হীরক রাজার দেশ ও মৃত ব্যক্তির কবর জিয়ারত

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি ১৬ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:৩৯:২৩ সন্ধ্যা

হীরক রাজার দেশে একটা বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, রাজা বলছে জনগণকে 'যত জানবে তত কম মানবে'। জনগণ যত কম জানে, যত অন্ধকারে থাকে রাজার জন্য তত ভাল হয়। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে আলোচনার ঝড় বইছে। তারেক রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, ১৫ আগষ্টের পটপরিবর্তন, সিপাহী-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থান, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী, তাহের-ইনু চক্রের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে ঐতিহাসিক দালিলিক প্রমাণাদির ভিত্তিতে তথ্যসমৃদ্ধ কিছু বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে তার দলের সভায় উপস্থাপন করেছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এর বিপরীতে যৌক্তিক কোনো বক্তব্য আসেনি। যেসব বক্তব্য আমরা মিডিয়াতে দেখেছি এটা কলমের জবাব দা বা কুড়াল অথবা সহজ কথায় লগি বৈঠার জবাব। কিন্তু কিছু সুবিধাবাদী কলাম লেখক বা সাংবাদিক বন্ধুরা যখন যুক্তি বা তথ্যের ধার ধারেন না তখন কষ্ট লাগে। তাহলে কি আমরা হীরক রাজার দেশের মত কম জেনে রাজাকে শান্তিতে দেশ শাসনের সুযোগ করে দিব আর মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রয়োজনে আজ্ঞাবহ আদালত দিয়ে ইতিহাস রচনায় সায় দিয়ে যাব। এটাই এখন বড় প্রশ্ন। ইতিহাসের কোনো বিষয় মীমাংসীত হয় না। আর আদালত দিয়ে তো ইতিহাস লেখার প্রশ্নই উঠেনা। কিন্তু তা করা হচ্ছে, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে।

সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাবলী নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটি সম্পর্কে নানাজন বিভিন্নভাবে মন্তব্য ও বিশে¬ষণ করছেন। এতে তিনি যুগপৎ প্রশংসা ও নিন্দার মুখে আছেন। এই ধরনের প্রেক্ষাপটেই বইয়ের লেখক শারমিন আহমদ ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ১৩ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে একটি কলাম লিখেছেন। কলামটির নাম ‘স্বাধীনতার অখন্ডিত ইতিহাস ভবিষ্যতের পাথেয়’। এই কলামটিতে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই কলাম লেখক শারমিন আহমদ আরেকজন বিখ্যাত উপন্যাস লেখক ও প্রবন্ধকার জর্জ অরওয়েলের লেখা থেকে দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন। প্রথম উদ্ধৃতি : ‘হু কন্ট্রোলস দ্য পাস্ট, কন্ট্রোলস দ্য ফিউচার, হু কন্ট্রোলস দ্য প্রেজেন্ট, কন্ট্রোলস দ্য পাস্ট।’ এর বাংলা ভাবার্থ : যিনি বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি অতীতকেও নিয়ন্ত্রণ করেন; যিনি অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনিই ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন। দ্বিতীয় উদ্ধৃতি : ‘দ্য মোস্ট ইফেক্টিভ ওয়ে টু ডেসট্রয় পিপল ইজ টু ডিনাই অ্যান্ড অবলিটারেট দেয়ার ওউন আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব দেয়ার হিস্টোরি।’ এর বাংলা ভাবার্থ : একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পন্থাটি হলো, সেই জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজেদের মতো করে নিজেদের ইতিহাস বোঝা ও মূল্যায়ন করার সুযোগ না দেওয়া। লেখক শারমিন আহমদকে অজস্র ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা আমাদের সামনে উদ্ধৃতির মাধ্যমে উপহার দেওয়ার জন্য। কথা দুটি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন সার্বিকভাবে প্রযোজ্য, তেমনি জনগোষ্ঠীর বিবিধ খ-ের জন্যও বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রযোজ্য।

ইতিহাস নিয়ে নানা সময়ে নানা আলোচনা ও বিতর্কও সৃষ্টি করেছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। তবে এসব আলোচনা বা বিতর্ক থেকে অনেক অজানা তথ্যও বেরিয়ে আসে যা নতুন করে ইতিহাস রচনায় সহায়ক হয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, মাহফুজ উল্লাহ এর ভাষায়, ইতিহাস ¯’বির কোনো বিষয় নয় এবং এ কারণেই নতুন নতুন তথ্যের ফলে ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। যেমন, ১৯০০ সালের আগ পর্যন্ত ট্রয়ের যুদ্ধ ছিল কল্পকাহিনী। চীনের পোড়ামাটির তৈরি সেনাবাহিনী অথবা মাচুপিচুর ব্যাপারগুলোই ছিল অজানা। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে নতুন নতুন ব্যাখ্যা ইতিহাসের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে। ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ইতিহাসবিদ জানার চেষ্টা করেন কোনো প্রমাণ বাস্তব ও সঠিক, না একপেশে। এই মূল্যায়নের পর ইতিহাসবিদ তার বর্ণনার জন্য কিছু প্রমাণ ব্যবহার করেন, অন্যগুলো বাদ দেন। এ থেকে যা বেরিয়ে আসে তার মধ্যে ইতিহাসবিদের মূল্যায়ন, দৃষ্টিভঙ্গি, সিদ্ধান্ত ও ভ্রান্তির প্রতিফলন ঘটে। এ কারণেই ইতিহাস মানসিকও বটে।

তিনি বলেন ইতিহাস হ”েছ সত্যের জন্য অনুসন্ধান। কেউ কেউ হয়তো এর বিরোধিতা করবেন; কিš‘ মনে রাখা প্রয়োজন, ইতিহাসে যা ঘটেছে তা না জানলে পৃথিবী সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ থেকে যাব। চূড়ান্ত সত্য একটি কঠিন পণ্য এবং বিভিন্নভাবে একে খুঁজে বের করতে হয়। সচেতন ইতিহাসবিদরা ঐতিহাসিক সত্যের জন্য তাদের অনুসন্ধানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকেন। ইতিহাসে যা লেখা হয়েছে তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকলেই ইতিহাসকে নির্মোহভাবে বোঝা সহজ হয়। এভাবে দেখলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে যে বিতর্ক চলছে, তাকে উপলব্ধি করা যাবে এবং তথ্যের বিনিময়ে সত্যকে খুঁজে বের করা সহজ হবে।

তারেক রহমানকে যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে তারেক রহমান সারাদেশে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। তাদের নিয়ে তৃণমূল সম্মেলন করেছেন। তারেক রহমান সারাদেশে ২০ টির মতো ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলন করেছেন। দেশের প্রায় ৫০ হাজারের অধিক নেতা কর্মীর সেখানে ডেলিগেট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আর সব কয়টি সম্মেলনে তারেক রহমান তাদের মধ্য থেকে কয়েক হাজার তৃণমূল নেতা কর্মীর বক্তব্য নিজে উপস্থিত থেকে শুনেছেন।

ঠিক এমনিভাবে দেশে থাকতে ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ তারেক রহমান মূলত ফরিদপুরে গিয়েছিলেন দলের তৃনমূল সম্মেলন করতে। দিনভর সম্মেলন শেষ করে রাতে ঢাকায় ফেরার পথে দিবাগত রাতে সদলবলে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেন। এ সময় তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ছিলেন তৃনমূল সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সংবাদ সংস্থা বাসস ও ইউএনবির প্রতিনিধিরা। আর তৃনমূল সম্মেলনে যোগ দেয়া তার সফর সঙ্গী দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল¬াহ আমান, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রশিদুজ্জামান মিল¬াত, সাইফুর রহমান নান্টু, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স এবং গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি এম এইচ খান মঞ্জুসহ অন্য নেতারা। তাই গোপনেতো নয়ই বরং সাথের নেতা কর্মীদের নিয়েই প্রকাশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেন তারেক রহমান।

শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রবীন রাজনৈতিক নেতা, বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতা ও বাকশালের প্রতিষ্টাতা। সর্বোপরী তিনি একজন মুসলমান । সুতরাং তার কবর জিয়ারত করা এটা কোনো নাটকীয় বিষয় নয়, কিংবা গোপন বিষয় নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করার পরে তার সফরসঙ্গী সাংবাদিকরা ঢাকায় যার যার সংবাদ সংস্থা ও পত্রিকায় রিপোর্টও করেন। পরদিন সংবাদটি জাতীয় দৈনিক গুলাতে গুরত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে । এই সংবাদ নিয়ে লুকুচুরির কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়। একজন জাতীয় নেতার প্রতি শ্রোদ্ধা জানাতে তারেক রহমান সেখানে গিয়েছিলেন এবং তা প্রকাশ্যে। শেখ মুজিবুর রহমান কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতা নন যে তার মাজারে গোপনে যেতে হবে। আমরা সকলেই জানি, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া মারা গেলে তাঁর মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া শোক জানাতে সেখানে উপস্থিত হন। এটা বিএনপির আদর্শ। ব্এিনপি গোপনে কিছু করতে পছন্দ করেনা। একজন মানুষের সাথে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে কিন্তু একজন মৃত ব্যক্তির সাথে কোনো শত্রুতা থাকতে পারেনা। তাই সেদিন তারেক রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন বলেই আমরা মনে করি । কোনো নেতার কবর জিয়ারত করলে বা তার প্রতি সম্মান দেখালে তার সকল কর্মকান্ডকে সমর্থন দেয়া বুঝায় না অথবা এতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একমাত্র নায়ক হয়ে যান না। কিন্তু আওয়ামীলীগের রাজনীতি তার উল্টো।

আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানকে দেবতার আসনে বসাতে চায়। শেখ মুজিবুর রহমান যে একজন মানুষ এটা তারা ভুলে যান। আর দেবতার আসনে বসাতে গিয়েই যত বিপত্তি। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একজনকে সকল কৃতিত্ব দিতে গিয়ে অন্যদের এমনকি সম্মুখ সমরে যারা জীবন বাজী রেখে লড়াই করেছেন তাদেরকে ও ইতিহাস থেকে তারা মুছে দিতে চায়। আর এজন্য বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঐতিহাসিক দালিলিক প্রমানের ভিত্তিতে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

তারেক রহমানের বিভিন্ন বক্তব্য ও সম্প্রতি তাঁর সম্পাদিত 'বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান' গ্রন্থে উলে¬খ করেছেন যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এমনকি ২৫ মার্চ যখন স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ চালায় তখনও স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানান সে সময়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিব। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর“, তাজউদ্দিন আহমদ : নেতা ও পিতা“ কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের উপ অধিনায়ক একে খন্দকারের লেখা “৭১ : ভেতরে বাইরে‘সহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইতে এর প্রমাণ রয়েছে। এতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম তাজউদ্দিন আহমদ ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার আহবান জানালেও মুজিব স্ব^াধীনতার ঘোষণা দেননি, এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেও অস্বীকৃতি জানান। শুধু অস্বীকৃতিই নয় তিনি তাজউদ্দিনকে পরামর্শ দিয়ে বলেন “যাও নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও আমি ২৭ মার্চ হরতাল ডেকে দিয়েছি“। আর পাকিস্তানিরা যাতে তাকে দেশদ্রোহী বলতে না পারে এজন্য শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছেন, স্বাধীনতাকামী লাখো জনতাকে হামলার মুখে রেখে শেখ মুজিব কেমন করে পাকিস্তানীদের কাছে আত্মসমর্পন করলেন ? কেন তিনি বাংলাদেশের জনগনকে বিশ্বাস করতে পারলেননা। কেন তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো স্বাধীনতাকামী জনতার আহবান স্বত্ত্বেও স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হলেন ? কেন ভাষণ শেষ করলেন ‘জয় পাকিস্তান‘ বলে ? এইসব প্রশ্ন অবান্তর নয়।

তিনি আরো উলে¬খ করেছেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন অ¯’ায়ী রাষ্ট্রপতি হিসোবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খন্ড, মঈদুল হাসানের “মূলধারা ৭১“, আওয়ামী লীগ নেতা মেজর রফিক-উল-ইসলাম বীরোত্তমের “এ টেল অব এ মিলিয়নস“, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শফিউল্লাহ‘র “বাংলাদেশ এট ওয়ার“, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সুবিদ আলী ভূইয়া‘র “মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস“ বইসহ অনেক বইপত্র ও সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় এই বক্তব্যের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

তিনি বলেছেন তার দেয়া বক্তব্য, দেশের সকল গনমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও প্রমাণ রয়েছে তিনি কোন মনগড়া কথা বলেন নি । যা বলেচেন তথ্যপ্রমাণ উদ্বৃত করেই বলেচেন। বিকৃতি এবং চাপিয়ে দেয়া ইতিহাসের পরিবর্তে দলীল প্রমাণসহ তিনি ইতিহাসের কিছু বাস্তব সত্য জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন মাত্র। ইতিহাসের ভিত্তিতে কিছু সত্য তথ্য উচ্চারণে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলা করা হয়েছে। তিনি তার বক্তৃতায় বলেছেন কথায় কথায় দেশদ্রোহী মামলা হবে কেন? ইতিহাসের প্রকৃত সত্য সবার সামনে উপস্থাপন করার জন্য যদি তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলা হতে হয়, তাহলে সেটি হওয়া উচিত শেখ মুজিবের নামে। কারণ শেখ মুজিব একজন পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে এসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম ও শত্রুমুক্ত। অথচ ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বরেরও কমপক্ষে ২৫ দিন পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী শেখ মুজিব স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরেছিলেন পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে। যে কোন যুক্তিতেই হোক, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার পর অন্য দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করা মানে আইনের দৃষ্টিতে তিনি ওই দেশেরই নাগরিক। বাংলাদেশের বিজয় দিবসের পরও বিনাবাক্য ব্যয়ে সজ্ঞানে পাকিস্তানের পাসপোর্ট গ্রহণ করে শেখ মুজিব পাকিস্তানের নাগরিকত্ব কবুল করেছেন। এটাই আইনের কথা। অতএব পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তার নাগরিকত্ব আইনের দৃষ্টিতেই বিচার্য। কিš‘ আমরা দেখেছি শেখ মুজিব পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে ফিরে এসেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। অতএব একজন পাকিস্তানী নাগরিক কেমন করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিলেন সেই প্রশ্নের আইনগত নিষ্পত্তির জন্য শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলা হওয়া জরুরী বলে মনে করেন তিনি ।

১৯৭৫ এর পট পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট একদলীয় বাকশালের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছিলেন। কিš‘ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যারা সেদিন শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র তৈরী করেছিলেন, ১৫ আগষ্ট যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিব নিরাপদে যেতে না পারেন সেইজন্য সুইসাইড স্কোয়ার্ড গঠন করেছিলেন, যারা শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাতে চেয়েছিলেন, যারা বিদেশী মিডিয়ায় সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন শেখ মুজিব ছিলেন স্বৈরাচারী... সেইসব লোকরাই এখন শেখ হাসিনার নেতা মন্ত্রী। সেইসব নেতামন্ত্রীরাই এখন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তার পরিবার সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগনকে বিভ্রান্ত করছেন।

ইতিহাসের তথ্য দিয়ে তিনি আরো বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৬ আগস্ট বাকশাল নেতা খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। গঠন করেন মন্ত্রীসভা। শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভার প্রায় সকলেই খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় শপথ নেন। খন্দকার মোশতাক ছিলেন শেখ মুজিবের একমাত্র আদর্শ বাকশালের ৪ নং সদস্য। সে সময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান কে. এম. শফিউল-াহ, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, রক্ষী বাহিনী, বিডিআর ও আনসারসহ সব বাহিনীর প্রধানরা নতুন এই সরকারের প্রতি আনুগত্য ও সমর্থন ব্যক্ত করেন। মোশতাক সারাদেশে সামরিক আইন জারি করেন। ঐ সময় সেনাপ্রধান ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এবং সেসময়কার জেনারেল শফিউল¬াহ। শহীদ জিয়া সেই সময় ছিলেন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ। শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডে পরে মোশতাকের মন্ত্রীসভার শপথ অনুষ্ঠানে বিজয়ীর বেশে গিয়েছিল কর্নেল (অবHappy তাহের-হাসানুল হক ইনু বাহিনী এবং তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী নেতারা।

৭৫ সালের শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের সময়কার ঘটনা দেখা এবং জানার মানুষের সংখ্যা এখনও অসংখ্য। ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে শেখ মুজিবের জ্ঞাতসারেই তিনটি ট্যাংক ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজপথে বেরিয়ে এসেছিলো। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এই কথাটি সম্প্রতি একটি লেখায় জানিয়েছেন। কেন ট্যাংক নামিয়েছিলেন সেটিও শেখ মুজিব নিজেই বলেছিলেন। র্বর্তমানে শেখ হাসিনার প্রিয় মানুষ ইনু আনোয়ার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতেই সেদিন শেখ মুজিব ট্যাংক নামিয়েছিলেন। অথচ এই ইনু বাহিনীই এখন শেখ হাসিনার কাধে ভর দিয়ে ইতিহাস বিকৃতির খেলায় মেতেছে। শেখ হাসিনাও সুর মিলিয়েছেন তার পিতা হত্যাকারীদের মদদদাতাদের সঙ্গে।

তারেক রহমানের এসব তথ্যের সত্যতা বিচার হবে ইতিহাসের আলোকে। তারেক রহমান যে সভাগুলোতে দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে এসব তথ্যাদি উপস্থাপন করেছেন, সেখানে তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন এর বিপরীতে কোনো দলিল প্রমাণ থাকলে সেটি উপস্থাপন করার জন্য। তারেক রহমানের বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন সরকারের এমন কিছু লোক কোনো প্রকার যুক্তিবুদ্ধি ছাড়াই লাঠিয়াল বাাহনীর সর্দারের মত মাঠে নেমেছেন যাদের অতীত প্রশ্নবিদ্ধ । শেখ মুজিবের এককালের কঠিন শত্রু যারা তার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাতে চেয়েছিলেন সেই ইনু-মতিয়া এখন শেখ হাসিনার চেয়েও শেখ মুজিবের বড় ভক্ত। এরা ইতিহাসের সত্য প্রমাণের পরিবর্তে হুমকি-ধমকি শুরু করেছেন। আসলে যারাই স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাস লেখায় মনোনিবেশ করেছেন, তাদের কাউকে কাউকে সর্বদা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আওয়ামী হুমকী ধামকী আর দলদাস বুদ্ধিজীবিদের নির্যাস হুঙ্কার । ইতিহাস রচনাকারীদের কেউ কেউ আবার করাচি কিংবা কলকাতা ফেরত বুদ্ধিজীবী অথবা হানাদারদের মুরগি সাপ¬াইকারী মুক্তিযোদ্ধাদের গোত্রভুক্ত যারা নিজেদের পাপ ঢাকতে পোপের চেয়েও বড় ক্যাথলিক। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হাফেজ হাকিম আজিজুল হকের পয়গাম পত্রিকার হকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলে পাকিস্তান সরকারের কর্মচারীদের ভাই-ভাতিজাদের পাপ মোচনের উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাস রচনার প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে কিছু মানুষের কলমে কিছু ইতিহাস উঠে এসেছে। তারেক রহমানের প্রতিটি বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপরের ঘটনার রয়েছে অনেক চুলচেরা বিশে¬ষণ। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো কিভাবে যে পারস্পরিক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আগলভেঙ্গে বেরিয়ে আসে অনেক সত্যকথন যা ঘটনার প্রতিপক্ষ নিজেও টের পান না।

বিষয়: বিবিধ

১১১৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

284945
১৬ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:১২
ফেরারী মন লিখেছেন : ভালো লাগলো আপনার বিশ্লেষণধর্মী লেখাটা। আসলেই সত্য কখনো গোপন থাকে না এক সময় না এক সময় বেরিয়ে আসেই।
১৮ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:৫৯
228794
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File