চোখের আলো নয়, মনের আলোতে বিশ্ব জয়

লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী ব্লগার ১১ আগস্ট, ২০১৪, ০৫:১০:৩২ বিকাল

চলো এবার আপনাদের নিয়ে উড়াল দেই দেশের মায়া কাটিয়ে বিদেশে। চলো পরিচিত হই দৈহিকভাবে অপূর্ণাঙ্গ কিন্তু মানসিকভাবে খুবই শক্তিশালী কিছু ভাইয়ার সাথে এবং নভোচারিণী এক বোনের সাথে। তোমাদের মতোই ফিলিপাইনের এক ছেলে নাম বেয়েনভেনিডো ক্যানোডিজাডো সংক্ষেপে বিয়েন। বয়স কিন্তু মাত্র ষোল। ম্যানিলার ইউনির্ভসিটি অফ সান্টোথমাসে পলেটিক্যাল সায়েন্সে সে এই কেবল অনার্স শুরু করেছে। বলা যায় আমাদের তুলনায় একটু আগেভাগেই, তাইনা? পড়াশোনার প্রতি তার ভীষণ আগ্রহ। তার ইচ্ছা আছে এখানকার পড়াশোনা শেষ করেই অ্যাটিনিও ল স্কুলে সে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেবে। তোমরা কি জান অ্যাটিনিও ল স্কুল খুব নামকরা প্রতিষ্ঠান? এখানে চান্স পাওয়া কিন্তু মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। তারপরও বিয়েন সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসী, স্কুলের ক্লাসগুলিতে সে বরাবরই ভালো গ্রেড পেয়ে এসেছে। তার বিশ্বাস এসব গ্রেডের জোরেই সে কোন একটি স্কলারশীপ জুটিয়ে ঠিকই ঢুকে পড়বে অ্যাটিনিওতে। নিজের বয়েসি আর দশটা ছেলের মতোই হাসিখুশি আর ব্যস্ত সময় কাটায় বিয়েন। নিয়মিত ক্লাস করে। বাসা থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করে। অবসরে আড্ডা দেয় ইন্টারনেটের চ্যাটরুম গুলোতে ঢুকে। পড়াশুনা, পরিশ্রম, জীবনযাত্রা, স্বপ্ন, বিনোদন সবদিক হতেই বিয়েনের সঙ্গে নানা মিল তার সহপাঠীদের। অমিল কেবল একটাই। ইস! সে অন্যদের মতো চোখে দেখে না। পৃথিবীর রং রূপ সে আস্বাদন করতে পারেনা। বিয়েন দেখে তার মনের চোখ দিয়ে তার গাঢ় অনুভূতি দিয়ে। হায়! গোটা দুনিয়ার পনের কোটি দৃষ্টিহীন মানুষের মধ্যে সেও একজন। মনের চোখ মেলে সাদা ছড়ি হাত এগিয়ে চলা ব্যতিক্রম একজন। অসাধারন মনের জোরই বিয়েনকে এমন ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। দূরারোগ্য এক নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের কারণে জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন সে। এমনকি সমস্যা হয় বাম কানে শুনতে। তারপরও থেমে থাকেনি বিয়েন। স্কিন রিডিং সফটওয়্যার, স্পিচ সিনথেসাইজার এর মতো অ্যসিসটিভ টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে চমৎকার দক্ষতা অর্জন করেছে সে কম্পিউটার ব্যবহারে। ফিলিপটাইন্স ব্লাইন্ড ইউনিয়ন পরিচালিত কম্পিউটার লিটারেসি কোর্স শেষ করেছে সে সাফল্যের সাথে।

সুপ্রিয় ভাইবোনেরা, চলো এবার আরেক বন্ধুর সাথে পরিচয় হই। ফিলিপাইন থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এক্কেবারে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকার ওহিও নগরীতে ছেলেটির বাস। নাম সুলেমান গকিইট। কি পরিচিত লাগছে নামটা? হ্যাঁ,তার জন্ম তুরস্কে,জাতিতে সে মুসলিম। পাঁচ বৎসর বয়সের সময় তার পরিবার স্থায়ীভাবে আমেরিকায় চলে আসে। এখন তার বয়স একুশ। ওহিরও ইউনিভার্সিটি অব টলেডোতে গ্রাজুয়েশন করছে সুলেমান। পাশাপশি কাজ করছে কম্পিউটার ফার্ম ইন্টোলিডাটা টেকনোলজিতে। দুই বৎসর বয়স হতেই সে দৃষ্টিহীন। কিন্তু ইন্টেলিডাটা কর্পোরেশনে বার্ষিক ১৪ হাজার ডলারের চাকুরীটা বাগাতে এই অন্ধত্ব তার কোন সমস্যাই করেনি। বরং ৭০ মিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে কম্পিউটার টেকনিশিয়ান এবং প্রোগ্রামার হিসাবে তাকে রাজকীয় সম্মান দেখানো হয়।

দুই বৎসর বয়সের সময়েই রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা নামক জটিল একটা অসুখে চোখের জ্যোতি হারাতে শুরু করে সুলেমান। উন্নত চিকিৎসার খোঁজে সুলেমানকে বুকে নিয়ে খোদ আমেরিকার মায়ো ক্লিনিকে ছুটে আসেন তার বাবা। কিন্তু হায়! বিশ্ববিখ্যাত মেডিক্যাল সেন্টারটিও ব্যর্থ হয় তাদের স্বপ্ন পূরণে। তবে ডাক্তার বাবাকে পরামর্শ দেন, সুলেমানকে সাধারণ ছেলেমেয়ের মতোই সমান গুরুত্ব দিয়ে মানুষ করতে কোন প্রকার হেলাফেলা না করতে। সে কথা শুনেই এক্কেবারে টার্কি থেকে সপরিবারে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন তার বাবা। ছেলেকে ভর্তি করে দেন স্কুলে। স্কুল পর্যায়েই সুলেমানের অসামান্য স্মৃতিশক্তির কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। দুইবার শুনেই যে কোন কিছু মুখস্থ করে ফেলতে পারে সে। দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন অন্যান্য সহপাঠীদের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে সে অসামান্য কৃতিত্বের সাথে স্কুলের গন্ডি ডিঙ্গিয়ে ভর্তি হয় কলেজে। একদিন কলেজের বুলেটিন বোর্ডে ঝুলানো ইন্টেলিডাটার রিক্রুটিং এডের কথা কানে আসে তার। অ্যাপ্লাই করে সুলেমান। পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটার হার্ডওয়ার ও সফটওয়্যারের কাজ দারুণভাবে শিখেছে সে। একজন ফুলটাইম প্রোগ্রামার এবং কম্পিউটার টেকনিশিয়ানকে রীতিমত ছাঁটাই করে পুরো দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাকে। অবশ্য সুলেমান সে বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে। ছোট বড় অসংখ্য প্রজেক্টে তার কোম্পানির টেকনিক্যাল নেতৃত্ব দিয়েছে সে। এখনও কাজ করছে সে সমান তালে। সে ছাড়াও আরও প্রায় সাড়ে তিনশত কর্মচারী কর্মকর্তা আছেন ইন্টেলডাটা কর্পোরেশন। কিন্তু সেই হলো একমাত্র কর্মকর্তা যে চব্বিশ ঘন্টা অনকলে থাকে। অর্থাৎ দিনরাত যখনই ডাকা হোক অফিসে এসে কাজে বসে যায় সে। দৃষ্টিহীন সুলেমানই এখন ৭০ মিলিয়ন ডলার কোম্পানিটির টপ ট্রাবলশুটার। হয়তো ভবিষ্যতে নতুন আমেরিকা গঠনে সে হবে একজন পথিকৃৎ। বন্ধুরা, এ সকল উদাহরণের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম দৈহিক অপূর্ণতা এমনকি অন্ধত্বও মানুষের জীবনে কোন বাধা নয় বরং এগুলিকেই শক্তি হিসাবে কাজে লাগিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া যায় সম্মুখপানে।

এই ফাঁকে ছোট্ট বোনদের উদ্দেশ্যেও বলতে চাই, শুধু মেয়ে হয়ে জন্মাবার কারণেই কি জ্ঞান বিজ্ঞান আর উন্নয়নে তোমাদের পিছিয়ে থাকা ঠিক হবে? এটা এক ধরনের হীনমন্যতা নয় কি? রাসূল (সা) এর সময়ও আল হাদিস স্মরণ ও সংরক্ষনে আয়েশা (রা) এর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। বর্তমান সময়ে ইরানে একজন পর্দানশীন মহিলাই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আজকে তোমাদের দু-তিনজন জগদ্বিখ্যাত মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।

১৯৬৩ সাল, রাশান নভোচারী ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা মহাশূন্য পরিভ্রমন করেন। মহাশূন্যে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা নভোচারী। ১৯৮৩ সালের আগ পর্যন্ত আমেরিকায় মহাশুন্যযানে নভোচারী হিসেবে কোন নারী নির্বাচিত হননি। আমেরিকায় প্রথমবারের মত ১৯৮৩ সালে মহাশূন্যযানের জন্য একজন নারী নভোচারী হিসেবে নির্বাচিত হন। ৩২ বৎসরের স্যালি রাইড স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার মহাশূন্যে পরিভ্রমন করেন। স্যালির পরে অনেক মেয়েই নভোযাত্রী হয়েছেন কিন্তু নভোযানের নেতা হয়েছেন মাত্র একজন। তিনি হলেন এপোলো ১১ মিশনে স্পেস শাটল কলাম্বিয়ার কমান্ডার এলিন কলিন্স। আমেরিকার স্পেস শাটল কলাম্বিয়ার মহাকাশযাত্রাকে নাসা কর্মকর্তারা স্মরনীয় করে রাখতে চাইলেন এপোলো-১১ র উড্ডয়নের ত্রিশতম বার্ষিকী পালনের মাধ্যমে। কর্মকর্তারা চাইলেন এই বিশেষ দিনটিতেই কলাম্বিয়া মহাশূন্যে যাত্রা করুক। কলাম্বিয়া স্পেস ফ্লাইটটির পাইলট সিটে বসে আছেন এলিন কলিন্স-আমেরিকার কোন স্পেস ফ্লাইটের প্রথম মহিলা কমান্ডার। তার মহাকাশযানটি আকাশে উড়াল দিল আর নারীদের ইতিহাসের তৈরী করলো এক গৌরবোজ্জ্বল বিজয়গাঁথা।

বিষয়: বিবিধ

১৩৯০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

253266
১১ আগস্ট ২০১৪ বিকাল ০৫:৪১
নূর আল আমিন লিখেছেন : ভাল্লাক্সে অনেক
কিছু জানতে পারলাম
লিখে যান আপনার
মতো
||
253282
১১ আগস্ট ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৯
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : গল্প পড়ে অসাধারণ লেগেছে, আমিও চাই নিজেকে প্রমাণ করতে, কিন্তু অপরের সফলতার কাহিনী শুনতে যত ভাল লাগে নিজের জন্য তা প্রয়োগ করতে গেলে বুঝি কত কঠিন। হতাশা পেয়ে বসে!
ধন্যবাদ আপনাকে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File