নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাওয়া নিয়মে পরীক্ষার পরিবর্তে নেওয়া হচ্ছে ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন। প্রথম দিনে গতকাল বুধবার ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে চারটি বিষয়ের মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে এতে অংশ নিতে দেখা যায়। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই আগের রাতে এ মূল্যায়নের নির্দেশিকা বা প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েছে। ফেসবুক ও ইউটিউবে সমাধান দেখেই প্রস্তুতি নিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। প্রশ্নপত্রের আলোকে সমাধানও (কীভাবে কাজ করতে হবে) বাসায় বসেই শিখেছে শিক্ষার্থীরা। ফলে স্কুলে গিয়ে পাওয়া প্রশ্নের সমাধান করতে তাদের বেগ পেতে হয়নি। স্কুলে গিয়ে শুধু সেগুলো করে দিয়ে এসেছে তারা। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের যে উদ্দেশ্য, তা এ ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রতিফলিত হয়নি। আগেই কী কাজ করতে হবে, তা শিক্ষার্থী জেনে সেটা আত্মস্থ করে স্কুলে এসেছে। এটা পরীক্ষায় অনেকটা নকল করার মতোই। এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও তাতে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি আগে থেকে জানেও যে, প্রশ্নপত্র কী হবে; তবুও তাতে কোনো গতি নেই। এখানে ফাঁস হওয়ার কোনো বিষয় নেই। প্রশ্নফাঁস করলেও সেটার কোনো উপকারিতা নেই। শিক্ষার্থীকে অবশ্যই কার্যক্রমে অংশ নিয়ে পারদর্শিতার স্তর অতিক্রম করতে হবে।
জানা গেছে, গতকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়, চলে বিরতিসহ পাঁচ ঘণ্টা। প্রথম দিনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাংলা, সপ্তমে ধর্ম, অষ্টমে জীবন ও জীবিকা এবং নবম শ্রেণিতে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের মূল্যায়ন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ষান্মাসিক মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র মঙ্গলবারই হাতে পেয়েছেন শিক্ষকরা। তারা সেই প্রশ্নপত্র ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ, শিক্ষাবিষয়ক পেজ, শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনের নামে চালানো ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছেন। প্রশ্নপত্র পেয়ে যাওয়ায় অনেক প্রাইভেট ও টিউশন শিক্ষক দ্রুত সেটির সমাধান করে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে মূল্যায়ন পরীক্ষার আগের রাতেই কী কী কাজ করতে হবে, তা শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগের রাতেই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা হয়। বুধবার সকালে রাজধানীর দুটি স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হচ্ছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রশ্নপত্র হাতে আসে। যেসব শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান, তারাই মূলত শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের নিয়ে চালু করা গ্রুপে এ প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভিকারুননিসার বেইলী রোড শাখার সপ্তম শ্রেণির একজন ছাত্রীর মা বলেন, মঙ্গলবার রাতে শিক্ষকরা গ্রুপে প্রশ্ন দিয়েছেন। সেটা দেখেই আমার মেয়ে সহ সবাই প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলে গেছে।
রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বলেন, আমরা আগেরদিন বিকেলে প্রশ্ন পেলেও কোনো শিক্ষকের কাছে দেইনি। বুধবার সকালে পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ আগে নিজস্ব প্রিন্টারের মাধ্যমে সেটি প্রিন্ট করে শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে। মূল্যায়ন পরীক্ষা সুন্দরভাবে নেওয়ার জন্য আমরা এত চেষ্টা করলাম, কিন্তু অনেকেই সেটি করলেন না। শিক্ষার্থীদের হাতে যদি প্রশ্ন ও উত্তর চলেই যাবে, তাহলে আমাদের দিয়ে এত কষ্ট করানোর তো কোনো মানে নেই।
জানতে চাইলে ভিকারুন্নেসা স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কেকা রায় চৌধুরী বলেন, মূল্যায়ন নির্দেশিকা আগের রাতে শিক্ষার্থীদের দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পেলে তখন ব্যবস্থা নেবো।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ জাফর আলী বলেন, আমরা পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বসে ষান্মাসিক মূল্যায়ন পরীক্ষার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। সেখানে এই পরীক্ষার প্রশ্ন গোপন রাখার বিষয়টিও বলা ছিল। কিন্তু তারপরও কিভাবে বাইরে বের হল, সে বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।
জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ পুরো দায়ভার তুলে দিলেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ঘাড়ে। তিনি বলেন, এসব টেকনিক্যাল বিষয় এনসিটিবি দেখে। তারাই এই বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।
এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান বলেন, প্রশ্নফাঁস হয়েছে এমন নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন ও এর উত্তর সম্বলিত টিউটোরিয়াল ছড়িয়ে পড়ায় শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা এটিকে প্রশ্নফাঁস মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। শিক্ষকরাও হয়তো এটি ভুল করে শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, নৈপূণ্য অ্যাপে শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষকদের আইডি রয়েছে। শিক্ষকদের এখানে ঢোকার সুযোগ নেই। মূল্যায়নের প্রশ্ন শিক্ষকদের সরবরাহ করবেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু তিনি সেটি তুলে দিলেন কোচিং ব্যবসায়ীদের কাছে। কোন আইডি থেকে এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় গিয়েছে সেটি ট্র্যাক করা হবে। আবার নৈপূণ্য অ্যাপ কর্তৃপক্ষের (এটুআই) কাছেও ওই আইডি ট্র্যাক করার জন্য বলা হবে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরগুলোর মাধ্যমে একটি নির্দেশনা স্কুলগুলোতে পাঠানো হবে। পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে যাতে এ ধরণের সমস্যা না হয় সেজন্য পরীক্ষার আগের দিন ৫টা বা ৭টায় প্রিন্ট করতে নির্দেশনা দেওয়া হবে। প্রধান শিক্ষক ছাড়া অন্য কোনো আইডি প্রশ্ন ধরা পড়লে আমরা সেই আইডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন