ব্রয়লার গরু ২৪ মাসেই মাংস দেবে ১ টন
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি ০৭ অক্টোবর, ২০১৫, ১০:৫৫:১১ রাত
দেশে মাংসের ঘাটতি পূরণে এবার নতুন সংযোজন হচ্ছে ব্রয়লার গরু। ব্রাহমা ক্রসের মাধ্যমে সংকরায়ন করা এ ব্রয়লার গরু শুধু মাংস উৎপাদন করবে। ফার্মের ব্রয়লার মুরগির চেয়েও এর মাংসের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হবে। দৈনিক এর শরীরে মাংস বাড়বে ৯শ গ্রাম থেকে ১ হাজার গ্রাম। প্রতি মাসে মাংস উৎপাদন হবে ২৭ থেকে ৩০ কেজি। আট-দশ বছর বয়সের দেশীয় গরুর মাংস উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র আড়াইশ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ কেজি পর্যন্ত হয়। তবে মাত্র ২৪ মাস বয়সেই এ ব্রয়লার গরু ৭৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার কেজি বা এক টন মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। ব্রয়লারের উৎপাদনের পদ্ধতি, সফলতা ও জনপ্রিয়তা বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। অচিরেই সারা দেশে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রমও শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে আমেরিকায় এ ব্রয়লারের ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম চলছে। তবে ব্রাহমা ক্রসের আদি জাত ভারতীয় উপমহাদেশের। তাই বাংলাদেশের আবহাওয়ায়ও ব্রয়লার গরু সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে উঠতে সক্ষম। ইতিমধ্যে প্রকল্পের আওতায় ব্রয়লার গরুর উৎপাদনে দারুণ সাফল্য পাওয়া গেছে। পশু প্রজনন বিজ্ঞানীরা এ প্রযুক্তি নিয়ে অপার সম্ভাবনা দেখছেন। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে বিদ্যমান মাংসের ঘাটতি দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই মেটানো সম্ভব। এ কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করার মধ্যদিয়ে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত মাংস রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও করতে পারবে। দেশে মাংস উৎপাদনকারী কোনো জাত আবিষ্কার এটিই প্রথম। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু মাংস উৎপাদনকারী গরুর ভিন্ন জাত থাকতে পারে এ ধারণা আগে কারও জানা ছিল না।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য বলছে, জনপ্রতি দৈনিক মাংসের চাহিদা আছে ১২০ গ্রাম। জোগান মিলছে মাত্র ৬৫ গ্রাম। ঘাটতি ৫৫ গ্রাম। আর সার্বিক হিসাবে দেশে বর্তমানে মাংসের চাহিদা আছে ৬৭ দশমিক ২০ লাখ টন। জোগান আছে মাত্র ৩৬ দশমিক ২০ লাখ টনের। এ হার শতকরা মাত্র ৫৩ ভাগ। অর্থাৎ প্রায় ৪৭ শতাংশ মাংসের ঘাটতি রয়েছে। তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৩ লাখ টন এবং সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাংস আহরণের পরিমাণ ছিল ৪৫ লাখ ২০ হাজার টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মাংস আহরণের পরিমাণ ছিল ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার টন।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের পশু প্রজনন কর্মকর্তারা বলছেন, আর নয় ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভরতা। গরু চোরাচালান নিয়ে সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যার নির্মমতাও আর হজম করতে হবে না। আমরা প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন আশা করছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু প্রজনন বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আজহারুল হক যুগান্তরকে বলেন, ব্রয়লার গরুর উৎপাদন দেশে একটি নতুন ধারণা। জাতটি ব্রয়লার মুরগির মতোই দ্রুত বেড়ে অস্বাভাবিক মোটাতাজা হয়। তবে কোনো পশুর শরীরে কোনো ধরনের হরমোন প্রয়োগের দরকার হয় না। ক্ষতিকর রাসায়নিক হরমোনের প্রয়োগের তো প্রশ্নই আসে না। এটি অনেকটা প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সংমিশ্রণের একটি নতুন সংযোজন মাত্র। তবে ব্রয়লার গরু উৎপাদনের জন্য দেশীয় সুস্থ সবল একটি গাভীর প্রয়োজন হয়। ওই গাভীর গর্ভাশয়ে সিমেন বা শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়। এ সিমেন আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয়। গাভী থেকে প্রসবকৃত বাছুর ব্রয়লার গরু হিসেবে পরিণত হবে। আবার এ বাছুর দেশের পরিবেশে স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে উঠবে। অন্যান্য পশু যা খায় তাকে তাই খাওয়াতে হয়। তবে জন্মের প্রথম তিন থেকে ৬ মাস ভালোভাবে দুধ খেতে দিতে হবে। যেহেতু এ বাছুর জন্মের পরপরই দ্রুত শারীরিকভাবে বেড়ে উঠে এবং আকারে বড় হয়, তাই এর খাবার দিতে হয় বেশি পরিমাণে। রাখতে হয় স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানে। তিনি বলেন, এ গরু শুধুই মাংস দেয়। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে মাংস। আমেরিকার পরিবেশে এ ব্রয়লার গরুর শরীরে প্রতিদিন দেড় কেজি করে মাংস বৃদ্ধি পায়। তবে আমাদের পরিবেশে এ বৃদ্ধির হার ৯০০ গ্রাম থেকে ১০০০ গ্রাম।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, আমরা এ প্রকল্প নিয়ে অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন বুনতেই পারি। নিজেরাই যদি মাংস উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে পারি, তাহলে দেশে পুষ্টির সরবরাহ বাড়বে। মাংসের দামও কমে আসবে। আবার এর চামড়া ও উদ্বৃত্ত মাংস রফতানি করে দেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। তবে এর জন্য সবার আগে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। প্রান্তিক চাষী পর্যায়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগগুলোরও সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, সরকারিভাবে একজন প্রান্তিক কৃষককে ৪টি করে বকনা পালনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর জন্য মাত্র ৫ শতাংশ সুদে প্রতিটি বকনার জন্য ৪০ হাজার টাকা করে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা ঋণ দেয়ার কথা। এ ঋণের ছাড় সহজীকরণ করতে হবে। গ্রামপর্যায়ে তালিকাভুক্ত প্রত্যেক কৃষক এ ঋণ সুবিধা পেলে দেশে পশু পালনের হার বাড়বে। এছাড়া দেশীয় পদ্ধতিতে গরুকে চিটাগুড় ও মিষ্টি আলু খাইয়েও সুস্থ সবল প্রক্রিয়ায় গরু মোটাতাজাকরণ করা যায়। এর মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এসএসএ সামাদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, এ ব্রয়লার গরুর মাংস খুবই স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুস্বাদু। চর্বির পরিমাণও খুব কম। প্রকল্পটি জনপ্রিয় ও বিস্তৃত করার উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমানে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট-এর আওতায় ১৬ হাজার গরুকে সিমেন প্রয়োগের মাধ্যমে বকনা বাছুরের জন্ম দেয়া হয়েছে। এরা খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠছে। প্রায় প্রতিমাসে প্রকল্পের আওতায় আড়াইশ থেকে তিনশ গরুর ওপর সিমেন প্রয়োগ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, উচ্চ শিক্ষা মানোন্নয়নে পশুপালন অনুষদের পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুজাফফর হোসেনের ব্যবস্থাপনায় বাকৃবিতে তিন বছরমেয়াদি একটি প্রকল্প রয়েছে। চাহিদা পূরণে দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ ও পোলট্রির উদ্ভাবনমুখী গবেষণা করাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এরই একটি উপপ্রকল্প ব্রাহমা ক্রস।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা দুই কোটি ৮৬ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ গাভী। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর ৬০ শতাংশই হয় কোরবানির ঈদে। অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ নিজস্ব উৎপাদন থেকে আসছে। তবে কোরবানির সময় এটি মোট চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঘাটতি থাকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ উপখাতের অবদান ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ০৮ শতাংশ, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আলী নূর যুগান্তরকে জানান, প্রতিবছর আমিষের চাহিদা বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রাণিজ সম্পদের উৎপাদনও বাড়ছে। তবে চাহিদা বাড়ছে তার চেয়েও বেশি হারে। এ ঘাটতি চাহিদা পূরণে আমদানির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও আরও বেশি উৎপাদন বাড়ানোর প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগেও কিংবা ব্যক্তি প্রচেষ্টায় মাংস উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম চলছে। সরকারিভাবে ইতিমধ্যে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট-এর আওতায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেশি পরিমাণ মাংস উৎপাদনের কাজ জোরেশোরে এগুচ্ছে। এছাড়া ব্রিড আপগ্রেডেশন থ্রু প্রজেনি টেস্ট, বাফেলো ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টসহ বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প দেশের গো-মাংসের উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হবে। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্বতি অনুসরণ করে গবাদিপশুর লালন-পালনের মাধ্যমে দেশে এর উৎপাদন বহুমাত্রায় বৃদ্ধি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাংস রফতানি করা সম্ভব হবে। -
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৩ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্বাধ দিয়ে লাভ নাই
ধন্যবাদ
এই গরু কিভাবে ফেলে জবাই করা হবে ? মাংশ পেতে হলে তো আগে সেটাকে জবাই করা লাগবে ।
শুরুর প্যারাতে যেভাবে বর্ণনা দিলেন যে প্রতিদিন ১ কেজি করে মাংশ বাড়বে , তাতে মনে হল যে গরুকে জীবিত রেখেই তার শরীর থেকে মাংশ কেটে কেটে খাওয়া যাবে ।
হাহাহাহাহাহাহাহাহাহা
আমার বড় মেয়ের নাম কিন্তু জান্নাত
মন্তব্য করতে লগইন করুন