সাদিক অ্যাগ্রোর ১২ লাখ টাকার এক ছাগলের রশি ধরে টান দিতেই বেরিয়ে আসে সরকারি কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সম্পদের ভান্ডার। এ সূত্রে দেশজুড়ে তুমুল আলোচনার খাতা খোলে সাদিক অ্যাগ্রো। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষিভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটির ছিল দুটি খামার। রামচন্দ্রপুর খাল দখলের অভিযোগে পুরো খামারের নাম-নিশানা এখন বিনাশ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) গেল বৃহস্পতি ও শনিবারের দু’দফা সাঁড়াশি অভিযানের মুখে রামচন্দ্রপুর খালপাড় থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়েছে সাদিক অ্যাগ্রো।
তবে এক ছাগলকাণ্ডে ডিএনসিসি এ প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দিলেও খাল দখল করে গড়ে ওঠা অনেক বহুতল ভবন ও স্থাপনায় এখনও লাগেনি উচ্ছেদের আঁচড়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, খালের দখল থেকে সাদিক অ্যাগ্রোকে তাড়ানো হলেও জামাল ডেইরি, আল-মদিনা ক্যাটেল, বাবু অ্যাগ্রোসহ বেশ কয়েকটি পশুর খামার এখনও আছে বহাল তবিয়তে।
এ ছাড়া খালের ওপর আবাসিক প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক কার্যালয়, সরকারি রাস্তা, প্রস্তাবিত খেলার মাঠ, ট্রাকস্ট্যান্ড, টং দোকান, ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘরবাড়িসহ ছোট-বড় কয়েকশ স্থাপনা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, খাল থেকে সাদিক অ্যাগ্রো উচ্ছেদ হলেও বাকিরা তো ধোয়া তুলসী পাতা নয়। তাদের কেন উচ্ছেদ করা হচ্ছে না? দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকলে প্রায় অর্ধেক বেদখল খাল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অতীতে রাজধানীর জলাশয় দখলমুক্ত করার নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা অল্পদিনের মধ্যে থেমে যায়। ডিএনসিসি বলছে, যারা খাল দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে সব অবৈধ স্থাপনা ভাঙা হবে।
কয়েকশ স্থাপনা বহাল
রাজধানীর রামচন্দ্রপুর খালটি শুরু হয়েছে মোহাম্মদপুর বছিলার লাউতলা খাল থেকে। সেখান থেকে মোহাম্মদিয়া হাউজিং হয়ে শেখেরটেকের পেছন দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তুরাগ নদে গিয়ে পড়েছে এটি। ২০০৮ সালের দিকে মোহাম্মদপুরের ভাঙা মসজিদসংলগ্ন খালের ওই অংশে মাটি ভরাট করে একটি ট্রাক টার্মিনাল করা হয়েছিল। তখন থেকেই সেখানে অবৈধ দখলের শুরু।
তবে খালটি আরও আগে মরতে শুরু করেছিল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা উত্তর সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তারা জানান, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর বেড়িবাঁধ সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে মূল রামচন্দ্রপুর খালের সঙ্গে এ অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ফলে উজান থেকে ভাটির দিকে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। খালে দখলদারের দৌরাত্ম্য তখন থেকেই শুরু।
মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ ও রামচন্দ্রপুর খালের আশপাশে ঘুরে দেখা গেছে, খালের অংশে শত শত স্থাপনা। এর মধ্যে ২২টি বহুতল ভবন এ খালপাড়ের কমবেশি জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে।
২০২২ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় খালটির সীমানা চিহ্নিত করে ডিএনসিসি। সে সময় খুঁটিও পুঁতে দেওয়া হয়। পরে সেসব খুঁটি গায়েব হয়ে যায়। এখন অনেকেই খালের জমি কমবেশি দখল করে বাড়ি বানিয়েছে। ‘ফিউচার টাউনের’ ই-ব্লকের ২ নম্বর রোডের বাড়িটিরও অংশবিশেষ খালের মধ্যে পড়েছে। স্বপ্নধরা হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডের ১৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৯ তলা ভবনের কিছু অংশও পড়েছে খালে। শাহজালাল হাউজিংয়ের ৪১/১ নম্বর বাড়িটির কিছু অংশও দাঁড়িয়ে আছে খালের ওপর।
এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান, সাতমসজিদ আবাসিক এলাকা হয়ে নবীনগর হাউজিং, জেমকন সিটি, মোহাম্মদী হাউজিং, রাজধানী উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং, বছিলা গার্ডেন সিটি, দয়াল হাউজিংও খাল দখল করে স্থাপনা বানিয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক প্রতিবেদনে রামচন্দ্রপুর খাল দখলের জন্য নবীনগর হাউজিং, মোহাম্মদী হাউজিং, জেমকন সিটি, মসজিদ, খ্রিষ্টান কবরস্থান, ঢাকা উদ্যানকে দায়ী করা হয়েছে।
বেড়িবাঁধ থেকে রামচন্দ্রপুর খালের মুখে আছে একটি সংগীত স্কুল, যা সুরের ধারা নামে পরিচিত। এ ব্যাপারে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ বলেন, সুরের ধারা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়ে স্থাপনা বানিয়েছে। তবে ডিএনসিসির অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাববীর আহমেদ বলেন, এ নিয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। কমিশনার কোন তথ্যের ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কথা বলছেন, আমার জানা নেই। খালের জায়গা কেউ লিজ নিতে পারবে না। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব। এ বিষয়ে জানতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করা হলে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্থানীয় কাউন্সিলরও দখলে এগিয়ে
ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে রামচন্দ্রপুর খাল। সেই খালে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড শাখার একটি কার্যালয় বানিয়েছেন। ওই কার্যালয়ের আশপাশে ছিল রিকশার গ্যারেজ, চালকদের থাকার ঘর, টং দোকান, রান্নাঘরসহ বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা। সাদিক অ্যাগ্রোকে গুঁড়িয়ে দিতে গিয়ে ওইসব স্থাপনাও ভাঙা পড়ে। সেসব স্থাপনার বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা ওই জায়গায় থাকতেন। এ জন্য প্রতি মাসে কাউন্সিলরকে তিন থেকে সাত হাজার টাকা দিতে হতো। এ ছাড়া স্থাপনা নির্মাণে সবাইকে এককালীন কিছু টাকা দিতে হয়েছে।
খালে ভরাট হওয়া জায়গায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজ ছিল আমিনুল ইসলামের। তিনি বলেন, রিকশার গ্যারেজটি করতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অনুমতি নিয়েছি। গ্যারেজ বাবদ তিনি প্রতি মাসে কাউন্সিলর কার্যালয়ে সাত হাজার টাকা দিতেন। প্যাডেলচালিত রিকশার একটি গ্যারেজ ছিল মোহাম্মদ পারভেজের। পারভেজ প্রতি মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা দেন বলে দাবি করেছেন। সেলিম আকন্দ নামের আরেক মালিকের রিকশার গ্যারেজ ছিল খালের মধ্যে। তিনি বলেন, কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে প্রতি মাসে সাত হাজার করে টাকা দিয়ে আসতাম।
তবে কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ খাল দখলের অনুমতি ও টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। মানুষ কত কথা বলে। নিজের অস্তিত্ব টেকানোর জন্য যে চেয়ারে থাকে, তাকেই বিক্রি করে দেয়।
খালের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৯ সালে এ খালের দখল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। তাতে বলা হয়, একসময় খালটির একাংশ ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্ট বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মধ্য দিয়েও প্রবাহিত হতো। ইউল্যাব রামচন্দ্রপুর খালের ওপর সড়ক নির্মাণ ও স্থায়ী দেয়াল দিয়ে খালটি দুই টুকরো করেছে। নদী রক্ষা কমিশনের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পাঁচ বছরেও ইউল্যাব খাল থেকে সরেনি। এ ব্যাপারে ইউল্যাব উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, ‘অভিযোগটি হয়তো সত্য নয়। আমরা সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গার নিয়ম মেনেই করেছি। তার পরও আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। এ রকম হওয়ার কথা নয়।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সিএস ম্যাপ অনুযায়ী, খালটির ৩.৬৫ কিলোমিটার জলপথ আর ৪.২১ হেক্টর জমি হারিয়েছে। নানা সময়ে অভিযানে ২.৪০৫ হেক্টর পুনরুদ্ধার করা হয়। তবে নতুন করে দখল আর দূষণে খালটির জলাভূমি আরও হারিয়ে গেছে। বর্তমানে খালের জায়গায় ৩৬.৬০ শতাংশ রাস্তা, ৫৫.৪৭ শতাংশ বসতি, ২.০৭ শতাংশ গাছপালা, ময়লা-আবর্জনায় ভরাট ২.২৩ শতাংশ, ফসল-তৃণভূমি ২.৩৪ শতাংশ আর কাদা-জলাভূমি আছে ২.২৯ শতাংশ।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, সিএস ম্যাপ অনুযায়ী দৈর্ঘ্যের হিসাবে খালটি প্রায় অর্ধেক হারিয়ে গেছে বা বেদখল হয়েছে। মোহাম্মদিয়া হাউজিং, মোহাম্মদিয়া সোসাইটি লিমিটেড, বছিলা হাউজিংয়ের পাশ দিয়ে খালটি ১০০ ফুটের বেশি প্রশস্ত ছিল। মোহাম্মদিয়া হাউজিং ও সোসাইটির মধ্য দিয়ে যে রাস্তা বেড়িবাঁধ পর্যন্ত গেছে, এ রাস্তার কিছু অংশ খালের ওপর পড়েছে। খাল দখল করেই এ রাস্তা করা হয়েছে। আমরা খালপাড়ের এমন কোনো জায়গা পাইনি, যেখানে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী স্থাপনা নেই। পুরো খালই অল্পবিস্তর দখল হয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বড় বড় কথা ও লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে খালের পানিপ্রবাহ ধরে রাখা যায় না। রামচন্দ্রপুর খালে এখনও বহু স্থাপনা রয়ে গেছে। দখলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরই অংশ। সব স্থাপনা উচ্ছেদ না হলে খালে প্রাণ ফিরবে না।
এদিকে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজধানীর ২৯ খালের ওপর সীমানা নির্ধারণ শুরু করে সেনাবাহিনী। ডিএনসিসির রামচন্দ্রপুর খালে গত ১৩ জুন পর্যন্ত সিএস ম্যাপ অনুযায়ী ১০১টি সীমানা খুঁটি স্থাপন করা হয়। এসব খুঁটির অধিকাংশই ডিএনসিসির সড়ক আর বিভিন্ন হাউজিং সোসাইটির মধ্যে পড়েছে।
রামচন্দ্রপুর খালের বাকি স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে ডিএনসিসির অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাববীর আহমেদ বলেন, ‘আমাদের লোকবলের অভাব আছে। ফলে একসঙ্গে সব করা যাচ্ছে না। তবে আমাদের অভিযান চলতে থাকবে। যারা খাল দখল করে ভবন বা স্থাপনা করেছে, সবাইকে উচ্ছেদ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে, খাল উদ্ধার করতে হবে। আমরা সে কাজ করে যাচ্ছি। এতদিন এসব খালের দায়িত্ব ছিল ওয়াসার। তাই আমরা কিছু করতে পারিনি। এখন খালের দায়িত্ব আমরা পেয়েছি। আমরা তাই উদ্ধারের কাজ করছি।’
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খাইরুল আলম সমকালকে বলেন, খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে। এ সীমানা ধরে অবৈধ স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হবে। খাল দখল করে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়, হাউজিং সোসাইটি, করপোরেশনের সড়কের বিষয়ে আইনি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুরের ধারা ভবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খালের কোনো জায়গা যদি কোনো সংস্থা বন্দোবস্ত দিয়ে থাকে, এসব ভবন উচ্ছেদেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন