মাহে রমজানঃ পুজিবাদী তথা বস্তুবাদী সংস্কৃতির মোকাবেলায় ইসলামী সংস্কৃতির বিপ্লবী ভূমিকা(পার্ট -১)
লিখেছেন লিখেছেন সুজন মাহমুদ ১৯ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:৩৩:০৯ সকাল
ভুমিকাঃ সমাজে দুটি ধারার পথ, মত ও মতাদর্শের মানুষের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যাদের চিন্তা চেতনা,মূল্যবোধ,জীবনবোধ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক আচার ব্যবহার আপাত দৃষ্টিতে প্রায় বিপরীত,তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে দুটি দর্শনই এক মোহনায় মিলিত হয়েছে।মানুষ মুক্তির অন্বেষণে যখন একটা বাদ দিয়ে আরেকটা গ্রহন করে তখন এক শৃঙ্খল থেকে অন্য শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজস্ব চিন্তা,বিচার- বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজসত্ত্বার সন্ধান এবং বিকাশ সাধন না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজ পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া মানুষকে শৃঙ্খলিত করে,ফলে ঐ দুটি মতাদর্শের শৃঙ্খল থেকেও মুক্ত হতে পারে না। এই দুটি দলের একটি হল, প্রচলিত অন্ধধর্মের ধর্মীয় শ্রেণী অন্যটি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্যাকুলার শ্রেণী। এই দুই দলই কুসংস্কারাছন্ন। এক দল ধর্মের নামে অন্য দল বিজ্ঞানের নামে।
পুজিবাদী দর্শনে,মুক্তবাজার অর্থনীতি,নয়া উদারনৈতিকতাবাদ,বেসরকারিকরন,সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানা অস্বীকৃত ইত্যাদি থেকে জন্ম নিয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গনতন্ত্র, জনগণের সার্বভৌমত্ব নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অবাধ যৌনাচার ,আরাম-আয়েশ বিলাসিতা,ভোগবাদীতা,বস্তুবাদীতা ইত্যাদি হল তাদের সংস্কৃতি। পুজিবাদী আদর্শের প্রধান নির্মাতা ইংরেজ দার্শনিক হারবারট স্পেন্সার “Survival of the fittest” অর্থাৎ “সবচেয়ে যোগ্যতমের টিকে থাকা” তত্ত্ব
দিয়েছেন। দার্শনিক হারবারট স্পেন্সার বলেছেন – অর্থনৈতিক ভাবে যে শক্তিশালী সে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল কে শেষ করে দিবে। অর্থাৎ দুর্বলের টিকে থাকার প্রয়োজন নেই। এটাই পুঁজিবাদী সাফল্যের মূল রহস্য। এতে করে সমাজের মানুষের মধ্যে চলবে চরম প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় যে টিকবে সে বাঁচবে যে টিকবে না তার বাঁচার অধিকার নেই। তিনি আরও বলেন- রাষ্ট্রের উচিত নয় জনকল্যাণ মূলক কার্যক্রম গ্রহন করা, কারণ জন্য কল্যাণ মূলক কার্যক্রম গ্রহন না করলে ঐ দুর্বল মানুষেরা হয়তো অনাহারে- অর্ধ হারে মারা যেত। তাতে সকল জনসাধারনের দুর্ভোগ বাড়ত না। কত অমানবিক তত্তের জনক পশ্চিমা পুজিবাদী দার্শনিকরা। এতে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, সমাজের যারা ছিন্নমূল জনসাধারণ অর্থাৎ যারা অন্ধ, বোবা, প্রতিবন্ধী , দরিদ্র, কর্মে অক্ষম, তাদের বেঁচে থাকার দরকার নাই। তাতে পুজিপুত্রদের দুর্ভোগ কমবে। পৃথিবীটা শুধু পুজিপুত্রদের ভোগ বিলাসিতার জন্য তৈরি। অথচ দুর্বল ও সবলকে নিয়েই সমাজ গঠিত। সবারই বাঁচার জন্মগত অধিকার রয়েছে। হারবারট স্পেন্সার আরও বলেছেন- ব্যক্তির জন্যই সমাজ, সমাজের জন্য ব্যক্তি নয়। অর্থাৎ সমাজ গোল্লায় গেলেও তাতে ব্যক্তির কিছু আসে যায় না। ফলে ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। তাতে ব্যক্তি হয়ে পড়েছে চরম স্বেচ্ছাচারী। আর ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী হলে সমাজের দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হয়ে পড়বে। সামাজিক সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়বে। যেমনটা বর্তমান সমাজে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে সমাজ ছাড়া যে ব্যক্তির অস্তিত্তহীন এই সত্যকে অস্বীকার করা হয়েছে।
অন্যদিকে ইসলাম পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে উম্মা (অর্থাৎ কমিউনাল) কনসেপ্ট ধারণ করে, ইসলামে একক ব্যক্তির চেয়ে বিশ্বের সকল মানুষকে একত্রে পারস্পারিক সহযোগিতা- সহমর্মিতা মাধ্যমে কল্যাণ মূলক সমাজ গঠন করতে চায়। যারা একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হবে, অন্যের জন্য সেক্রিফাইস করবে। পুজিবাদী দর্শনে সমাজ জীবনের ভিত্তি হল সেলফ ইন্টারেস্ট। অন্যদিকে ইসলামী দর্শনে সমাজ জীবনের ভিত্তি হল সেলফ সেক্রিফাইস।
আবার ক্লাসিক্যাল ইকনমিস্ট এডাম স্মিথ বলেছেন – “বাজারে (Market) কোন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ করা যাবে না। মার্কেটই মানুষের সংস্কৃতি নির্ধারণ করবে”। অর্থাৎ মানুষের কালচার হবে মার্কেট কেন্দ্রিক। উল্লেখ্য যে, ইহজাগতিকতার (স্যাকুলারিজম) ভিত্তিতে চার্চের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অবসানের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ বেড়ে উঠেছিল এবং ধর্মীয় নীতি- নৈতিকতা প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু পুজিবাদী মতাদর্শে মার্কেট,যা মানুষের নীতি নৈতিকতা ও সংস্কৃতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রন করে। ফলে মার্কেট এখন ঈশ্বরের মত পুজিবাদী সমাজকে পরিচালনা করে। এই প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক নোয়াম চমনস্কি বলেছেন – “মধ্যযুগে ঈশ্বর সবকিছু নির্ধারণ করেছে, বর্তমানে মার্কেটই ঈশ্বর যা সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে”। ফলে পুঁজিবাদে মানুষ মার্কেট ও পুঁজির দাসে পরিণত হয়েছে। মার্কেট ও পুঁজি মানুষকে শৃঙ্খলিত করেছে। তাই পুঁজিবাদে পুঁজি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা ফলে সমাজে গুটিকয়েক পুজিপুত্রের হাতে অধিক সম্পদ পুঞ্জিভুত হয়। ফলে সম্পদের বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার কারনে ধনীরা আরও ধনী এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে।
সমাজের এই আর্থিক বৈষম্য দেখে পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র অর্থনৈতিক সাম্য ও মুক্তির শ্লোগান নিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃতে বৈষম্য নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই মতবাদে মনে করে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানায় সকল সমস্যার মূল। তাই সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা হস্তগত করে সকল সম্পদ রাষ্ট্রের মালিকানা করতে হবে। উৎপাদন কাজে সবাই অংশগ্রহণ করবেএবং উৎপাদিত ভোগ্য দ্রব্য সবাই ভোগ করবে। ফলে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে।
কিন্তু সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ মানুষকে অর্থনৈতিক জীব হিসেবে মনে করে। সমাজতন্ত্র মানুষকে একনায়কতন্ত্রের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছে। অর্থনীতি ও রাজনীতি পুঁজিবাদ থেকে ভিন্ন হলেও অনেক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদী দর্শন ধারণ করে। এই প্রসঙ্গে ডঃ আলী শরীয়তী বলেছেন- “সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের চেয়েও বড় পুঁজিবাদ। কারণ পুঁজিবাদ চায় ব্যক্তিগত পুঁজির বিকাশ আর সমাজতন্ত্র চায় রাষ্ট্রীয় পুঁজির বিকাশ”। সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের সংস্কৃতিও এক আর তা হল ভোগ। এই দুটি মতবাদে মানুষ পুঁজি উপার্জন ও ভোগের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি বলেছেন -“মানব সভ্যতার মূল বিপদ আজ এইযে মানুষ অভ্যন্তরীণ এক শত্রু দ্বারা আক্রান্ত। এই শত্রু হল মানুষের অভ্যন্তরীণ ভোগ প্রবনতা”। পুঁজিবাদে শুধু সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা এবং বেঁচে থাকার চরম প্রতিযোগিতা যেমন এক চরম পন্থা। অন্যদিকে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং একনায়কতন্ত্রও তেমন এক চরম পন্থা। এই দুই মতবাদই কুসংস্কার এবং মানবীয় সমাজ বিনির্মাণের পথে বাধা।
অন্যদিকে ইসলাম সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকৃতি দেয় আবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাকেও স্বীকৃতি দেয় ।ব্যক্তিকে স্বাধীনতাও প্রদান করে আবার ব্যক্তির স্বাধীনতা যদি সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়, এমন অবাধ স্বাধীনতাও দেয় না। আর ইসলামের সংস্কৃতি হচ্ছে ত্যাগধর্মী।
বিষয়: বিবিধ
১৩০১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন