সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ এবং জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার কথা বলা হলেও এ নিয়ে সচিবদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। কয়েকজন সচিব বলেছেন, আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী এসব তথ্য গোপন থাকবে। আর তিনজন সচিব বলেছেন, স্ত্রীদের সম্পদের হিসাবও জমা দিতে হবে। তবে প্রত্যেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হিসাব বিবরণী জমা দেবেন।
সম্পদের তথ্য প্রকাশে মতানৈক্য
এ তথ্য কর্তৃপক্ষকে গোপন রাখতে হবে। জনগণের কাছে প্রকাশ করা যাবে না। সচিবদের এসব মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে জ্যেষ্ঠ কয়েকজন সচিব বলেছেন, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯-এর সংশোধনীতে জনমতের প্রতিফলন থাকা উচিত। এ জন্য বিদ্যমান আইন অনুযায়ী প্রত্যেককে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান রাখতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজনীয় জনবলও নিয়োগ করতে হবে। কারণ বিদ্যমান জনবল দিয়ে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাই করা সম্ভব না। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবসভায় এসব কথা বলেন সচিবরা। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেন। সভায় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করা হয়। সভায় সম্পদের হিসাব জমা দেওয়া না-দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সচিবদের মধ্যে লম্বা সময় বিতর্ক হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সচিব কালের কণ্ঠকে জানান, বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান এবং কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। কেউ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না।
কারণ প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এ ছাড়া তাঁরা বলেছেন, সম্পদের হিসাব দেওয়া যাবে। তবে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন রাখতে হবে।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পর পর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়া আর জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ ছিল—প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ কর্তৃক এ ক্ষেত্রে পূর্বে ভেটিংকৃত অংশ থেকে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা উপবিধি-১০(২) বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি আয়কর আইন, ২০২৩-এর ৩০৯ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ কর্তৃক উপবিধি-১০(২) বাদ দেওয়া হয়। একইভাবে ১১ ধারার বিষয়ে মতামত দিয়েছে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ। এ নিয়েও বৈঠকে সচিবদের মধ্যে মতানৈক্য হয়েছে।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা দ্রুত যুগোপযোগী করে নতুন বিধিমালা চূড়ান্ত করা হবে। একই সঙ্গে ২০১২ সালের শুদ্ধাচার কৌশলও সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যখন প্রথম সচিবসভা করেন, তখন আমাদের কাছে একটি নির্দেশনা এসেছিল, আমরা যেন বছরে অন্তত দুটি সচিবসভা করি। সে হিসেবে আমরা হিসাব করেছিলাম জুলাই মাসে একটি সচিবসভা করব। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। প্রথম সভার যে বাস্তবায়ন অগ্রগতি সেটি জানতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে চিঠি দেওয়া হয়। সেটির পরিপ্রেক্ষিতে এই সচিবসভা।’
এই সভায় গত সভার বাস্তবায়ন অগ্রগতি আলোচনা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা শুদ্ধাচার বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। বাজেট বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনী ইশতেহার নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের কিছু দাপ্তরিক কাজে প্রধানমন্ত্রী সময় সময় যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন সেগুলো যেন যত্নসহকারে অনুসরণ করা হয় সে ব্যাপারে সভায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ অনুযায়ী পাঁচ বছর পর পর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকার বিধিমালাটি বাস্তবায়ন করছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ সরকারের অনেক কর্মকর্তা বিপুল টাকার মালিক হলেও সরকারি দপ্তরে কোনো তথ্য নেই। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর বিষয়টি এবার আলোচনায় এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এই বিধিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সর্বশেষ সচিবসভা হয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সভায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সচিবদের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতি প্রতিরোধ, সরকারি অর্থের সাশ্রয় ও রপ্তানি বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোও বিশেষ গুরুত্ব পায় ওই সভায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন