ভারতের কলকাতায় খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের লাশের সন্ধান মেলেনি ১৩ দিনেও। লাশ সন্ধানে শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা খালে তল্লাশি চালায় ভারতীয় সিআইডি ও পোলেরহাট থানা পুলিশ। খালে জাল ফেলা হয়, নামানো হয় নৌকাও। ব্যবহার করা হয় ড্রোনও। ব্যাপক তল্লাশির পরও মরদেহের কোনো অংশ খুঁজে না পাওয়ায় দুপুর ২টার দিকে অভিযান বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা।
চিকিৎসা করাতে ভারতে গিয়ে একজন সংসদ সদস্যের এমন হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে৷ হত্যাকাণ্ডের ১৩ দিন পরও মরদেহ না পাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার মূলহোতা তারই বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আখতারুজ্জামান শাহিন। সংস্থাটি জানায়, শাহিনই পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে হত্যাকারীদের দিয়ে এমপি আনারকে হত্যা করান।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন অভিযুক্ত শাহিন। এ হত্যাকাণ্ডে তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে মোবাইল ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহিন।
কেউ বলছেন, বাল্যবন্ধু নয়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরেই এমপি আনারকে সোনা কারবারিরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ব্যবসায়িক ২০০ কোটি টাকা দ্বন্দ্ব। এই ঘটনায় জড়িতদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ হয়।
এমপি আনার নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবার স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি না করে সরাসরি ডিবি পুলিশের দারস্থ হওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
এই খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনজন ও ভারতে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশে গ্রেফতার তিনজন হলেন— আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, সেলেস্তি রহমান (সিনথিয়া রহমান) ও তানভীর ভূঁইয়া।
আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া আদালতে জানিয়েছেন, আখতারুজ্জামান শাহীনের সাথে ব্যবসা ছাড়াও কিছু বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। যার কারণে তিনি এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই বিষয়টি শিমুলকে জানালে তিনি তাকে সহায়তার জন্য ভারত যান। মূলত তাদের পরিকল্পনাতেই আনারকে হত্যা করা হয়। এছাড়া শিমুলের সাথে এমপি আনারের রাজনৈতিক পার্থক্য ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে।
এদিকে এমপি আনার হত্যার ঘটনা তদন্তে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল রোববার (২৬ মে) কলকাতায় গেছেন। টিমের অপর দুজন হলেন— ওয়ারী বিভাগের ডিসি আব্দুল আহাদ ও এডিসি শাহীদুর রহমান।
অন্যদিকে এ খুনের ঘটনায় দুই বাংলাদেশিসহ ভারতে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের নিয়ে কয়েকদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন দেশটির সিআইডির সদস্যরা। কিন্তু এমপি আনারের মরদেহের সন্ধান এখনও মেলেনি। যদিও ভারতে গ্রেফতার হওয়া কসাই জিহাদ ওরফে জাবেরের বরাত দিয়ে দেশটির সিআইডি দাবি করেছে, আনারের লাশ কাটার জন্যই তাকে ডাকা হয়েছিল। তিনি মূলত একজন কসাই। সেই সূত্রে তাকে ভাড়া করা হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশে থাকা জিহাদের পরিবার ও স্ত্রী গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, জিহাদ কখনো কসাই ছিলেন না। তিনি কখনো কসাইয়ের কাজও করেননি।
জিহাদ কলকাতার পুলিশকে জানিয়েছেন, লাশটি কাটার পর তিনি টুকরো টুকরো করেন। পরে সেগুলো লাগেজে ভরা হয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে ফেলে দেওয়া হয়। তবে কোন কোন এলাকায় লাশের টুকরো ফেলা হয়েছে তা জানাতে পারেনি ভারতীয় পুলিশ। এদিকে এই ঘটনায় গ্রেফতার চালকও ভারতীয় পুলিশকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ডিবির দাবি, গ্রেফতার শিমুল লাশের টুকরোর ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে। সে নিজেই প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা টুকরোগুলো ফেলে দিয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ বলেন, তিনি (এমপি আনার) যে হত্যার শিকার হয়েছে সেই প্রমাণ তো আমরা আপনাদেরকে দেব না। সেটা পরে আপনাদের আমরা জানাবো। তদন্তে স্বার্থে বলা যাচ্ছে না। প্রমাণ পেয়েছি বলেই তার নামে মার্ডার মামলা হয়েছে।
রহস্য উদ্ঘাটনে কতদিন লাগবে?
ভারতীয় সিআইডি ও পুলিশের তথ্য মতে, গত ১৩ মে হত্যা করা হয় এমপি আনারকে। পরে তার লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে টুকরো টুকরো করা হয়। ঘটনার ১৩ দিন পার হলেও লাশের সন্ধান এখন মিলেনি। আদৌ কি সেই লাশের টুকরোগুলো মিলবে?
আনারের একমাত্র মেয়ে ডরিন বলেন, আমার বাবার ব্যবহৃত শার্ট-প্যান্ট, জুতা, হাতের দুইটি আংটি, ব্রেসলেট, চশমা ও পকেটে থাকা চিরুনির কিছু একটা প্রমাণ স্বরূপ আমাদের দেখাতে হবে। তার ব্যবহৃত আরও অনেক জিনিস ছিল।
তিনি বলেন, কিছু না কিছু একটা তো পাওয়া যাবেই। তা না হলে আমার বাবার শরীরের এক টুকরো মাংস ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ হিসেবে আমাকে দিতে হবে। আমি বিশ্বাস করব কিভাবে যে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে।
এমপি আনারের মেয়ে বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন যে, শ্বাসরোধ করে তাকে মেরে ফেলা হয়। পরে ছুরি বা চাকু কিছু একটা দিয়ে তার শরীরের চামড়া ছাড়ানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কোনো কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি তারা।
উল্লেখ্য, আনোয়ারুল আজিম আনার ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ উপজেলা) আসনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
গত ১২ মে তিনি চিকিৎসার কথা বলে ভারতে যান। ১৪ মে থেকে পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিও বন্ধ ছিল। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও কলকাতায় উপদূতাবাসে যোগাযোগ করে খোঁজ নিতে বলা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন