গ্রীষ্মের শুরুতে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজার ক্ষেতগুলো সাধারণত পাকা ফসল দিয়ে ভরা থাকত। উপত্যকাটির মাঠ, ক্ষেত ও বাগান থাকত ফুলে ফলে পরিপূর্ণ। রঙ্গিন রঙ্গে ভোরে যেত চারপাশ।
কিন্তু এবারের গ্রীষ্ম যেন অন্যরকম হয়ে এসেছে গাজাবাসীর জন্য। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর থেকে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। প্রায় নয় মাসের যুদ্ধে ভূখণ্ডটির কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল।
কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার ডিজিটাল তদন্ত দল, সানাদ দ্বারা বিশ্লেষণ করা স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে দেখা গেছে যে, গাজার কৃষি জমির অর্ধেকেরও বেশি (৬০ শতাংশ) ধ্বংস হয়ে গেছে ইসরায়েলি হামলায়।
উত্তর থেকে দক্ষিণ কোন স্থানেই কৃষি জমি অক্ষত রাখেনি দখলদার দেশটির বাহিনী।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার জনসংখ্যার অধিকাংশ বাসিন্দা ৯৬ শতাংশ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করছেন। এছাড়া উপত্যকাটিতে প্রতি পাঁচজন ফিলিস্তিনি বা প্রায় ৪ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ অনাহারে ভুগছে।
উত্তর গাজা
ফিলিস্তিনি কৃষক বেইত লাহিয়াতে ইসরায়েলি আক্রমণ সত্ত্বেও তার কৃষি উদ্যোগ শুরু করেছিলেন
উত্তর গাজার বেইত লাহিয়াতে, একসময় বেশ বিখ্যাত ও পরিচিত ছিল মোটা এবং রসালো স্ট্রবেরির জন্য। যেগুলোকে স্থানীয়রা আদর করে "লাল সোনা" বলে ডাকত। কিন্তু যুদ্দের পর ইসরায়েলি বুলডোজার এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা স্ট্রবেরির ক্ষেতগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছে। ময়লার স্তূপে পরিণত হয়েছে এক একটি ক্ষেত।
আল জাজিরা জানায়, যুদ্ধের আগে, গাজার স্ট্রবেরি চাষ ও বিপণনে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান ছিল। এই ফলটির বীজ বপন এবং রোপণ সেপ্টেম্বরে শুরু হয়, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফসল তোলা হত।
ইসরায়েলের চলমান আক্রমণের মাঝেও ক্ষুধার্ত কৃষকরা বোমা হামলায় বিধ্বস্ত ভবনগুলোর মধ্যে স্ট্রবেরি চাষের উপায় খুঁজে বের করেছিলেন। তবে ইসরাইলি হামলায় সেখানের এসব ক্ষুদ্র প্রয়াসও ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজা শহর
বাগান দিয়ে ঘেরা এবং বাড়ির উঠানে জলপাইসহ নানা ফলের গাছ দিয়ে ভরা ছিল একসময়ের গাজা শহর। যুদ্ধের আগে গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ সাড়ে সাত লাখই থাকত এই শহরে।
ফিলিস্তিনের অর্থনীতিতে জলপাই চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তেল থেকে সাবান পর্যন্ত সবকিছুতে ব্যবহৃত হয় এই জলপাই। এছাড়া জলপাই গাছ ফিলিস্তিনে খুবই প্রিয়। এই গাছ দেশটিতে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক ।
গাজা শহরের দক্ষিণে জেইতুন পাড়া, (জলপাই এর আরবি শব্দের নামানুসারে নামকরণ করা একটি পাড়া)। স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে আল জাজিরা দেখিয়েছে দক্ষিণ জেইতুনের যুদ্ধের আগের ও পরের অবস্থা। অঞ্চলটির প্রতিটি জলপাই গাছ উপড়ে ফেলেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গত বছরের ২২ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম দফা যুদ্ধ বিরতির সময় ফিলিস্তিনি কৃষকরা তাদের জলপাই সংগ্রহ করতে এবং তেল আহরণের জন্য চেষ্টা করেছিল। কারণ তাদের বেঁচে থাকার জন্য এই ফসলের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এগুলো থেকে তারা তেল এবং সাবান তৈরি করে তা বাজারজাত করে জীবন ধারণ করে থাকে।
দেইর এল-বালাহ
ফিলিস্তিনি খামারিরা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গাজার দেইর এল-বালাহতে খেজুর সংগ্রহ করছেন
দেইর আল-বালাহ হল গাজা উপত্যকার একটি ফিলিস্তিনি শহর। এটির নামের অর্থ "হাউস অফ ডেটস" অর্থাৎ খেজুরের বাসা। দেইর এল-বালাহ গাজার অন্যতম বৃহত্তম কৃষি উৎপাদনকারী এলাকা ছিল। এলাকাটি কমলা, জলপাই এবং খেজুর উৎপাদনের জন্য পরিচিত।
সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে শুরু ফসল উৎপাদন শুরু হয় এবং অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে।
স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে আল জাজিরা দেখিয়েছে যে দেইর এল-বালাহের কেন্দ্রে পূর্ব মাগাজিতে ইসরায়েলের হামলায় খামার, কৃষিজমি, রাস্তা এবং বাড়িঘরের ব্যাপক ধ্বংস হয়েছে। এলাকাটির ৬৪ শতাংশ কৃষি জমি ধ্বংস করেছে ইসরায়েল।
খান ইউনিস
গাজার দক্ষিণে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খান ইউনিসে কমলা ও আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফলের সিংহভাগ উৎপাদন হত।
ভূমধ্যসাগরীয় অবস্থানের দিক থেকে এই অঞ্চলের উর্বর মাটি এবং আদর্শ জলবায়ু কৃষির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া এই অঞ্চলটিতে প্রচুর খালি স্থান রয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলেও তাণ্ডব চালিয়েছে দখলদার বাহিনী।
গাজায় ইসরায়েলের হামলার আগের এবং পরের স্যাটেলাইট থেকে সংগৃহীত ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যেসব অঞ্চল আগে সবুজ ছিল সেগুলো হামলার পর ওপর থেকে ধূসর দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ হামলার ফলে ওই অঞ্চলের ফসলের গাছগুলো সব ধ্বংস হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনে অলিভ বা জলপাই চাষ খুবই জনপ্রিয়।
ইসরায়েলের হামলা ও অভিযানে গাজার জনগণ যে সকল ফসলের ওপর নির্ভর করত, সেগুলোর উৎপাদন পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ইসরায়েলের চলমান হামলা যদি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে সেখানের মানুষ কর্মসংস্থান হারানোর পাশাপাশি চরম দুর্ভিক্ষে পতিত হবে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা।
ফিলিস্তিনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে গাজার কৃষকরা ৪ কোটি ৪৬ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞা কয়েকটি প্রতিবেশী দেশে বিক্রি সীমিত করে।
ওই বছর গাজার রপ্তানিগুলির মধ্যে এক তৃতীয়াংশ (৩২ শতাংশ) ছিল স্ট্রবেরি, ২৮ শতাংশ টমেটো এবং ১৫ শতাংশ শসা।
ফিলিস্তিনি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুসারে ২০২১ সালে, গাজা প্রায় ৪৭০০ টন মাছ উৎপাদন করেছিল। কিন্তু ৭ অক্টোবর যুদ্ধের শুরু থেকে অনেক জেলে সাগরে প্রবেশ করতে পারছে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন