গাজার রক্ত ইসরাইলের চিন্তার কারণ

লিখেছেন লিখেছেন পাঠ প্রক্রিয়া ০৭ আগস্ট, ২০১৪, ০৫:২৮:০৮ বিকাল

গাজা থেকে ইসরাইল সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে অনেক রক্তক্ষয়ের পর। প্রায় দুই সহস্রাধিক নিরীহ ফিলিস্তিনী জনগণকে হত্যার দায় নিতে হবে ইসরাইলকে। অনেকটা উপায়ন্তর না দেখে এই প্রস্থান। মুখে না বললেও এবার যে ইসরাইল হামাসের হাতে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এবারের মতো এরকম ক্ষতির মুখে ইসরাইল আগে কখনো পড়েনি। এর আগে একবার লেবাননে হিজবুল্লাহর কাছে তাদের পরাজয় হয়েছিল।

এবারে পরাজয় ইসরাইলের জন্য যেমন সামরিক পরাজয়, একই সঙ্গে মানসিক পরাজয়ও বটে। বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে তাদের অবস্থানগত পরাজয়ও হয়। পণ্যবর্জনের মুখে তাদের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে। ধারণা করা হয় প্রায় চল্লিশ ভাগ ব্যবসা কমে যেতে পারে। সামরিক হামলায় প্রচুর মরণাস্ত্র ধ্বংস হয়েছে। এসবের আর্থিম মূল্যও ইসরাইলকে এখন দিতে হবে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে, ব্লগগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পরলেও গণমাধ্যমগুলোতে এসংক্রান্ত খবর ছিল না তেমন। হয়ত সেন্সর ছিল। না হয় ইসরাইলের বিরুদ্ধে যায় বলে তা চেপে যাওয়া হয়েছে। এসব ক্ষয়ক্ষতির জন্য আবার তাকে নতুন করে বাজেট করার কথা ভাবতে হবে। যদিও ধারণা করতে পারা যায় আমেরিকা সেই ঘাটতি পূরণে বড় ধরনের সহায়তা করবে। হয়ত মুসলিম দেশগুলোর কেউ কেউ এর সাথে শরিক হতে পারে।

প্রায় একটা শক্ত প্রতিরোধের মুখে গণহত্যা পড়ে ইসরাইল ভেবাচেকা খেয়ে যায় যা তাদের বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের মন্ত্রীদের মুখেও হামাসের শক্তি সম্পর্কে, তাদের ঘায়েল করতে না পারা সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখা গেছে। তবে এই যুদ্ধের ফলে জঘন্যভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের, চেহারা উন্মোচিত হয়। প্রকাশ্যে কেউ কেউ ইসরাইলের পক্ষে সমর্থন নেয় যা সত্যি মুসলমানদের জন্য দুর্ভাগ্যের ও বড় লজ্জার। ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে তাতে আরব জাহানের অনেকেই গর্ববোধ করেন।

ধন্যবাদ ওয়ার্সি, ইসরাইলের হামলার প্রতিবাদে বৃটিশ মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের জন্য। সিনিয়র বৃটিশ মন্ত্রী সৈয়দা ওয়ার্সি ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধে বৃটিশ সরকারের গৃহীত নীতিকে তিনি কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারেননি বলে পদত্যাগ করেছেন। একটি টুইটার বার্তায় তিনি এমনটি নিজেই জানিয়েছেন। তার টুইটার বার্তাটি ছিল এরকম, With deep regret I have this moring written to the Prime Minister & tendered my resignation. I can no longer suport Govt policy on Gaza. (গভীর অনুতাপের সাথে এই সকালে আমি প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছি এবং আমার পদত্যাগ পত্র পেশ করেছি। গাজা বিষয়ে আমি কোনোভাবেই সরকারী নীতিমালাকে সমর্থন করতে পারি না)। তিনি বৃটেন সরকারের ইসরাইলের পক্ষে অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং তা নৈতিকভাবে অমার্জনীয় বলে উল্লেখ করেন। পদত্যাগ পত্রে এই সাহসী ও প্রতিবাদী নারী মন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাজ্যের (বর্তমান) অবস্থান “আইনের শাসন এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের দীর্ঘ সমর্থনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” তিনি আরো বলেন, গাজার সাম্প্রতিক সংকটের বিষয়ে সরকারের আচরণ এবং ভাষা নৈতিকভাবে অমার্জনীয়, বৃটেনের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়ভাবে আমাদের সুনামের উপর এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।”

সৌদী আরব, মিশরীয়, জর্ডান, আরব আমিরাত নৈতিক এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল ইসরাইলের পক্ষে। এটা ছিল মুসলমানদের জন্য একটি চরম লজ্জা ও অববামনাকর দিক। মিশর ও ইসরাইলের সাথে সৌদী দূতিয়ালী ছিল অমার্জনীয়। শত শত নিষ্পাপ শিশু সহ নারী, পুরুষের বর্বরোচিত হত্যায় তারা ছিল জঘন্য ভূমিকায়। তাদের এই ভূমিকা একজন মুসলমানের পক্ষে সহজে ভোলা সম্ভব নয়। তাদের এই ভূমিকা অনেক অমুসলিমদেরও হতবাক করে। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ সরাসরি গাজার পক্ষে অবস্থান নেয়। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকা সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত করে এবং তারা হতাশ হয়। তারপরও ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রকেট হামলায় ইসরাইল নির্বোধ ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। কাতার হামাসের পক্ষে ছিল। ইরান প্রত্যক্ষভাবে ঘোষণা দিয়ে গাজার পক্ষে তার সমর্থন ও অবস্থানের কথা জানায়।

অস্ত্র, প্রযুক্তি, অর্থ, সমর্থন ব্যতীতই হামাসের এই প্রতিরোধ ছিল সত্যি সাহসী। যেখানে হামাস বিপক্ষে ও গাজা নিশ্চিহ্ন করতে অস্ত্র, প্রযুক্তি, অর্থ, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনপুষ্ট যুদ্ধাপরাধী ইসরাইল এভাবে ধরাশায়ী হবে তা ইসরাইল ও তার পক্ষাবলম্বনকারীদের ধারণারও বাহিরে ছিল। তবে হামাস সারা বিশ্বের সমর্থন পেয়েছেন। গাজা পেয়েছে বিশ্ব নাগরিকদের সমর্থন ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসায় কোনো সীমানা ছিল না, কোনো ধর্ম বা বর্ণও ছিল না।

এই ইসরাইলি ধ্বংসলীলা চলাকালীন এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ইসরাইল সমস্যা জিইয়ে রাখার পিছনে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকা আছে। আর গাজার ঘটনার মধ্যে দিয়ে তথাকথিত আরব সরকারগুলোর ও আরব জনগণের মধ্যে গভীর বিভেদ পরিষ্কার হয়েছে। ইসরাইলের চেয়েও বেশি হামাসের ধ্বংস চায় আরব সরকারগুলো। তারা চায় তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। যার জন্য তারা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন করতেও দ্বিধা করেনি।

বিভিন্নভাবে এটা দেখা গেছে যে আরব জনগণ ইসরাইলকে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে দেখে থাকে এবং তারা হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল। ধারণার চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর লড়াকু শক্তিতে পরিণত হয়েছে হামাস, তারা সেটার প্রমাণও দিয়েছে এবং হামাসকে ধ্বংস করতে পারেনি ইসরাইল। বিষয়টি আজ সবাইকে স্বীকার করে নিত হচ্ছে। হামাসের কাছে মার খাওয়া ইসরাইলের জন্য হামাসের এই উত্থান রীতিমতো মাথা ব্যথার কারণ হিসেবে দেখা দেবে ভবিষ্যতে। হয়ত ইতোমধ্যেই তারা তাদের চিন্তার কারণে আরো দুঃশ্চিন্তার আগুন জ্বেলে দিয়েছে।

সার্বিকভাবে মুসলিম, অমুসলিম গোটা বিশ্ব গাজার গণহত্যার প্রতিবাদ করে। গাজার নিরীহ জনগণের প্রতি সমর্থন করে। ইসরাইলের প্রতি ধিক্কার জানায় এবং তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। সকলে প্রতিবাদ করে, ইহুদী পণ্য বর্জনের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। পশ্চিমা বিশ্বের সকল শান্তিকামী জনগণ কোনোভাবেই ইসরাইলের এই বর্বরতা মেনে নিতে পারে না।

এসব কিছুকে সামনে রেখে হামাসের টিকে যাওয়া হামাসের বিজয় হিসেবেই প্রমাণ করে। সৈন্য প্রত্যাহার আরেকটি বিজয়। ভবিষ্যতে গাজা থেকে ইসরাইলি অবরোধ শিথিল করাতে পারলে তা হবে হামাসের জন্য একটা বড় বিজয়। সার্বিকভাবে তা গাজা ও ফিলিস্তিনের একটি ঐতিহাসিক বিজয় হবে। দুবাই ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তৌফিক রহিম জেরুজালেম পোস্টকে বলেন, ‘গাজার রাস্তায় লাশ দেখে হতাশা থাকলেও হামাসের জয়ের ব্যাপারে আরব দুনিয়ায় সবাই একমত।’

আশা করা যায়, ভবিষ্যতে ইসরাইল এরকম জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে। গাজার রক্ত ভবিষ্যতে ইসরাইলের জন্য আরো শক্ত প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা যায়। ইসরাইলকে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবে অনেক কিছু। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নতুন করে দেখা দিতে পারে নতুন মেরুকরণের পথ। এখন থেকে তাই বিশ্লেষিত হবে নতুন ভাবে।

০৭.০৮.২০১৪

বিষয়: বিবিধ

৯০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File