দেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশঃ অতীত বর্তমান
লিখেছেন লিখেছেন নয়া জামানার ডাক ২৪ জুন, ২০১৬, ০৫:০৭:০৬ সকাল
রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের মূল এবং প্রাচীন নাম রোহাংগ শব্দ থেকে। রোহিঙ্গারা মুসলমান।এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত।বর্তমানে এটা রাখাইন স্ট্যাট নামে পরিচিত। আদিবাসী জনগোষ্টী পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম প্রধান নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্টী। এদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা ও পাত্তরকিল্লা এলাকায় তাদের বাস। অন্যান্য জনগোষ্টী যেমন-চিন, কোচিন, কিউন, কাউয়াহ, মান এবং রাখাইনদের সাথে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করছে। বর্তমানে ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা আরাকানে বসবাস করে।এছাড়া বাংলাদেশ ও সৌদি আরবে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আছে বলে ধারণা কর যায়। রোহিঙ্গাদের জাতিসত্ত্বার ইতিহাস সুদীর্ঘ। ১৬৬০ সাল থেকে তারা ভুমি উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। টেকনাফ, কক্সবাজারের সর্ব প্রথম গণহারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে ১৬৬০ সালে। আরাকান রাজা চন্দ্র সুধর্মার হাতে সম্রাট শাহজাদা সুজার পরিবার নিহত হওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গারা বার্মা থেকে পালিয়ে আসতে শুরু করে। দ্বিতীয়বার আসে ১৬৬১ সালে তৎকালীন রাজা চন্দ্র উইজাইয়ার কামানচি যিনি শাহ সুজার অনুসচরদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালান, তার সময়ে রোহিঙ্গাদের একটা বিরাট অংশ বার্মা ত্যাগ করে। তখনকার সময় বর্মী সামরিক জান্তার অত্যাচার ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরাকানীদের প্রায় দু’তৃতীয়াংশ লোক পাশ্বর্তী অঞ্চল চট্রগ্রামে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। হত্যাযজ্ঞের শিকার এতদাঞ্চলের মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার যেন জন্মসুত্রে গাঁথা। এর পর ১৭৮৫ সাল হতে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত আরাকানীরা ব্যাপক হত্যার শিকার হয়। এ হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে আরাকানের ব্যাপক জনগোষ্টি তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে বৃটিশ শাসিত চট্রগ্রাম অঞ্চলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ ঘটনার পর বৃটিশ কোম্পানীর রাষ্ট্রদূত মিঃ সাইমম বার্মা থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্স । ১৭৯৬ সালের ৬ই অক্টোবর মিঃ কক্স দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই আরাকান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব অর্পিত হয়। জনগণের চাহিদার পরিপেক্ষিতে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সহজেই পাওয়ার জন্য মিঃ কক্স এই জনপদে একটি বাজার প্রতিষ্টা করেন। পরবর্তীতে এটি ‘কক্স সাহাবের বাজার’ নামে পরিচিত লাভ করে। কয়েক বছর পর ক্যাপ্টেন কক্স জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর কক্স সাহেবের বাজার থেকেই বর্তমানে ‘কক্সবাজার’ নামে উৎপত্তি হয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ কখনো স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়নি। ১৯৭৮ সালে আবার ঢালও ভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এ সময়ে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এবং শিশু সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশ। পরবর্তীতে তাদের মায়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে মায়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ৩১শে আগস্ট ১৯৭৮ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরু হয় এবং ১৯৭৯ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এ সময়ে ১ লক্ষ্য ৮৭ হাজার ২৫০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী চুড়ান্তভাবে আরাকান প্রদেশে ফিরে যায়। অবশিষ্ট শরণার্থীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক বিভিন্ন কারণে আশ্রয় শিবিরে রোগ ভোগে মারা যায় এবং বাকি কিছু সংখ্যক কক্সবাজার ও চট্রগ্রামের পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে ছটিয়ে পড়ে। আবার অনেকে অন্য দেশে পাড়ি জমায়। ১৯৯২ সালের শুরু থেকে পুনরায় সীমান্ত অতিক্রম করে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। মাত্র ৩/৪ মাসের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার শরনার্থী কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া এবং রামু উপজেলার ২০ টি ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ সময় বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোন বাঁধা প্রদান করেনি বরং তাদের আশ্রয় , ত্রাণ ও জরুরী চিকিৎসা সাহায্য প্রদান করন। পাশা-পাশি আন্তর্জাতিক সাহায্য জানিয়ে UNHCR এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষন করে। একই সাথে বাংলাদেশ সরকার দ্বিপাক্ষিক ভাবে সমস্যাটি সমাধানের জন্য বার্মার সাথে আলোচনা চালিয়ে যায়। ২৯শে এপ্রিল ১৯৯২ সাল, বাংলাদেশ ও বার্মা একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মায়ানমার সরকার নাগরিকত্ব প্রমাণ সাপেক্ষে সকল শণার্থীদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। এ ছাড়া মায়ানমার সরকার বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বস্থ করে যে , বাংলাদেশ সরকার শরণার্থীদের যে তালিকা সরবরাহ করবে মায়ানমার কর্তৃপক্ষ তা বিবেচনা করবে।
৮ই অক্টোবর,১৯৯২ সাল বাংলাদেশ সরকার এবং এবং UNHCR এর মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। কয়েকদফা আলোচনার পর ১৯৯৩ সালের ১২ই মে UNHCR এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে পুণরায় একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে UNHCRকে প্রত্যাবর্তন প্রকৃতি জানানোর জন্য ক্যাম্পে প্রবেশ করে শরণার্থীদের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়। যাতে UNHCR প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া কি রকম হওয়া প্রয়োজন, সে সম্পর্কে শরণার্থীদের মতামত নিতে পারে। এ ছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টি UNHCR এবং বাংলাদেশ সরকার কে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ এবং UNHCR এর মধ্যে সমঝোতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল যে, UNHCR নিরাপত্তার সাথে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের দায়িত্ব নিবে এবং প্রত্যাবর্তনে তাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরে UNHCR ও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা -কর্মচারীগণ একযোগে ইনফরমেশন সেশন শুরু করে এবং নতুন অগ্রগতি মূলক পরিস্থিতি সম্পর্কে শরণার্থীদের অবহিত করবে। কিন্ত পর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে শরণার্থীদের সন্তুষ্ট করা যায়নি। কেননা তারা তাদের নাগরিকত্ব এবং আরাকান রাজ্যের মধ্যে চলাচলের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। এর ফলে রোহিঙ্গারা তাদের নীতি পরিবর্তন করে । ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে আবার গণহারে প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮১৫ জনের মধ্যে ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৫ জন প্রত্যাবর্তন করে। বাকী ২১ হাজার ৩২৯ জন নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য নয়া পাড়া এবং কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করে।
পরবর্তীতে UNHCR এর সহযোগীতায় ২০০০ সালের মে মাসে প্রত্যাবর্তন পক্রিয়া আবার শুরু হয়। এ মাসে প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ৩০ টি পরিবার কে মায়ানমার ফেরত পাঠানো হয়। এ পক্রিয়া ২০০৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে । সর্বশেষ ২৮শে জুলাই, ২০০৫ সালে মাত্র দুইজন শরণার্থী প্রত্যাবর্তন করা হয়েছিল। সীমান্তের কাঁটা তাঁরের বেড়াতে ঝুলিয়ে আছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন। বনে-জঙ্গলে, ডাঙ্গায় ও পাহাড়ে মানবেতর জীবন যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না। প্রতিকূলপরিবেশে সীমান্ত পারা পারের সময়নৌকাডুবিতে হতাহতেরঘটনাঅহরহ। নাফ নদীতেই সলিল সমাধি হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা বনি আদমের। দীর্ঘ সময় ধরে এদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরার বিষয়টি ঝুলে আছে নানাকারণে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৩১শে আগস্ট পরারাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ে মায়ানমার-মাংলাদেশ সচিব পর্যায়ে বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয় দু’মাসের মধ্যে ২হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মায়ানমার সরকার ফিরিয়ে নেবে। কিন্ত সময় পেরিয়ে গেলেও চুক্তি যেন কাগজে-কলমে, থমকে আছে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া। UNHCR কক্সবাজার অফিস সূত্র মতে, বর্তমানে উখিয়ার কুতুপালং এবং টেকনাফের নয়া পাড়ায় অবস্থিত দু’টি ক্যাম্পে প্রায় ৩২ হাজার নিবন্ধিত শরণার্থী রয়েছে। এছাড়াও ৫ লক্ষাধিক অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে বলে ধারণা করা হলেও এর সঠিক পরিসংখ্যান সর্বশেষ নিবন্ধন প্রক্রিয়া আগামী ডিসেম্বর মাসে জানা যাবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন কার্যক্রম শুরু থেকে চলতে থাকলেও হতাশার কথা হল এই যে, কখনো কখনো দেখা যায়, যেসব পরিবারকে বার্মায় ফেরত পাঠানো হয়, তাদের প্রত্যাবর্তনে সাহায্য প্রাপ্ত অর্থ ও খাদ্য দ্রব্য শেষ হয়ে গেলে পুনরায় ফিরে আসে বাংলাদেশে। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ফিরে এসে শরণার্থী ক্যাম্পে স্থান এবং অর্থনৈতিক কোন সুযোগ সুবিধা না পেয়ে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার কিংবা এর আশে পাশের বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় মানুষের বাসায় ভাড়া থাকে এবং বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজের মাধ্যমে পয়সা উপার্জনের প্রচেষ্টা নেয়।স্থানীয়ভাবেবিয়ে-সাদীকরে এখন তাদের অনেকেই এদেশের নাগিরিক পরিচয় দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। কেউবা ব্যবসায়-বাণিজ্যের মাধ্যমে স্থানীয় প্রভাবশালী সেজে সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্টানাদিতে সরব থকতে দেখা যায়। জাতিসংঘেরতথ্যমতে, রোহিঙ্গারাবর্তমানবিশ্বেরসবচেয়েনির্যাতিতজনগোষ্টী। রোহিঙ্গাদের বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত এবং অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু। ১৯৮২ সালের নাগরিক আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। সরকারী অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গিকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়। সর্বোপরি এখন তাদের কে সে দেশের সরকার মায়ানমারের নাগরিক মেনে নিতে অস্বীকার করে আসছে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৬৯ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন