রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল হত্যাকাণ্ডে মাত্র এক মিনিটেই ‘কিলিং অপারেশন’ শেষ করে খুনিরা। তারপর পুলিশের সামনে দিয়েই বীরদর্পে নিরাপদে চলে যায় তারা। এই হত্যার দৃশ্য ধরা পড়েছে সিসি ক্যামেরায়, যার ফুটেজ দৈনিক আমাদের সময়ের হতে এসেছে। গত ২২ জুন শনিবার সকালে এই ঘটনার পর ২৬ জুন বুধবার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধাীন অবস্থায় মারা যান বাবুল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হত্যার নেপথ্যে ছিল মূলত বাঘা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক সমিতি ও চাঁদার নিয়ন্ত্রণ।
নেপথ্যে চাঁদাবাজি : স্থানীয় রাজনীতিক ও দলিল লেখকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলিল লেখক সমিতির কমিটি আগে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতো। ২০১৯ সাল থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলোচনার মাধ্যমে কমিটি করে দিচ্ছেন। এর ফলে এমপির অনুসারীরা কমিটিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। সর্বশেষ গত ৭ জুন একইভাবে নতুন কমিটি করা হয়, যাতে উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. শাহিনুর রহমান পিন্টুকে সভাপতি এবং পাকুড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সামিউল আলম ওরফে নয়ন সরকারকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কমিটি গঠনের পর গত ৯ জুন এমপি শাহরিয়ার আলম তাদের দুজনের নাম লিখে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) এসএমএস পাঠান।
দলিল লেখকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে দলিল লেখকরা ক্রেতাদের সঙ্গে দরাদরি করে সম্মানী নিতেন। তবে ২০১৯ সাল থেকে দলিল লেখকদের ‘অনির্বাচিত’ কমিটির নেতারা মুহুরিদের প্রলোভন দেখান- প্রতিটি দলিল লেখার বিপরীতে লেখকরা কোনো সম্মানী নেবেন না। সমিতির নির্ধারিত ফি নিয়ে সমিতিতে জমা দেবেন। সমিতি দিন শেষে দলিল লেখককে প্রতিটি দলিল লেখার বিপরীতে নগদ ২৫ শতাংশ বিল বুঝিয়ে দেবে। বাকি টাকার একাংশ সমিতির জন্য রেখে এবং আরেকাংশ প্রতি সপ্তাহে ১৬৫ জন দলিল লেখকের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি সমিতির নেতারা। ফলে নিয়মিত সম্মানী পাচ্ছেন না দলিল লেখকরা।
যেভাবে সংঘর্ষ শুরু : এই ‘চাঁদাবাজির’ বিরোধিতা করে আসছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাভলু, পৌর মেয়র আক্কাস আলী ও পাকুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মেরাজুল ইসলামসহ তাদের অনুসারীরা। এর জের ধরে প্রথমে গত ১০ জুন দলিল লেখকদের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়, যাতে ১৫ জন আহত হন। পরে ২০ জুন কমিটির বিরোধিতা করে মানববন্ধনে অংশ নেন মেয়র আক্কাস, উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব ও ইউপি চেয়ারম্যান মেরাজ। দলিল লেখক সমিতির ‘দৌরাত্ম্য’ বন্ধের দাবিতে তারা ২২ জুন বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেন। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে একই দিন পৌর মেয়র আক্কাস আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মানববন্ধনের ডাক দেয় বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগ। উপজেলা পরিষদের প্রধান ফটকের সামনে মানববন্ধন শুরু হয়। একপর্যাযে পৌর মেয়র আক্কাসের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল মানববন্ধনটির সামনে এলে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। উভয় পক্ষই অস্ত্রের মহড়া দেয়।
কিলিং অপারেশন : সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, সংঘর্ষের একপর্যায়ে মেয়র আক্কাসের অনুসারীরা ধাওয়া দিয়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরে ঢুকে পড়ে। এ সময় আতঙ্কে এমপির অনুসারী নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এতে উপজেলা পরিষদের পুরনো অডিটোরিয়ামের সামনে একা হয়ে পড়েন বাবুল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, বেলা ১১টা ৪ মিনিটে এক ব্যক্তি প্রথমে বাবুলের মাথায় আঘাত করে। এতে তিনি সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মুহূর্তেই ৬-৭ জন মিলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একের পর এক কুপিয়ে বাবুলকে ফেলে রেখে তারা উপজেলা পরিষদের প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এক মিনিটেরও কম সময়ে তারা কিলিং অপারেশন শেষ করে। বাবুলকে আঘাতের সময় আশপাশে পুলিশ থাকলেও এগিয়ে আসেনি। খুনিরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করলে স্থানীয় এক সাংবাদিক প্রথমে বাবুলের কাছে ছুটে যান। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।
এ ঘটনায় বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াহেদ সাদিক কবির আমাদের সময়কে বলেন, ঘটনার সময় পুলিশ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
নিহত বাবুলের স্ত্রী জরিনা বেগম বেবি বলেন, ‘আমার স্বামীকে নিয়ে কোনো অপরাজনীতি হোক, এটা আমি চাই না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রকৃত খুনিদের বিচার চাই।’ নিহত বাবুলের ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিক জাভেদ বলেন, ‘পুলিশের ব্যর্থতার কারণে আমার বাবার প্রাণ গেছে। আমরা নিরাপত্তীনতায় আছি।’
রাজশাহীর পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান বলেন, পুলিশ সেদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ৩৫ রাউন্ড রাবার বুলেট এবং ৩০ রাউন্ড টিয়ারশেল ছুড়েছিল। হত্যার বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পুরো এলাকা পুলিশ কাভার করতে পারেনি।
কর্মসূচি দেবে না রাজশাহী মহানগর আ.লীগ : রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে আর কোনো কর্মসূচি পালন না করার ঘোষণা দিয়েছে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ। মহানগর নেতারা জানিয়েছেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তাদের শান্ত হতে বলেছেন। তিনি বিষয়টি দেখবেন। গতকাল দুপুরে নগরের কুমারপাড়ায় দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসলাম সরকার। উপস্থিত ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল, সহসভাপতি তবিবুর রহমান শেখ প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত কর্মী। তিনি আহত হওয়ার পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসার সার্বক্ষণিক খোঁজ নেন রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন। এরপরও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্রকারী খায়রুজ্জামান লিটনের বিরুদ্ধে নতুন করে হত্যা মামলার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণায় আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী ও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন