়া প্রথম উপহার ও আমার অনুভূতি
পৃথিবীর সন্তানের জন্মের শুরুলগ্ন থেকেই বাবা মা থেকে উপহার পেতে থাকেন। বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন শুরু হয় সন্তান ভূমিষ্ঠের পূর্ব থেকেই। আর প্রত্যেক বাবা-মা-ই সন্তানের মুখে হাসি দেখতে ভালোবাসে নিজে সিমাহীন কষ্ট সহ্য করেও। নিজেরা কষ্ট করে হলেও সন্তানের আবদার পূরনে তাদের পূর্ণ খেয়াল রাখেন। তারা নিজেরা না খেয়ে, না পরে হলেও সন্তানকে পরিপূর্ণতা দিতে চান, দেন। বাবা-মায়ের ভালোবাসাই এমনই হয়। কোন বাবা-মাকেই তাদের সন্তানের ভালোবাসা থেকে আলাদা করা যায়না কোন বিনিময় ছাড়াই তারা সন্তানের সকল আবদার পূরন করেন। কোন বিনিময় ছাড়াই সন্তানকে ভালোবেসে যান আজীবন।
জীবনের প্রথম নামাজ শিখেছি মনে খুবই আনন্দ এর আগে কেউ নামাজের ব্যপারে জোর করেনি। নিজের ইচ্ছাতে দাদা-দাদী ও প্রতিবেশী দাদীদের কাছ থেকে জেনেছি দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ আর ইচ্ছা করে নামাজ না পড়ার শাস্তি কি? অথচ তখনও নামাজ আমার উপর ফরজ হয়নি। তাতে কি আল্লাহর হুকুম যখন মানতেই হবে তখন দেরি কেন? শিখেছি যখন পড়তে থাকি আল্লাহ কবুল করার মালিক। নামাজ পড়া শুরু করেছি মাত্র কয়েকদিন হলো। মনের মাঝে খুবই প্রফুল্লতা নিয়ে অযু করে নামাজ আদায় করি যেন আমি পেয়েছি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল এক নেয়ামত আর এই নেয়ামত পাওয়ার আনন্দকে বুকে ধরে নামাজ পড়তে শুরু করি। সেই ছোট্ট মনের মাসুম বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নামাজ শুরু করি সেই নামাজে এত ভালোলাগা ছিলো যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। সেই বিশ্বাস ছিলো পূত-পবিত্র আর সেই ইবাদতও ছিলো লৌকিকতা থেকে মুক্ত।
তখনো বাসায় নামাজের মুসাল্লা নেই। আর সবার ঘরে মুসাল্লা থাকতো ও না। বেশীর ভাগ মানুষই নামাজ আদায় করতেন নামাজের পাটি বিছিয়ে। বড়রা যারা নামাজ পড়ে তারা সবাই নামাজের পাটি বিছিয়েই নামাজ আদায় করতেন। আর পুরুষ লোকেরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে আসতেন। আমি তখন নামাজ পড়া শুরু করি পাটির উপর ধোয়া বিছানার চাদর বিছিয়ে, নামাজ শেষ হলে আবারও তা ভাঁজ করে রেখে দিতাম। কখনো কখনো আব্বুর সাদা লুঙ্গি বিছিয়ে নামাজ পড়তাম, যেটা পরিধান করে আব্বু জু'মার নামাজে যেতেন। সেটাও নামাজ শেষ হলে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখতাম মা এসব দেখে মনে মনে খুশিই হতেন। আরো নানা রকম দোয়া শেখার জন্য আগ্রহ বাড়াতেন উৎসাহ দিতেন যেন নিয়মিত নামাজ আদায় করি। মাঝে মাঝে ফজরের সময় জাগিয়ে দিতেন তখন মায়ের সাথে বসে বসে ফজরের নামাজ পড়তে কি যে ভালোলাগতো লিখে বুঝাতে পারবোনা।
এভাবে আরো কয়েকদিন যাওয়ার পর একদিন এ'শার নামাজ পড়ছিলাম আব্বু সেদিন হঠাৎই দোকান থেকে বাসায় চলে আসলেন। আমি সেদিনও আব্বুর সাদা-লুঙ্গি বিছিয়ে নামাজ পড়ছিলাম। আব্বুর কোন কিছু কেউই ধরতো না। আর পোষাকের মধ্যে আব্বুর সাদা-লুঙ্গি পরিধান করাটা খুবই পছন্দের ছিলো। আব্বু এসে দেখে ফেলেন আর আমিও ভয় পেয়ে যাই আব্বুর লুঙ্গিতে দাঁগ পড়ে কিনা সেই কারনে। তারপরও আমি আস্তে ধীরে নামাজ শেষ করি। আব্বু বিষয়টা লক্ষ করেন তিনি কোন এক অজানা কারনে বাসায় আসেন ও একটু পরই আবার দোকানে চলে যান। পরে জানতে পারি ঘরে দোকানের টাকা ছিলো সেগুলো নিতেই আব্বু বাসায় এসেছিলেন। আমাকে কিছুই বললেন না কিন্তু আমি মায়ের কাছে জানতে চাইলাম মা মাগো আব্বু কি আমার উপর রাগ করেছে? আমি আর কখনোই আব্বুর লুঙ্গি বিছিয়ে নামাজ পড়বোনা। মা জানতে চাইলেন কেন রাগ করবে?
আমি বললাম আব্বুর লুঙ্গি বিছিয়ে যে নামাজ পড়েছি সেজন্য মা বললেন না রাগ করেন নি বরং অনেক খুশি হয়েছেন। আর সকল বাবা-মাই সন্তানের ভালো কাজে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন তেমনী তোর আব্বুও খুব আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেই, রাতে ঘুমাতে গিয়েও ভাবতে ছিলাম নাঃ ঠিক হয়নি আব্বুর লুঙ্গি বিছিয়ে নামাজ পড়াটা। আবার মনে মনে এও ভাবছিলাম সবার চেয়ে বড় আল্লাহর ইবাদত করার জন্যই তো আমি একাজ করেছি আর মহান আল্লাহ তৌফিক দিলে আব্বু এরকম হাজারও মুসাল্লা কিনতে পারবে।
পরেরদিন ফজরে আম্মা জাগিয়ে দিলেন নামাজ পড়তে আর কেন জানি আম্মা ডাক না দিলেও আমি আযান শুনে আগেই জেগে যেতাম। সেদিনও আমি জাগছি ঠিক সে সময়ই আম্মুও আমাকে ডাক দিলেন উঠ; ফজরের নামাজ পড়বি না? আমি বললাম পড়বো। আম্মু বললেন সময় বেশী বাকি নেই, আমি উঠে অযু করতে গেলাম আম্মু এর আগেই অযু করে এসেছিলেন তিনি একটি চাদর বিছালেন ও একটি নামাজের মুসাল্লা বিছালেন। আমি অযু করে এসে দেখি একটি নতুন নামাজের মুসাল্লা আম্মু ইশারা করলেন নামাজের মুসাল্লাতে আমাকে নামাজ পড়তে আমি কোন প্রশ্ন না করে সেটাতে নামাজে দাড়ালাম।
যখন নামাজ শেষ করেছি তখন আম্মু বললেন ৩৩ বার সুবহানল্লাহ ৩৩বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪বার আল্লাহু-আকবার পড়তে আমি সেগুলো পড়লাম তখনো তেমন দোয়া-কালাম পড়তে জানিনা। যখন মুসাল্লা থেকে উঠে যাচ্ছি মনে আমারও মনের মাঝে একটি প্রশ্ন এই নামাজের মুসাল্লা কোথা থেকে আসলো? আম্মু তখনই ডেকে বললেন তুই না রাতে জানতে চেয়েছিলি তোর আব্বু তোর উপর রাগ করেছে কিনা এই দেখ তোর আব্বু যে তোর উপর রাগ করেনি সেটার প্রমাণ হলো তোর জন্য এই নামাজের মুসাল্লা এনেছেন। দেখেছিস আমি কত বছর ধরে পাটিতে নামাজ পড়ি আর বাসা পরিবর্তনের সময় এবার সকল নামাজের পাটি গুলোই নষ্ট হয়ে গেছে তারপরও তোর আব্বু আমাকে একটি নামাজের মুসাল্লা এনে দেয়নি অথচ তোকে একবার লুঙ্গি বিছিয়ে নামাজ পড়তে দেখে রাতেই নামাজের মুসাল্লা কিনে এনেছেন। আসলে তোর আব্বু অনেক খুশি হয়েছেন। এরজন্যই এই উপহার তোর জন্য এনেছেন।
আমি সেদিন এত খুশি হয়েছি যে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম আর বলেছিলাম মানুষ কখনো কখনো অনেক আনন্দেও কাঁদে আর কখনো কখনো অনেক কষ্টের মাঝেও হাসতে পারে। আমি সেদিন বেশী আনন্দে কেঁদেছিলাম। আর আমি সব সময় ভাবতাম আমার আব্বু শুধু রাগী মানুষই উনার মাঝে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই অথচ আব্বুর মনটা কতটা কমল তা বুঝতে পারতাম না যদি না তিনি এই সুন্দর কাজটি করতেন। আম্মু বুঝালেন পৃথিবীর সকল আব্বু-আম্মুই উদার মনের কিন্তু স্থান, কাল, পাত্র ভেদে মানুষ এক এক রকম অনুভুতি প্রকাশ করে। আমিও সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম জীবনে কখনো নামাজ পরিত্যাগ করবোনা। আমি যেভাবেই পারি সেভাবেই নামাজ পড়বো।
আর সেদিন থেকেই আব্বু-আম্মু ও সকলের জন্য প্রাণ ভরে নেক হায়াতের প্রার্থনা করতে শুরু করি। আরো প্রার্থনা করি মহান আল্লাহ যেন আমার আব্বু-আম্মু সহ পৃথিবীর সকল আব্বু-আম্মুকে নেক হায়াত দান করেন, নেক আমল করার তোফিক দান করেন, ঈমানের সাথে রাখেন, ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করেন। সেদিন হয়তো এত সুন্দর করে বলতে পারিনি কিন্তু সেদিনের সকল দোয়াগুলোই মহান আল্লাহ কবুল করে নিয়েছিলেন বাস্তবে তার প্রকাশ আমি দেখেছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার এখনো ভাবলে খুবই ভালোলাগে আমাকে দেয়া আব্বুর প্রথম উপহার ছিলো একটি নামাজের মুসাল্লা। এই হায়াতের জীবনে আব্বুর থেকে যত উপহার পেয়েছি সবকিছুর থেকে সেই নামাজের মুসাল্লাটি আমার কাছে খুবই মূল্যবান ও দামী এখনো আব্বুর বাসায় বেড়াতে গেলে সেই নামাজের মুসাল্লাটি আমার প্রাণ-প্রিয় স্বামীকে বিছিয়ে দেই। এখন ঘরে প্রায় এক ডজন নামাজের মুসাল্লা কিন্তু কেন যেন সেই প্রথমে দেয়া মুসাল্লাটির মত মনে হয়না সেগুলোকে।
আব্বুর দেয়া সেই উপহারকে আমার মনে হয় যেন আমার আব্বুর পক্ষ থেকে আমার জন্য একটি নামাজের মুসাল্লা নয় জান্নাতে যাওয়ার সরল একটি পথ। মনে হয় সেটি যেন জান্নাতের যাওয়ার মজবুত একটি সিঁড়ি এই সিঁড়ি দিয়ে পৃথিবীর সকল মানুষ জান্নাতের দরজায় পৌছাতে পারবে ইনশা-আল্লাহ। পৃথিবীর সকল আব্বু-আম্মু যেন হয় সকল সন্তানের উত্তম আদর্শ, উত্তম শিক্ষক, উত্তম আব্বু-আম্মু। আমরা একে অপরকে যেন জান্নাতের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারি। সকলেই আমরা পৃথিবীতে এখন যেভাবে একে অপরের আপনজন হয়ে কাছাকাছি আছি মহান আল্লাহ যেন জান্নাতেও এভাবেই আমাদের সকলকে আপনজনের মত করে কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দেন। আব্বু ও আম্মুর জন্য সর্বাঙ্গীন কল্যাণের দোয়া করবেন। সকলের আব্বু ও আম্মুর জন্যেও এই প্রার্থনা।
২ই মার্চ ২০১৫
মদিনা মনোয়ারাহ সৌদি আরব
বিষয়: সাহিত্য
১০৮৭ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার আব্বু আম্মুকে হায়াতে ত্যায়েবা দান করুন । আমীন ।
লেখা ও অভিব্যক্তি বড়ই ভাল লাগল৷ শুভেচ্ছা রইল৷
০ জায় নামাজ তো আব্বু কিনে আনলো আর আপনি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন !
আব্বুকে মনে হয় ভয় পেতেন খুব ?
সুন্দর পোস্ট দিয়েছেন - মাশা আল্লাহ
আপনার দোয়ার সাথে আমিন ছুম্মা আমিন।
আমিন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন