পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সুযোগ নিয়ে চাকরি বাগিয়েছেন প্রথম শ্রেণির অনেক কর্মকর্তাও। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা প্রশ্নফাঁসকাণ্ডে গ্রেপ্তার আসামিদের বয়ানে। এর মধ্যে ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা, ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষা, পলিটেকনিক্যাল কলেজের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য উঠে এসেছে। সবশেষ, রেলওয়ের দশম গ্রেডের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগের প্রশ্নপত্র ট্রাংকের তালা কেটে পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম সাজু প্রশ্ন ফাঁস করেছেন বলে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ইতোমধ্যে পিএসসির দুই উপপরিচালক ও সাবেক গাড়িচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছয়জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসে চাকরি মিলেছে অন্তত চারজন রাজস্ব কর্মকর্তার। অ্যানালগ যুগে ডামি প্রার্থীর পাশে পরীক্ষার সিট ফেলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের দুই ডজন উপসহকারী প্রকৌশলীকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে চক্রের সদস্যরা। পিএসসি ডিসপাচ অফিসার খলিলুর রহমান ৩৩তম বিসিএসের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রসহ গ্রেপ্তারের পর পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জেলে বসেই চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষার আগেই চাকরি প্রার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেন খলিলুর। তার দেওয়া ওই প্রশ্নপত্রে চাকরি পাওয়া তিনজন এখন বিসিএস ক্যাডার।
সবশেষ রেলওয়ের প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামের এক কোটি ২১ লাখ টাকা নেওয়ার হিসাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী দেন ৭৫ লাখ, খলিল ৪৫ লাখ ও ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান সোহেল দেন এক লাখ টাকা। কয়েক মাস আগে এই চক্রের হাতেই ফাঁস হয় পলিটেকনিক্যাল কলেজের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদের প্রশ্নপত্র।
জবানবন্দিতে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী জানিয়েছেন, তিনি পিএসসির এক চেয়ারম্যান ও দুই সদস্যের গাড়ি চালিয়েছেন। অফিসের মাইক্রোবাসে তিনি কর্মকর্তাদের অফিসে আনা-নেওয়া করতেন। চাকরির শুরুর দিকে চাকরি প্রার্থীদের ইচ্ছামতো সিট ফেলা যেত। পরীক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে তখন আবেদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এক লাখ টাকার বিনিময়ে দুজন ডামি প্রার্থীর মাঝখানে একজন চাকরি প্রার্থী বসানো হতো। এভাবে আবেদ চক্র গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে ২০-২৫ জনকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। ২০১৩ সালে তার চাকরি চলে যায়। ২০১৫ সালে চক্রের এক সদস্য তাকে জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে রাজস্ব কর্মকর্তা পদে চাকরি দিতে পারবে। প্রতি প্রার্থীকে দুই ধাপে ২ লাখ করে টাকা দিতে হবে। সেই পরীক্ষায় তার দেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ১৬ জন প্রিলিমিনারি ও ৯ জন লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন। পরে চাকরি হয় চারজনের। এ জন্য তাকে দিতে হয় ৩২ লাখ টাকা। কয়েক মাস আগে পলিটেকনিক্যাল কলেজের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদের প্রশ্নফাঁসের জন্য পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম সাজুকে ৮০ লাখ টাকা দেন আবেদ। চাকরি প্রার্থী ৪০ জনের সঙ্গে তিনি ৮ লাখ টাকা করে চুক্তি করেন। পরীক্ষা শুরুর দুদিন আগে প্রার্থীদের দুটি গ্রুপে (২০ জন করে) ভাগ করে এক গ্রুপকে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার আল আমিনের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। মিরপুরের একটি বাসায় রাখা হয় আরেক গ্রুপকে। এ ছাড়া রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরি দিতে ৪৪ প্রার্থীর সঙ্গে ৮-১০ লাখ টাকার চুক্তি করেন। তাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পরীক্ষার দুদিন আগে রমনা পার্কের গেটে সাজেদুলকে ৭৫ লাখ টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র নিয়ে ‘বুথ করে’ প্রার্থীদের পড়ান। সেই প্রশ্নই পরীক্ষায় হুবহু মিলে গেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, সাজেদুল ২ কোটি টাকায় পিএসসির উপপরিচালক জাফরের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পেয়েছিল বলে গ্রেপ্তারের পর জানিয়েছে। পরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে।
জবানবন্দিতে সাজেদুল বলেছেন, ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান সোহেল তাকে বলেছেন, ৪৬তম বিসিএস প্রিলির প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে। তাকে ১৭ জন চাকরি প্রার্থী দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে দিয়েছিলেন খলিলুর রহমান। ওই ১৭ জনের মধ্যে ১৩ জন বিসিএস প্রিলিতে পাস করেছেন। প্রার্থীদের কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা নিয়ে সোহেলকে ১৩ লাখ টাকা দিয়েছেন সাজেদুল।
রেলওয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে সাজেদুল বলেন, তিনি একটি হেক্সব্লেড দিয়ে প্রশ্নপত্র রাখা ট্রাংকের তালা কাটেন। এরপর প্রশ্নপত্র বের করে নষ্ট তালা লাগিয়ে রাখেন। যেটি যে কোনো চাবিতেই খুলে। তিনি জানান, রেলওয়ের পরীক্ষার জন্য খলিলুর ৯৮ জন প্রার্থীর জন্য দিয়েছিলেন ৪৫ লাখ টাকা। আবেদ আলী দেন ৭৫ লাখ। এ ছাড়া আবু সোলায়মান সোহেল এক লাখ টাকা দেন।
পিএসসির ডিসপাচ অফিসার খলিলুর রহমান জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ৩৩তম বিসিএসের প্রশ্নপত্রসহ তিনি রমনার সাকুরা বারের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন। পরে ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়। এরপরও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। জেলে থেকেই তিনি চক্রের সদস্য দেলোয়ারের সঙ্গে চাকরি প্রার্থীদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। দেলোয়ার ওই ছয় প্রার্থীকে গাড়িচালক আবেদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। এর মধ্যে তিনজন বিসিএস ক্যাডার হন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন