লালনের স্বীকারুক্তি, শাই শব্দটি কোরাণের। লালন পর্ব-১১
লিখেছেন লিখেছেন পাতা বাহার ২৬ আগস্ট, ২০১৪, ০৪:৩৩:১৩ বিকাল
লালন ঘরাণার যারা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন যে, লালন তার গানে বেদ, কোরাণ মানতে না করেছেন, এবং তিনি নিজেই বেদ, কোরাণের বাইরে নিজস্ব মতবাদ প্রচার করেছেন। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলবো যে, আপনারা লালনের এই গানটি পড়ার পরেও কি বলবেন যে, লালন বেদ কোরাণের বাইরে নিজস্ব মতবাদ প্রচার করেছেন? আসুন, দেখুন তো, এই গানে লালন কি বলতে চেয়েছেন তার ঘরাণার লোকদেরকে।
দিন থাকিতে মূর্ষীদ রতন চিনলে না।
হেন যে সাধেরো জনম, বয়ে গেলে আর হবে না।।
এক
কোরাণ পাকে শুনিতে পায়, ওয়ালিয়ম মূর্ষীদো শাই।
ভেবে বুঝে দেখ মন তাই, মূর্ষীদো কেমন জনা।।
দিন থাকিতে মূর্ষীদ রতন চিনলে না।
দুই
মূর্ষীদ আমার দয়াল নিধি, মূর্ষীদ আমার বিষয় আদি।
পারে যেতে ভব নদী, ভরষা ঐ চরণ খানা।।
দিন থাকিতে মূর্ষীদ রতন চিনলে না।
তিন
মূর্ষীদো চিনলে পারে, চিনা যায় মন আপনারে।
লালন বলে মূলাধারে, নজরে পড়বে তৎক্ষণা।।
দিন থাকিতে মূর্ষীদ রতন চিনলে না।
আসুন এই গানটি পর্য্যালোচনা করে দেখি যে, এই গানের মাধ্যমে লালন তার ঘরাণার লোকদের কাছে কি বার্তা রেখে গেছেন।
আসুন দেখে নিই এই গানের মূখো বন্ধে লালন কি বলেছেন-
দিন থাকিতে মূর্ষীদ রতন চিনলে না। হেন যে সাধেরো জনম, বয়ে গেলে আর হবে না।।
এই গানের মূখো বন্ধে লালন মূর্ষীদ বলতে যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন, এটা একটি আরবী শব্দ। পূর্ণাঙ্গ কোরাণ শরীফের মধ্যে এই শব্দটি মাত্র একবার ব্যবহার হয়েছে। আর সে টা হলো সূরা কাহাফ এর সতেরো নম্বর আয়াতে। এই আয়াতে বলা হয়েছে ওয়ালিয়াম মূর্ষীদা র কথা। আর লালন এই গানে সেই কোরাণ থেকেই উপস্থাপন করেছেন ওয়ালিয়াম মূর্ষীদা। তার মানে লালন এই গানে যে বার্তা দিয়েছেন, তাহা কোরাণের কথা, নিজস্ব কোন মতবাদ নয়।
এবার আসুন দেখে নিই, এই গানের প্রথম কলিতে লালন কি বলেছেন-
কোরাণ পাকে শুনিতে পায়,ওয়ালিয়ম মূর্ষীদো শাই। ভেবে বুঝে দেখ মন তাই, মূর্ষীদো কেমন জনা।।
এই গানের প্রথম কলিতে লালন নিজেই স্বীকার করেছেন যে, কোরাণে শুনেছেন, ওয়ালিয়াম মূর্ষীদ ও শাই এর কথা। তার মানে এখানে একেবারেই পরিস্কার যে, ওয়ালিয়াম মূর্ষীদা ও শাই শব্দটি কোরাণ থেকে লালন ব্যবহার করেছেন, এটা লালনের নিজের কোন মতবাদ নয়। আর লালন তার গানের মাধ্যমে সকল মানুষকে বলেছেন যে, তোমরা শাই ও মূর্ষীদ কেমন তা বুঝে দেখো। তার মানে লালন ও সিরাজের নামের সাথে যে শাই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তাহা কোরাণ থেকে নেওয়া, ও এই মূর্ষীদ শব্দটিও কোরাণ থেকে নেওয়া। তার মানে, লালন নিজস্ব মতবাদ নয়, কোরাণের কথাই প্রচার করেছেন।
এবার আসুন দেখা যাক এই গানের দ্বিতীয় কলিতে লালন কি বলেছেন।
মূর্ষীদ আমার দয়াল নিধি, মূর্ষীদ আমার বিষয় আদি। পারে যেতে ভব নদী, ভরষা ঐ চরণ খানা।।
গানের এই কলিতে লালন বলেছেন, মূর্ষীদ হলো দয়াল নিধি, অর্থাৎ কাণ্ডারী, মাঝি, স্রষ্টা। আর মূর্ষীদ হলো বিষয় আদি। অর্থাৎ সকল কিছুই স্রষ্টা। আর ভব নদী পাড়ি দিতে একমাত্র ভরষা হলো, মূর্ষীদ বা স্রষ্টার চরণ বা বাণী, অর্থাৎ প্রচলিত কোরাণ। তার মানে লালন এই গানে সকলকে কোরাণ মানার জন্যই বলেছেন, তার নিজস্ব কোন মতবাদ মানতে বলেন নাই।
এবার আসুন দেখে নিই এই গানের শেষ কলিতে লালন কি বলেছেন।
মূর্ষীদো চিনলে পারে, চিনা যায় মন আপনারে। লালন বলে মূলাধারে, নজরে পড়বে তৎক্ষণা।।
এই গানের শেষ কলিতে লালন বলেছেন যে- মূর্ষীদ চিনলেই আপনাকে বা নিজকে চিনা যায়। আর লালন বলে মূলাধার বা আসল আশ্রয়টি তৎক্ষণাৎ নজরে পড়বে বা দৃষ্টি গোচর হবে। তার মানে মূর্ষীদ চিনলে নিজকে চিনা যায়, আর নিজকে চিনলেই আমাদের আসল আশ্রয় স্থলটিও দেখতে পাওয়া যাবে। তাহলে দেখা গেলো এই গানে লালন কোরাণ মানার জন্যই সকলকে আহবান করেছেন, নিজস্ব কোন মতবাদ মানতে বলেন নাই।
তাহলে এবার দয়া করে বলুন, এর পরেও কি আপনারা বলবেন যে, লালন কোরাণের বাইরের বিষয়, বা লালন তার নিজস্ব মতবাদ প্রচার করেছেন?
এই লেখাটি আমার নয়। এটা লিখেছেন গুরুজী। আমি তার অনুমতি সাপেক্ষে এখানে পোষ্ট করলাম।
মূল পোষ্টটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বিষয়: বিবিধ
৩১৪১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাঁই শব্দটি স্বামী শব্দের অপভ্রংশ। যেমন হিন্দুরা তাদের একটি উপাধি গোস্বামীকে গোসাঁই বলে ডাকে। স্বামী শব্দের অর্থ গুরু, প্রভু ইত্যাদি। অশিক্ষিত এবং ইতর জীবনাচরণে অভ্যস্ত বাউলরা লালনকে সাঁই বলে ডাকে। কিন্তু লালনকে ভদ্রসমাজে সুফী দরবেশ হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টায় রয়েছে একটি গোষ্ঠী। তারা লালনের নামের শেষে ‘শাহ’ লাগিয়ে দিয়েছে, যে শব্দ মুবারক মুসলিমরা তাদের পীর সাহেব উনাকে সম্বোধন করতে ব্যবহার করে।
বাউল মতবাদ সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদ থেকে এসেছে। বাউলরা এরকম জীবনযাপন করেও। লালন যে কাজটা করেছিল, তা হলো ছূফী কবিতায় ইশারা করার যে বিষয়টি, সেটি সে তার গান লেখায় ব্যবহার করে। সে ইসলামী শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে দেহতত্ত্বের বিষয়গুলো ইশারা করেছে। ইসলামী ভাবধারায় সে সহজিয়া বৈষ্ণব মতকে উপস্থাপন করেছে। ফলে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কথাটি দ্বারা মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়, কারণ গানের বিষয়টি আদৌ আখিরাত সম্পর্কিত নয়। এই বিভ্রান্ত হওয়াটা থেকে মুসলমানদের দূরে থাকতে হবে।
তার গানে যে ‘আল্লাহ’ ‘রাসূল’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, তা সে খুব কদর্য্য অর্থে ব্যবহার করেছে। কারণ সহজিয়া বা দেহতত্ত্বে দেহই সবকিছু। এটাকে খুশি রাখতে পরকীয়া তো কিছুই নয়। এবং এই দেহের সৃষ্টি হলো পুরুষের স্খলিত তরলের উসীলায়। ওটাকেই তারা বলে সৃষ্টিকর্তা। তারা বলে থাকে, বীজমে আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ), বাউল গবেষক ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য বাউলধর্ম সম্পর্কে বলেছে, “বাউলগণ পুরুষদের বীজরূপী সত্ত্বাকে ঈশ্বর বলে। বাউলদের মতে এই বীজসত্ত্বা বা ঈশ্বররস ভোক্তা, লীলাময় ও কাম ক্রীড়াশীল।”
পশুরা তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী চালিত হয়ে থাকে। আর দেহতত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপনকারী বাউলরা, কতগুলো সমাজচ্যুত পশু ব্যতীত কিছু নয়। মুসলমানদে কে এদের থেকে সাবধান থাকা উচিত।
বাউল সম্প্রদায়ের গুরু হল লালন। লালনের কিছু কিছু গানে আল্লাহরাসূল প্রভৃতি শব্দ থাকায় অনেকে লালন ও তার অনুসারী বাউলদের অনৈসলামিক মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। মুসলমানরা যখন লালনের অনুসারী বাউলদের অসামাজিক কাজের বিরোধিতা করে তখন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের গুটিকয়েক সমাজচ্যুত বাউলদের জন্য সইতে হয় সাম্প্রদায়িকতার অপবাদ। যারা বাউলদের পক্ষাবলম্বন করছে তারা কি জানে বাউল তত্ত্বের উদ্দেশ্য কি? বাউল নামটি এসেছে বা’ল বা হোবল দেবতার নাম হতে। এবং বাউল তত্ত্বের বাইরে হল ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ, ভেতরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের কাহিনীনির্ভর বৈষ্ণব বা সহজিয়া মতবাদ। গুরুরতি সাধন করা বা গুরুর মলমূত্র বীর্য রজঃপান বাউলমতে দীক্ষা নেয়ার প্রথম ধাপ(নাউযুবিল্লাহ)। লালনের অধিকাংশ গান রাধাকৃষ্ণ দেহসাধনা নিয়ে লেখা, দু একটি গানে ইসলামের কথা যা আছে তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলামের জন্য অবমাননাকর। হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে আমাদের দেশে একটি গুজব রয়েছে আর তা হল তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন ডাকাত, পরে আউলিয়া হন। কিন্তু কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। তিনি ছিলেন আওলাদে রাসূল মাদারজাদ ওলীআল্লাহ, উনার যামানার মুজাদ্দিদ। আর এ গুজবের হোতা হল লালন তথা বাউল সম্প্রদায়। লালনের গানে আছে
নিজাম নামের বাটপার সেতো পাপেতে ডুবিয়া রইত
তার মনে সুমতি দিলে,কুমতি তার গেল চলে
আউলিয়া নাম খাতায় লিখিলে, জানা গেল এই রহমই
বাউলতত্ত্ব বইতে রয়েছে ““ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্র মত। যার নাম নাথপন্থা। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থা এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে”
বস্তুতঃ বাউলরা হল মুসলমানের ছদ্মবেশে হিন্দু বৈষ্ণব, যারা মুসলমানের ঈমান কেড়ে নিতে চায়। তারা আল্লাহরাসূলের কথা বলে পুরোন প্রথা তথা রাধাকৃষ্ণের দেহতত্ত্বের সাধনা করে। যবনলালন মুসলমানদের প্রতি কীরূপ মনোভাব পোষণ করতো তা কিন্তু তার গানেই রয়েছে। লালন তার গানে সাধারণত কখনোই মুসলমানদের মুসলমান বলে সম্বোধন করতোনা, করতো যবন বলে(নাউযুবিল্লাহ)। সে হিন্দুদের হিন্দু বলত, বৌদ্ধদের বৌদ্ধ বলত, খ্রিস্টানদের বলত খ্রিস্টান। কিন্তু এক মুসলমানকে সর্বদা বলত যবন। এ অবমাননাকর উপাধি সর্বদাই সে মুসলমানদের জন্যই ব্যবহার করতো, অন্য কারো জন্য নয়। যেমন লালনসমগ্র(আবদেল মাননান,প্রকাশক নালন্দা) এর স্থুলদেশ অধ্যায়ের ৩৮ নম্বর গানে রয়েছে
জাত বলিতে কি হয় বিধান
হিন্দু যবন বৌদ্ধ খৃস্টান
এরকম আরো বহু গান রয়েছে যার উদ্ধৃতি দিলে লেখার কলেবর বেড়ে চলবে। সে তার সাঁই বা যাকে মুর্শিদ মানতো তাকেও যবন বলতো। কারণ তার মুর্শিদের নাম ছিল সিরাজ সাঁই, সে ছিল মুসলমান ঘরের সন্তান। তার গানে (স্থূলদেশ ৫২ নং)রয়েছে
ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছে সাঁই
হিন্দু কি যবন বলে
জাতের বিচার নাই
অর্থাৎ লালনকে যতই অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা গন্ডমূর্খরা করুক না কেন, সে কিন্তু এমন একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে যেখানে মুসলমান তো বটেই এমনকি মুসলমান সাঁইকেও হতে হয় অপমানিত। লালনের যে গানটিকে(স্থুলদেশ ৩৫ নং) পুঁজি করে লালনভক্তরা তাকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা চালায় তা হলো
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যে দিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান
জাতিগোত্র নাহি রবে
এ গানটিতেই কেবল মুসলমান শব্দের দেখা মেলে, কিন্তু কখন? যখন মুসলমান জাতির বিনাশ কামনা করা হয়! নাউযুবিল্লাহ। লালনের কোন গানে মুসলমানকে মুসলমান বলার সম্মানটুকু দেয়া হয় নাই। যাও একবার বলা হয়েছে, তাও ধ্বংস কামনা করে। চৈতন্যদেবের মত বৈষ্ণব(হিন্দুধর্মের একটি ফেরকা) ধর্মপ্রচারকের যে স্বভাব তার পুরোটাই লালনের মধ্যে ছিল। চৈতন্যদেব বৈষ্ণবমত গ্রহণকারী মুসলমান ঘরের মুরতাদকেও যবন বলে হিন্দুদের তুলনায় নিকৃষ্ট গণ্য করতে ছাড়তো না, তাদের মত গ্রহণ করলেও তাদের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করত না। অর্থাৎ তারা যতই উদারতার ভেক ধরুক না কেন তাদের অন্তর গরলে পরিপূর্ণ। উল্লেখ্য লালন নিজেও ছিল চৈতন্যদেবের অনুসারী। প্রত্যেক বৈষ্ণবধর্মপ্রচারকের স্তুতি লালনের গানে আছে। নিমাই, নিতাই, গৌর বা চৈতন্যদেব প্রত্যেকের ছানাছিফত সে করেছে। এবং এত বেশি করেছে যে লালনসমগ্র গ্রন্থে নিমাইলীলা, নিতাইলীলা, গৌরলীলা এ তিন ধর্মপ্রচারকের নামে তিনটি আলাদা আলাদা অধ্যায় রয়েছে। কিন্তু বাউলরা পাগড়ি পরে, দাড়ি রাখে, লুঙ্গি পরে। যা বৈষ্ণবরা করে না। পাগড়ি দাড়ি লুঙ্গির আড়ালে তারা বৈষ্ণবসাধনা করে।
অর্থাৎ লালন কখনোই অসাম্প্রদায়িক নয়। সে হল দুরাচার যবন অনুপ্রবেশকারী, যে ইসলামের ভেক ধরে মুসলমানদের সর্বনাশ করতে উদগ্রীব থাকতো। শুধু তাই নয়, লালনের সাথে সুসম্পর্ক ছিল ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের, যে ঠাকুর পরিবারের সদস্য ইসলামবিদ্বেষী যবন রবীন্দ্রনাথ! যারা বাউল সম্প্রদায়ের ইতিহাস জানেন তারা অনেকেই মানবেন, এদেশের মুসলমানদের পথভ্রষ্টকারী যেসব মতবাদ ছিল তার মধ্যে বাউল মতবাদ অন্যতম। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে প্রায় সকল মুসলিম লেখকগণ মুসলমান সমাজে বাউল মতের বিধ্বংসী প্রভাব দেখে এ মতবাদের বিরুদ্ধে লিখে গিয়েছেন।
কোলকাতার যবনরা আমাদের দেশে লালন মতবাদের প্রচারপ্রসারে উদগ্রীব। কিছুদিন আগেই কোলকাতার কিছু যবন এদেশে ‘মনের মানুষ’ নামে একটি সিনেমা করে গিয়েছে। এর কারণ লালন মতবাদ হল ইসলামের ছদ্মবেশে রাধাকৃষ্ণ তথা হিন্দুদের মতবাদ। এদেশে এখন ব্যান্ডসংগীতের নাম দিয়ে কৃষ্ণকীর্তন করা হয়। রাস্তাঘাটের গানের দোকান থেকে কৃষ্ণলীলার গান ভেসে আসে, যা এখন দেশের মানুষের কাছে দুঃখজনকভাবে স্বাভাবিক। এবার নববর্ষে চারুকলার শিক্ষার্থীরা ভার্সিটি এলাকার দেয়াল কৃষ্ণের ছবি দিয়ে ভরে ফেলেছে, যা কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। এদেশের সংবিধান সংস্কৃতি মানুষের চিন্তাচেতনা থেকে যারা ইসলামকে উঠিয়ে দিতে চায় তারা জানে, একদিনে এ মহাযজ্ঞ সম্ভব নয়। এজন্য তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, বাউল মতবাদের আড়ালে মুসলমানদের মনমগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণের অভিশপ্ত পরকীয়ার শিক্ষা। স্লো পয়জনিংয়ের মতো হিন্দুরা আমাদের মুসলমানিত্বকে আমাদের মধ্যে থেকে কেড়ে নিয়ে হিন্দুধর্মের দীক্ষা দিচ্ছে, কথিত সংস্কৃতির নামে। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকরাও তা চায়। এজন্য কিছুদিন আগেই এপ্রিল মাসে রাজবাড়ীর পাংশায় বাউলদের কথিত সাধুসঙ্গে তাদের চুলদাড়ি কেটে নেয়ার পরই সরকার তৎপর হয়ে উঠল। কথিত সুশীল সমাজ এবং লালনের গান গেয়ে জীবিকা অর্জনকারী ব্যান্ড গায়করা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। প্রথম আলোর মত সাম্প্রদায়িক ইসলামবিদ্বেষী পত্রিকাগুলো বাউলদের সপক্ষে লেখা শুরু করল। ফলশ্রুতিতে সরকার বাউলদের জন্য ৯৭ শতাংশ মুসলমানের টাকায় চালিত পুলিশ প্রশাসন দিয়ে পুনরায় বাউল গায়কদের সাধুসঙ্গের আয়োজন করল। অথচ চুলদাড়ি কেটে নিয়েছিল আওয়ামীলীগেরই তৃণমূল নেতাকর্মীরা, মিডিয়াকর্মীরাও কবুল করেছে বাউলদের অসামাজিক কার্যের বিরুদ্ধে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকদেরও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। স্থানীয়রাই উদ্যোগী হয়ে বাউলদের জটাদাড়ি কেটে নিয়েছিল(সুন্নতী দাড়ি নয়), কারণ বাউল সম্পর্কে আরেকটি বিষয় হলো তারা গাঁজায় আসক্ত, যুবসমাজ থেকে তারা তাদের নিজেদের উত্তরসূরি বেছে নেয়। এজন্য তারা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে বাউলদের জটা কেটে,দাড়ি সিনা পর্যন্ত কেটে ইমাম দিয়ে তওবা পড়িয়েছিল, যেন বাউলরা সৎপথে ফিরে আসে। কিন্তু সরকার আসল বাউলদের ত্রাণকর্তারূপে, আবারও বসল সাধুসঙ্গ। যারা সাধুসঙ্গ সম্পর্কে জানে তারা বলেছে, সাধুসঙ্গ হলো বাউলদের কুকর্মের আনুষ্ঠানিক মহাযজ্ঞ। অর্থাৎ তাদের নাপাক বস্তু ভক্ষণ এবং কৃষ্ণের অনুকরণে তারা যে অবাধ মেলামেশা করে তার আসর। সাধুসঙ্গে সকালে মাইকে গান হয়, রাতে সমস্ত বাতি নিভিয়ে হয় জেনার আসর।নাউযুবিল্লাহ।
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম একসময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।…আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
“আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।...আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ...ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন... এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বিষয়: বিবিধ
Share on facebook Share on email Share on print
এডিট করুন | ড্রাফট করুন | মুছে ফেলুন | ব্লক করুন | প্রিয়দেরকে আমন্ত্রণ জানান | প্রিয়তে রাখুন
মন্তব্য করতে লগইন করুন