নমরূদের খোদা দাবী করা
লিখেছেন লিখেছেন নেনাভাই ০৮ আগস্ট, ২০১৪, ১০:০৬:৫৮ রাত
আমাদের সমাজে একটা কথা খুব বেশী প্রচলিত আছে যে, নমরুদ নিজকে খোদা দাবী করেছিল । এ সম্পর্কিত বর্নণা রয়েছে সুরা বাকারার ২৫৮ নং আয়াতে। আসুন আয়াতটি একটু পর্যালোচনা করে দেখি নমরুদ নিজকে কী দাবী করেছিল?
আল্লাহ বলেন-
﴿ اَلَمۡ تَرَ اِلَى الَّذِىۡ حَآجَّ اِبۡرٰهٖمَ فِىۡ رَبِّهٖۤ اَنۡ اٰتٰٮهُ اللّٰهُ الۡمُلۡكَۘ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ رَبِّىَ الَّذِىۡ يُحۡىٖ وَيُمِيۡتُۙ قَالَ اَنَا۟ اُحۡىٖ وَاُمِيۡتُؕ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ فَاِنَّ اللّٰهَ يَاۡتِىۡ بِالشَّمۡسِ مِنَ الۡمَشۡرِقِ فَاۡتِ بِهَا مِنَ الۡمَغۡرِبِ فَبُهِتَ الَّذِىۡ كَفَرَؕ وَاللّٰهُ لَا يَهۡدِىۡ الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِيۡنَ ۚ﴾
তুমি সেই ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করোনি, যে ইবরাহীমের সাথে তর্ক করেছিল ? তর্ক করেছিল এই কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব কে ? এবং তর্ক এ জন্য করেছিল যে, আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছিলেন যখন ইবরাহীম বললোঃ যার হাতে জীবন ও মৃত্যু তিনিই আমার রব৷ জবাবে সে বললোঃ জীবন ও মৃত্যু আমার হাতে ৷ ইবরাহীম বললোঃ তাই যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে, আল্লাহ পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠান,দেখি তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও ৷ একথা শুনে সেই সত্য অস্বীকারকারী হতবুদ্ধি হয়ে গেলো কিন্তু আল্লাহ জালেমদের সঠিক পথ দেখান না ৷ _(সূরা বাকারা-২৫৮)
কে ছিল নমরুদ ?
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বদেশভূমি ইরাকের বাদশাহ ছিল এই নমরুদ ৷ এখানে যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে বাইবেলে তার প্রতি কোন ইংগিত নেই৷ তবে তালমূদে এই সমগ্র ঘটনাটিই বিবৃত হয়েছে ৷ কুরআনের সাথে তার ব্যাপক মিলও রয়েছে৷ সেখানে বলা হয়েছেঃ হযরত ইবরাহীমের (আ) পিতা নমরুদের দরবারে প্রধান রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর (Chief officer of the state) পদে অধিষ্ঠিত ছিল৷ হযরত ইবরাহীম (আ) যখন প্রকাশ্যে শিরকের বিরোধিতা ও তাওহীদের প্রচার শুরু করে এবং দেব-মন্দিরে প্রবেশ করে প্রতিমাগুলো ভেঙে দেন তখন তাঁর পিতা নিজেই বাদশাহর দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা পেশ করে তারপর বাদশাহর সাথে তাঁর যে বিতর্কালাপ হয় তাই এখানে উল্লেখিত হয়েছে৷
কি বিতর্ক হয়েছিল?
অর্থাৎ যে বিষয়টি নিয়ে এ বিতর্ক চলছিল সেটি ছিল এই যে ইবরাহীম (আ) কাকে নিজের রব বলে মানেন ? আর এ বিতর্কটি সৃষ্টি হবার কারণ ছিল এই যে, বিতর্ককারী ব্যক্তি অর্থাৎ নমরুদে আল্লাহর রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছিলেন৷ এই দু'টি বাক্যের মধ্যে বিতর্কের ধরনের প্রতি যে ইংগিত করা হয়েছে তা বুঝবার জন্য নিম্নলিখিত বাস্তব বিষয়গুলো সামনে রাখা প্রয়োজন৷
একঃ প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত মুশরিক সমাজগুলোর এই সম্মিলিত বৈশিষ্ট দেখা গেছে যে,তারা আল্লাহকে সকল খোদার প্রধান খোদা, প্রধান উপাস্য ও পরমেশ্বর হিসেবে মেনে নেয় কিন্তু একমাত্র তাঁকেই আরাধ্য, উপাস্য, মাবুদ ও খোদা হিসেবে মানতে প্রস্তুত হয় না৷
দুইঃ আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে মুশরিকরা চিরকাল দু'ভাগে বিভক্ত করে এসেছে৷ একটি হচ্ছে, অতি প্রাকৃতিক (Super natural) খোদায়ী ক্ষমতা৷ কার্যকারণ পরম্পরার ওপর এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং মুশরিকরা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য এর দোহাই দেয়৷ এই খোদায়ীর ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর সাথে অতীতের পুন্যবান লোকদের আত্মা, ফেরেশতা (দেবতা), জিন, নক্ষত্র এবং আরো অসংখ্য সত্তাকে শরীক করে৷ তাদের কাছে প্রার্থনা করে৷ পূজা ও উপাসনার অনুষ্ঠানাদি তাদের সামনে সম্পাদন করে৷ তাদের আস্তানায় ভেট ও নজরানা দেয়৷ দ্বিতীয়টি হচ্ছে তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের খোদায়ী (অর্থাৎ শাসন কর্তৃত্ব) ক্ষমতা৷ জীবন বিধান নির্ধারণ করার ও নির্দেশের আনুগত্য লাভ করার অধিকার তার আয়ত্বাধীন থাকে৷ পার্থিব বিষয়াবলীর ওপর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্ণ ক্ষমতা তার থাকে৷ দুনিয়ার সকল মুশরিক সম্প্রদায় অথবা তার সাথে রাজপরিবার, ধর্মীয় পুরোহিত ও সমাজের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কালের মনীষীদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছে ৷ বেশীর ভাগ রাজপরিবার এই দ্বিতীয় অর্থে খোদায়ীর দাবীদার হয়েছে৷ তাদের এই দাবীকে শক্তিশালী করার জন্য আবার তারা সাধারণভাবে প্রথম অর্থে খোদাদের সন্তান হবার দাবী করেছে৷ এ ব্যাপারে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো তাদের ষড়যন্ত্রে অংশীদার হয়েছে৷
তিনঃ নমরুদের খোদায়ী দাবীও এই দ্বিতীয় ধরনের ছিল৷ সে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না৷ নিজেও পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা ও পরিচালক বলে সে দাবী করতো না৷ সে একথা বলতো না যে, বিশ্ব-জগতের সমস্ত কার্যাকারণ পরম্পরার ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে৷ বরং তার দাবী ছিল, আমি এই ইরাক দেশ এবং এর অধিবাসীদের একচ্ছত্র অধিপতি৷ আমার মুখের কথাই এ দেশের আইন৷ আমার ওপর আর কারো কর্তৃত্ব নেই৷ কারো সামনেই আমাকে জবাবদিহি করতে হবে না৷ ইরাকের যে কোন ব্যক্তি এসব দিক দিয়ে আমাকে রব বলে মেনে নেবে না অথবা আমাকে বাদ দিয়ে আর কাউকে রব বলে মেনে নেবে, সে বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক৷
চারঃ ইবরাহীম আল্লাইহিস সালাম যখন বললেন, আমি একমাত্র রবুল আলামীনকে খোদা, মাবুদ ও রব বলে মানি, তাঁর ছাড়া আর সবার খোদায়ী, প্রভূত্ব ও কর্তৃত্ব অস্বীকার করি, তখন কেবল এতটুকু প্রশ্ন সেখানে দেখা দেয়নি যে, জাতীয় ধর্ম ও ধর্মীয় মাবুদদের ব্যাপারে তাঁর এই নতুন আকীদা ও বিশ্বাস কতটুকু সহনীয়, বরং এই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে যে, জাতীয় রাষ্ট্র ও তার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা-কর্তৃত্বের ওপর এই বিশ্বাস যে আঘাত হানছে তাকে উপেক্ষা করা যায় কেমন করে? এ কারণেই হযরত ইবরাহীম (আ) বিদ্রোহের অপরাধে নমরুদের সামনে আনীত হন৷
যদিও হযরত ইবরাহীমের (আ) প্রথম বাক্যের একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ রব হতে পারে না তবুও নমরুদ হঠধর্মিতার পরিচয় দিয়ে নির্লজ্জের মতো তার জবাব দিয়েছে৷ কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যের পর তার জন্য আবার হঠধর্মী হবার আর কোন সুযোগই ছিল না৷ সে নিজেও জানতো, চন্দ্র-সূর্য সেই আল্লাহরই হুকমের অধীনে যাকে ইবরাহীম রব বলে মেনে নিয়েছে৷ এরপর তার কাছে আর কি জবাব থাকতে পারে? কিন্তু এভাবে তার সামনে যে দ্ব্যর্থহীন সত্য আত্মপ্রকাশ করেছিল তাকে মেনে নেয়ার মানেই ছিল নিজের স্বাধীন সার্বভৌম প্রভুত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব পরিহার করা৷ আর এই কর্তৃত্ব পরিহার করতে তার নফসের তাগুত মোটেই প্রস্তুত ছিল না৷ কাজেই তার পক্ষে নিরুত্তর ও হতবুদ্ধি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল৷ আত্মপূজার অন্ধকার ভেদ করে সত্য প্রিয়তার আলোকে প্রবেশ করা তার পক্ষে সম্ভবপর হলো না৷ যদি এই তাগুতের পরিবর্তে আল্লাহকে সে নিজের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেব মেনে নিতো, তাহলে হযরত ইবরাহীমের প্রচার ও নসিহত প্রদানের পর তার জন্য সঠিক পথের দ্বার উন্মক্ত হয়ে যেতো৷
হযরত ইবরাহীম আ. এর শাস্তি-
তালমূদের বর্ণনা মতে, তারপর সেই বাদশাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীমকে বন্দী করা হয়৷ দশদিন তিনি কারাগারে অবস্থান করেন৷ অতপর বাদশাহর কাউন্সিল তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার যে ঘটনা ঘটে তা সূরা আম্বিয়ার ৫ম রুকূ', আনকাবুতের ২য় ও ৩য় রুকূ' এবং আস সাফ্ফাতের ৪র্থ রুকূ'তে বর্ণিত হয়েছে৷
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন