রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব দেশে আগে থেকেই রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সাপটি চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামে পরিচিত। বর্ষা-বন্যার সময় (মে-জুলাই) এমনিতেই বাড়ে সাপের উপদ্রব। সম্প্রতি বৃষ্টি ও বন্যা দেখা দেওয়ায় বিচরণ বেড়েছে সাপের। কোনো কোনো এলাকায় রাসেলস ভাইপারও মিলছে। কিন্তু এ সাপটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, মানুষ নির্বিচারে সাপ মেরে তা ফলাও করে প্রচার করছে। সাপ মারতে পারলে পুরস্কার ঘোষণার খবরও মিলছে।
গুজব ও অপপ্রচারে সাপের ওপর এমন আগ্রাসী মনোভাব বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপ নিরীহ প্রাণী। ভয়ের কোনো কারণ নেই। সাপে দংশন করলে অ্যান্টিভেনম প্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি। রাসেলস ভাইপার নিয়ে সচেতনতার চেয়ে আতঙ্ক বেশি ছড়ানো হচ্ছে। সাপ নিধন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। ফলে প্রাকৃতিকভাবে প্রাণীর ভারসাম্য রক্ষায় সাবধানতা ও সচেতনতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। আর সারাদেশে রাসেলস ভাইপার নিয়ে জরুরি নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
ভুল তথ্যই বেশি
বেসরকারি সংস্থা ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন বলছে, রাসেলস ভাইপার মোটেও দেশের সবচেয়ে বিষধর কিংবা প্রাণঘাতী সাপ নয়; বরং দেশে প্রতিবছর সাপের দংশনে যত লোক মারা যায়, তার অর্ধেকই পাতি কেউটের দংশনে। তবে সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রাসেলস ভাইপারের দংশনেও মৃত্যু হতে পারে।
প্রাণিবিদ আবু সাইদ বলেন, ২০০২ সাল পর্যন্ত রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিভাগের ১২টি জেলায় রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি ছিল। গত বছর পর্যন্ত এটি প্রায় ২৫ জেলায় বিস্তৃতি পেয়েছে। সম্প্রতি মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও চাঁদপুরে রাসেলস ভাইপারের দংশনের খবর মিলেছে। প্রতিবছর গড়ে সাড়ে সাত হাজার মানুষ এবং আড়াইহাজার গবাদি পশু সাপের দংশনে মারা যায়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় কোনো প্রচার-প্রচারণা কিংবা উদ্বেগ ছিল না। এখন রাসেলস ভাইপারে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ এবং আতঙ্ক বেশি করে ছড়ানো হচ্ছে। বুঝে না বুঝেই অনেক ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, রাসেলস ভাইপারের কোনো অ্যান্টিভেনম নেই। অথচ এটি ভুল তথ্য।
ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের পরিচালক ইফতিকার মাহমুদ বলেন, রাসেলস ভাইপার তেড়ে এসে কামড় দেয় না। সাপটি খুবই ধীরগতির এবং টানা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে না। এর কাছে গেলে বা ভুলবশত গায়ে পা পড়লে দংশন করতে পারে। বাংলাদেশে যেসব বিষধর সাপ রয়েছে, তার মধ্যে চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে কম সময় পাওয়া যায় কোবরা (গোখরা) এবং ক্রেইটের (কালাচ বা কেউটে) দংশনে। এসবের বিষের তীব্রতা রাসেলস ভাইপার থেকে অনেক বেশি।
তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপারের বিষের অ্যান্টিভেনম দেশে রয়েছে। দ্রুত হাসপাতালে গেলে বেশির ভাগ রোগীই বেঁচে যাবেন। রাসেলস ভাইপার ঢাকায় চলে এসেছে– প্রশ্নে ইফতিকার মাহমুদ বলেন, ঢাকার অদূরে থাকা নদীর আশপাশে রাসেলস ভাইপার থাকতে পারে। তবে জনবসতির ভেতর এ সাপ আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বাস্তুসংস্থানে সাপের গুরুত্ব অপরিসীম জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সাপ এমন জায়গায় যেতে পারে, যেখানে অন্য প্রাণী যেতে পারে না। পরিবেশের ভারসাম্যে সাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বিচারে সাপ হত্যা পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলত পারে। ফলে গুজব না ছড়িয়ে সতর্ক থাকা দরকার।
গবেষক আবু সাইদ বলেন, রাসেলস ভাইপারের দংশনেই রোগী মারা যায়– কথাটি সত্য নয়। ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টার আগে রোগী মারা যায় না। এ সাপের দংশনের পর দেশে ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা (ওঝা-কবিরাজে কাজ হবে না) করালে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে না।
উপজেলা পর্যায়ে নেই বিষ ক্ষয়ের ওষুধ
গতকাল শনিবার নোয়াখালীর সুবর্ণচর, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, কক্সবাজারের মহেশখালী ও উখিয়া, খুলনার দাকোপ, বরগুনার বেতাগী ও আমতলী, পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করা হয়। এসব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের কাছে সাপের বিষের প্রতিষেধক নেই। খুলনা, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য নিয়ে জানা যায়, তিন জেলার ২৩ উপজেলার কোনো হাসপাতালেই সাপের বিষ ক্ষয়ের ওষুধ নেই।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুবীর সরকার জানান, তাদের কাছে ১০ ভায়াল অ্যান্টিভেনম রয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে আরও ৫০ ভায়াল আসবে। ফলে সাপে দংশন করলে সহজেই তারা চিকিৎসা দিতে পারবেন।
মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকরা বলছেন, সব হাসপাতালে এ ওষুধ দিলেও কাজ হবে না। কারণ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক নেই। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ছাড়া ওষুধ প্রয়োগে ঝুঁকি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, সাপের বিষ ক্ষয়ের ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন ইনজেকশন প্রয়োগের পর আক্রান্ত ব্যক্তির অনেকের তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন কিনা– এমন আশঙ্কা থেকে অনেক চিকিৎসক সাপের বিষক্রিয়ার চিকিৎসা করতে চান না। গ্রামে সাপের দংশনের ঘটনা বেশি ঘটলেও, চিকিৎসার সুযোগ তুলনামূলক সীমিত। এ জন্য গ্রামে অসুস্থতা ও মৃত্যু বেশি। কুসংস্কার মেনে অনেকে ঝাড়ফুঁক ও কবিরাজের কাছে যান। সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবেও গ্রামে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। তাই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
অ্যান্টিভেনমের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ সমকালকে বলেন, দেশে সাপে দংশনের রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম আসে ভারত থেকে। এসব অ্যান্টিভেনমের কার্যকারিতা নিয়ে আমরা সন্দিহান। এরপরও ভারতের সাপের বিষের অ্যান্টিভেনম দিয়েই এখন রাসেলস ভাইপারে দংশনে রোগীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। ওই অঞ্চলের আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মাটি ভিন্ন হওয়ায় অ্যান্টিভেনমের কার্যকারিতা আমাদের অঞ্চলের জন্য ঠিকমতো হয় না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেওয়ায় আমাদের গবেষণাগারে সাপটিতে দংশনে রোগীর ক্ষেত্রে ভারতের অ্যান্টিভেনম কার্যকর কিনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যাবে।
সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। ২০২০ সালে বাজারে আনা ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অ্যান্টিভেনম ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। শুরুতে ৭০০ হলেও বর্তমানে এটির দাম ১ হাজার ৬০০ টাকা।
গতকাল শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সারাদেশের সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। এ সময় বিভিন্ন এলাকায় সাপের দংশন ও রাসেলস ভাইপার নিয়ে কথা বলেন তিনি। রাসেলস ভাইপারে দংশনের ওষুধ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি এনামুল হক]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন