মাথিন কূপঃ কালের সাক্ষী ; দু’টি জীবন মিলন ও বিচ্ছেদের
লিখেছেন লিখেছেন নয়া জামানার ডাক ১০ জুন, ২০১৬, ০৫:০৮:৩৮ সকাল
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতার ধীরাজ ভট্রাচার্য নামে এক পুলিশ অফিসার টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। এ সময় টেকনাফের জমিদার ছিলেন ওয়ানথিন। তিনি ছিলেন মগ( রাখাইন) সম্প্রাদায়ের। জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র কণ্যা মাথিন টেকনাফ থানার ভিতরের কূপ বা কূয়া থেকে অন্যান্য মেয়েদের মত নিয়মিত পানি নিতে আসতো। নবাগত সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্রাচার্য থানার কোয়াটারের ছোট্র বারান্দায় বসে কুপ থেকে মেয়েদের পানি নেওয়ার দৃশ্য দেখতেন। এসব মেয়েদের মধ্য থেকে কখন যেন ভাল লেগে যায় জমিদারদার কণ্যা মাথিনকে। মাথিন ও পুলিশ অফিসার ধীরাজ ভট্রাচার্যের ভালবাসার দৃষ্টি নিবন্ধ আড়চোখে তাকানোকে উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে শুরু হল দেখা দেখি, হাসা-হাসি এবং একে অপরকে ভালবাসার প্রস্তুতি। এক সময় টেকনাফের সকল বাসিন্দাই ছিল মগ বা রাখাইন সম্প্রাদায়ের। টেকনাফ থানায় ধীরাজ বদলি হওয়ার পর তেমন কোন কাজ চিলনা। চুরি, ডাকাতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ সহ সংঘটিত সব ধরনের ঘটনার নিষ্পত্তি হত থানাতে বসেই। পশ্চিমাকাশে সুর্য উঠতে তখনো অনেক বাকী। পাখিদের কলকাকলিতে চারিদিক মুখরিত। এমন সময় নারী কন্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে হঠাৎ ধীরাজের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ধীরাজ একপা দু’পা করে এগিয়ে থানার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় রঙ বেরঙ্গের থামি আর ব্লাউজ এবং নিজেদের তৈরী তাঁতের লুঙ্গি পরিহিতা রাখাইন যুবতিরা পাতকূয়ার চতুর্দিকে জড়ো হয়ে থানা এলাকা মুখরিত করে তুলত। থানার বিতরে অবস্থিত এই পাত কূয়াটিই ছিল সেই সময়কার এ অঞ্চলের একমাত্র পাতকূয়া। যা থেকে রাখাইন যুবতিরা পানি নিতে আসত। পুলিশ অফিসার ধীরাজ প্রতিদিন বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ার ছলে পানি তোলার দৃশ্য দেখত। যথারীতি সে দিনও পত্রিকা পড়ার ছলে বারান্দায় বসে ছিলেন বাবু ধীরাজ। পাতকূয়ার পাশে সবে মাত্র তিন-চার জন যুবতির জটলা শুরু। হঠাৎ নজরে পড়ল ধীরাজের তের-চৌদ্দ বছরের এক মেয়ে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে ধীরাজ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। মেয়েটিও দু’একবার ধীরাজের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে ফিরে তাকায়। মেয়েটির নাম মাথিন। জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র আদুরে কন্যা । সখের বশবর্তী হয়ে মাথিন মাঝে মধ্যে পানি নিতে আসতো, তবে খুব সকালে। তার আগেই ধীরাজ মাথিন কে দেখার আশায় বারান্দায় গিয়ে বসতেন।মাথিন সম্ভব-অসম্ভব নানা কল্পনার জালবুনে চলতো। অন্যরা দেখে হাসাহাসি করত কিন্ত তারা পাত্তা দিত না। জল নিতে আসা মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে গেলে মাথিন চলে যেত।
মাথিন ও ধীরাজ একে অন্য জনের ভাষা না বুঝলেও এক জন অন্য জনের সাথে না বল্লেও দু’ জনের চোখের ভাষায় পরিচয় ঘনীভূত হয়েছে অতি সহজে । ধীরাজকে এক নজর দেখার আশায় প্রতিদিন সকাল-সন্ধায় মাথিন থানার ভিতর পাতকূয়ায় আসে। যতক্ষণ থাকা সম্ভব পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকে কিন্ত কোন কথা হয় না। নীরব চোখের ভাষায় কথা হয় দু’জনের মধ্যে । এক সময় তাদের বিচিত্র প্রেমের কথা এলাকার সবাই জেনে যায়। জেনে যায় স্বয়ং মাথিনের বাব ওয়ানথিনও। সমগ্র এলাকা জুড়ে আড়ালে আবডালে কানা ঘুষা চলতে থাকে এ ঘটনা নিয়ে। তোয়াক্কা করেনি মাথিন ও ধীরাজ। জমিদার বাবাও একমাত্র কণ্যার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রবল ভাবে বাঁধ সাধতে পারেনি। বাবার প্রবল অনচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাথিন সম্মতি পায় বিয়ের। দিন গড়তে থাকে একদিন, দু’দিন, তিন দিন। এরই মাঝে কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসে ধীরাজের কাছে। অন্ততঃ একমাসের জন্য হলেও ছুটি নিয়ে কলকাতায় যেতে হবে। ধীরাজের প্রচণ্ড অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাবার কথা মতে ছুটিতে গেলেন। কিন্ত আর ফিরে আসা হয়নি টেকনাফ থানায়।
এদিকে চরম কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে ধীরাজের পালিয়ে যাওয়াকে মাথিন সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ছুটিতে যাওয়া একথা মাথিন মোটেও বিশ্বাস করেনি। মাথিন ,অনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে ধীরাজ তাকে বিয়ে করার ভয়ে পালিয়ে গেছেন। মাথিন খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। বাব ওয়ানথিন এমনকি এলাকাবাসীর শত চেষ্টাতেও মাথিন কে খাবার খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। প্রেমের বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে এবং না খেয়ে শেষ পর্যন্ত মাথিন মারা যায়।
এই করুণ মৃত্যুর সাক্ষী হিসেবে আজও বিদ্যমান রয়েছে টেকনাফ থানা ভিতরে অবস্থিত কূপটি। সেই মাথিনের নামেই বর্তমান কূপটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ মাথিন কূপ’ । এই প্রেমের নায়ক ধীরাজ ভট্রাচার্য তাঁর লেখা ' যখন আমি পুলিশ ছিলাম ‘ গ্রন্থে মাথিন এবং তাঁর প্রেমের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন।
বিষয়: বিবিধ
১৪১১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
Click this link
মন্তব্য করতে লগইন করুন