লালনের গানে শাই পরিচয় ও গুরুচণ্ডালি। লালন পর্ব-৯
লিখেছেন লিখেছেন পাতা বাহার ২৪ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:৫৩:৪২ সন্ধ্যা
আমি পর্ব আট এ উপস্থাপন করেছিলাম যে, শাই শব্দটি মূলতঃ লালনের নিজের তৈরী কোন শব্দ নয়, এই শাই শব্দটি আরবী শব্দ, এবং এই শাই শব্দের বাংলা অর্থ- জিনিস, বস্তু ও দ্রব্য। অর্থাৎ স্রষ্টা হতে শুরু করে সৃষ্টির সকল কিছুই শাই এর অন্তর্ভূক্ত। আর সেই সাথে বলেছিলাম লালন তার গানে সাম্প্রদায়ীক ধর্ম গন্থেরে গুরুচণ্ডালি করেছেন। এবার আসুন লালন তার লেখা গানে শাই এর কি পরিচয় ব্যক্ত করেছেন, ও কি গুরুচণ্ডালি করেছেন তা দেখে নিই, লালনের এই গানটিতে-
শাইর লীলা বুঝবি খ্যাপা কেমন করে।
লীলার যাহার নাই রে সীমা, কোন সময় কোন রুপ সে ধরে।।
এক
গঙ্গায় গেলে গঙ্গা জল হয়, গর্তে গেলে কূপ জলো হয়।
বেদ বিচারে।
তেমনি শাই এর অনন্ত রুপ, জানায় পাত্র অনুসারে।।
শাইর লীলা বুঝবি খ্যাপা কেমন করে।।
দুই
আপনি ঘর আর আপনি ঘোরী, আপনি করেন রসের চুরি।
ঘরে ঘরে।
আপনি করেন ম্যাজেস্ট্রারী, আপন হাতেই বেড়ি পরে।।
শাইর লীলা বুঝবি খ্যাপা কেমন করে।।
তিন
একটি নাম অনন্ত ধারা, তুমি আমি নাম বেওয়ারা।
ভবের পরে।
সিরাজ শাই কয় অবোধ লালন, জানলেই ধাঁধাঁ যেতো দুরে।।
শাইর লীলা বুঝবি খ্যাপা কেমন করে।।
এবার আসুন, এই গানটির একটু পর্য্যালোচনা করে দেখি যে, এই গানে লালন তার ঘরাণার লোকদের জন্য কি বার্তা রেখে গেছেন। আসুন দেখে নিই এই গানের মূখো বন্ধে লালন কি বলেছেন।
শাইর লীলা বুঝবি খ্যাপা কেমন করে। লীলার যাহার নাই রে সীমা, কোন সময় কোন রুপ সে ধরে।।
ব্যখ্যা- গানের এই মূখোবন্ধে লালন বলেছেন, শাই এর লীলা বা ক্রীয়া কেমন করে বুঝবি খ্যাপা বা পাগলের দল। অর্থাৎ বলেছে, ওরে পাগল, তোরা শাইর লীলা বা ক্রীয়া কিভাবে বুঝবি। যার লীলা বা ক্রীয়ার কোন সীমা নাই, সে কোন সময় কোন রুপ বা আকৃতী ধারণ করে, তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই।
এবার আসুন দেখে নিই, এই গানের প্রথম কলিতে লালন বি বলেছেন।
গঙ্গায় গেলে গঙ্গা জল হয়, গর্তে গেলে কূপ জলো হয়। বেদ বিচারে। তেমনি শাই এর অনন্ত রুপ, জানায় পাত্র অনুসারে।।
ব্যখ্যা- এই কলিতে লালন বলেছেন যে- জল গঙ্গা বা নদীতে গেলে তাকে গঙ্গা বা নদীর জল বলা হয়, আবার কূপ বা কূয়ায় গেলে সেই জলকেই কূপজল বলে, আর এটা বলে বেদের বিচারে।
একটু খেয়াল করুন। আরবী শাই শব্দকে পরিচয় করাতে এসে এখানে লালন কোরাণের বিচারে না বলে বলে দিলেন বেদ বিচারে। তার মানে এখানেও সে গুরুচণ্ডালির আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ বেদের কোথাও শাই শব্দ ব্যবহার হয় নি। আমি বলবো, এটা লালনের অজ্ঞতা বৈ কিছু নয়।
এর পরে এই কলিতে লালন বলেছেন, তেমনি শাই এর অনন্ত রুপ জানায় পাত্র অনুসারে। তার মানে, শাই যে পাত্রে অবস্থান করেন, শাই সেই পাত্রের আকার ধারণ করেন ও সে পাত্রের নামের সাথে তার নাম যোগ করেই শাই এর নাম করণ করা হয়।
প্রকাশ থাকে যে, সকল সৃষ্টি ও স্রষ্টাই যখন শাই হয়, তখন জলও শাই, আবার যে পাত্র সমুহে জল রাখা হয়, বা জল যে পাত্র সমুহে অবস্থান করে, সে পাত্র সমুহও শাই এর অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ স্রষ্টামৌলিক স্বত্বাটিই শাই, এবং সৃষ্টিতে স্রষ্টার অবস্থান পাত্রভেদে যত কিছু বস্তুই সৃষ্টি হয়েছে, তার সবই শাই। আর সৃষ্টি সূত্রে তাদের যে ভীন্ন ভীন্ন নাম করণ করা হয়েছে, তার প্রতিটা নামই স্রষ্টা ও পাত্র বা শাই ও শাই এর নামানুসারে নাম করণ করা হয়েছে।
এবার আসুন এই গানের দ্বিতীয় কলিতে লালন কি বলেছেন, তা দেখে নিই।
আপনি ঘর আর আপনি ঘোরী, আপনি করেন রসের চুরি। ঘরে ঘরে। আপনি করেন ম্যাজেস্ট্রারী, আপন হাতেই বেড়ি পরে।।
ব্যখ্যা- এই কলিতে বলা হয়েছে, শাই নিজেই ঘর, নিজেই ঘরের বাসকারী, আবার সে নিজেই সে ঘর সমুহের রস চুরি করেন, আবার নিজেই বিচারক হয়ে বিচার করেন, আবার নিজেই বিচারের প্রাপ্ত সাজা খাটেন। অর্থাৎ এর সব গুলিই শাই। এখানে শাই ভীন্ন অন্য কিছুই নাই।
এবার আসুন এই গানের শেষ কলিটা দেখে নিই।
একটি নাম অনন্ত ধারা, তুমি আমি নাম বেওয়ারা। ভবের পরে। সিরাজ শাই কয় অবোধ লালন, জানলেই ধাঁধাঁ যেতো দুরে।।
ব্যখ্যা- এই গানের শেষ কলিতে লালন বলেছেন, এই শাই এর একটি নাম হলেও, এর ধারা অনন্ত। যে ধারার কোনই সীমা পরিসীমা নাই। আর সে অনন্ত ধারার নিয়ম অনুসারে এই ভবে বা সৃষ্টিতে, তুমি আমির ভীন্নতা। আর সিরাজ শাই বলেছেন লালন, এই শাই বা বস্তু ও বস্তুর ভীন্ন ভীন্ন নাম করণ বিষয় জ্ঞান প্রাপ্ত হলেই, জীবের সকল ধাঁধাঁ কেটে যাবে।
এই লেখাটি আমার নয়। এই লেখাটি লিখেছেন গুরুজী। আমি তার অনুমতি সাপেক্ষে এখানে পোষ্ট করেছি। মূল পৌষ্টটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বিষয়: বিবিধ
১০৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন