মাওলানা মওদুদী'র জন্য বিবৃতি দিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানী
লিখেছেন লিখেছেন আরাফাত হোসাইন ৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ০৮:৩২:৪৯ রাত
আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা(বর্তমান আওয়ামী লীগ) সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, উপমহাদেশের কৃষক আন্দোলনের অগ্রনায়ক।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা,ইসলামী আন্দোলনের অগ্রনায়ক মাওলানা সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী।
১৯৫৩ সালের আটাশে মার্চ হঠাৎ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের কোন কারণ বলা হলো না।
লাহোরের সামরিক আদালত মাওলানা সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড এবং পরে তা প্রত্যাহার করে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এ দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে শুধু পাকিস্তানেই নয়, সমগ্র মুসলিম জগতে যে তুমুল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তার দৃষ্টান্ত অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠায় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর প্রতি এহেন আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে হরতাল, শোভাযাত্রা, সভা-সমিতি প্রভৃতি শুধু বড় বড় শহর ও রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ রইল না, বরঞ্চ দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহর ও গ্রামাঞ্চলেও বিক্ষভের অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। নিভৃত পল্লী থেকে বড় বড় শহর পর্যন্ত সকল স্থান থেকে অগণিত টেলিগ্রাম, পত্র ও প্রস্তাবাদির মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দাধ্বনি মুখলিত হতে লাগলো। এই যে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ, এ কোন সাময়িক উত্তেজনা কিংবা ভাবপ্রবণতার বশে প্রদর্শন করা হয়নি। এ ছিল প্রকৃতপক্ষে মাওলানার প্রতি মুসলিম জগতের স্থায়ী শ্রদ্ধার স্বতস্ফুর্ত অভিব্যক্তি। এটি জল বুদবুদের ন্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে হঠাৎ বিলনি হয়ে যায়নি। এ বিক্ষোভ প্রতিবাদ চলেছে অবিরাম পাঁচ মাস ধরে। যারা অতীতে খেলাফত ও কংগ্রেস আন্দোলনের যুগে নানা প্রকার বিক্ষোভ-প্রতিবাদ লক্ষ্য করেছেন, তারাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন যে, এ ধরনের বিক্ষোভ, আন্তরিক সমবেদনা, শোক ও কাতর ফরিয়াদ ইতঃপূর্বে কখনও দেখা যায়নি।
আরব, মিসর, ইরাক, সিরিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দ এর তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। সে সব দেশে সংবাদপত্রগুলির সম্পাদকীয় প্রবন্ধে পাকিস্তান সরকারের আচরণের নিন্দা করে মাওলানার আশু মুক্তি দাবি করা হয়।
পকিস্তানে নিম্নলিখিত সংবাদপত্রের সম্পাদকগণও এক স্মারকলিপির মাধ্যমে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেনঃ
করাচীঃ দৈনিক জং, দৈনিক আনজাম, দৈনিক মিল্লাত, টাইমস অব করাচী, দৈনিক ইমরোজ, দৈনিক আল মুন্তাজের, দৈনিক ইকবাল, দৈনিক আসরে জাদীদ, দৈনিক মুসলমান, দৈনিক নয়া রুশনী, দৈনিক শবনম, দৈনিক ওয়াতন, দৈনিক নয়ী সিন্ধ, আল অহীদ, মাকাসেদ, সাপ্তাহিক জাহানে নও, পাক্ষিক নিমকদান, মাসিক ফারান, মাসিক রিয়াজ, মাসিক মুশীর, মাসিক চেরাগে রাহ, পাক্ষিক স্টুডেন্টস ভয়েস, মাসিক কালীম প্রভৃতি।
ঢাকাঃ দৈনিক পাসবান, আজাদ, আংগারা, সিতারা, মর্নিং নিউজ, সাপ্তাজিক আল কায়েদ (ইংরেজী), দি মেইল, সাপ্তাহিক দৈনিক ও নিজামে ইসলাম।
পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে মাওলানার মুক্তি দাবি করেন, তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী খাজা নাযিমুদ্দীন, মিঃ এম. গাযদার, মিঃ হুসাইন ইমাম, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী, পীর গোলাম মুহাদ্দিদ সিরহিন্দী, মাওলানা আকরাম খাঁ, মাওলানা দীন মুহাম্মদ খান,মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং মাওলানা রাগেব আহসানের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
“কাদিয়ানী সমস্যা” পুস্তিকার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে বিদ্বেষ প্রচার এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অভিযোগে মাওলানা মওদুদীর এবং তাঁর সহকর্মী মালিক নসরুল্লাহ খান আজিজ ও জনাব নকী আলীকে সামরিক আদালতে অভিযুক্ত করা হয়। উক্ত অভিযোগেই মাওলানা মওদূদীর প্রতি ৮ই মে সামরিক আদালত কর্তৃক ফাঁসীর আদেশ দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে এ কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না যে, এক শ্রেণীর ইসলাম ও ইসলামী শাসনতন্ত্র বিরোধী লোক মাওলানা মওদূদীর প্রতি এ মিথ্যা অভিযোগ করে থাকেন যে, পাঞ্জাবের কাদিনয়ানী দাঙ্গার জন্যে তিনি প্রধানত দায়ী এবং তাঁরই উস্কানিতে তথায় হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে। উপরে যে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিক কার্যক্রম আলোচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে কোথাও কণামাত্র অসত্য অথবা অতিরঞ্জনের লেশ নেই। এ আমরা গর্ব করে বলতে পারি। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, মাওলানা মওদূদী পাঞ্জাবের দাঙ্গার জন্যে দায়ী ছিলেন। স্বার্থবাদী লোকেরা একে “কাদিয়ানী দাঙ্গা” আখ্যা দিয়েছে এবং প্রথম কথা এই যে, এটা মোটেই “কাদিয়ানী দাঙ্গা” ছিল না এবং এতে হাজার হাজার লোকও নিহত হয়নি। কাদিয়ানীদের অমুসলিম সংখ্যালঘু হিসাবে ঘোষণা করার জন্যে সর্বদলীয় কনভেনশন সরকারের নিকট দাবি জানান। সরকার এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করলে উক্ত কনভেনশন সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম (Direct Action) অবলম্বন করে। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে সংগ্রাম। একে দমন করার জন্যে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১১ জন নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়। (মুনির রিপোর্ট-পৃঃ ১ দ্রষ্টব্য)।
মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলাম এ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা বরঞ্চ সর্বদলীয় কনভেনশনের “প্রত্যক্ষ সংগ্রামের” ও বিরোধিতা করেছে এবং জনসাধারণকেও তা থেকে বিরত থাকার জন্যে আবেদন জানিয়েছে। তাঁর প্রতি উক্ত অভিযোগ যে সম্পূর্ণ বিদ্বেষপ্রসূত, অমূলক ও ভিত্তিহীন, তা যে কোন বিবেকসম্পন্ন নিরপেক্ষ ব্যক্তি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করবেন।
মুনির রিপোর্টের কোথাও এ গোলযোগের জন্যে মাওলানাকে দায়ী করা হয়নি। এর জন্যে প্রধান দায়ী অধুনালুপ্ত আহরার দলের নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য দলকেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছে। মজার ব্যাপার এই যে, দেশের এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী আদর্শহীন রাজনৈতিক দল আহরার দল প্রধানদেরকে নিয়ে নিজেদের দল গঠন করে আপন অপকর্ম ঢাকবার জন্যে মাওলানা মওদুদীকে পাঞ্জাব হাঙ্গামার জন্যে দায়ী করে।
আরও মজার ব্যাপার এই যে, সরকারী ভাষায় পাঞ্জাবের গোলযোগ (Punjab Disturbance) সংগঠিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। এটা ছিল সরকার ও জনগণের মধ্যে সংগ্রাম। এ গোলযোগের সাথে জামায়াতে ইসলামী তথা মাওলানা মওদূদীর দূরতম সম্পর্কও ছিল না।
অপরদিকে যে “কাদিয়ানী সমস্যা” বই লেখার অপরাধে মাওলানার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়, পাঞ্জাব গোলযোগের সাথে সে বইয়েরও কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামের হঠকারী ও অন্ধ দুশমনেরা এভাবেই মারাত্মক ভুল করেছে। যে বইয়ের জন্যে প্রাণদণ্ডাদেশ হলো, সে বই বাজেয়াফত হলো না, কোনদিন হয়নি, এখনো সে বই বাজারে পাওয়া যায়। সে বইয়ের মধ্যে এমন একটি ছত্রও নেই যার জন্যে লেখকের কোন ন্যূনতম শাস্তিও হতে পারে। কিন্তু বিনা দোষে হলেও ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তাকে রাতারাতি শেষ করতে হবে। অতএব একটা কারণ তো দেখাতেই হবে। কাদিয়ানী সমস্যা নামটিতেই ইসলামের দুশমনরা মনে করেছিল এটা একটা মারাত্মক গ্রন্থ। বইখানা পাঠ না করেই তাদের সম্ভবত এ ধারণা জন্মেছিল যে, বইখানিতে কাদিয়ানী নিধনের উস্কানি দেওয়া হয়েছে। বইখানা পড়ে দেখারও তাদের সময় ছিল না। এমনকি যে বইয়ের জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে, তা বাজেয়াফত করারও চিন্তা মনের মধ্যে আসেনি।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন কতিপয় ব্যক্তি তাদের মনের ব্যাধি গোপন করে ইসলামী আন্দোলনের মূল্যেৎপাটন করতে চেয়েছিল। তা পারেনি, তাদের গোপন মানসিকতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ইসলামী আন্দোলন মরেনি, মাওলানা মওদূদীও মরেনি। কিন্তু প্রতিপক্ষের অপমৃত্যু ঘটেছে। তাদের অপমৃত্যু আমাদের কাছে আনন্দের নয়। তবে এটাই ইতিহাসের নির্মম বিচার।
“আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে এবং তারা (বিপদে-আপদে, অত্যাচার ও উৎপীড়ন) আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট আছেন। তারাই আল্লাহর দলভুক্ত। অতএব সাবধান, মনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর দল জয়যুক্ত হবে। (মুজাদালা ২২)া
বই: মাওলানা মওদুদী (র)
লেখক: আব্বাস আলী খান
বিষয়: রাজনীতি
১৪৪০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন