শা‘বান ও শবে বরাতের গুরত্ব ও তাৎপর্য
লিখেছেন লিখেছেন রাজপথের সাক্ষী ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:১৬:৪৭ দুপুর
মাহে শা‘বান ও শবে বরাত বৎসরের বিশেষ ও গুরুত্ব পূর্ন মাস ও দিন। একাধীক ছহীহ হাদীসে এমাসের বিশেষ গুরুত্ব ও ফযিলতের কথা বলা হয়েছে। মহা নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে অনেক বেশী রোজা রাখতেন । যা অন্য মাসে পরিলক্ষিত হত না। এমাসেই রয়েছে একটি গুরুত্ব পূর্ন রজনী যা গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য অন্যতম তাৎপর্য পূর্ন । যাকে আমরা “শবে বারাত ”নামে চিনি।
শবে বারাতের নামকরণ ঃ হাদীস শরীফে এ রাতের কোন নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য ليلة النصف من شعبان شبঅর্থাৎঃ শা‘বানের পঞ্চদশ রাত বলেই এর বিভিন্ন তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে।মূলত شب براء.(শাবে বারাত ) শব্দটি ফরাসূ ভাষা উদ্ভুত । شب এবং براءت সংমিশ্রণে গঠিত شب অর্থ রজনী বা রাত্রি আর براءت অর্থ পবিত্রত, নাাজাত , মুক্তি পরিত্রতণ ইত্যাদি। এ রাতে যেতু অগুণত মানবের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং জাহান্নামীদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় , এজন্যই রাত্রটি ‘শবে বারাত’ বা ‘মুক্তির রজনী’ নামে পরিভাষায় পরিচিত।
শা‘বান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ বৎসরের বরকতময় মাস গুলোর মধ্যে শা‘বান মাস উল্লেখযোগ্য। মহানবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমাসেই সর্বাধিক রোযা রাখতেন। হাদীস শরীফ এ আছে যে, তিনি শা‘বান মাসের মতো অন্য কোন মাসে এতো অধিক (নফল) রোযা রাখতেন না। যেমন-
عن عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ: (كَانَ عليه السلام، يَصُومُ حَتَّى نَقُولَ لا يُفْطِرُ، وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُولَ لا يَصُومُ، فَمَا رَأَيْتُ النبى اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِى شَعْبَانَ) .
হযরত আয়শা (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রমযান ছাড়া অন্য কোন সময়ে মাস ব্যাপি রোযা রাখতে দেখিনি। তেমনি শা‘বান মাসের মতো অন্য কোন মাসে এতো অধিক (নফল) রোযা রাখতে দেখিনি। (বুখারীঃ১৯৬৯, মুসলিমঃ১১৫৭,আবূদাউদঃ২৪৩০, নাসায়ীঃ২৩৫১-২৩৫৪)
শা‘বান মাস হলো এমন যে, এমাসে মানুষের আ‘মাল আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হয়। যেমন হাদীস শরীফ এ আছে,
عن أسامة بن زيد - رضي الله عنهما - قال: قلت يا رسول الله لم أرك تصوم شهراً من الشهور ما تصوم من شعبان. قال: ((ذلك شهر يغفل الناس عنه بين رجب ورمضان، وهو شهر ترفع فيه الأعمال إلى رب العالمين، فأحب أن يرفع عملي وأنا صائم))
হযরত উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) বলেনঃ একদা আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমিতো আপনাকে শা‘বান মাসের মতো অন্য কোন মাসে এতো অধিক রোযা রাখতে দিখিনি? উত্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন এ মাসটি (শা‘বান ) ‘রমযান’ ও ‘রজব’ এর মধ্যবর্তী মাস। মানুষ এ মাসের ফযীলত সম্পর্কে উদাসীন থাকে। অথচ এ মাসটি এমন যে, এ মাসেই মানুষের আ‘মাল আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হয় । আর একারণে আমি চাইযে, আমার আ‘মাল(আল্লাহর দরবারে) এমন অবস্থায় পেশ করা হোক যে অবস্থায় আমি রোযাদার।(নাসায়ীঃ ২৩৫৭, শায়াবুল ঈমানঃখন্ডঃ৩ পৃঃ ৩৭৭,৩৭৮ হাদীস নং ৩৮২০)
এছাড়া বুখারী ও মুসলিম সহ হাদীসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমুহে মাহে ‘শা‘বান’ এর গুরত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যে গুলো শা‘বান মাসের গুরত্ব ও তাৎপর্য কেই ফুটিয়ে তোলে। তাছাড়া শবে ব্রাতও এ মাসেই অবস্থিত, যা অত্যন্ত বরকতময় ও অধিক তাৎপর্যপুর্ণ।
শবে বরাতের গুরত্ব ও তাৎর্পযঃ
শবে বারাতের ফযীলত ও তাৎপর্য অপরিসীম। মহান আল্লাহ এ রাতে তাঁর বান্দাহদের দিকে মনোনিবেশ করেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে,
عن معاذ بن جبل رضى الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال:"يطلع الله إلى خلقه ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا مشركًا ومشاحناً".
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রা. বর্ণনা করেন যে, মহানবী হযতরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ মহান আল্লাহ শা‘বারে পঞ্চদশ রাতে তাঁর বান্দাহদের দিকে মনোনিশে করেন এবং মুশরিক ও পরস্পর বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যাতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। ( সহীহ ইবনে হিব্বান, শোয়াবুল ঈমান-খন্ডঃ ৩ পৃঃ ২৮২, হাদীস নং ৩৮৩৩)
এছাড়াও আল্লাহ এ রাতে স্বীয় বান্দাহদের ক্ষমা করে দেন ও মুমিন বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَن أبي ثَعْلَبَة الْخُشَنِي عَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ: إِذا كَانَ لَيْلَة النّصْف من شعْبَان اطلع الله تَعَالَى إِلَى خلقه فَيغْفر للْمُؤْمِنين و يترك أهل الضغائن و أهل الحقد بحقدهم ُ
হযরত আবূ সা‘লাবাহ ( রাঃ ) বলেনঃ হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ১৫ ই শা‘বানের রাতে আল্লাহ স্বীয় বান্দাহদের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং মু‘মিন বান্দাহদের ক্ষমা করে ওদন। অপর দিকে পরস্পর হিংসা বিদ্বেশ পোষণকারীদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন। অর্থাৎঃ যতক্ষণ না তারা তা থেকে বিরত হয়ে তওবা করতঃ ক্ষমা প্রার্থনা করে। (শায়াবুল ঈমান- খন্ডঃ ৩পৃঃ ৩৮১-৩৮২ হাদীস নং ৩৮৩২)
শবে বরাতের আ‘মাল
এই রাতে আমাদের কি কি করনিয় এ সম্পর্কে হাদীস ও ফিক্হ দ¦ারা আমরা যা জানতে পারি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রাত্রে নফল ইবাদত করা, পরের দিন(১৫ই শা‘বান) রোজা রাখা, আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফ চাওয়া, যারা দুনীয়া থেকে চলে গেছেন(মুমিন নর-নারী , শহীদ ) তাদের জন্য দোয়া করা। জেয়ারতের জন্য কবর স্থানে যাওয়া ও গোছল করা। ফোকাহায়ে কেরাম এই রাত্রে গোছল করা মুস্তাহাব বলেছেন। হাদীস শরীফে এসেছে,
عَن عَائِشَة رَضِي الله عَنْهَا قَالَت: فقدت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم ذَات لَيْلَة فَخرجت أطلبه فَإِذا هُوَ بِالبَقِيعِ رَافعا رَأسه إِلَى السَّمَاء فَقَالَ يَا عَائِشَة: أَكنت تَخَافِينَ أَن يَحِيف الله عَلَيْك وَرَسُوله قلت: مَا بِي من ذَلِك وَلَكِنِّي ظَنَنْت أَنَّك أتيت بعض نِسَائِك فَقَالَ: إِن الله عز وَجل ينزل لَيْلَة النّصْف من شعْبَان إِلَى السَّمَاء الدُّنْيَا فَيغْفر لأكْثر من عدد شعر غنم كلب
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন এক রাতে আমি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (শয্যার পার্শে ) না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। (খুঁজতে খুঁজতে ) তাঁকে “জান্নাতুল বাকী” তে পেলাম। (আমাকে দেখে) তিনি বললেনঃ হে আয়শা তুমি কি এই আশংকা করছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার সাথে খেয়ানত করেছেন?(হযরত আয়শা বলেন) আমি বললাম ঃ হে আল্লাহর রাসূল আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ছেড়ে অন্য কোন বিবির ঘরে গমন করেছেন। অতপর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ১৫ই শা‘বানের রাতে আল্লাহ পাক প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং “বনুকালব” গোত্রের পালিত ছাগল পালের শরীরের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক বান্দাহদের তিনি ক্ষমা করে দেন। ( তিরমিযীঃ৭৩৯)
উক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রাতে কবরস্থানে গিয়েছিলেন। এছাড়া অন্য এক হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا، فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا، فَيَقُولُ: أَلَا مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ أَلَا مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلَا مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلَا كَذَا أَلَا كَذَا، حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ "
হযরত আলী রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন ঃ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ যখন শা‘বানের ১৫তম রাত তোমাদের সম্মুখে এসে যায় তখন তোমরা তাতে নামায পড়ো এবং পরবর্তী দিনটিতে রোযা রাখো। কারণ সেদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ পাক প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং (বান্দাহদের ডেকে ডেকে ) বলতে থাকেনঃ আছো কি কোন ক্ষমা প্রার্থী যাকে আমি ক্ষমা করে দিই? আছো কি কোন রিযিক অন্বেষু যাকে আমি রিযিকের ব্যাবস্থ করে দিই? আছো কি কোন বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি যাকে আমি বিপদ মুক্ত করে দিই? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতেই থাকেনঃ আছো কেউ অমুক বস্তুর প্রার্থী? আছো কি অমুক বস্তুর প্রার্থী? আমি যার সকল মনোস্কামনা পূর্ণ করে দিই? (ইব্নে মাযাহঃ ১৩৮৪)
আলোচ্য হাদীস গুলো ও ফোকাহায়ে কেরামের মাছআ‘লার ভিত্তিতে পূর্বে উল্লেখিত আ‘মাল গুলোই কেবল মাত্র সুন্নাত আমল হবে। এছাড়া বাকী সব মনগড়া, সুন্নাত বর্জিত আ‘মাল গুলো বিদআ‘ত ও নিষিদ্ধ কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।
শবে বরাতে যা বিদ‘আত ও নিষিদ্ধঃ কোন মোবারক তথা রবকতময় স্থন, সময় বিংবা ইবাদত এমন নেই যাতে শয়তান এই প্রচেষ্টা না চালায় যে, কোন না কোনভাবে আদম সন্তানদের বঞ্চিত করা যায় কি না। আর এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত কররা লক্ষেই সে এসকল কাজে কিছু বিদ‘আত ও মনগড়া বিষয়ের উদ্ভব করে দেয়। “শবে বরাত”ও সেসব বিদ‘আত এবং নব নব আবিস্কৃত বিষয়াদী থেকে মুক্ত থাকেনি।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুপম আদর্শ ত্যগ করে আশ্চর্য ধরনের কতগুলো অনর্থক কার্যাবলী বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন-আতশবাজী, হালুয়া প্রথা, শিরনি বা তাবাররুক, আলোক সজ্জা প্রথা, মাইকে কুরআন তিলাওয়াত, মসজিদে জমায়েত হয়ে হৈ চৈ করা গোরস্তানে মেলা বসানো ইত্যাদি। শয়তান তো এসব বর্জনীয় কাজগুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে তোলে যে, কিছু লোক তো গোড়ামীর কারণে আর কিছু লোক নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতার কারণে ঐসব শয়তানী ধোকার বেরাজালে অতি দ্রুত আটকে যায়। এমন কি সেগুলোকে আবার ফরয ও ওয়াজিবের মতো গুরুত্বও দেওয়া হয় এবং অত্যাবশ্যকীয় ভাবে তা বাস্তবায়িত করা হয়। ফলে সওয়াব আর পুণ্যের বদলে ইহকালীন ও পরকালীন ক্ষতি ও অকল্যাণের বোঝা ক্রয় করে নেয়।
আল্লাহ তাআ‘লা আমাদের সবাইকে সকল নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় বিষয় থেকে বেচে থাকার এবং এ রাতের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করতঃ একাগ্রতার সাথে তাঁর ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। -আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৯৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন