মুসলিমদের একটি ঘাতক ব্যাধি "আল ওয়াহ্‌হান" ও তার প্রতিকার-১

লিখেছেন লিখেছেন ইসলামী দুনিয়া ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:৫৭:৩৪ দুপুর

মুসলিমদের একটি ঘাতক ব্যাধি – আল ওয়াহ্‌হান ও তার প্রতিকার

‘আমরা এমন জাতি, যারা নিতান্ত তুচ্ছ, নীচু জাত ছিলাম, আল্লাহ আমাদের মর্যাদা উঁচু করেদিয়েছেন ইসলামের মাধ্যমে। আমরা যদি অন্য কোন উপায়ে সম্মান কামনা করি, তবেআল্লাহ আবারো আমাদের নীচু করে দেবেন।‘

~ উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু

“সেসব মুনাফেককে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব - যারা মুসলমানদের বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের আউলিয়া (সাহায্যকারীবন্ধু, অন্তরঙ্গ, অভিভাবক) বানিয়ে নেয় এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ যাবতীয় সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।“

~ সূরা নিসা৪:১৩8-১৩৯

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

‘শীঘ্রই মানুষ তোমাদেরকে আক্রমন করার জন্য আহবান করতে থাকবে, যেভাবে মানুষ তাদের সাথে খাবার খাওয়ার জন্য একে-অন্যকে আহবান করে।’

জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তখন কি আমরা সংখ্যায় কম হবো?’

তিনি বললেন, ‘না, বরং তোমরা সংখ্যায় হবে অগণিত কিন্তু তোমরা সমুদ্রের ফেনার মতো হবে, যাকে সহজেই সামুদ্রিক স্রোত বয়ে নিয়ে যায় এবং আল্লাহ তোমাদের শত্রুর অন্তর থেকে তোমাদের ভয় দূর করে দিবেন (অর্থাৎ তারা তোমাদের ভয় করবে না) এবং তোমাদের অন্তরে আল-ওয়াহ্হান ঢুকিয়ে দিবেন।’

জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আল- ওয়াহ্হান কি?’

তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহর পথে মৃতু্ কে অপছন্দ করা।’ মুসনাদে আহমদ, খন্ডঃ ১৪, হাদিস নম্বরঃ ৮৭১৩, হাইসামী বলেছেনঃ হাদিটির সনদ ভালো, শুয়াইব আল আর নাউতের মতে হাদিসটি হাসান লি গাইরিহি

সাওবান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছেঃ

‘দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।’

সুনানে আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ, হাদিস হাসান

এইহাদিস নিয়ে একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় আসলেই রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিওয়া সাল্লামকে ‘অল্পকথায় অনেক কথা প্রকাশ করা’র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ

‘পূর্ববর্তী অন্যান্য নবীদের উপর ছয়টি বিষয়ে আমাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।আমাকে দেয়া হয়েছে অল্প শব্দে অনেক বেশী অর্থবোধক কথা বলার যোগ্যতা, আমি অনেক দূর থেকে শত্রুবাহিনীর মধ্যে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে বিজয় প্রাপ্ত হই।গনিমত তথা পরাজিত শত্রুবাহিনীর ফেলে যাওয়া সম্পদ আমার জন্যে বৈধ করা হয়েছে। যমিনের মাটিকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম এবং সেজদা প্রদানের স্থান বানানো হয়েছে। সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য আমাকে নবী বানানো হয়েছে এবং আমার মাধ্যমেই নবী আগমনের ধারাকে সমাপ্ত করা হয়েছে।’~ মুসলিম৫২৩

ওয়াহহান সম্পর্কিত আলোচ্য হাদীসে মাত্র কয়েকটি বাক্য রয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা, তাদের মূল সমস্যা এবং তার সমাধান নিখুঁতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে নীচে উল্লেখ করা হলো:

•প্রথমত: ‘শীঘ্রই তোমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য লোকজন একে অন্যকে আহবান করবে, যেভাবে খাবারের জন্য আহবান করা হয়।’

‘শীঘ্রই’ কথার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি যে দ্রুত ঘটতে যাচ্ছে তাই বোঝা যাচ্ছে। এই হাদীসের অসাধারণ একটি বিষয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রোতাদের মনের সামনে যেন একটি বাস্তব স্পষ্ট ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে, মুসলিম উম্মাহকে প্রথমে তুলনা করা হয়েছে, কিছু ক্ষুধার্ত লোকের সামনে রাখা সুস্বাদু খাবারের সাথে। কিন্তু, যেহেতু তারা ভাগাভাগি করে খাবে একারণে প্রত্যেকেই নিজ নিজ অংশ থেকে ভাগ নিতে চাইবে, ফলে খাদ্যটি ভাগ হয়ে যাবে ‘আমন্ত্রিত অতিথি’র মর্যাদা ও ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে। এই কাফেররা একে অপরকে আহবান করে তৈরি করেছে ‘জাতিসংঘ/ন্যাটো’। তারা দলবদ্ধ হয়ে এখন মুসলিমদের আক্রমণ করছে, আর মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

খিলাফত পতনের অল্প কিছু সময় পর থেকেই, মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে দেয়া হল বিভিন্ন রাষ্ট্রে, ইউরোপিয় দখলদারি শক্তি এটা করেছিল। এবং তাদের প্রত্যেকেই এরপর নজর দিল মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ যে প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়েছেন সেদিকে।সত্যিই বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ দলে দলে বিভক্ত, আল- কুরআনও সুন্নাহ হতেদূরে সরে যাওয়ার কারণে। এই অবস্থায় দুনিয়ার অন্যান্য জাতি, মুসলিম উম্মাহর উপর সরাসরি আক্রমণ চালাচ্ছে এবং একে অন্যকে আক্রমণের জন্য উৎসাহ দিচ্ছে, একদেশের

মুসলিমদের আরেক দেশের মুসলিমদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছে এবং যুদ্ধসৃষ্টি করেছে। যেমন : ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ফিলিস্তান, কাশ্মীরইত্যাদি-সেটা তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য হোক অথবা খনিজ সম্পদ দখলের জন্য হোক অথবা অর্থনৈতিক বাজার দখল করার জন্য হোক।

কেউ আক্রমণ করছে সরাসরি আগ্রাসী সেনাবাহিনী পাঠিয়ে, কেউবা কুটনৈতিক (diplomacy) এর মাধ্যমে, কেউবা আদর্শিকভাবে (ideologically), কেউবা সংবাদ মাধ্যম, প্রিন্ট কিংবাইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে, কেউবা তাদের আবিস্কৃত শিক্ষা-ব্যবস্থা রপ্তানীকরে তাদের মানসিক দাস তৈরির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই মানসিক দাসেরা পশ্চিমা দেশের অপ সংস্কৃতিকে মনে করে আধুনিকতা আর ইসলামের পবিত্রতা আর সুস্থসামাজিক ব্যবস্থাকে মনে করে পশ্চাদপদতা, তারা কুফফারদের পরিচালিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মানব রচিত মতবাদ গ্রহণ করতে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে আর ইসলামের শিক্ষা অনুসারে দেশ, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে বাধা দেয় ।আর এক্ষেত্রে তারা ‘গণতন্ত্র রক্ষা, মানবতা, নারী-মুক্তি, শিশু-অধিকার, সবারজন্য শিক্ষা, সামাজিক-উন্নয়ন’ ইত্যাদি বিভিন্ন মনভুলানো চটকদার শব্দের মোড়কে তাদের এই দালালী কার্যক্রমকে ঢেকে নিয়েছে।

বস্তুতঃইসলামী খিলাফতব্যবস্থা ধ্বংস করার পর থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহরউপর এই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে অনবরত, এটা যারাই আল-কুরআনে বর্ণিত আনআম (গবাদি-পশু) এর মতোনয়, তারাই জানেন ও বুঝেন।

আল্লাহ বলেনঃ“আর যারা কাফের তারা পারস্পরিক সহযোগী, বন্ধু। তোমরা (মুসলিমরা) যদি এমনব্যবস্থা না কর (পরস্পরের সহযোগী না হও), তবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিস্তার লাভ করবে এবং দেশময় বড়ই অকল্যাণ হবে।”

সূরা আনফাল ৮:৭৩

দ্বিতীয়ত: ‘তখন কি আমরা সংখ্যায় কম হবো?’ তিনি বললেন, ‘না, বরং তোমরা তখন অগণিত হবে।’

এখান থেকে বুঝা যায়, বেশি সংখ্যক হওয়া ইসলামের কোন পূর্বশর্ত নয়। ইসলাম চায় মানসম্পন্ন মুসলিম,যারা আল্লাহর দীনের জন্য নিবেদিত প্রাণ। সংখ্যা এখানে মূখ্য নয়। আল্লাহ চেয়েছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আমলে উত্তম’ (আ’মালুন সালিহান), এটা চাননি যে, ‘তোমাদের মধ্যে কে আমলে বেশি’ (আ’মালুনকাছিরান)। বদরের যুদ্ধে কাফিরদের সংখ্যা ছিলো মুসলিমদের তিনগুণ। ইয়ারমুকেরযুদ্ধে কাফিররা ছিলো মুসলিমদের ৭০ গুণ। উভয় যুদ্ধেই মুসলিমরা বিজয়ী হয়।অপরদিকে, হুনায়ুনের যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো, কাফিরদের চেয়ে বেশি।কিন্তু সে যুদ্ধে তারা পরাজয়ের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহর রহমতে বিজয় আসে। আফসোস, বর্তমান মুসলিম উম্মাহ, তাদের সংখ্যাধিক্যের পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যস্ত, কোন ধর্ম সবচেয়ে বেশি গতিতে বেড়ে চলেছে, কোনদেশে মুসলিম Growth rate কত ইত্যাদি ব্যাপার নিয়ে তারা ব্যস্ত; কিন্তু মুসলিমদের মান নিয়ে কোন চিন্তা হচ্ছে না। অথচ আল্লাহ আল-কুরআনে বারবার বলেছেন, বিজয় শুধুমাত্র তাঁর কাছ থেকে আসে, আর তাঁর বিজয় দানের ওয়াদা শুধু মুমিনদের জন্য।

দেড়শ কোটি মুসলিমের এত বিশাল সংখ্যাও কোন কাজে আসছে না, কারণ অধিকাংশ জনতা মানসিকভাবে পশ্চিমা দেশ ওতাদের আদর্শের দাসত্ব করে আসছে। রাখাল যেভাবে তার খেয়াল খুশি মত পালের ভেড়াদের যেদিকে খুশি সেদিকে নিয়ে যায়, এই পশ্চিমাদেশগুলোও আমাদের মুসলিম দেরসেভাবে পালের ভেড়া বানিয়ে রেখে মানসিকভাবে গোলামে পরিণত করে রেখেছে।

চলবে......

বিষয়: বিবিধ

১৫৩৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

264272
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০৪
দিশারি লিখেছেন : ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File