দুনিয়ার সর্বপ্রাচীন কম্পিউটারের গল্প

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি ১৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:৩৯:০২ দুপুর



১৯০০ সালের গ্রীষ্মের সময় তখন। এপ্রিলের দিকে একদল গ্রীক ‘স্পঞ্জ ডাইভার’ [স্পঞ্জ ডুবুরী] অলস ডুব দিচ্ছেন গ্রীসের ‘এন্টিকিথেরা’ দ্বীপের কাছাকাছি একটা জায়গায়। উদ্দেশ্য দ্বীপের পাশের পানির নিচ থেকে স্পঞ্জ তুলে এনে বাজারে বিক্রি করা। এই ডুবুরীর দল কখনো স্বপ্নেও ভাবেন নি যে তারাই হতে যাচ্ছেন দুনিয়ার সবচেয়ে পুরাতন কম্পিউটারের আবিষ্কারকারী। কারন আদতে কম্পিউটার তখনো বানানো হয় নি সেভাবে। সাধারন মানুষ তো দূরের কথা এমনকি বিজ্ঞানচর্চার সাথে জড়িত সবাইও জানতো না কম্পিউটার নামক যন্ত্র সম্পর্কে।

ডুবুরী দলের একটা অংশ ডুব দিলেন সাগরের ৪৫ মিটার বা ১৪৮ ফুট গভীরে। পানির নিচে যাওয়ার পরে খুব অবাক হয়ে তারা লক্ষ্য করলেন আবছা অন্ধকারে সম্ভবত অনেক পুরাতন একটা জাহাজের ভাংগা কিছু অংশ দেখা যায়। আবিষ্কারের উত্তেজনায় তারা উপরে উঠে এলেন। দলের বাকী সবাইকে জানালেন। সবাই আবার ডুব দিয়ে নিচে গিয়ে নিশ্চিত হলেন যে, এই জাহাজটি অনেক অনেক পুরাতন একটা জাহাজ। তাদের স্পঞ্জ তুলে আনার চিন্তা উড়ে গেলো। দলের সবাই মিলে পুরাতন জাহাজটা নিয়ে খাটাখাটি শুরু করলেন। জাহাজটার নাম হলো ‘এন্টিকিথেরা শিপর‍্যাক’। ডুবুরির দল আস্তে আস্তে তুলে আনতে শুরু করলেন ডুবে যাওয়া জাহাজের পুরাতন জিনিসপত্র। কিছু অতি প্রাচীন ব্রোঞ্জ, মার্বেলের মূর্তি, কাঁচের বাসনপত্র, অলংকার, মুদ্রা ইত্যাদি। জিনিসগুলো দেখে তারা নিজেরাও অবাক! এরকম জিনিসপত্র তো স্মরণকালের মাঝে কেউ ব্যবহার করেছে বলে তাদের জানা নেই!



উদ্ধার করা সবকিছু তারা দিয়ে দিলেন এথেন্সের ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আর্কিওলজী’ তে যাতে সায়েন্টিস্টরা এসব নিয়ে কাজ করে সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করতে পারেন, জিনিসগুলোর পেছনের ইতিহাস বের করে আনতে পারেন।

ডুবুরীর দল ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসগুলোর সাথে ব্রোঞ্জ এলয়’র (ব্রোঞ্জের সাথে অল্প টিনের মিশ্রন) কতগুলো আধা ভাংগা, এলোমেলো বিছিন্ন কিছু দাঁতওয়ালা চাকা উদ্ধার করে এনেছিলেন। সবগুলো জিনিস মিউজিয়ামে পড়ে রইলো ২ বছরের মত। এর মাঝে মিউজিয়ামের কর্মী ও গবেষকের দল টুকরা টুকরা বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে অনুমান করে একসাথে করতে লাগলেন। ওই দলের এক সদস্য আর্কিওলজিস্ট ভেলেরিস স্টেইস তখনো জানতেন না যে তিনি কত সুপ্রাচীন ইতিহাসের অন্ধকার থেকে কী অসম্ভব এক আবিষ্কারকে বের করে আনতে যাচ্ছেন!



১৯০২ সালের ১৭ মে। স্টেইস টুকরা টুকরা জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করছেন, মনে মনে একটা টুকরার সাথে আরেকটা টুকরার মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন, একটা পাথরের ভেতর একটা চাকা আটকানো। প্রথমে উনি ভাবলেন এটা একটা ‘এস্ট্রোনোমিকাল ক্লক’ বা এর চেয়ে এডভান্সড অন্য কোন কিছু একটা হতে পারে কিন্তু অন্যান্য সাইন্টিস্টরা অমত করলেন। অসম্ভব, এটা হতেই পারেনা। এতো আগে এইরকম একটা কমপ্লেক্স মেশিন মানুষ কিভাবে বানাবে?

এরই মধ্যে বের হয়ে এসেছে যে, এই জাহাজ মোটামুটিভাবে ঈসা (আঃ) এর জন্মের সময়কার তথা প্রায় ১৯০০ বছরের পুরাতন! তারা আন্দাজ করে নিলেন এই চাকার মত জিনিসটার বয়স আরো কিছু বেশী হতে পারে। তারা ধারনা করলেন এই জিনিসটা ঈসা (আঃ) এর জন্মের কমপক্ষে ১০০-১৫০ বছরের পুরাতন। এতো পুরাতন একটা ব্রোঞ্জের টুকরা গবেষকের দলকে খুব একটা টানতে পারলো না। দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন কম্পিউটারকে তারা না জেনেই আবিষ্কার করতে গিয়ে একেবারে কাছ থেকে সরে এলেন।

তারপরে প্রায় ৫০ বছর ব্রোঞ্জের ভাংগা চাকাগুলোর দিকে কেউ নজর দিলো না। এগুলো পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রইলো এথেন্সের মিউজিয়ামে। ১৯৫১ সালের দিকে ইয়েল ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর, পদার্থবিদ ও বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ ডেরেক জন ডি সোলা প্রাইস ব্রোঞ্জের টুকরাগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখালেন। এই মহান মানুষটা দীর্ঘ অনেক বছর কাজ করলেন এগুলো নিয়ে। এর মাঝে সাথে পেলেন গ্রিক এক নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ কারালাম্পোস কারাকালোসকে। ১৯৭১ সালের দিকে দুজনে মিলে মোট ৮২ টুকরা ভাংগা চাকাগুলোর উপরে এক্স-রে, গামা-রে পরীক্ষা চালালেন। যে ভাংগা টুকরাগুলোকে কেউ পাত্তা দিতে চায়নি সেগুলোকে নিয়েই প্রাইস তার ২০ বছরের বেশী সময়ের গবেষনা আর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ৭০ পৃষ্ঠার এক বিশাল আর্টিকেলে!

প্রফেসর প্রাইস সেই টুকরাগুলোকে একসাথে দাঁড় করিয়ে ২০০০ বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন সেই কম্পিউটারকে আবারো বানিয়ে দুনিয়ার মানুষকে দেখালেন, ‘দেখো, ২০০০ বছর আগেরকার কম্পিউটার কেমন ছিলো’! প্রাচীন গ্রীসের এন্টিকিথেরা দ্বীপের সায়েন্টিস্টরা তাঁদের এই যন্ত্রকে কি নামে ডাকতেন তা জানা সম্ভব হয় নি, কিন্তু একটা নাম তো দিতেই হয়। প্রফেসর প্রাইসের আবিষ্কার করা দুনিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এই মেকানিক্যাল কম্পিউটারের নাম দেয়া হয় ‘এন্টিকিথেরা মেকানিজম’।



আজকের আধুনিক ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের কাছে ঐ কম্পিউটারটা হয়তো কিছুই না কিন্তু ২১০০ বছর (২০১৪ সালে এসে সাইন্টিস্টরা বলছেন কমপক্ষে ২২০০ বছর) আগে মানুষ তার নিজের ডিজাইন করা মেকানিকাল কম্পিউটার দিয়ে তখন মহাকাশ গবেষণায় রত থেকেছে, এটা দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করে নিজেদের ক্যালেন্ডার (বর্ষপঞ্জিকা) বানিয়েছে, এমনকি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হওয়া গ্রীক অলিম্পিয়াডের সঠিক সময়ও কি না নির্ধারন করেছে! আজকে ২০১৫ সালে কোন ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করার সময় এসব ভাবতেও ভালো লাগে!

বিষয়: বিবিধ

১৫৫৭ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

346032
১৭ অক্টোবর ২০১৫ বিকাল ০৫:২১
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : ভাল লাগলো, নতুন কিছু জানলাম, ধন্যবাদ আপনাকে
১৭ অক্টোবর ২০১৫ বিকাল ০৫:২৫
287163
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
346045
১৭ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৪৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
এন্টি কাইথেরা মেকানিজম মুলত সরল এষ্ট্রলোব।
১৭ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৪৯
287178
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
346054
১৭ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১৬
হতভাগা লিখেছেন : এটা নিয়ে হৈ চৈ শুনলাম না কেন আগে ?
১৭ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩৬
287175
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়ার ফলে সেটা হৈচৈ পড়ে
তখনকার যুগে কোন হৈচে করার মতো মাধ্যম আমাদের আয়ত্বে ছিল না তাই আমরা পারি নাই
346057
১৭ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩২
শেখের পোলা লিখেছেন : অবাক হওার মত কথা৷ ধন্যবাদ৷
১৭ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩৬
287176
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
346069
১৭ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:০৩
আফরা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
১৭ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:৪৭
287185
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপু আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
346079
১৭ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১১:০৫
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ভাইয়া, অনেক কিছু জানলাম, শুকরিয়া।
১৮ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ১২:৩৬
287239
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : ওয়ালাইকুম সালাম
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
346114
১৮ অক্টোবর ২০১৫ সকাল ০৯:০৬
দ্য স্লেভ লিখেছেন : আমি হলে ানেক গবেষনার পর বলতাম এটা সম্ভবত একটা বাইসাইকেল Happy
১৮ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ১২:৩৬
287240
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : হাহাহাহাহাাহ
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File