দর্শনকোষ
লিখেছেন লিখেছেন আমজনতার কথা ১৯ আগস্ট, ২০১৪, ১২:৪৯:২০ দুপুর
সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান আল্লাহ যুগে যুগে মানুষকে ‘সীরাতুল মুস্তাকিম’ (সঠিক পথ) প্রদর্শনের জন্য নবী রাসূল ও আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছেন। কিন্তু আফসোস, সামান্য কিছু ঈমানদার ব্যতীত পরবর্তীতে অনেকেই আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে ধর্মকে বিকৃত করে ফেলেছিল, শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সেসব বিকৃত ধর্মবিশ্বাস তৎকালীন মানুষের জানার আগ্রহ মিটাতে ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় অনেক জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব দিতে। ফলে তখনকার সমসাময়িক অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেদের মত করে বিভিন্ন তত্ত্ব (Theory) ও দর্শন (Philosophy) দাঁড় করায়। সেগুলি মূলত ছিল কিছু অন্ধবিশ্বাস ও মনগড়া হাস্যকর বিষয়ের সমন্বয় যেগুলি মানুষকে আরো বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিল। আবার কিছু তত্ত্ব ও দর্শন সাময়িকভাবে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল কিন্তু পরবর্তী যুগে সেগুলি অসাড় প্রমাণিত হয়। আবার কিছু তত্ত্ব ছিল সঠিক কিন্তু অপূর্ণাঙ্গ। অর্থাৎ গুটিকয়েক সঠিক তত্ত্ব পাওয়া গেলেও সেগুলির কোনোটিই মানুষের জন্য Complete Code of Life (পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান) ছিল না। তবে স্রষ্টা, সৃষ্টি, বিশ্বজগত নিয়ে তাদের সকল তত্ত্ব ও দর্শনই ছিল ভুল ও আজগুবী কল্পনাপ্রসূত। এমনই কিছু তত্ত্ব ও দর্শন নিয়ে আজকের আলোচনা।
Hsun Tzu : সুনজু(২৪৯-২৩৮ খৃ.পূ)
প্রাচীন চীনের একজন বস্তুবাদী দার্শনিক ছিলেন সুনজু। তাঁর সময়কার প্রচলিত চিন্তাধারার তিনি ছিলেন বিরোধী। সমগ্র বিশ্বকে বস্তু হিসেবে ব্যাখ্যা করার তিনি চেষ্টা করেন। বিশ্বের কোনো স্রষ্টা আছে-এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি প্রকৃতির ক্ষেত্রে দুটি শক্তি অস্তি (ইয়াং) এবং নাস্তি( ইন) এর তত্ত্ব তৈরি করেন। বিশ্বের সব কিছুই নিয়ত অস্তি এবং মাস্তির পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভূত ও পরিবর্তিত হয়ে চলছে। তাঁর মতে জ্ঞানের শুরু ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিতে। কিন্তু শুধু অনুভূতি জ্ঞান নয়। মানুষের বুদ্ধি ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতির ভিত্তিতে প্রকৃতির জ্ঞান তৈরি করে। শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়। মানুষের মধ্যে যার যা কিছু মহৎ তা শিক্ষার দ্বারাই সৃষ্টি হয়। চীনের দর্শনের পরবর্তী বিকাশ সুনজুর চিন্তাধারা দ্বারা বিরাটভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
Hume, David: ডেভিড হিউম(১৭১১-১৭৬৬ খৃ.)
ইংরেজী ভাববাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম মনোবিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। জ্ঞানের সমস্যার যে ব্যাখ্যা হিউম উপস্থাপিত করেন তা পরবর্তীতে ভাববাদী দর্শনকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেন। ‘জ্ঞানের মূল হচ্ছে ভাব’- এ তত্ত্ব দুটি ধারার সৃষ্টি করে। জন লক বলেছেন, ভাবের মূল হচ্ছে অভিজ্ঞতা। বার্কলে বলেছেন, ভাবের মূল হচ্ছে মন। ভাব মনকে অতিক্রম করে বস্তু বা অভিজ্ঞতায় আদৌ পৌছতে পারে না। এ তর্কে হিউম যোগদান করে বললেন, এই বিরোধিতায় জ্ঞানের মূল সমস্যার কোনোরূপ মীমাংসা আদৌ সম্ভব নয়।
‘বস্তু আছে কি নেই’ এরূপ প্রশ্নের সমাধান ভাবের তত্ত্ব দ্বারা কোনোরূপে সম্ভব নয়। হিউমের মতে আসলে মানুষ বস্তুর জ্ঞান আদৌ লাভ করতে পারে না। তার অর্থ এই নয় যে, বস্তু নেই-একথা মানুষ জানতে পেরেছে। বস্তু আছে বা নেই জ্ঞান দ্বারা মানুষ এর কোনো উত্তরই দিতে পারে না। বস্তুর সঠিক জ্ঞান বলতেও কিছু নেই। সঠিকজ্ঞান কেবলমাত্র অঙ্কশাস্ত্রেই সম্ভব। কারণ, অঙ্কের কারবার বস্তু নিয়ে নয়, সংখ্যা নিয়ে, সূত্র নিয়ে। সংখ্যা বা সূত্র কোনো বস্তু নয়। জ্ঞানের মূল কাজ বস্তুর অস্তিত্ব নির্ণয় করা নয়। জ্ঞানের কাজ হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সহায়ক মাধ্যম হওয়া। ভাবের প্রবাহ বা ধারা নিয়ে আমাদের সাধারণ জ্ঞান তৈরি হয়। কিন্তু ভাবের মূল কি, তা মানুষের অজ্ঞেয়। বস্তু আছে কি নেই-দুটোই আমাদের অবিশ্বাসের ব্যাপার, প্রমাণের বিষয় নয়। আমরা বিশ্বাস করি, ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে। কোনো ঘটনাকে কোনো ঘটনার কারণ কিংবা ফল হিসেবে আমরা চিহ্নিত করি। কিন্তু ঘটনার মধ্যে কারণ কিংবা ফল আছে বলে প্রমাণ করা চলে না। মানুষের মধ্যে যে সময় বোধ আছে, তা থেকে মানুষ ঘটনাসমূহকে কালের বুকে পূর্বাপর হিসেবে কল্পনা করতে পারে; কিন্তু তার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে বার করে তার ভিত্তিতে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী সে করতে পারে না। মানুষ অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেবল আশা করতে পারে যে, অতীতে যা ঘটেছে ভবিষ্যতেও তা ঘটবে। কিন্তু অনিবার্য পুনরাবৃত্তির নিয়ম সে আবিষ্কার করতে পারে না। হিউম অবশ্য মানুষের ভাবের রাজ্যকে অরাজক বলতে চান নি। মানুষ অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক ভাবকে শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে সংঘটিত হতে দেখে। কিন্তু কার্যকারণের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস এক কথা, আর তার অস্তিত্ব প্রমাণ আর এক কথা। মোট কথা, জ্ঞানের সমস্যার বিশ্লেষণে হিউম দেখাতে চেয়েছেন যে, মানুষের পক্ষে জ্ঞান অর্থাৎ বস্তুর লাভ সম্ভব নয়। এই জন্য হিউমকে অজ্ঞেয়বাদী বলে অভিহিত করা হয়।
(চলবে)।
বিষয়: বিবিধ
১১৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন