জলের স্বর্গরাজ্য কথাটা যেন সত্য মনে হল!
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০২:২৩:২৯ দুপুর
সন্ধ্যায় সদরঘাট লঞ্চে, পারাবত-১২।
আমাদের এবারের ট্যুর ছিল বরিশাল-পিরোজপুর-ঝালকাঠি। এই অঞ্চলের পেয়ারা বাগান, আমড়া বাগান আর জলের স্বর্গরাজ্য দেখা। নেটে পড়ে আর ছবি দেখে বেশ কিছু দিন যাবৎ ইচ্ছে হচ্ছিল যাই একবার দেখে আসি সেই রাজ্য কেমন যার ছবি এতো সুন্দর! পরিকল্পনা করছিলাম বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই।যখন আমরা দূর্গ ভ্রমণে যাই। সেখানে কথা হয় আনিস ভাই আর আরিফ ভাইয়ের সাথে ভ্রমণ নিয়ে। যাওয়ার দিন এসে যোগ দিলেন ওহিদ ভাই।
সংগৃহীত।
আগে থেকেই কেবিন বুক দিয়ে রেখেছিলেন আনিস ভাই। আমাদের নির্ধারিত কেবিনে গিয়ে দেখি অন্য লোক বসে আছে! পড়লাম ফাঁপরে! কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বুঝলাম তাদের ভুল হয়েছে আমাদের আমাদের কেবিন চেঞ্জ করে দিলেন। এবার রিভার ভিউ সাইড ছেড়ে কেবিন পেলাম ভিতরে। সেখানে গিয়ে দেখি আরেক ঝামেলা! এক বয়স্ক মহিলা তার তরুণী মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন কেবিনের দরজায়! তিনি নাকি ওটার বুকিং দিয়েছেন! অবশেষে মেলা ঝামেলা শেষ করে একটা সিঙ্গেল এবং একটা ডাবল কেবিন নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। আরিফ ভাইয়ের ঈমামতিতে এশার সালাত আদায় করে নিলাম লঞ্চের নামাজের স্থানে। এর পর আরিফ ভাইয়ের আনা খাবার দিয়ে রাতের খাবার সেরে যার যার কেবিনে।
লঞ্চের কেবিনে।
ঢেউয়ের ধাক্কায় লঞ্চের কেরত কুরুত শব্দে। আনিস ভাই এক সময় গামছা দিয়ে কান বাঁধলেন। আমি এপাশ-ওপাশ করতে করতেই ওহিদ ভাই উঠে বসেলন। বললেন, লেপ-কাঁথা-বালিশ লন। জিগাইলাম কোথায় যাইবেন? তিনি বললেন, কেবিনে আর না চলেন লঞ্চের ছাঁদে গিয়ে ঘুমাব! দুজনে রাত দুটোয় উঠে বালিশ-লেপ-চাদর নিয়ে সোজা উপরে গিয়ে দেখি জায়গা ফাঁকা নাই! কিছু সময় ঘুরেফিরে আবার কেবিনে এসে শুয়ে পড়লাম। এক সময় ঘুমিয়েও গেলাম। সকালে জেগে দেখি বরিশাল ঘাটে! ফজরের সালাত আদায় করে সোজা আরিফ ভাইদের বাসায়।
আরিফ ভাইদের বাসায়।
আরিফ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে সকালের নাস্তার অবস্থা দেখে সবার চোখ ছানাবড়া! এতো এতা নাস্তার আইটেম কেউ সকালে খেতে পারে! আলহামদুলিল্লাহ তবু আমি সবার মধ্যে থেকে যথেষ্ট টানলাম। সবার পক্ষ থেকে পুষিয়ে দিলাম। আমি এত বেশি খাবারে কখনও মাইন্ড করি না। কিন্তু ওহিদ ভাই আর আনিস ভাই তেমন টানতে পারলেন না। যাই হোক সকালের নাস্তা শেষ করতেই আরিফ ভাইয়ের ভাড়া করা গাড়ি এসে হাজির, ড্রাইভার নাস্তা করে আমাদের নিয়ে রওয়ানা করলেন বানারিপাড়ার উদ্দেশ্যে।
পেয়ারা বাগানের পথে নৌকায়।
আমরা কুড়িয়ানা থেকে একটি ট্রলার ভাড়া করে স্বরূপকাঠির ভিমরুল পেয়ারা বাজার পেয়ারা বাগান এবং আমড়া বাগান দেখার উদ্দেশ্যে চলতে থাকলাম। ট্রলারে চলার সময় ছোট ছোট খালের সৌন্দর্য আর সেই রাস্তার কথা বর্ণনা করতে হলে আমাকে কবি সাহিত্যিক হতে হবে। সবুজ পেয়ারা বাগান আর মাঝে মাঝে রেইনট্রি গাছ। খালের পাশঘেষা আমড়া গাছগুলো চাইলে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।
আমড়া বাগান।
এই রাস্তার সৌন্দর্যে আপনি যদি বিমোহিত না হন। আর কিসে আপনাকে সৌন্দর্যের সূধা পান করাবে। আপনার কাছে মনে হবে এখান এই খালের পথে নৌকায় বসে দুপুরের খাবার খাই ডাল আলু ভর্তা দিয়ে। এটাকে কেন জলের স্বর্গ রাজ্য বলে আজ বুঝলাম।
খাল পথের ছবি(সংগৃহীত)।
খাল-নদী পথে দেখা যাবে অনেক ছোট ছোট ব্রীজ।যেগুলো পথের সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
এরকম অনেক ব্রীজ দেখতে পাবেন।
সবাই বরিশালের ধান-নদী-খালের গল্প শুনেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন অপার্থিব সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এই নদী খালের মাঝে! এসব শান্ত-স্নিগ্ধ ছবির মতো ছায়া সুনিবিড় খালের পানে চলবেন আর মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবেন। তাকিয়ে থাকবেন আর চলবেন।
ছবির অনেক বেশি সুন্দর সেই দেশ।
এ যেন এক ছবির দেশ ছবির মতো ভাসে।
সেথায় যেন জলপরীরা ঝলমলিয়ে হাসে!
ভাসমান পেয়ারা বাজার।
চোখ ভরে বুক ভরে মন ভরে পেট ভরে এসব সৌন্দর্য গিলতে গিলতে আমরা চলেছি ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখতে। কখন কোন ফাঁকে পৌছে গেলাম ভীমরুলী ভাসমান পেয়ারা বাজারে। কিন্তু গিয়ে আমাদের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল! আমরা গিয়েছি পেয়ারার শেষ সময়ে। তখন বাজারে তেমন পেয়ারা নাই। মাত্র দু/একটি নৌকা পেয়ারা নিয়ে আসছে বাজারে।
চলতে পথে আমর সাক্ষ্য দেই তাওহীদের।
যিনি আমাদের জন্য তৈরী করেছেন এ সৌন্দর্য। বলি সুবহান আল্লাহ! আল্লাহু আকবার। তিনি মহান স্রষ্টা। যার সৃষ্টিতে কোন খুঁত নাই।
হাত বাড়ালেই ধরা যায় পেয়ারা।
কিন্তু সাবধান! না বলে খাবেন না। পরিণতি ভয়াহব হতে পারে হাসরের মাঠে। আমাদের নৌকার ছোট্ট ছেলেটি একটি পেয়ারা পেরে আমার হাতে দিয়ে বলছেন খান। আমি জিজ্ঞেস করলাম গাছওয়ালা কে? সে বলল জানি না! আমি সেই পেয়ারা খেতে পারব না বলে তার হাতে ফিরিয়ে দিলাম।
আমড়ার আড়ৎ।
পথে যেতে যেতে দেখতে পাবেন কয়েকটি ছোট ছোট বাজার দোকান ঘর। চাইলে দোকান থেকে কিছু কিনে খেতে পারেন। এখানকার খাল-নদী-মাঠ-ঘাট-বাগান-বাজার-নৌকা-মাঝি-ছেলে-মেয়ে সব কিছুই আপনার কাছে মনে হবে কোন পটে আঁকা ছবি!
ভাসমান পেয়ারা বাজার।
আমরা ভীমরুলী বাজারে পৌছে সেখানে নেমে কিছু সময় হাটাহাটি করলাম। বাজারটা ঘুরে দেখলাম। চারিদিকে জালের মতো শুধু খাল-বিল। এদের জীবনকে অক্টোপাসের মতো পেচিয়ে আছে খাল-বিল।
আমরা বেড়ালাম কুড়িয়ানা-আদমকাঠি-ভীমরুলী-আ্টঘর বাজার হয়ে আবার কুড়িয়ানা ফিরে এসে আমাদের শহর হতে ভাড়া করা বাহনে উঠলাম।
বরিশালের ডাব।
বায়তুল আমান জামে মসজিদ গুঠিয়া।
মাহিদ্রতে উঠে সোজা গুঠিয়া সেন্টু মিয়ার বায়তুল আমান জামে মসজিদে এসে। মসজিদ দেখে চলে এলাম। দূর্গা সাগর দীঘি দেখতে।
দূর্গা সাগর জলে গোসল।
এর পর শহরে এসে নতুন বাজার মসজিদে জুম্মার সালাত আদায় করে আরিফ ভাইদের বাসায় এসে দুপুরের খাবার দেখে সবার ভিমরি খাবার জোগাড়! এ যেন বিয়ে বাড়ির আয়োজন। কোনটা রেখে কোনটা খাব! আলহামদুল্লিাহ আমি বেশ টানলাম। কয়েক পিস ইলিশ ভাজা খেলাম। বড় চিংড়ি খাওয়ার পর টানলাম গরুর গোস্ত ভূনা। অন্যান্য আইটেম তেমন ধরলাম না।
এই ব্রীজের নাম মনে না্ই বলতে পারবেন মোরশেদুল বারী ভাই।
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুম। এক ঘন্টা ঘুমিয়ে আবার বিকেল বেলা চলে গেলাম এয়ারপোর্ট।
বরিশাল এয়ারপোর্ট।
সেখানে দেখা হল আমাদের ভার্চূয়াল জগতের পরিচিত আরেক দ্বীনি ভাই মোরশেদুল বারী ভাইয়ের সাথে। তিনি আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন। এর পর আমরা আসরের সালাত আদায় করে চলে গেলাম দুইটি ব্রীজ দেখতে। এরপর মাগরিবের সময় হলে মাগরিব পড়ে সোজা আরিফ ভাইদের বাসায়। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে লঞ্চ ঘাট।
লঞ্চে জড়িয়ে ধরে হাসি-কান্নায় বিদায়।
এ যে দ্বীনি বন্ধন। এ বন্ধন আল্লাহর জন্য। আমরা ভাই ভাই সকল মুসলিম। একে অপরের কত যে আপন।
এ সেই রাস্তা।
জলের পথ।
আমড়া গাছের চারা।
রাতে লঞ্চের ছাদে।
এ চলায় আনন্দ আছে।
সন্ধ্যা নদীর পাড়ে।
সংগৃহীত।
চাইলে আপনিও যেতে পারেন সেই ছবির দেশে। দেখে আসতে পারেন স্বপ্ন রাজ্য। বার বার যেতে মন চাইবে। ওপেন চ্যলেঞ্জ!
যেভাবে যাবেন- ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় হুলারহাটের উদ্দেশে ২-৩টি লঞ্চ ছেড়ে যায়। এতে উঠে পরের দিন সকাল ৬টার দিকে বানারীপাড়া নেমে যাবেন। ভাড়া নেবে ডেক ১৮০ টাকা, কেবিন : ১০০০ টাকা (সিংগেল) আর ডাবল ১৮০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার গাবতলী থেকে স্বরূপকাঠির উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। এতে উঠে বানারীপাড়া যাবেন। ভাড়া নেবে ৫০০ টাকা। বরিশাল হয়েও যেতে পারেন। লঞ্চে বা বাসে বরিশাল গিয়ে আবার বাসে বা অটোতে করে বানারীপাড়া। কুড়িয়ানা থেকে নৌকা ভাড়া করে বেড়াতে পারেন জলের রাজ্যে।
শহর থেকে এগুলো রিজার্ভ নিতে পারেন।
বানারীপাড়া পৌঁছাবেন সকাল ৬টার মধ্যে। এরপর যেকোনো একটি রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে আবার নদী তীরে চলে আসুন। একটি বড় ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করুন। বলবেন আপনি ৬-৭ ঘণ্টা ঘুরবেন এভাবে : বানারীপাড়া, আটঘর-কুড়িয়ানা, ভিমরুল ও মাহমুদকাঠি অথবা বানারীপাড়া-হাড়তা বা বৈঠাকাঠা। ১০-১৫ জন বসার মতো একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নেবে এক হাজার ৫০০ টাকার মতো। দুপুরে কুড়িয়ানার বিখ্যাত বৌদির রেস্টুরেন্টে (সকাল-সন্ধ্যা) খেয়ে নিতে পারেন। আগে অর্ডার করলে ভালো খাবার রান্না করে রাখবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ বাজারের ছোট বৌদির রেস্টুরেন্টে কয়েকশ বিদেশি খাবার খেয়েছেন। বৌদির রেস্টুরেন্টের ফোন নম্বর : ০১৯২৩-৭৪৪৯৩৭ (সন্ধ্যা রানী)
ফেরার সময় বানারীপাড়া থেকে বাসে করে চলে আসুন গুঠিয়া। গুঠিয়ার বিখ্যাত বায়তুল আমান জামে মসজিদ দেখে অটো নিয়ে চলে যান দুর্গাসাগর। দুর্গাসাগর দেখে বাসে উঠে চলে যান বরিশাল শহরে।এর পর লঞ্চ ঘাট।
বিষয়: বিবিধ
১৮৩৮ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ ভাইয়া ।
জাযাকাল্লাহ খাইরান।
আমাদের বরিশাল কেমন লাগলো। জোয়ার ভাটা সম্পর্কে কিছু বলেনি। আমি নিজেও থাকি না এখন। এখানে জম্নেছে ইসলামী আন্দোলনের অনেক নেতা,মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সায়েদী, মাওলানা আবদুর রহীম,মেজর(অব) আবদুল জলিল । কিছু পীর। কিছু নাস্তিক , কিছু সেকুলার, আঃ গা:চৌধুরী এবং শেরে বাংলা। ছোট বেলার ঘটনা, মনে করিয়ে দিলেন। কখনো নৌকা চালানো , কখনো
মাছ ধরা। কখোনো নারিকেল গাছে উঠা।
যে মুহূর্তে কমেন্ট করছি। ঠিক সেই সময় হারাতে যাচ্ছি, আরেক জন,ইসলামী আন্দোলনের নেতা।
ভাল লাগল ছবি গুলি। অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন