স্বপ্নিল প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনঃ স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি
লিখেছেন লিখেছেন নয়া জামানার ডাক ১৮ জুন, ২০১৬, ০৪:৩৯:৪৩ রাত
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের মন কেড়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের সর্ব দক্ষিণ সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের মূল ভূখন্ড থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ৯ মাইল দূরে চারদিক পানি বেষ্টিত সেন্টমার্টিন তথা ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ যেন এক স্বপ্নিল দ্বীপ। রূপ কথার মত এর সৌন্দর্য্য। এ দ্বীপের অপরূ পদৃশ্য ও সৌন্দর্য্য শোভা সহজেই হৃদয় মন কেড়ে নেয় সকলের ।
নামকরণঃ- স্থানীয় ভাবে দ্বীপটি জিঞ্জিরা বা নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত। এ দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতানৈক্য রয়েছে। নারিকেল জিঞ্জিরা নামটি সেন্টমার্টিনের আদিনাম। আর এই নারিকেল জিঞ্জিরা নামটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে। আরবি ভাষায় নারজিল শব্দের অর্থ নারিকেল আর জাজিরা শব্দের অর্থ দ্বীপ । আরবি শব্দ ‘জাজিরা’ স্থানীয় লোকদের মুখে ভাষান্তরিত হয়ে জিঞ্জিরা নামে পরিচিত লাভ করেছে। অনেকে বলেন, এই দ্বীপে প্রচুর নারিকেল গাছ রয়েছে বলেই একে নারিকেল জিঞ্জিরা বলা হয়। আবার স্থানীয়দের মতে, জনবসতি গড়ে উঠার শুরুর দিকে এ দ্বীপের এক পাশে ছিল কেয়া বন। মাঝে মাঝে এ কেয়া বন থেকে পথচারীরা অদৃশ্যের আওয়াজ শুনতে পেতেন, রান্না করা তরকারীর সুগন্ধ নাকে ভেসে আসত তাই লোকদের ধারণা এখানে জিনেরা বিশ্রাম নেয়। সেখানে ছিল জিনের আনাগুনা। জিনের বিশ্রাম বা জিনদের জিরানো(স্থানীয় ভাষায় জ্বিরা অর্থ বিশ্রাম) থেকে জিঞ্জিরা নামে দ্বীপের নামকরণ হয় বলে স্থানীয়দের অভিমত।
সেন্টমার্টন নামকরণঃ আশির দশকের শেষের দিকে ইউরোপের দুই পর্যটক সেন্ট এবং মার্টিন এ দ্বীপে ভ্রমণে আসেন। তারা দ্বীপের পশ্চিম তীরের পাথরে তাদের দু’জনের নাম খচিত করেন। পরবর্তীতে তাদের নাম বিভিন্ন পর্যটকগণ দেখে সেন্টমার্টিন নামে অভিহিত করেন। এখন স্থানীয় ভাবে নারিকেল জিঞ্জিরা এবং বাহিরে ও প্রশাসনিক নাম সেন্টমার্টিন নামে পরিচিত।
দুরত্ব ও অবস্থানঃ- সেন্টমার্টিন দ্বীপ টেকনাফ শহর থেকে ৩৪কিঃমিঃ এবং মূল ভূখণ্ড শাহ পরীর দ্বীপ থেকে ৯ মাইল সোজা দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপ সাগরের বুক চিরে জেগে উঠা এক আকর্ষণীয় দ্বীপ। এ দ্বীপের আয়তন প্রায় ৪ বর্গ কিলোমিটার। সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ। প্রতি বছর জলোচ্ছ্বাস , ঘুর্ণি ঝড় ও মাত্রাতিরিক্ত জোয়ারে ভাঙ্গন সৃষ্টির ফলে কিছু অংশ ক্ষয় হলেও দ্বীপের অদূরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ছেরা দ্বিয়া নামে আরও একটি দ্বীপ জেগেছে।
যেভাবে গড়ে উঠে জনবসতিঃ- লোকে মুখে ও বিভিন্ন গ্রন্থে যেভাবে বিবৃত হয়েছে, তা থেকে জানা যায়, বহুকাল পূর্বে তথা ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে এ দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে মায়ানমারের ‘আরাকান অঞ্চল ছিল আন্তঃমহাদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে এক প্রসিদ্ধ অঞ্চল। তাই বিশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে এর বাণিজ্য যোগাযোগ ছিল। চট্রগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার কয়েক জন ব্যবসায়ী আরাকানে বাণিজ্যে এসে এতদাঞ্চলে বিয়ে করে স্থানীয় ভাবে বসবাস শুরু হয়। তাদেরই পুত্র সন্তানেরা মাছ শিকারের জন্য বঙ্গোপ সাগরে বের হলে সবুজ বেষ্টনীতে ঘেরা অপূর্ব সুন্দর দ্বীপটি দেখতে পায়। তারা একদিন এত সুন্দর দ্বীপটির দেখার জন্য কূলে উঠে এর অভূতপূর্ব সৌন্দর্য্য দেখে আবেগাপ্লোত হয়ে দ্বীপে স্থায়ী ভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে সেই মাছ শিকারী কয়েকজন তথা ইব্রাহীম, লাল মোহাম্মদ ও হাসান আলী সহ মোট ছয় ভাইয়ের তেরটি পরিবার স্থায়ভাবে বসবাস শুরু করে । সেই ১৮৭০ সালেই এ প্রবাল দ্বীপ নারিকেল জিঞ্জিরা কালের আবর্তে সেন্টমার্টিনে জন বসতি গড়ে উঠে। বর্তমানে এ দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৯ সহস্রাদিক। সাগরের উত্তাল ঢেউ, প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশের সাথে অভিরাম যুদ্ধ করে বেড়ে উঠে তাদের জীবণ। মৎস আহরণ, শুঁটকি ও ট্যুরিজম ব্যবসায় এ দ্বীপের মানুষের প্রধান উপার্জন।
যাতায়ত ব্যবস্থাঃ-টেকনাফ স্থল বন্দর (পোর্ট) থেকে সী ট্রাক, দমদমিয়া কেয়ারী জেটি থেকে সমুদ্রগামী বিলাস বহুল জাহাজ সিন্দাবাদ , এল সি কুতুবদিয়া, গ্রীন লাইন সহ অনেক বিলাস বহুল সী ট্রাক পর্যটন মৌসুমে প্রতিনিয়ত যাতায়ত করে থাকেন। প্রতিদিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থান হতে এ জাহাজ গুলো যাওয়া আসা করে থাকেন। এছাড়া টেকনাফবাস ষ্টেশনের পুর্ব পার্শ্বে কায়ূক খালী খাল থেকে সেন্টমার্টিন গামী কাঠের বোট তথা ইঞ্জিন চালিত নৌকার মাধ্যমে যাতায়ত করা হয়। স্থানীয় ভাবে ইঞ্জিন চালিত এ যাতায়ত বাহনকে সার্ভিস বোট বলা হয়। বছর পাঁচেক আগে এটির মাধ্যমে পর্যটক সহ স্থানীয় লোকজন যাতায়ত করলেও এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালামাল বোঝাইয়ের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এটি বর্ষা মৌসুমের একমাত্র জলযান।
উপরোক্ত সী বাহনের মাধ্যমে যখন নাফ নদী হয়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে তখন যাত্রীদের মন আনন্দে নেচে উঠে।পশ্চিমে সারিবদ্ধ টেকনাফের নে টং বা কালো পাহাড় পূর্বে মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের কাল-সবুজ অপূর্ব সুন্দর পর্বত শ্রেণী সামনে উত্তাল সাগরের তরঙ্গমালা, সী বার্ড বা গাং চিলের মাছ শিকারের অভিনব দৃশ্য দেখে হ্রদয়ে এক অজানা রোমাঞ্চ দোলা দেয় এবং ভরে উঠে মন। ভাটার টানে যাত্রীবাহী নৌযান গুলি যখন সাগর-নদীর বুক চিরে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাবে তখনকার ছবি গুলো স্মৃতি হয়ে থাকবে জীবনে। অবশেষে নাফ নদী ও সাগর মোহনার উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে সারি-সারি নারিকেল বাগান দেখতে দেখতে পৌছে যায় স্বপ্নের নারিকেল জিঞ্জিরা তথা সেন্টমার্টিনে।
স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টির প্রবাল দ্বীপঃ স্রষ্টার অপরূপ সব সৃষ্টিতে ভরপুর যেন এই দ্বীপ। চতুর্দিকে লোনা পানি বেষ্টিত দ্বীপের চরে মাটি ভেদ করলেই প্রমাণ মিলে স্রষ্টার কুদরতির অনন্য নিদর্শন মিঠা পানি। দ্বীপ জাগার পর থেকেই মহান আল্লাহর কুদরতির হাতে প্রবাল, শৈবাল, চুনা পাথর ও কাল পাথরের এক প্রাচুর্য সৃষ্টি করলেন এই দ্বীপে। সেই প্রবাল ও পাথরের অলৌকিক বাঁধ শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেশের আর সকল পর্যটন স্পট থেকে ভিন্ন এবং আকর্ষণীয়। এ দ্বীপে প্রকৃতি প্রেমি যে কোন মানুষ ভ্রমণে আসলেই মুগ্ধ হয়ে যায়। সে কারণে প্রতি বছর দেশী-বিদেশী ভ্রমণ পীপাষূ পর্যটকের পদাচারনায় মূখরিত হয়ে ওঠে দ্বীপের উভয় তীর, ভিড় জমে জেটি ঘাটে প্রতিনিয়ত।পরিবেশ ও বন মন্ত্রাণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ, ম্যারিন পার্ক প্রতিষ্টা ও ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প বিগত ২০০১-২০০২ পর্যটন মৌসুম থেকে এই দ্বীপে প্রতি বছর কি পরিমাণ পর্যটক আসে তার উপর জরিপ চালিয়ে আসছে। এই জরিপে রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা গেছে ২০০১-২০০২ সালে এই দ্বীপে পর্যটক এসেছিল ৬২,৫৪২ জন এবং ২০০৩ সালে এর সংখ্যা দাড়িয়েছিল ১,০৯,৭৮১ জন। সর্বশেষ ২০১৫-২০১৬ পর্যটন বর্ষে এর সংখ্যা- প্রায় তিন লক্ষ। এ তথ্য থেকে ধারণা করা যায় যে, ক্রমেই এ দ্বীপে ভ্রমণে আসা পর্যটকের সংখ্যা ক্রমাণুপাতিক হারে বাড়ছে।
বর্তমানে এ দ্বীপে সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। বিশেষ করে এই দ্বীপে নৌবাহিনী , কোস্টাল গার্ড, পুলিশ, আনসার বাহিনী, ভিডিপি বিভিন্ন এনজিও সংস্থা সহ অবকাশ কেন্দ্র, হোটেল-মোটেল, কটেজ, স্কুল-মাদ্রাসা, জেলা প্রশাসনের ডাক-বাংলা, রাত্রে সমুদ্রে ভ্রমণকারী নাবিক ও মাঝি-মাল্লাদের দিক নির্দেশনা কেন্দ্র লাইট হাউজ এবং দশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল । দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে দ্বীপের উন্নয়ন অবকাঠামো। শীত মৌসুমে এই দ্বীপ ভ্রমণ অধিকতর নিরাপদ।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরিচিতের ধ্রুতে একটা কেটেজে ছিলাম । পর্যটনের অবকাশ আর বেসরকারী সি ব্লু ছাড়া আর কোন হোটেল চোখে পড়ে নি । কোস্টগার্ডের আস্তানাটাই আমার মনে হয়েছে সবচেয়ে বেস্ট জায়গা । আর ১০ শয্যার যে হাসপাতালের কথা বলছেন সেটা আমার কাছে সেন্ট মার্টিনের সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি মনে হয়েছে । ডুপ্লেক্স বা ট্রিপলেক্স মনে হবে প্রথমে কেউ যদি সেটা দেখে ।
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় (আবার বোধগম্য কারণেই অনুমেয়) যে সেখানে কোন রোগী নেই , কোন ডাক্তার নেই , নার্সও নেই । শুধু একজন আরএমপি নাকি সেটার দায়িত্বে আছে ।
সর্বদক্ষিনের জায়গায় গিয়ে বেশ কিছু ছবিও তুলেছিলাম । এটাকে নাকি দারূচিনি দ্বীপ বলে ।
সেন্ট মার্টিনের ভেতরে ছোট রিকশা ভ্যান নিয়ে চলাচল করা যায়, সিমেন্টের সরু রাস্তা বানানো আছে । ১০০ টাকা দিয়ে সারা বিকেল ঘুরেছিলাম । ভ্যানওয়ালা কিন্তু রংপুরের লোক ছিল !
খাবার খেয়ে খুব একটা মজা পাইনি , মাছের প্রতি বেশী ফ্যাসিনেসন ছিল । মনে হয় রান্নায় খুব একটা এক্সপার্ট না । ফেরার দিন সকালে জেলেরা যে মাছ ধরে আনে সেটা দেখছিলাম । বড় বড় লবস্টার ছিল ।
কোস্টগার্ডের ইনচার্জ আমাদের জানিয়েছিলেন কিভাবে তারা মানব পাচার/চোরাচালান ঠেকাতে সেখানে কাজ করেন ।
দুবারই এখানে এসেছি কেয়ারী সিনবাদ দিয়ে । সকাল ৯.৩০ এ ছাড়ে পৌছে দুপুর সাড়ে ১২ টায় । সেটাই আবার ছাড়ে বিকেল ৩/৩.৩০ টায় । আপ ডাউনের টিকিট কেটে রাখে ৩৫০/৩৭০ টাকা/পারসন (মনে হয় ) । আপনি আজকে গেলে ২ দিন পরও আসলে টাকা একই ।
যাবার সময় টেকনাফের ঢেউ খেলানো পাহাড় গুলো দেখে খুব ভাল লেগেছিল । নাফ নদীর পাড়ে সবুজ-সাদা রংয়ের সার্কিট হাউজ খুব সুন্দর দেখায় শিপ থেকে ।
লাস্ট বার ফেরার পথে সাগর থেকে নাফ নদীতে ঢোকার সময় কালবৈশাখী শুরু হয়েছিল । চেয়েছিলাম যে ডেকে থেকে বৃষ্টিতে ভিজি। কিন্তু ঝড়ো বাতাস শুরু হওয়াতে ডেক থেকে নিচে ভেতরে চলে যাই । বৃষ্টির পর মাশা আল্লাহ চারপাশ খুব সুন্দর ও ঝকঝকে হয়ে এসেছিল ।
সবাই যায় শীতের সিজনে । আমার পছন্দ অফসিজন । কারণ কোলাহল আমার খুব একটা পছন্দ না । কিন্তু ২০১৩ তে গিয়ে একটু হতভম্ভই হয়ে গিয়েছিলাম । কারণ ম্যাক্সিমাম লোকই দিনে এসে দিনেই ফিরে গিয়েছিল । মনে হয়েছিল যে সারাটা দ্বীপে পর্যটক হিসেবে কেবল আমরা দুজনই ! দ্বীপের প্রবেশদ্বারে নৌবাহিনীর একটা বা দুইটা যুদ্ধ জাহাজ সবসময়ে স্ট্যান্ডবাই থাকে ।
শীতে যাবার মূল কারণ হল , এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই । জেনারেটর দিয়ে কাজ সাড়া হয় , তাও আবার বিকাল ৫/৫.৩০ টা থেকে রাত ১১/১১.৩০ টা পর্যন্ত ।
আমি সবসময়ই বলি - মহান আল্লাহ তায়ালা বাংলাদেশকে বিশেষভাবে দিয়েছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে । এটার সুন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তো মানুষের হাতেই দিয়েছে ।
পর্যটন খাতে বাংলাদেশের আয় বহুগুনে বেড়ে যাবে যদি সরকার এসব ইনফ্রা-স্ট্রাকচারের দিকে সিরিয়াসলি নজর দেয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন