বন্ধ হোক হত্যাকাণ্ড

লিখেছেন লিখেছেন Shopnil Shishir_MD Shariful Hasan ১৯ আগস্ট, ২০১৪, ০১:১২:৩৫ দুপুর



বাংলাদেশের মানুষ একটি স্লোগানের সঙ্গে খুব পরিচিত। স্লোগানটি হচ্ছে : ‘লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই; লড়াই করে বাঁচতে চাই’। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা চলছে, সে বিচারে তো বটেই; সামাজিক ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও ‘লড়াই’য়ের জায়গায় আমরা আর পৌঁছতেই পারছি না। লড়াই করার আগেই আমরা পরাজিত হচ্ছি। সামাজিক ক্ষেত্রে এই চিত্রটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে

Click this link

আগের দিনে আমাদের দেশে বিবদমান দুই গোষ্ঠী একে অপরকে উদ্দেশ করে বলত, তোকে মামলায় জড়াব, তোকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ব। তারা এখন আর মামলার কথা বলে না। এখন তারা চায়, মামলা নয় বরং প্রতিপক্ষ বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হোক। কারণ অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে বেশিরভাগ গরিব মানুষ বড় ধরনের রোগগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলেছে। গবেষক চিকিৎসকরা যখন বুক ফুলিয়ে দর্পিত কণ্ঠে বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো রোগ নেই যার চিকিৎসা নেই, তখন বাংলাদেশের গরিব মানুষ ভাবে অন্য কথা। আকাশছোঁয়া চিকিৎসার খরচ জোগাবে সাধ্য কার। তার চেয়ে মৃত্যু ভালো। এই যে চিকিৎসার খরচ জোগাতে না পেরে গরিব-দুঃখী রোগীর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা, ইংরেজিতে একে বলে মার্সি কিলিং। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে : ‘সদয় হত্যা’ বা ‘সহৃদয় হত্যা’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, পৃথিবীবিখ্যাত স্বাস্থ্য পত্রিকা দ্য ল্যানসেটের সমীক্ষাগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর তিন লাখেরও বেশি মানুষ ওষুধ, চিকিৎসকের মোটা অংকের ফি এবং বিভিন্ন রকম প্যাথলজিক্যাল টেস্টের খরচ বহন করতে না পেরে অসহায় হয়ে মৃত্যুকে শ্রেয়তর ভাবে। বড় রকমের এবং জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনরাও এই মার্সি কিলিংকে মেনে নেয়। টাকা-পয়সার অভাবে এছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথও খোলা থাকে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দ্য ল্যানসেটের মতে, গত দুই বছরে বাংলাদেশে ডাক্তারদের কনসালটেশন ফি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের খরচ দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি বেড়ে গেছে। আর ওষুধের দামের তো কোনো মা-বাপই নেই। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো চড়া হারে ফি বাড়িয়ে মধ্যবিত্ত আর নিু-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর গলায় অতি দ্রুত ঋণের মালা পরিয়ে দিতে কালবিলম্ব করছে না।

এর ভেতর পত্রিকাগুলোয় খবর প্রকাশিত হয়েছে, বাংলাদেশ ওষুধ প্রস্তুতকারক সমিতি নিজেদের ইচ্ছামতো ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে মাস দেড়েক অগে কৈফিয়ত চেয়েছিল ওষুধ শিল্পের মালিকদের কাছে। তারা জানিয়েছিলেন, বিদেশী ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এঁটে ওঠার জন্য ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছেন তারা। এর অর্থ হচ্ছে এই, মানুষ চিকিৎসা পাক বা না পাক, তদর্থে বাঁচুক বা না বাঁচুক, তাতে কিছু যায় আসে না- দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারকেরা বিদেশীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারলেই হল।

দ্য ল্যানসেট বাংলাদেশের বিষয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার ব্যয় বহন করে নিজের পকেট থেকে আর ৭২ শতাংশ মানুষ ওষুধপত্র কেনে গাঁটের পয়সা খরচ করে। দ্য ল্যানসেটের মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ শুধু চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। পত্রিকাটি তথ্য দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের ৪৮ শতাংশ মানুষ হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার জন্য যায় আর গ্রামাঞ্চলের ৩১ শতাংশ মানুষ এই সুযোগ নিয়ে থাকে। প্রতি ক্ষেত্রেই চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে ঋণ নিতে হয়, না হলে বাড়ি, ঘর-দুয়ার অথবা অন্য সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়।

এর কারণ, বাংলাদেশে যে শুধু ওষুধপত্রের দাম অথবা চিকিৎসকের ফি বেড়েছে তাই নয়, বরং এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর রমরমা ব্যবসা। যেমন এমআরআইয়ের খরচ ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা। সিটি স্ক্যান ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা। লিপিড প্রোফাইল ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। থাইরয়েড প্রোফাইল ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। সনোগ্রাফি ১ থেকে ২ হাজার টাকা।

এর বাইরে বিভিন্ন রকম অপারেশনের খরচও দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর কোনো মানদণ্ডও নেই। যত নামকরা ডাক্তার, তত বেশি ফি। ব্যাপারটিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ লোকই এখন বিশ্বাস করছে, যদি কোনো অপারেশন কম ফি দিয়ে করানো হয়, তাহলে জীবনের ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাবে। ফলে কেউ এখন আর একান্ত বাধ্য না হলে ওই ঝুঁকি নিতে চান না। আবার কিছু মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, সরকারি হাসপাতালগুলোয় ভালো চিকিৎসা হয় না। ভালো চিকিৎসা পেতে গেলে বেসরকারি হাসপাতাল অথবা ক্লিনিকগুলোয় যেতে হবে। বস্তুত কিছু দুষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন ক্লিনিক মালিক-চিকিৎসক ক্লিনিক ব্যবসাটা ভালোভাবে চালানোর জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধারণার সৃষ্টি করেছেন।

একটা সময় ছিল, যখন চিকিৎসা এক মহান পেশা হিসেবে চিহ্নিত হতো আমাদের দেশে। ফলে চিকিৎসকদের শ্রদ্ধার একটা আসনে বসানোর প্রবণতা ছিল মানুষের মধ্যে, যা আজ তিরোহিত। এর জন্য দায়ী কি শুধু রোগী ও তার পরিজনরাই, ডাক্তাররা নন?

চিকিৎসার এই যে লাগামছাড়া খরচ এবং সব মিলিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য চলছে, তা দেশের অসহায় আর গরিব চিকিৎসা প্রার্থীদের অনেককেই আজ মার্সি কিলিং বা সহৃদয় হত্যাকাণ্ডের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের মধ্যে এক নম্বরে আছে সরকার এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও ডাক্তারের ফি, চিকিৎসা ও সেবার কোনো মানদণ্ড সরকার বা বিএমডিসি আজও নির্ধারণ করতে পারেনি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর গলাকাটা ব্যবসার কথা তো বলাই বাহুল্য। চিকিৎসাব্যবস্থায় এই যে নৈরাজ্য আমাদের দেশে, এই চক্রে যুক্ত আছেন একশ্রেণীর কিছু স্বার্থপর চিকিৎসকও। আর তাদের জন্য সৎ ও নিষ্ঠাবান চিকিৎসকরাও আজ বদনামের অংশীদার হচ্ছেন। এসব বিষয়ে যারা ত্রাতার ভূমিকা নিতে পারে, সেই মিডিয়ার ভূমিকাও অস্বচ্ছ।

তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? এ নিয়ে যদি লড়াই করতে হয়, তাহলে সেই লড়াইটা তারা করবে কোথায়? মাঝে মাঝে পত্রিকাগুলোয় খবর প্রকাশিত হয়, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর পর রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা ভাংচুর করেছে ক্লিনিক বা হাসপাতাল। এসব করে সাময়িক উত্তেজনার প্রশমন ঘটে, কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান হয় না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রিত্বের পাঁচ বছর মেয়াদের প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে তার হাতে আরও কয়েকটা দিন সময় এখনও আছে। এ স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের আগামী দিনের সহৃদয় হত্যাকাণ্ড বন্ধে কোনো পদক্ষেপ তিনি নেবেন কি?

কে জানে? বাংলাদেশের গরিব, অসহায় আর সাধারণ মানুষ কিন্তু আশায় দিন গুনছে।

বিষয়: রাজনীতি

২৮৫১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

255872
১৯ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০২:২৮
মু. মিজানুর রহমান মিজান (এম. আর. এম.) লিখেছেন : মার্সি কিলিং!

গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট। আপনারা কী দুজন মিলে একটি আইডি খুলেছেন?
১৯ আগস্ট ২০১৪ বিকাল ০৪:১৬
199499
Shopnil Shishir_MD Shariful Hasan লিখেছেন : md shariful hasan amar name & virtual world & writting world evryone knew me as shopnil shisir
255905
১৯ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০৩:১৯
নূর আল আমিন লিখেছেন : কথা একটাই বন্ধ হোক বর্বরতা
১৯ আগস্ট ২০১৪ বিকাল ০৪:১৭
199500
Shopnil Shishir_MD Shariful Hasan লিখেছেন : ঠিক

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File