বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর দেওয়া তথ্যে অনেকের নাম পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। দুর্নীতির সত্যতা পেলে তাঁদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। গতকাল বুধবার সিআইডি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আবেদন আলীপ্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সঙ্গে বিজি প্রেসকেন্দ্রিক কারো সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না, পিএসসির কতজন এ ঘটনায় জড়িত, কে কত টাকা লেনদেন করেছেন, এভাবে কে কত টাকা আয় করেছেন, সেসব টাকা বিদেশে কেউ পাচার করেছেন কি না, সেসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।
স্বীকারোক্তি দেওয়া ছয়জনের বাইরে বাকি ১১ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার পিএসসির পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে পিএসসি।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদুর রহমান গতকাল বলেন, গ্রেপ্তার করাদের স্বীকারোক্তির পাশাপাশি তদন্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে যাঁরা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাঁদের পর্যায়ক্রমে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এজাহারভুক্ত ১৪ জনসহ অন্য যাঁরা এখনো গ্রেপ্তার হননি, তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
আবেদ আলীর তথ্যে আরো ঊর্ধ্বতনের নাম
আবেদ আলীর উদ্ধৃতি দিয়ে সিআইডি সূত্র বলেছে, আবেদ আলী পিএসসির ঊর্ধ্বতনদের আরো অনেকের নাম বলেছেন। পিএসসির সাবেক সদস্য মাহফুজুর রহমানের গাড়িচালক ছিলেন তিনি।
সে সময় রাজধানীর গুলশান এলাকায় একটি ভবন এবং নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ‘ভিন্ন জগৎ’ নামের একটি রিসোর্ট ছিল মাহফুজুর রহমানের। অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের এ দুই জায়গায় রেখে পরীক্ষার এক দিন আগে প্রশ্নপত্র দেওয়া হতো। বিনিময়ে মাহফুজুর রহমানকে টাকা দিয়েছেন তিনি। ওই সময় দলীয় নেতাদের তালিকা অনুযায়ী তিনি টাকা নিতেন এবং নেতাদের ভাগ দিতেন।
মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে এর আগে মামলা হয়।
মামলায় তাঁর দণ্ড হয় জানিয়ে সিআইডি সূত্র বলেছে, এর আগেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তত দিনে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন।
সিআইডি সূত্র বলেছে, মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোটের একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট ছিল বলে আবেদ আলী তাদের জানান। তাঁদের কিছু ক্ষমতাধর নেতা প্রশ্ন ফাঁসের এই টাকার ভাগ পেতেন। ওই সময় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীরা বেশি ঢুকেছেন বিসিএস ক্যাডারে।
আবেদ আলীর তথ্য মতে, দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিসিএস প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। তবে ২৪তম, ২৫তম ও ২৭তম ব্যাচে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে আরো অনেকে জড়িত। বিভিন্ন সময় পিএসসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের আরো অনেকের গাড়ি চালিয়েছেন তিনি। তাঁদের অনেকে প্রশ্ন ফাঁসের কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন। পিএসসির শীর্ষ কর্মকর্তাসহ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত। ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, পিএসসির অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও তাঁরা ফাঁস করেছেন। তাঁদের সহযোগীদের কেউ ধরা পড়েছেন, কেউ এখনো আড়ালে রয়ে গেছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলীর তথ্য অনুযায়ী, তিনি শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। ঢাকায় তাঁর একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স ভবন। তবে সিআইডি বলেছে, আবেদ আলীর আরো সম্পদ রয়েছে। তাঁর অনুসারীরাও কোটি টাকার মালিক।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আবেদ আলীর সঙ্গে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত পিএসসির আরো একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ১০ কোটি টাকার চেকসহ গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্তে দুদকে পিএসসির চিঠি
বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পিএসসির পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুদকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। এই পাঁচজন হলেন উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির এবং পিএসসির কর্মচারী ডেসপাচ রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। গতকাল সন্ধ্যায় পিএসসি থেকে দুদকের সচিব বরাবর এই চিঠি পাঠানো হয়।
পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম মতিউর রহমান জানান, যেহেতু তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য আসছে, তাই এগুলো অধিকতর তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহের জন্য দুদকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আগেও আবেদ আলীর বিরুদ্ধে মামলা
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ২০১৪ সালে আবেদ আলীকে প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করেছিল থানার পুলিশ। এরপর তিনিসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরের বছর তাঁদের বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। তবে ৯ বছরেও এ মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি।
ঘর ভাড়া নিয়ে উত্তর মুখস্থ করাতেন
বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করাতে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সাভারের রেডিও কলোনিতে ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন আবেদ আলী ও তাঁর চক্রের সদস্যরা। গত মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এ তথ্যের পাশাপাশি আবেদ আলী আরো বলেন, ২০০৫ সাল থেকে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাঁরা জড়িত। এ ছাড়া ঢাকার শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়া এলাকার বাসায়ও কক্ষ ভাড়া নেন তিনি। তখন ৪৪ জনের কাছ থেকে চার লাখ টাকা করে নেন। এ ছাড়া ২০০৫ সালে গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন।
ব্যাংক হিসাব জব্দের আবেদন করা হবে
সিআইডি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ১৭ জনের পরিবার ও নিকটাত্মীয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করবে সিআইডি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন