বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে তিনদিনের কর্মসূচি শেষ করেছে বিএনপি। বুধবার (৩ জুলাই) সারাদেশের জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশ ছিল তিনদিনের শেষ কর্মসূচি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, আবারও দ্রুততম সময়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের ইস্যুতে কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
দলের দায়িত্বশীল নেতারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, খালেদা জিয়ার ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে অন্যান্য ইস্যু যুক্ত করতে চায় বিএনপি। এক্ষেত্রে দেশের আর্থিক দুরবস্থা, দুর্নীতি ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক বাতিলের দাবিগুলোও যুক্ত হবে। যুগপৎ ধারায় যুক্ত দলগুলোকে এই ইস্যুতে যুক্ত করতে চায় বিএনপি। ইতোমধ্যে দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে, তা গোলামির নবতর সংস্করণ মাত্র।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবার (২৮ জুন) এক অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন, ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার আন্দোলন খুব জরুরি। আমরা এটাকে আলাদা করে দেখতে চাই না, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে এটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত’।
দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির আগামী বৈঠক বা তার আগেই নতুন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি জানাবেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জানতে চাইলে বুধবার বিকালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনও আলোচনা করিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলবো। তারপর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।’
গত ২৬ জুন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি ও তার মুক্তির দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। ২৯ জুন রাজধানীতে সমাবেশ ও ১ জুলাই সারা দেশের মহানগরে সমাবেশ করেছে দলটি।
বুধবার (৩ জুলাই) জেলা সদরে সমাবেশ করেছে বিএনপি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, বুধবার জেলা পর্যায়ে সমাবেশ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও সরকারদলীয় অনুসারীদের হামলার শিকার হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। নাটোর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় এসব ঘটনা ঘটে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বিএনপির চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসা ও মুক্তির দাবিতে ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর ৮ দিনের কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। এরপর ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকাসহ দেশের মহানগর ও জেলা শহরে সর্বশেষ অনশন কর্মসূচি পালন করেন নেতাকর্মীরা। উভয় সময়েই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল।
এ বছরের সাত জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তুলতে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে বিরোধী দলের নেতারা। সভা-সেমিনারে বিরোধী দলীয় নেতারা নিজেদের আগামী দিনের আন্দোলনের জন্য ‘পরস্পরকে উৎসাহিত’ করছেন।
বুধবার রাজধানীতে ইসলামী আন্দোলনের একটি সংলাপে অংশ নিয়ে নেতারা বলেছেন, সরকারের পতন ঘটাতে আন্দোলন তীব্রতর করতে হবে। আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ এবং সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নেতারা।
সংলাপে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘প্রিয় স্বদেশ যখন তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্নের মুখে, তখন রুখে দাঁড়ানো আমাদের সকলের সমান দায়িত্ব। আমরা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনও জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি, বিজয় আমাদেরই হয়েছে।’
গণফোরামের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য করতে হলে আমাদেরকে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। আমরা রাজপথে খুব শিগগিরই নামবো।’
সংলাপে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এ বছরের মধ্যে সরকারকে বিদায় করা উচিৎ। সরকারকে আল্টিমেটাম দেওয়া দরকার।’
যুগপতে যুক্ত ও বাইরে থাকা বিরোধী দলের কয়েকজন নেতা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, সভা-সেমিনার বা শুক্রবার জুমার পর বিক্ষোভ করে সরকারকে কার্যকর চাপে রাখার কোনও সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলোকে আরও কাছাকাছি এসে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠের কর্মসূচিতে যেতে হবে।
কোনও কোনও দলের নেতারা আন্দোলনকে আরও বড় আকার দেওয়ার জন্য যুগপতের বাইরে থাকা সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে বিএনপির আচরণ কী হবে, এ চিন্তায় অনেকে উদ্যোগী ভূমিকা নিলেও সামনে এগোতে হিসাব-নিকাশ করছেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, ‘বিরোধী দলগুলো এখন হোমওয়ার্ক করছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী কিছুদিনের মধ্যে এ বিষয়ক প্রক্রিয়াগুলো সামনে আসা শুরু হবে। বিভিন্নভাবে বিরোধী দলগুলোকে ‘পুশ করার’ চেষ্টা চলমান আছে। এক্ষেত্রে বিএনপির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাড়তি উদ্যোগ নিতে গেলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কী চিন্তা হবে, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, এরইমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে যুগপৎ ধারায় আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আগামী দিনের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আলোচনা করার কথা রয়েছে।
তবে মঞ্চের নেতারা বলছেন, নতুন কোনও নীতি বা কৌশল নয়, ৩১ দফার ভিত্তিতে যুগপতের ধারা এগিয়ে যাবে। তবে তারেক রহমানের সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে কিছু বিষয়ে স্পষ্ট বোঝাপড়া হতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন কোনও কোনও নেতা।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপি যে এখন কর্মসূচি পালন করছে এসব নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি, তারা স্বাধীনভাবে দিয়েছে প্রোগ্রামটি। যুগপতের নতুন কর্মসূচি নিয়েও কোনও আলোচনা হয়নি। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক হবে কিনা, সেটিও জানি না।’
পরবর্তী কর্মসূচির ইস্যুর ক্ষেত্রে ভারত প্রসঙ্গটি উল্লেখযোগ্য বলে জানান বিএনপির দায়িত্বশীলরা। কোনও কোনও প্রভাবশালী দায়িত্বশীল দাবি করেন, ‘পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে’ কর্মসূচি দেবে বিএনপি। যুগপৎ-ধারায়ও একই থাকবে। তবে চলমান পরিস্থিতির মধ্যে বন্যার বিষয়টিও নীতিনির্ধারকদের আমলে নিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতাও যুক্ত হবে।
‘আমরা ব্রডলি যুগপতের মধ্যে আছি। যদিও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই’ বলছিলেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘আশা করছি অল্প কিছুদিনের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, এবং বাংলাদেশবিরোধী চুক্তি নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কর্মসূচি বের করতে পারবো।’
ভারতের সঙ্গে করা সমঝোতা স্মারক বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি দিলেও তাতে ক্ষমতাসীন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যই প্রধান। বিগত সময়ে বিএনপিতে সরাসরি ‘ভারতবিরোধিতা’ যেমন ছিল, সামনে এই দৃশ্য নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে জনমানসের চিন্তার প্রতিফলন ঘটানোই মূল লক্ষ্য বলে জানান বিএনপির একাধিক নেতা।
জানতে চাইলে বুধবার সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, দেশবিরোধী চুক্তি-সমঝোতার বিরুদ্ধে কর্মসূচি আসছে। কখন, কবে দেওয়া হবে কর্মসূচি, তা তো আমি বলতে পারবো না। তবে আমাদের কর্মসূচিতে তো কোনও গ্যাপ নেই। আশা করি দ্রুত আসবে। একইসঙ্গে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতেও কর্মসূচি চলমান থাকবে। একদিকে আইনি লড়াই করবো, রাজপথেও কর্মসূচি পালন করবো।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন