মাহে রমজানঃ পুজিবাদী তথা বস্তুবাদী সংস্কৃতির মোকাবেলায় ইসলামী সংস্কৃতির বিপ্লবী ভূমিকা(পার্ট-২)
লিখেছেন লিখেছেন সুজন মাহমুদ ২৩ আগস্ট, ২০১৪, ০৩:১৫:৫৫ দুপুর
মানব প্রকৃতির স্বীকৃতি চাইঃ মানুষ কেন মুক্তির অন্বেষণ করে? মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রানী কেন মুক্তির অন্বেষণ করে না? মুক্তির তৃষ্ণায় মানুষ এতটাই তৃষ্ণার্ত যে মানুষ দিক দিগন্তে ছুটাছুটি করে পারি জমায় মহাকাশে, চন্দ্রলোকে এবং মঙ্গল গ্রহে অবধি মুক্তির অন্বেষণে মৃত্যুকে পর্যন্ত বেঁচে নেয় আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। অন্য কোন প্রানী মুক্তির জন্য আত্মহত্যা করে বলে আমার জানা নাই। যীশু খ্রিস্ট্রের আগমনের পূর্বে ইহুদীরা অপেক্ষামান ছিল যে ঈসা মসীহ নামে একজন ত্রাণকর্তা (মুক্তিদাতা) পৃথিবীতে আগমন করবে। যিনি ইহুদীদেরকে পৃথিবীতে নৈরাজ্য, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিবেন। বর্তমানে মুসলমানেরাও মনে করে ইমাম মাহদী (আঃ) নামে একজন ত্রাতা( মুক্তিদাতা) আসবেন,যিনি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কবল থেকে মজলুম জনতাকে উদ্ধার করবেন। যিনি পৃথিবীতে অন্যায়ের উচ্ছেদ করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করবেন। বৌদ্ধ ধর্মেও বুদ্ধ মনে করেন- মানুষের কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা,লোভ- লালসা মানুষকে অসুখী করে, দুঃখে পর্যবসিত করে। তাই মানুষ যদি কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা,লোভ- লালসা, আবেগ- অনুভুতি ইত্যাদিকে একদম আগুনে পুড়িয়ে ফেলে তবেই মানুষ নির্বাণ(মুক্তি) লাভ করতে পারবে। হিন্দু ধর্মেও মানুষের প্রবৃত্তি প্রবনতাকে নিয়ন্ত্রন করে মোক্ষ (মুক্তি) লাভ করতে বলা হয়েছে। নিরীশ্বরবাদী নাস্তিকরা তাদের জীবন যন্ত্রণায়, বিপদে-আপদে কোন শক্তিমান সত্ত্বার আশ্রয় না থাকায় আত্মহত্যা করে মুক্তির অন্বেষণ করে। কারণ মানুষ মাত্রই নির্ভরশীল সত্ত্বা তাকে নিরাপত্তা দিতে পারে এমন শক্তিমান সত্ত্বার আশ্রয় গ্রহন করতে হয়।
এখানে প্রশ্ন একটায় , মানুষ কেন মুক্তি চায় ? মানুষ এই জন্য মুক্তি চাই যে, মানুষের রয়েছে স্বাধীন আত্মা (Autonomous soul) সোল বা আত্মা হচ্ছে আল্লাহর অংশ। খোদা প্রদত্ত রুহানী শক্তি বা চিন্তা, বিচার- বিশ্লেষণ ক্ষমতা । এই শক্তিকে বিকশিত করে মানুষ কিছু কিছু খোদায়ী গুণাবলি ধারণ করতে পারে। এই স্বাধীন আত্মা কখনো শৃঙ্খলিত হতে চায় না। মানুষ যদি নিজের আত্মস্বার্থ, আত্মপ্রীতি , দুনিয়াপ্রীতি দিয়ে শৃঙ্খলিত করতে চায়। তখন মানুষ তার নিজের প্রতি নিজেই জুলুম করে। ফলে মানবসত্ত্বা পরাধীন হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য যে,প্রটেস্টেন্টিজম,মানবতাবাদ,পুঁজিবাদ,সমাজতন্ত্র,বিজ্ঞানবাদ,অস্তিত্ববাদ পশ্চিমা মতাদর্শ গুলো মানুষের সারসত্তা (Essence) স্বাধীন আত্মা (Autonomous soul) কে অস্বীকার করে। ফলে স্বাধীন আত্মাকে নাকচ করে মুক্তির অন্বেষণে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করলেও মানুষ নতুন নতুন শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়।
দ্বিতীয়ত, মানুষ সামাজিক জীব। একজন ব্যক্তি মাত্রই একটা সমাজ। সমাজ ব্যতিত একক ব্যক্তির কোন অস্তিত্ত নাই। অতএব ব্যক্তি যদি অন্যের জন্য সেক্রিফাইস না করে তাহলে ব্যক্তি অন্যের সেক্রিফাইস পাবে না। ফলে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। তাতে স্বার্থপরতায় সামাজিক সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়বে। ব্যক্তি যদি সমাজ ব্যতিত শুধু নিজেকে নিয়েই চিন্তা করে, তাহলে ব্যক্তি কেন একা জঙ্গলে গিয়ে বাস করতে পারে না? অতএব হারবারট স্পেন্সার যে ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদী তত্ত্বে বলেছেন- ব্যক্তির জন্যই সমাজ, সমাজের জন্য ব্যক্তি নয়। এটি মানুষের প্রকৃতি বিরোধী তত্ত্ব । কারণ মানুষ মানুষের সম্পর্ক, সাহায্য- সহযোগিতা ছাড়া বাঁচতে পারে না। এই প্রসঙ্গে আল্লামা সাইয়্যেদ হুসাইন তাবাতাবাঈ বলেছেন- সমাজের মূল তত্ত্বই হচ্ছে সমাজের সদস্যদের একে অন্যের সহযোগিতা করা। এই মহাসত্যটি পশ্চিমা ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদীরা অস্বীকার করে থাকে। সুতরাং মানব প্রকৃতির স্বীকৃতি ব্যতিত মানুষের সমস্যা সমাধান সম্ভব না।
অন্যদিকে ইসলাম মানুষের আসল প্রকৃতিকে (স্বাধীন আত্মা) স্বীকৃতি দেয় এবং আত্মাকে সংশোধনের মাধ্যম হিসেবে কতগুলো সিস্টেম দিয়েছে। যেমন, কালিমা,নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাত, অন্যায়ের উচ্ছেদ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। যাতে সমাজের মানুষের আত্ম সংশোধনের মাধ্যমে পারস্পারিক সাহায্য সহযোগিতার ভিত্তিতে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়।
আত্মাসংশোধন কেন প্রয়োজনঃ মানব শিশু নিস্পাপ হয়ে জন্ম গ্রহন করলেও পরবর্তীতে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন , প্রচলিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং অনুকরন প্রবনতার মাধ্যমে সোশালাইজড হয়। ( যদি জ্ঞান বুদ্ধির বাড়ন্ত বয়সে তাকে সংশোধনের মাধ্যমে গড়ে তোলা না হয়) ফলে মানুষের স্বাধীন সত্ত্বাকে বিকশিত করতে পারে না। তখন সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সমাজের আরোপিত কুসংস্কারাছন্ন ধ্যানধারণা লালন করে। তাই তখন খোদা প্রদত্ত রুহানী শক্তি বা চিন্তা, বিচার- বিশ্লেষণ ক্ষমতা বিকশিত করতে না পারে তখন মানুষ হয়ে পড়ে কুপ্রবৃত্তি, আত্মস্বার্থ ও সমাজের দাস।
এই ধরনের ব্যক্তিরা যখন সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। তাদের দ্বারা পুরো সমাজ ব্যবস্থা শৃঙ্খলিত হয়। কারণ স্বার্থের তাড়নায় ক্ষমতার খায়েশ পূরণ করতে যে কোন মুহূর্তে স্বৈরাচারী হতে পারে। গণহত্যা, খুন, ঘুষ, দুর্নীতিতে সমাজ ভরে যেতে পারে। যে বারটান্ড রাসেল মনে করেছিল যে, বিজ্ঞান মানুষকে মুক্তি দিবে। কিন্তু বিজ্ঞান অসংশোধিত মানুষের কাছে যাওয়ার কারনেই পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলায় হিরোশিমা- নাগাসাকিতে বিশ্ব মানবতা বিরোধী ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত হয়েছে। এখনো বিজ্ঞানকে অপব্যবহার করে এতসব গণবিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করেছে যা দ্বারা বিশ্বকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব। এসব দেখে বারটান্ড রাসেল হতাশ হয়ে বলেছে- মানুষের কি কোন ভবিষ্যৎ আছে ? সমাজতান্ত্রিক কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো জনগণের বিশাল জমি নিয়ে তার নিজ বাস ভবন বানিয়েছে। রাশিয়া, চীন দেশ গুলোতে প্রশাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে দুর্নীতি চলছে যা প্রায় সময় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
অন্যদিকে ইসলাম বলেছে, “আমার যোগ্যতাসম্পন্ন (আত্মসংশোধিত) বান্দাগণ পৃথিবীর অধিকারী হবে”। (আল কোরআন ২১.১০৫) তারা হবে সকল প্রকার দুর্নীতি মুক্ত। কারণ তারা মনে করে আল্লাহর সম্মুখে আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। আজকের বিশ্বে দিকে দিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে শুধু স্বার্থ আর আদিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে। সংশোধিত মানুষ ছাড়া সমাজ রাষ্ট্র বিশ্বে কোনদিন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। আত্মসংশোধনের এই সিস্টেম ইসলাম ছাড়া কোন মতাদর্শে ( পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র) দেখাতে পারেনী।
বিষয়: বিবিধ
১০৮৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পথে পথে ঘুরে বেড়ানোদের কথায় কাণ দিতে নেই
মন্তব্য করতে লগইন করুন