আমির হোসেন উদ্ভাবিত ধান কাটার যন্ত্র

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি ০৬ অক্টোবর, ২০১৫, ০৬:৫৪:২২ সন্ধ্যা



ক্ষেতভরা সোনালি ধান দেখে আনন্দে মন নাচে কৃষকের। একই সঙ্গে একটু দুরুদুরু ভাবও থাকে। ধান পাকার মৌসুমে যখন-তখন ঝড়বৃষ্টি বা শিলায় ফসল নষ্ট হয়। এ জন্য ভালোয় ভালোয় ধান কেটে ঘরে তুলতে হন্যে হয়ে ওঠেন কৃষকেরা।

কিন্তু ধান কাটা মাঝেমধ্যে বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়। বোরো বা আমন মৌসুমে সব ক্ষেতের ধান পাকতে শুরু করে। এতে এলাকার মজুরেরা একসঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের কাছে ধরনা দেওয়া এক ঝক্কি। কাজটি যদি সুবিধাজনক এক যন্ত্রের ওপর চাপানো যায়, তাহলে ধান কাটা নিয়ে আর দুর্ভাবনা নেই।

এ চিন্তা মাথায় রেখে বগুড়া শহরের আমির হোসেন ধান কাটার এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন, যা টেকসই ও হালকা; আর দামেও কম। এটি কৃষকদের শুধু মজুরসংকট থেকেই বাঁচাবে না, আনুষঙ্গিক ব্যয়ও কমাবে।

উদ্ভাবকের এগিয়ে আসা: বগুড়া শহরের কাটনার পাড়ার বাসিন্দা আমির হোসেন (৫০)। সেখানে রয়েছে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। ছোটখাটো বিভিন্ন কলকারখানার যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় সেখানে। আমির হোসেন নিজেই তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগর। এই কারিগরি গুণ বাবার কাছ থেকে পাওয়া।

আমির হোসেন জানান, ১৯৪০ সালে তাঁর বাবা ধলু মেকার এই কারিগরি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি একটি সাইরেন যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাস করে আমির বাবার ব্যবসায় যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে বাবা মারা গেলে আমির ব্যবসা পরিচালনার ভার নেন।

শুরু থেকেই আমির উদ্ভাবনী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে আসছেন। তাত্ত্বিক কোনো কারিগরি জ্ঞান তাঁর নেই। নেই প্রযুক্তিবিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ। স্রেফ হাতে-কলমের অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনী মেধা কাজে লাগিয়ে তিনি একের পর এক বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে যাচ্ছেন।

প্রথমে তিনি চিকন সেমাই উত্পাদনের একটি যন্ত্র তৈরি করেন। স্বল্প পুঁজির অনেক ব্যবসায়ী এ যন্ত্র ব্যবহার করে উপকার পাচ্ছেন। তাঁর উদ্ভাবিত ‘বগুড়ার চিকন সেমাই মেশিন’ এখন সারা দেশে প্রচলিত। তাঁর তৈরি ইটভাঙা ও ইট তৈরির যন্ত্রও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার তিনি কৃষকদের কষ্ট লাঘবে উদ্ভাবন করেছেন ধান কাটার যন্ত্র, যার নাম দিয়েছেন ‘কলের কাঁচি’।

আমির বলেন, ‘মূলত ধান কাটার জন্য এই যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। তবে এটি দিয়ে গম, ভুট্টা, পাট, আখসহ অন্যান্য শস্যও কাটা যাবে।’

তৈরি হলো যেভাবে: কোনো যন্ত্র একবার মনে ধরলে অবিকল সে-রকম যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করেন আমির হোসেন। এটি তাঁর শখ।

আমির জানান, তাঁর ‘কলের কাঁচি’ দিয়ে দুই ঘণ্টায় এক একর জমির ধান কাটা যাবে।

প্রতি বিঘা জমির ধান কাটতে খরচ হবে ৬০—৭০ টাকা। যন্ত্রটি তুলনামূলকভাবে হালকা হওয়ায় এটি দিয়ে পূর্ণবয়স্ক যে কেউ সহজে ক্ষেতের ফসল কাটতে পারবেন।

তিনি জানান, কৃষকেরা এখন যন্ত্রটি আট হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় কিনতে পারবেন।

যন্ত্রটি আরও সস্তা ও আধুনিক করতে তিনি কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে কৃষক পাঁচ-ছয় হাজার টাকায় এটি কিনতে পারবেন।

সরেজমিনে একদিন: সম্প্রতি বগুড়া সদর উপজেলার জয়পুরপাড়া গ্রামে এই যন্ত্র দিয়ে আমিরকে ধান কাটতে দেখা যায়।

শত শত গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে তিনি তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে সফলভাবে ৩০ শতক জমির ধান কেটে দেখান।

এ সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক রোস্তম আলী মণ্ডল ও কৃষি বিভাগের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

জমির আইল দিয়ে ছোট একটি যন্ত্র নিয়ে আমির হোসেন যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন উপস্থিত নারী-পুরুষেরা বলাবলি করছিলেন, ‘এই যন্ত্র দিয়ে কেংকা করে ধান কাটপি?’

পরে আমিরের সাফল্যে সবাই অভিভূত হন। জয়পুরপাড়ার বৃদ্ধ কৃষক হাছেন আলী বলেন, ‘জিংকা করে এই যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা দেকালো, তাতে হামাগোরে ধান কাটতে বেশি ট্যাকা লাগবি না। কী সুন্দরভাবে ধান কাটিচ্ছে, আর সেগুলো ধীরে ধীরে পড়ে যাওচে। ইংকা জিনিস কেনা লাগবি।’

রোস্তম আলী মণ্ডল বলেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রটি কৃষকের খুব উপকারে আসবে। এটির দাম কম, যা কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। যন্ত্রের কিছুটা আধুনিকায়নের পর বাজারজাত করা হলে চাষিরা উপকৃত হবেন।

বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর যুগ্ম পরিচালক (প্রকৌশল বিভাগ) মাহমুদ হোসেন খান বলেন, ‘আমির হোসেন একটি ভালো জিনিস তৈরি করেছেন। যন্ত্রটি দিয়ে ধান কেটে ভালো ফল পেয়েছি। সরকারি সহযোগিতায় এই যন্ত্র সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হলে ধান কাটার সময় যে শ্রমিকসংকট দেখা দেয়, তা থাকবে না।

বিষয়: বিবিধ

১৮১৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

344678
০৬ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫০
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : এসব আবিষ্কারগুলি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। ‍a2i নামে একটি সরকারী প্রকল্প আছে যার মাধ্যমে ইনোভেটিভ কাজগুলিকে প্রমোট করা হয়। সেখানে যোগাযোগ করে সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে।
০৬ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৮:২৭
285976
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : হুম
344679
০৬ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫৪
শেখের পোলা লিখেছেন : আমির হোসেনকে জানাই শুভেচ্ছা৷ আল্লাহ তার উদ্ভাবনি শক্তি আরও বাড়িয়ে দিক৷৷ আমার ধারণা এ মেশিনে কাটা ধান আঁটি বাধা যাবেনা,বরং মলনদিতে হবে৷(গরুদিয়ে মাড়াই)
কালে হয়ত এটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের তালিকায় যোগ হবে৷
০৬ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৮:২৮
285977
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : সহমত
হাহাহাহাহাহাহাহা
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
344685
০৬ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:৩৭
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৬ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১১:৩৫
286004
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : Rolling on the Floor Rolling on the Floor Rolling on the Floor Good Luck Good Luck Good Luck
344695
০৬ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১০:৩৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এমন অনেক ক্ষুদ্র অথচ জরুরি প্রযুক্তি আমাদের দেশে আবিস্কৃত হয়েছে। কিন্তু সরকারি আমলাদের অপচেষ্টায় সেগুলির পেটেন্ট বিদেশের হাতে চলে গেছে।
০৬ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১১:৩৫
286005
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : সহমত
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File