জাফলং, তামাবিল (সিলেট ভ্রমণ ২০১৫)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১০:৩৫:০৪ সকাল
এর আগে দাপ্তরিক প্রয়োজনে সিলেট বেশ কয়েকবার গেলেও শহরের বাইরে তেমন একটা দেখা হয় নি। তবে মৌলভীবাজার বেশ ঘুরেছি। সে গল্প অন্যদিনের জন্য থাক।
সময়টা ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস। একটি অফিস ট্যুরে সিলেট গিয়েছি। অফিস ট্যুর এর আগে ছিল দুই দিনের সরকারী ছুটি। এর সাথে আরো তিনদিন ছুটি নিলাম। প্রায় ৭/৮ দিন ম্যানেজ হয়ে গেল। আগে সপরিবারে চলে গেলাম চট্টগ্রাম মায়ের সাথে দেখা করার জন্য। আম্মাকে দেখে একদিন পর চট্টগ্রাম হতে সিলেট এর ট্রেনে চড়ে বসলাম। চট্টগ্রাম হতে সিলেট ট্রেন ভ্রমণ একটি দীর্ঘ পথ। সকাল সাড়ে আটটায় চড়ে বসলাম পাহাড়ীকা এক্সপ্রেস এ। সিলেট পৌছলাম সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ।
দীর্ঘ ট্রেন জার্নির পর হোটেল খোঁজার পালা। অনলাইনে সার্চ দিয়ে কয়েকস্থানে যোগাযোগ করলাম। সাপ্তাহিক ছুটির সাথে সরকারী ছুটি যোগ হওয়ায় পর্যটকের চাপে সব জায়গায় বুকড। অবশেষে হোটেল অনুরাগে ফোন করে জানলাম একটি মাত্র ফ্যামিলী রুম খালি আছে। বুকিং দিয়েই সিএনজি ডেকে উঠে পড়লাম। এ হোটেলটি ধোপা দিঘীর পাড় (পূর্ব), জিন্দাবাজার হতে ১০ মিনিট এর পথ। থ্রী স্টার মানের মোটামুটি ভাল হোটেল।
আগে হতেই জেনে এসেছিলাম পাঁচ ভাই রেস্তোরার খাবার বিখ্যাত। পেটে তখন সাংঘাতিক ক্ষিধে জানান দিচ্ছে। হোটেলে উঠে একটু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম পাঁচ ভাই রেস্তোঁরার খাবারের উদ্দেশ্যে। এ রেষ্টুরেন্টটি অবস্থিত জল্লারপাড়, দারিয়াপাড়া ঠিকানায়। আমাদের হোটেল হতে ১৫ টাকা রিক্সা ভাড়া। (ঢাকার তুলনায় সিলেটে রিক্সা ভাড়াটা কমই মনে হলো)।
পাঁচভাই এর খাবার দামে সহনশীল, স্বাদেও বেশ। ক্ষুধাও ছিল, তাই বেশ আনন্দ নিয়েই খেলাম পেটপুরে। যে কয়দিন থেকেছি প্রতিবেলা পাঁচভাই এ খেয়েছি। তবে শুঁটকীভর্তাটি ভাল হয় নি, বোধহয় পঁচা শুটকি। একবার ট্রাই করে পরে আর শুটকি খাই নি। অন্য সব খাবার সত্যিই দারুণ ছিল।
সে যাই হোক, ঘুমুতে যাওয়ার আগে আগামী দিনের ভ্রমণপ্ল্যান ফাইনাল করলাম। আমার স্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক ক্লাসমেট এর বাড়ি সিলেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে সিলেটেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রজেক্টে জব করছেন। তাকে ফোন দেয়া হলো। ভদ্রলোক সানন্দে আমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয়ে গেলেন। পরদিন জাফলং, তামাবিল যাবো চূড়ান্ত হলো।
সকাল আটটার মধ্যেই ইমাম (উনার নাম ইমাম উদ্দীন) আমাদের সারাদিনের ভ্রমণের জন্য সিএনজি চালিত থ্রী হুইলার রিজার্ভ নিয়ে চলে এলেন। শ্বশ্রুমন্ডিত সৌম্য চেহারার সুঠাম যুবক। পাঁচ ভাইতে সকালের নাস্তা সেরে দুপুরের লাঞ্চও পার্সেল করে নিলাম। পরে বুঝলাম এটা ভুল হয়েছে। এক সময় জাফলং এ পর্যটকদের খাবারের জন্য কোন রেষ্টুরেন্ট না থাকলেও বর্তমানে আছে বেশ কয়েকটি। তাই খাবার টেনে নেয়াটা ঝামেলা বাড়ানো ছাড়া কিছু নয়।
শহর ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই পড়লো লাক্বাতুরা টি এস্টেট। এখানে কিছুক্ষণ নেমে ছবি তুললাম।
বেশি সময় নষ্ট করলাম না এখানে। সাড়ে এগারোটার মধ্যে পৌছে গেলাম জাফলং এ। রাস্তার অবস্থা অবশ্য বেশি সুবিধের ছিল না। বড় বড় ট্রাক আর লরিতে করে পাথর পরিবহনের কারনে রাস্তার বেশিরভাগ স্থানে এবড়ো থেবড়ো অবস্থা। পথে পথে দেখলাম অনেক স্টোন ক্রাশার মেশিন। পাথরশিল্প এখানে বেশ জমজমাট।
জাফলং কেন প্রকৃতিকন্যা হিসেবে পরিচিত তা এখানে না এলে কেউ সহজে বুঝবে না। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত এই জাফলং। সিলেট শহর হতে এর দূরত্ব ৬৬ কিমি। স্বচ্ছ নীল পানির নীচে স্তরে স্তরে বিছানো নানা বর্ণের, নানা ডিজাইনের ছোট বড় পাথরের স্তূপ জাফলংকে দিয়েছে অন্য মাত্রার সৌন্দর্য। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং সত্যিই অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। ডাউকি পাহাড় বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সীমানাপ্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীন নির্জনবনভূমি। ১৯৫৪ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যেরঅবসান ঘটে। তারপরও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত পড়ে রয়েছিল।ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌ পথে জাফলং আসতে শুরু করেন। পাথর ব্যবসারপ্রসার ঘটতে থাকায় গড়ে উঠে নতুন জনবসতিও।
বলে রাখা ভাল জাফলং গেলে সাথে করে বাড়তি কাপড় চোপড় ও তোয়ালে/গামছা নিতে ভুলবেন না। জাফলংয়ের স্বচ্ছ নীল পানির স্রোতের সাথে পাহাড় হতে গড়িয়ে আসা মোহনীয় বর্ণের ও কারুকার্যের পাথর আপনাকে গোসল করার জন্য তুমুলভাবে আকর্ষণ করবে। এছাড়া ঠা ঠা রোদের কারণে গরমের ক্লান্তিতো আছেই।
পিয়াইন নদীর তীরে-
জাফলং এর মূল পয়েন্ট এ যেতে হলে আপনাকে এখান হতে নৌকায় যেতে হবে। পথ সামান্য, তবে নৌকায় দরদাম করে যাবেন। পর্যটকদের সবাই ঠকানোর ধান্ধায় থাকে। ৩ - ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত নৌকা ভাড়া চাইতে পারে। পাত্তা না দিয়ে একটু সামনে হাঁটুন। দেখবেন জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা করে ডাকছে। আমরা গিয়েছিলাম জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকায় আর ফিরে আসার সময় ছোট একটি বোট রিজার্ভ করলাম ২০০ টাকায় মাত্র। নৌকায় যেতে যেতে দেখবেন পাথরশ্রমিকরা পাথর তুলছে ডুব দিয়ে দিয়েেএবং সে পাথর সংগ্রহ করে নৌকায় জমা করছে। সে এক অন্যরকম দৃশ্য। কষ্টকর কাজ বেশ। তবে এ অঞ্চলের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবিকার ভাল উৎস এটি। নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রচুর শ্রমিক এ পেশায় আছে।
নৌকায় করে ২০ মিনিটের মধ্যে পৌছে গেলাম গন্তব্যে। ছেলেকে নিয়ে পাথর সংগ্রহ করলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে গোসল করলাম। তবে এখানে সাবধানতা জরুরী। আপাত শান্ত মনে হওয়া পানির নীচে প্রচন্ড স্রোত। যে কোন সময় পা পিছলে পাথরে পড়ে মারাত্মক আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাঁতার না জানলে কোন অবস্থাতেই গভীর পানিতে যাওয়া উচিত নয়। অনেক স্থানে পানির গভীরতা অনেক বেশি কিন্তু স্বচ্ছতার কারণে মনে হবে দুই ফুটের বেশি নয়।
উনার জন্য খুব আফসোস! গোসল করতে পারেন নি। তাই পাথর কুড়িয়ে আর হাত মুখ ধুয়েই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাচ্ছেন।
কয়েকঘন্টা সুন্দর স্বচ্ছ পানিতে দাপাদাপি করে কাটিয়ে ফিরলাম জাফলং হতে।
পিয়াইন নদীর তীরে এই “বল্লারহাট জামে মসজিদে” আমরা নামাজ আদায় করলাম।
জাফলং হতে ফেরার পথে তামাবিল স্থল বন্দরে ঢুঁ মারলাম। জাফলং হতে তামাবিল যাওয়ার তিন কিমি পথটা অসাধারন সুন্দর।
এটা হচ্ছে জিরো পয়েন্ট-
বিজিবির সাথে কথা বলে ভারতীয় সীমান্তে ডুকলাম। তবে ছোট একটি নির্দিষ্ট এরিয়ার মধ্যে থাকতে বললো। দাদারাও দেখি দলবেঁধে দেখতে আসে বাংলাদেশ। ডাউকি শহরের এক দম্পতি বাংলাদেশ সীমানায় এসে আঙ্গুল উঁচিয়ে দূরে দেখিয়ে বলছে- “দিস ইজ বাংলাদেশ।” আমি ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলাম-“ইউ আর অলরেডী স্ট্যান্ডিং অন দ্য ল্যান্ড অব বাংলাদেশ।” শুনে বললো, “ওয়াও!”
কৌতুকপ্রদ ঘটনাটি বলি।
এক আচার বিক্রেতা সেখানে আচার বিক্রয় করছে। খেয়াল করে দেখলাম, ইন্ডিয়ান পাবলিক বুঝতে পারলে সে বলছে- “বাংলাদেশী আচার, বাংলাদেশী আচার”। আবার বাংলাদেশীদের কাছে গিয়ে বলছে, “ভারতের আচার, ভারতের আচার”। হাহাহা।
আমরা এখন নো ম্যানস ল্যান্ডে-
তামাবিল হতে ফেরার পথে ইমাম উদ্দীন ভাই প্রস্তাব দিলেন, শাবিপ্রবিতে যাওয়ার। সানন্দে রাজি হলাম। ইমাম ভাই শাবিপ্রবিতে পড়ুয়া এক ছোটভাইকে ফোন দিলেন আমাদের রিসিভ করার জন্য। শেষ বিকেলে পৌছলাম শাবিপ্রবিতে। ঐ ছোটভাই আমাদের সঙ্গ দিয়ে পুরো ভার্সিটি ঘুরে দেখালেন। এর আগেও একবার দেখেছিলাম ২০০৮ সালে। তবে আমার স্ত্রী আর ছেলের জন্য প্রথমবার।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এর সামনে।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজলো প্রায়। ফ্রেশ হয়ে আবার পাঁচভাইয়ে রাতের খাবার খেয়ে পরদিনের ভ্রমণ প্ল্যান করতে করতে ঘুমুতে গেলাম।
(আগামী পর্বে থাকছে রাতারগুল আর বিছানাকান্দি ভ্রমণ)।
বিষয়: সাহিত্য
১৭৩১ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ, বাংলার প্রকৃতিকে আপনার লেখনীর মধ্যে তুলে ধরার জন্য।
তবে পুরুষ ও মহিলার পর্দার পরিধি ভিন্ন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন