চট্টগ্রামের কালুরঘাটে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণে ৮১ কোটি ৪৯ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। ডলার প্রতি ১১৭ টাকা ৫১ পয়সা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার বিকালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (ইআরডি)।
বহুল প্রত্যাশিত দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতুর এই প্রকল্পে চার লেনে রেল ও সড়ক সেতু নির্মিত হবে, যার একপাশে দুই লেনে চলবে সাধারণ পরিবহন এবং অন্যপাশে দুই লেনে চলবে ট্রেন। প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় হবে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ইআরডির ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং কোরিয়া এক্সিম ব্যাংকের পক্ষে নির্বাহী পরিচালক হোয়াং কিওন ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন।
সূত্র জানা, কোরিয়ান ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-আপারেশন ফান্ডের (ইডিসিপি) সঙ্গে এই চুক্তির মধ্য দিয়ে বহুল প্রত্যাশিত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি চূড়ান্ত হলো। বর্তমানে পুরনো রেলওয়ে সেতুর ৭০ মিটার উজানে নতুন সেতু নির্মাণ হবে।
২০১০ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সেবার জন্য ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং মিয়ানমার সীমান্ত ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি জরাজীর্ণ কালুরঘাট রেল সেতুর পরিবর্তে একটি রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণে উদ্যোগ নেয় রেল মন্ত্রণালয়।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১২ সালে তাইওয়ানের রেলসেতু অবকাঠামো নির্মাণ প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়াইকন কোম্পানি লিমিটেড, দেশীয় প্রতিষ্ঠান স্মেক, এইস কনসালট্যান্ট লিমিটেড এবং ইঞ্জিনিয়ার কনসোর্টিয়াম যৌথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
প্রাথমিক সমীক্ষায় রেলের জন্য সিঙ্গেল লাইন ও সড়কের জন্য দুই লেনের একটি রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের পরামর্শ আসে। সমীক্ষায় কর্ণফুলী নদীর পানি স্তর থেকে সেতুর ব্যবধান (নেভিগেশন) মাত্র ৭ দশমিক ৬২ মিটার ধরে ২০১৪ সালে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইডিসিএফকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার প্রস্তাব পাঠায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
সমীক্ষা প্রতিবেদন মোতাবেক জানা গেছে, বর্তমানে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপরে যে পুরনো সেতু রয়েছে তার ঠিক ৭০ মিটার উজানে এই নতুন প্রস্তাবিত নতুন সেতু নির্মিত হবে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৭০০ মিটার।
তবে সংযোগসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৬ কিলোমিটার। আর এতে নেভিগেশন হাইট বা উচ্চতা হবে ১২.২ মিটার আর এ জন্য দুই প্রান্তে সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে ২.৫০ মিটার করে।
সমীক্ষা অনুযায়ী নতুন সেতু প্রস্থ হবে ৭০ ফুট। এর মধ্যে ৫০ ফুটে হবে ডবল গেজ ও মিটার গেজ (এমজি ও বিজি) ডবল ট্র্যাক রেল লাইন। এছাড়া ২০ ফুটের মধ্যে দুই লেনের সড়ক পথ তৈরি করা হবে।
যেভাবে প্রকল্প এবং ব্যয় পরিবর্তন
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পে দুই লেনের সড়ক এবং এক লেনের রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ওই সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট প্রকল্পটির চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের নকশা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রেল ও সড়ক পথে চলাচলের আলাদা নকশা এবং সড়কের জন্য দুই লেনের পাশাপাশি ডাবল রেললাইন স্থাপনের নির্দেশ দিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে ফেরত দেন তিনি।
এরপর ইডিসিএফ নতুন নকশার জন্য ২০২১ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব দেয় দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘দহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কো-অপারেশন জেভিকে।
দ্বিতীয় ওই নকশায় কালুরঘাট রেল-কাম সড়ক সেতুটি পদ্মাসেতুর আদলে দ্বিতল সেতু তৈরির নকশা করা হয়। ওই নকশা অনুযায়ী সেতুর নিচতলায় ডাবল লাইনে রেল এবং উপরের তলায় দুই লেনে গাড়ি চলার কথা ছিল। ওই নকশায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
এরপর ২০২২ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় নকশাটিও প্রধানমন্ত্রী ফেরত পাঠান। তিনি একতলা সেতুতেই ডাবল রেললাইন ও যানবাহন চলাচলের জন্য দুই লেন বিশিষ্ট সড়ক সেতুর নকশা করার নির্দেশ দেন। তারপর নতুন এই নকশা করা হয়েছে।
নতুন নকশা অনুযায়ী সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন।
এ বিষয়ে রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার জানিয়েছেন, এখন প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ‘নতুন নকশায় এই সেতুর নেভিগেশন (পানি থেকে সেতুর উচ্চতা) বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ মিটার। প্রথম প্রস্তাবে নেভিগেশন ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬২ মিটার। নতুন নকশায় নেভিগেশন ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ২ মিটার।’
এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘২০১৮ সালে বিআইডব্লিউটিএ নদীর ওপর সেতু তৈরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম নেভিগেশন বাধ্যতামূলক করে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী এবং কর্ণফুলী নদীতে ভবিষ্যতে কত বড় জাহাজ চলাচল করতে পারে সেই সম্ভাব্যতা নতুন নকশায় আমলে নেওয়া হয়েছে।’
প্রকল্পটির ব্যয় এতো বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘নতুন নকশায় ভায়াডাক্টসহ এই সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৬ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ ভায়াডাক্টের জন্য জমি অধিগ্রহণেই ব্যয় হবে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, প্রকল্পটির প্রথম নকশায় ২০১৫ সালের রেট শিডিউল ধরা হয়েছিল। ফলে ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় কম ধরা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বেড়ে যায়।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াও প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ বলেও জানান রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার।
কোরিয়া সরকার কোরিয়া এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অগ্রাধিকার উন্নয়ন প্রকল্পে নমনীয় ঋণ সহায়তা দিয়ে আসছে। এ ঋণচুক্তির আওতায়ও নমনীয় সুদে ঋণ দেওয়া হয়। যার বার্ষিক সুদের হার মাত্র ১ শতাংশ এবং ঋণ পরিশোধকাল মোট ২৫ বছর।
এর আগে গত সোমবার বাংলাদেশ সরকার এবং কোরিয়া এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে ইডিসিএফ প্রোগ্রাম ফর ‘সেকেন্ড স্ট্রেংদেনিং সোস্যাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম, সাবপ্রোগ্রাম-১’ কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ এবং কোরিয়া এক্সিম ব্যাংকের পক্ষে নির্বাহী পরিচালক হোয়াং কিওন ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
ওই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা টেকসই ও জোরদার এবং কাজের পরিধি বাড়াতে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার এই ঋণ দিবে দক্ষিণ কোরিয়া।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন