ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে কলকাঠি নেড়েছেন মাস্টারমাইন্ড শাহিন। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া এই মাস্টারমাইন্ডের মাথার ওপর ‘নাটের গুরু’ হিসেবে আরও কেউ থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। কারণ এর আগেও দুবার আনারকে খুন করার চেষ্টা করা হয় গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে। এ ক্ষেত্রে রহস্য উদ্ঘাটনে নানা বিষয় খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। তারা বলছেন, আনার হত্যাকাণ্ডে বেশ কিছু রাঘববোয়ালের নাম উচ্চারিত হলেও শাহিনকে না পাওয়া পর্যন্ত সেই রহস্য উন্মোচন করা দুঃসাধ্য।
আনারকে আগেও দুবার হত্যার ষড়যন্ত্র হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। হত্যাকাণ্ডের স্থান পরিদর্শনে তার নেতৃত্বে ডিবির তিন কর্মকর্তা শিগগিরই পশ্চিমবঙ্গে যাচ্ছেন, জানান তিনি। ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় নিহতের মেয়ের দায়ের করা অপহরণ মামলার তদন্তসূত্রেই তাদের এ সফর।
ইতিপূর্বে ধারণা করা হচ্ছিল, এমপি আনারকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগেই মৃত্যু হয় আনারের। ডিবি সূত্র জানায়, এমপি আনারকে হত্যার আগে ব্ল্যাকমেইল করে বিপুল অংকের অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা ছিল খুনিদের। তবে অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগে আনারের জ্ঞান না ফেরায় পরিকল্পনা পাল্টে তার লাশ টুকরো টুকরো করে গুম করা হয়। এখনো লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করছে কলকাতার পুলিশ। আনারের লাশের অপেক্ষায় বাংলাদেশে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তার স্বজনরাও।
গতকাল শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, আগেও এমপি আনোয়ারুলকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একবার ব্যর্থ হয় হত্যাচেষ্টা। এরপর নির্বাচনের পরপর অর্থাৎ জানুয়ারির ১৭-১৮ তারিখে আনোয়ারুল কলকাতায় গেলে খুনিরা হত্যার উদ্দেশ্যে কলকাতায় যায়। কিন্তু আনোয়ারুল হোটেলে থাকার কারণে সেবার তারা ব্যর্থ হয়। তৃতীয় ধাপে গত ১৩ মে তারা সফল হয়। তবে হত্যার আগে এমপি আনোয়ারুলকে জিম্মি করতে চেয়েছিল খুনিচক্র। তার আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে হুন্ডির মাধ্যমে এবং কলকাতায় থাকা তার বন্ধুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু আনোয়ারুল ওই বাসায় যাওয়ার পর তার মুখে চেতনানাশক স্প্রে করায় জ্ঞান হারান। অজ্ঞান অবস্থায় আনোয়ারুলের আপত্তিকর ছবি তোলা হয়। তবে স্প্রে করায় জ্ঞান না ফেরায় ব্ল্যাকমেইলের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে লাশ গুমের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এরপর তারা আনারের মোবাইলের সিমগুলো বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয় তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার জন্য। হত্যাকারীদের একজন আনোয়ারুলের চারটি মোবাইল বেনাপোল এলাকায় নিয়ে আসে। এখানে এসে আনোয়ারুলের প্রতিপক্ষকে চারটি মোবাইল থেকে ফোন করা হয়। ফোন করে বলা হয় ‘শেষ’। এর টার্গেট ছিল এই ফোনের সূত্র ধরে যেন পুলিশ প্রতিপক্ষকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। হত্যাকারীদের সন্ধান যেন না পায়।
হারুন অর রশীদ বলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হত্যার ঘটনা তদন্তে ভারতীয় পুলিশের একটি দল ঢাকায় কাজ করছে। পাশাপাশি আমাদের হাতে গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দুটি গ্রুপ পেয়েছি। তাদের মধ্যে একটি গ্রুপ হত্যাকাণ্ডে মদদ দিয়েছে, আরেকটি গ্রুপ বাস্তবায়ন করেছে। এ কাণ্ডের মদদদাতা আক্তারুজ্জামান শাহিন ৩০ এপ্রিল কলকাতায় তিন সদস্যকে নিয়ে যান। সেই দলে এক মেয়েও ছিল। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের মূল হোতা ছিলেন শাহিন। তিনি ১০ মে পর্যন্ত কলকাতায় অবস্থান করেন। কিলিং মিশন বাস্তবায়নের মূল নেতা পূর্ববাংলা কমিউনিস্টের নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ। সেই আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াকে খুনের ছক বুঝিয়ে দিয়ে দেশে চলে আসেন শাহিন। তাদের কাছ থেকে আমরা বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। যেহেতু ভারতীয় পুলিশ আমাদের এখানে কাজ করছে, তাদের কাজ শেষ হলে আমরাও কলকাতায় যাব।
কী কারণে হত্যা করা হয়েছে জানতে চাইলে ডিবির কর্মকর্তা বলেন, এই হত্যার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এই হত্যা বাস্তবায়নে জড়িত সবাই পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কী কারণে হত্যা, সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত শেষে তা বলা যাবে।
সোনা চোরাচালান চক্রের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট কোনো কিছুই বলা যাবে না। তবে অনেকগুলো বিষয় আছে। তদন্ত শেষ করে আমরা আপনাদের জানাতে পারব।
আনোয়ারুল আজিমকে অপহরণ মামলার তদন্তে অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদসহ তিন কর্মকর্তার আজ রবিবার কলকাতায় যাওয়ার কথা রয়েছে। অপর দুই কর্মকর্তা হলেন- ডিবির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. আ. আহাদ ও অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহিদুর রহমান। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান কলকাতায় যাচ্ছেন না। তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া ডিবির টিম ভারতে যাওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, পাসপোর্ট না থাকায় মাহফুজুর রহমান ভারতে যেতে পারছেন না।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির বরাত দিয়ে গণমাধ্যম জানিয়েছে, আনোয়ারুল আজিমকে খুন করার পর তার শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এরপর তার লাশ কেটে ৮০ টুকরো করা হয়। এমপি আনার হত্যায় ভারতে গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদার ওরফে কসাই জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে ভারতের গণমাধ্যম। এ কাজের বিনিময়ে কসাই জিহাদ ৫ হাজার টাকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এমপি আনারের দেহ টুকরো করে নিউটাউনের এলাকার নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে গ্রেপ্তার কসাই জিহাদ। খণ্ডিত দেহ খুঁজতে তল্লাশি চালাচ্ছে সিআইডি। সিআইডির ধারণা, এমপি আনারের মরদেহের খণ্ডিত অংশ এর মধ্যেই হয়তো চলে গেছে বিভিন্ন জলজ প্রাণীর পেটে। লাশের টুকরোগুলো জলাশয়ে ফেলে দেওয়ায় সব অংশ উদ্ধার করা কঠিন বলে মনে করছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১২ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে কলকাতার বরাহনগরে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে উঠেন। ১৩ মে চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। গত বুধবার সকালে জানা যায়, নিউটাউনের অভিজাত এলাকা সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম।
কূটনীতিকদের লাগেজে সোনার চালান
এদিকে আনার খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে একে একে বেরিয়ে আসছে আরও সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত শুক্রবার তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, এমপি আনার খুনের মাস্টারমাইন্ড শাহিনের রাজধানীর বাসায় তারা নকল বিদেশি মদ তৈরির কারখানা পেয়েছেন। গতকাল তদন্তকারীরা জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে কূটনৈতিক লাগেজে করে বাংলাদেশে আনা হতো অবৈধ সোনার চালান। এসব চালান নিরাপদে খালাস ও যথাস্থানে হস্তান্তর করা হতো শাহিনের তত্ত্বাবধানে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন