গণমানুষের কবি দিলওয়ারের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং দোয়া করি আল্লাহ পাক যেনো তাঁকে জান্নাতবাসী করেন।

লিখেছেন লিখেছেন সাহেদ কালাম ১০ অক্টোবর, ২০১৪, ০৬:৪৬:৩৯ সন্ধ্যা

কবি দিলওয়ারের কবিতা যারা পড়েন বা তাঁর সম্পর্কে জানেন,

তারা সকলেই লক্ষ করবেন যে, মানবেতিহাসের প্রথম

মানবশিশুটির প্রতি তিনি যেমন সংবেদনশীল ও অসহায়ত্বের

তীব্র মমত্ববোধে কাতর, তেমনি যে-শিশু আজ ভোরে জন্মগ্রহণ

করেছে, হোক না পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের পর্ণকুটিরে, তার

প্রতিও কবির সমান সংবেদনশীলতা, মমত্ববোধ ও দায়। সেই দায় ও মমত্বকে কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর খুব কম কবিই

কবিতা লিখে গেছেন, কবিত্ব বা শিল্পের প্রশংসা পাবার

তোয়াক্কা না করেই। বিশেষ করে কবিতাকে গণমানুষের

অধিকার আদায়ের অস্ত্র ও এক কল্যাণকর ব্রত হিসেবে মোহময়

পৃথিবীতে একটা গোটাজীবন কাটিয়ে দেওয়া কোনো সাধারণ

মানুষের পক্ষে সম্ভব কি-না, তা একমাত্র শুভবোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব।

মানুষ ও মানবতাই কবি দিলওয়ারের জীবনদর্শনের মূলমন্ত্র।

শুধু কবিতা নয়, তাঁর প্রতিদিনের আলাপচারিতা, চিন্তা-

চেতনা, গদ্যরচনা, খেদোক্তি, বক্তৃতা, তর্ক প্রভৃতিতে মানুষের

মুক্তি ও প্রগতি, মানব হয়ে ওঠার প্রকল্প এবং মানবজাতির

মহাঐক্যের সুর অবিসংবাদিতভাবে উচ্চকিত। গোটা জীবন- জুড়ে তাঁর আরাধ্যও ছিল তাই। এই আরাধ্য-বাসনা শৈশব থেকেই

তাঁর মর্মমূলে যে-গেঁথে গিয়েছিল, নানা বক্তৃতা ও

আত্মরচনা থেকে আমরা জানতে পারি; এবং এও

উপলব্ধি করতে পারি যে, দিলওয়ার খান-এর দিলওয়ার

হয়ে ওঠার পেছনে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক

প্রেক্ষাপটেরও একটা সুগভীর ভূমিকা রয়েছে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের মাঝামাঝিতে জন্মকারী এই

মানব সন্তানটি শৈশব-কৈশোরে চাক্ষুষ করেছেন এক পৈশাচিক

জগতের। আন্তর্জাতিক দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও

তারপরে দুইমেরু-কেন্দ্রিক স্নায়ুযুদ্ধ এবং জাতীয় দিক

থেকে ভারত বিভাগ তথা বঙ্গবিভাজন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-

এ-সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এতদ্-অঞ্চলের মানুষের ভেতরে যে- সুগভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, সেইসব ক্ষত নিয়েই জীবনের

স্বাভাবিক ধাপগুলো অতিক্রম করছিলেন কবি। একদিকে অর্থহীন

বিশ্বযুদ্ধের দানবীয় লীলা, মানবাত্মার পরাজয়, দুই

মেরুকেন্দ্রিক পৃথিবীর ভয়াল রূপ, নব্য

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পৃথিবীব্যাপী আগ্রাসন, অর্থপুঁজির

বিস্তার, অস্ত্রের হুঙ্কার ও মারণাস্ত্রের মজুত; সর্বোপরি সমাজে বিদ্যমান অনাচার ও শোষণ;

এবং অন্যদিকে দেশবিভাগে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের

জন্ম, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভরপুর প্রতিবেশী দুই

বাংলার মানুষের উন্মুল হয়ে ওঠার গল্প, নব্য ধনিকশ্রেণির

উদ্ভব ও উল্লাস, নিঃসহায় মানুষের উৎপীড়িত জীবন ও

বঞ্চনা যে-সমাজ-আবহ এবং প্রতিবেশ তৈরি করেছিল তার ইতিবাচক শক্তি হিসেবে এই কবিপুরুষটির শাণিত-সংগ্রাম।

সর্বোপরি স্বদেশ ও স্বকালের মানুষের প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য

দায় ও দায়িত্বের নিবিড় পরাকাষ্ঠা হিসেবে দিলওয়ারের

কবিপ্রতিভার উন্মেষ ও উদ্ভাসন। একইসঙ্গে, জন্ম

থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে-দুঃসহ নীতি বাঙালি জীবনের

ওপর খড়্গহস্ত ছিল; বেসামরিক-সামরিক শক্তির দানবীয় ঘটনাক্রম, জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ আর এর

সঙ্গে সকলপ্রকার অনাচার-উৎপীড়ন-অপ্রেম-বাধাবিপত্তি-

বঞ্চনা-পীড়ন অতিক্রম করে যে-

বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান ও ক্রমবিকাশ,

কবি দিলওয়ারের তারুণ্য ও যৌবনের উদ্যমতা অনেকটা এ-

সবকে কেন্দ্র করেই। সুতরাং দিলওয়ারের কবি হয়ে ওঠার পেছনে তাই

মানবেতিহাসের অমোঘ নিয়তি যেমন কার্যকর ছিল,

তেমনি সমভাবে কার্যকর ছিল সমকালীন ইতিহাসের

অপ্রতিরোধ্য ঘটনাপ্রবাহও। আর একজন বিবেকবান ও

দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে সমাজরাষ্ট্রের অপশক্তির

বিরুদ্ধে লেখনি ধরা ছাড়া, প্রতিবাদী কবিকণ্ঠ হয়ে ওঠা ছাড়া তাঁর অন্য বিকল্প ছিল বলে মনে হয় না।

কবি দিলওয়ারকে আমার কখনো মনে হয় গ্রিক

অ্যাস্ফিথিয়েটারের কোনো বেদনাবিধূর চরিত্র, আবার

কখনো মনে হয় ভারত-পুরাণের আরেক বেদনাবিধূর চরিত্র,

রাবণের মতো। এরূপ মনে হওয়ার কারণ, তাঁর সমকালীন

সমাজরাষ্ট্র, তাঁর সুগভীর মনীষা, তাঁর সংবেদনশীলতা এবং তাঁর ব্যক্তিজীবন-সকলদিক

বিবেচনা করেই। দিলওয়ারের কবিতায় ঘুরে-

ফিরে এসেছে গ্রিক-রোমান পুরাণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা-

আসলে যার মর্মের প্রণোদনা সমকাল ও সমকালীন মানুষের দুঃসহ

অনুভব ও বৈরি পরিবেশ। অনায়াসে তিনি তাই গ্রিক-পুরাণের

ভেতর ঢুকে তমোহর ব্যক্তিসত্তা হয়ে ক্রান্তিকালের স্বদেশকে অনুভব করেন : ফেডিপাইডিসের, আমার হৃদয়ের ম্যারাথনের সময়

সমগ্র সমতল ভূমি ঘিরে শত্রু সৈন্যের সমাবেশ,

আমি খবর পাঠাবো আমার বন্ধুদের কাছে স্পার্টায় :

সেই দেশের বীরদের হাতে বৈরীনাশা হাতিয়ার

শাণিত বিদ্যুল্লতার মতো ক্ষণে নৃত্যমুখর… দিলওয়ারের স্বদেশে এক ভয়াল যুদ্ধ হয়েছিল। উনিশ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তিনি তার স্বাক্ষী। এমন যুদ্ধ গ্রিসেও

হয় নি। লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতাও এসেছিল।

দিলওয়ারের কাছে সেই রক্তদান, লক্ষপ্রাণ আর

স্বাধীনতা বড়োই অর্থহীন ঠেকে বাস্তবের বর্তমান

পর্যবেক্ষণ করে। সর্বদা তাঁকে ক্ষতাক্ত করে মধ্যসত্তরের নব্যস্বাধীন রাষ্ট্রের দানবীয় লীলা ও জাতির জনকের

সপরিবার নৃশংস হত্যাকা-। স্বাধীনতাকে তাঁর কাছে অর্থহীন

করে তোলে স্বাধীনতা-উত্তর সামরিক শাসন ও নানা অন্যায়

জেল-জুলুম, হত্যাকা- এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ

সংবিধানকে কেটেছেঁটে সাম্প্রদায়িক করে তোলার ষড়যন্ত্র।

অন্যদিকে সমাজ-রাষ্ট্রের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসা মুনাফাখোর

দুর্বৃত্তরা যেভাবে ধীরে ধীরে সমাজের ও রাষ্ট্রের ত্রাতা-

ভাগ্যবিধাতা বনে গেল এবং এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল

সমাজ-প্রতিবেশের ভেতর থেকে জন্ম নিল সাম্প্রদায়িক

রাজনৈতিক গোষ্ঠী, দেশজুড়ে সৃষ্টি হলো এক অন্ধ মধ্যযুগীয়

দাঁতাল চরিত্রের সমাবেশ- যাদের দুর্বৃত্তপনা ও অশুভ তৎপরতা সমাজরাষ্ট্রের মুক্তি ও প্রগতির চাকাকে অকার্যকর

করে তুলতে সর্বদা বদ্ধপরিকর হলো। এই অন্ধকার

পরিবেশে সমগ্র স্বদেশের মানুষের হয়ে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন

মানুষের হয়ে, মানবাত্মার শুভ্রবাহক হয়ে, স্বদেশ ও মানুষের

জন্য দিলওয়ারের গগণভেদী আর্তি শুনি : সুউচ্চ অলিম্পাসের চূড়াবাসী দেবতাকূলই আজ

আমার ভায়ের, আমার বোনের, প্রিয়তম ও সন্তানদের

জঘন্য আরতি। তারা নতুন যুগের প্লুয়োটাস। তারা

দানবনিন্দিত মুনাফালোভের সুরম্য প্রাসাদকক্ষে বসে :

ইউরেপিডিস, এস্কাইলাস, সকোক্লিস আর আরোস্টোফানিসের

নাটকের পাতায় হিসাবের অংক কষে দেখো, ফেডিপাইডিস, মনুষ্যের বীর্যরসে এরা কোন ধাতব রাক্ষস? এইসব ‘ধাতব-রাক্ষস’ই সমাজ ও সভ্যতার চিরশক্র এবং এই

শত্রুদের প্রতিই কবির শাণিত অস্ত্র। দিলওয়ার জানতেন

সুবিধাভোগী এ-সব মনুষ্যবেশী জানোয়ার মেহনতি মানুষের

রক্তচুষে খেয়ে তাদের দেহকে কংকালসার করে তুলছে। মানুষের

মূল লড়াই আসলে এদের বিরুদ্ধেই। তাই তাঁর লড়াই

চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু। বলেছিলাম কবি দিলওয়ারকে ভারত-পুরাণের চরিত্র রাবণের

মতোই ভাবতে ভালো লাগে। আর্যসভ্যতা রাবণকে রাক্ষস

হিসেবে তুলে ধরলেও, নবযুগের বার্তাবাহক কবি মধুসূদন সে-

রাবণকে আমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন এক মহাপুরুষ

হিসেবে। প্রাজ্ঞ তিনি, দেশপ্রেমিক, ত্রাতা, পিতা ও স্বামী।

সুগভীর চারিত্র্যিক গুণাবলি তাকে মহান পুরুষে পরিণত করেছে। তা না হলে রাবণ ট্র্যাজেডির নায়ক হবেন কীভাবে?

রাবণের ট্র্যাজেডির মূলে স্বদেশের প্রতি দায়বোধ ও

সন্তানের প্রতি সুগভীর মমত্ব। নিজের চোখের সামনে রাবণের

স্বর্ণলঙ্কা অপশক্তির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে;

একে একে প্রিয় পুত্র ও জাতীয় বীরেরা মৃত্যুর

কোলে ঢলে পড়ছেন, রাবণ শুধু বেঁচে থেকে দেখছেন তার প্রিয় স্বদেশ ও সন্তানদের বিনাশী-দৃশ্য। অর্থাৎ নিয়তির নিষ্ঠুর

যজ্ঞে রাবণ অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কিন্তু জীবনবিমুখ নন

এতটুকু। স্বর্ণলঙ্কা বিদেশি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত

হলে কি নিদারুণ আর্তি ছিল আমরা শুনি

বিষয়: বিবিধ

১০৮৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File