ত্যাগ

লিখেছেন লিখেছেন ইসলামী দুনিয়া ১৩ অক্টোবর, ২০১৪, ০৭:৩১:৪০ সন্ধ্যা

একদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট একজন অতি সাধারণ সাদামাটা একজন লোক কিছু প্রশ্ন নিয়ে উপস্থিত হলেন, তিনি সা’দ আল আসওয়াদ আল সুলুমি নামে পরিচিত, তিনি জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমিও কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর করলেন, “অবশ্যই! অবশ্যই তুমিও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে যদি তুমি একজন বিশ্বাসী হয়ে থাক”। সা’দ অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু আমি! আমি তো বিশ্বাসীদের মাঝেও অতি সাধারণ নগণ্য একজন মানুষ !” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে সা’দ অন্যান্য বিশ্বাসীদের জন্যে যা পুরষ্কার রয়েছে তোমার জন্যেও অনুরুপ রয়েছে,”

“তাহলে কেন কেউই তার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়না?”, সা’দ জানতে চাইলেন। উল্লেখ্য, তিনি এতই সাধারণ একজন লোক ছিলেন যে, সামাজিক তথাকথিত মান মর্যাদাহীনতার কথা তুলে কেউই তাদের মেয়েকে তাঁর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ইবন আল-ওয়াহাব এর নিকট যাওয়ার উপদেশ দিলেন, তিনি ছিলেন মদীনার সম্ভ্রান্ত নেতাদের একজন যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, এবং তাঁর কন্যা সৌন্দর্যের কারণে অন্যান্য নারীদের চেয়ে বিশিষ্ট ও সুপরিচিত ছিলেন।

নবীজী সা’দ কে এই উপদেশ দিলেন যে তিনি যেন ইবন আল-ওয়াহাব এর নিকট গিয়ে বলেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব এসেছে যে, ইবন আল-ওয়াহাব যেন সা’দ এর সাথে তাঁর কন্যার বিয়ে দেন।

সা’দ তাঁর নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ইবন আল ওয়াহাব এর বাড়িতে হাজির হলেন, তিনি খুশি এবং উত্তেজনায় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন। যিনি কিনা মদীনার অতি সাধারণ একজন নগণ্য মানুষ তিনি বিয়ে করবেন একজন সম্ভ্রান্ত নেতার সুন্দরী কন্যাকে! তিনি দরজার কড়া নেড়ে ইবন আল ওয়াহাবকে বললেন, আল্লাহর রাসূল আপনার নিকট আমাকে প্রেরণ করেছেন, আর তিনি অনুরোধ করেছেন আপনি যেন আমার সাথে আপনার কন্যার বিয়ে দেন।

ইবন আল ওয়াহাব সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, “তুমি ! তোমার কাছে আমার মেয়ে ! তুমি কি আমার মেয়ের সম্পর্কে কিছুই জাননা ! সে তার সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত” এবং তিনি উপদেশ দিলেন সা’দ যেন বাড়ি চলে যায়।

যখন সা’দ ভগ্ন মনে হাঁটতে শুরু করলেন, তারপূর্বে ইবন আল ওয়াহাব এর কন্যা তাদের এই কথোপকথন শুনে ফেলেন, তিনি বলেন, “ও আব্বা, থামুন, থামুন ! এটা আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে অনুরোধ। আমরা যদি আল্লাহর রাসূল এর অনুরোধ প্রত্যাখান করি তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায় হবে? আমাদের অবস্থান কোথায় হবে যদি আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সচেতনতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই? আমি বলছি আমরা কোথায় থাকব, আমরা এখানেই থাকব আজ আমরা যেখানে আছি !” এবং তিনি সা’দ কে বললেন, “আল্লাহর রাসূলের নিকট যান, তাঁকে বলুন আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি আছি”।

সা’দ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গেলেন এবং তিনি ছিলেন আনন্দে বিভোর ! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিয়ের মোহরানা ঠিক করলেন ৪০০ দিরহাম। একথা শুনে সা’দ অবাক হয়ে বলেন, “৪০০ দিরহাম ! হে আল্লাহর রাসূল, আমি নিজের চোখে কখনও ৪০০ দিরহাম দেখিনি !” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন আলী, আব্দুর রহমান ইবন আউফ এবং উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর নিকট যান এবং প্রত্যেককে ২০০ দিরহাম করে দিতে বলেন। তাঁরা প্রত্যেকে ২০০ দিরহামের আরও বেশি করে দিলেন।

নিজের স্ত্রীর নিকট যাওয়ার পূর্বে তিনি একটি বাজারের নিকট থামলেন, তিনি ভাবলেন তাঁর স্ত্রীর জন্যে কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাবেন। বাজারে অবস্থান কালেই তিনি শুনলেন, জিহাদের জন্যে আহবান করা হচ্ছে এবং অস্ত্রসহ তৈরি হবার জন্য আহবান করা হচ্ছে। সা’দ যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আকাশের দিকে মাথা ঊঁচু করে বললেন, “হে আল্লাহ ! আমি এই দিরহামগুলোর বিনিময়ে এমন কিছু কিনব যা আপনাকে সন্তুষ্ট করবে”। তিনি একটি তরবারী কিনলেন, একটি ঘোড়া কিনলেন এবং আল্লাহর রাসূলের চোখ এড়ানোর জন্যে নিজের মুখমণ্ডল একটি কাপড়ে ঢেকে নিলেন। কারণ তিনি জানতেন, যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে দেখে ফেলেন তাহলে তিনি তাঁকে বাড়ি ফেরত পাঠাবেন কারণ তিনি মাত্রই বিয়ে করেছেন , তিনি সদ্য বিবাহিত।

সাহাবীরা বলাবলি শুরু করলেন, “কে এই লোক, মুখ ঢেকে ঘোড়া ছুটিয়ে জিহাদের জন্য আসছে”? আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব করলেন, “ ছাড় তাকে, সে জিহাদের জন্যে আসছে”। সা’দ সাহসিকতার সাথে বীরদর্পে ঘোড়া ছুটিয়ে ময়দানে মিশে গেলেন, এবং এক পর্যায়ে তাঁর ঘোড়া আহত হয়ে পড়ে গেল, তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, এবারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গাঢ় চামড়ার রং দেখে তাঁকে চিনে ফেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্ন করলেন, “হে সা’দ, এটা কি তুমি?” সাদ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা মাতার জান আপনার জন্য কুরবান হোক, এটা সাদ”।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “হে সাদ, তোমার জন্যে জান্নাত ছাড়া আর কোন পুরষ্কার নেই” একথা শুনে সাদ লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং দৌড়ে যুদ্ধের ময়দানে হারিয়ে গেলেন। একটু পর শোনা গেল, লোকেরা বলছে সাদ আহত হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৌড়ে গেলেন সাদকে দেখার জন্যে। তিনি খুঁজতে লাগলেন, তিনি যুদ্ধাহত সাদের মাথা নিজের কোলে রাখলেন, প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চোখের অশ্রু সাদের মুখমণ্ডলে পড়তে লাগল, নবীজী কাঁদতে শুরু করলেন। একটু পর তিনি হাসতে শুরু করলেন, এরপর তিনি তাকালেন।এ অবাক করা ঘটনার সময়ে সেখানে একজন সাহাবা ছিলেন, যার নাম ছিল আবু লুবাবা, তিনি বলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আজ আপনাকে এমন এক অবস্থায় দেখলাম যা আমি আগে কখনো দেখিনি, প্রথমে আপনি কাঁদলেন, এরপর হাসলেন এরপর আপনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি কাঁদলাম কারণ আমার প্রিয় একজন সাহাবী মৃত্যু বরণ করল, আমি দেখলাম সে আমার জন্যে কতটুকু ভালোবাসা সঞ্চিত করে রেখেছিল, আমি দেখলাম তাঁর ত্যাগ। কিন্তু যখন আমি দেখলাম আল্লাহর নিকট হতে তাঁর জন্যে কি অপেক্ষা করছে, সে হ’দ এ পৌঁছে গেছে”। আবু লুবাবা বলেন, “হ’দ কি?” । “এটা জান্নাতের এমন একটি ঝর্ণা যেখান থেকে কেউ পান করলে আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না”, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর করলেন, “এটা মধুর চেয়েও মিষ্টি আর দুধের চেয়েও সাদা, আর আমি যখন দেখলাম আল্লাহর নিকট তাঁর মর্যাদা কিরূপ, আমি হাসতে শুরু করলাম। এরপর আমি আরও দেখলাম জান্নাতে তাঁর জন্যে অপেক্ষমাণ স্ত্রীগণ সাগ্রহে দৌড়ে ছুটে আসছে, যখন তাঁদের পায়ের গোঁড়ালি আমার নজরে আসল, তখন আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম”।

এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের নিকট আসলেন এবং সাদের তরবারী এবং ঘোড়া নিয়ে আসতে আদেশ করলেন। তিনি এগুলো সাদের স্ত্রীকে উপহার দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন এগুলো তোমার উত্তরাধিকার। এবং আরও জানালেন, আল্লাহ জান্নাতে সাদকে যে স্ত্রীদের সাহচর্য দান করেছেন তাঁরা আরও অনেক বেশি সুন্দরী।

বিষয়: বিবিধ

৯৯৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

274070
১৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০১:১০
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

প্রতিযোগী(লোভী)দের তো এমন জিনিসের জন্যই প্রতিযোগিতা(লোভ) করা উচিত
(মুতাফফিফীন-২৬)

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
১৪ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৯:৫২
218088
ইসলামী দুনিয়া লিখেছেন : ধন্যবাদ।
274105
১৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০২:৪৭
আফরা লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ খাইরান ।অনেক অনুপ্রেরনা মূলক একটা ঘটনা পড়লাম ।
১৪ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৯:৫২
218089
ইসলামী দুনিয়া লিখেছেন : পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File