ইমাম আবূ হানীফার জীবনী ও মূল্যায়ন ডঃ খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

লিখেছেন লিখেছেন নুর আয়শা আব্দুর রহিম ১৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:৪৭:২০ রাত





ইমাম আবূ হানীফার জীবনী প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাম্বালী ফকীহ আল্লামা যাহাবী (৭৪৮ হি) প্রসিদ্ধ একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

الإمامة في الفقه ودقائقه مسلمة إلى هذا الامام. وهذا أمر لا شك فيه.

وليس يصح في الاذهان شئ : إذا احتاج النهار إلى دليل

‘‘ইলমুল ফিকহ ও এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে নেতৃত্বের মর্যাদা এ ইমামের জন্য সংরক্ষিত। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। ‘‘যদি দিবসকে প্রমাণ করতে দলিলের প্রয়োজন হয় তবে আর বুদ্ধি-বিবেক বলে কিছুই থাকে না’’।

অর্থাৎ দিবসের দিবসত্বে সন্দেহ করা বা দিবসকে দিবস বলে প্রমাণ করতে দলিল দাবি করা যেমন নিশ্চিত পাগলামি, তেমনি ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদার বিষয়ে সন্দেহ করা বা তাঁর মর্যাদা প্রমাণের জন্য বিস্তারিত আলোচনা করাও জ্ঞান জগতের পাগলামি বলে গণ্য হওয়া উচিত। তারপরও কিছুটা ‘পাগলামি’ করতে বাধ্য হলাম।

আমার একান্ত প্রিয়ভাজন কয়েকজন আলিম ও সচেতন মানুষ আমাকে অনুরোধ করলেন ইমাম আবূ হানীফার মূল্যায়ন বিষয়টি একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে। কারণ ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থটি ইসলামী আকীদা বিষয়ে লিখিত সর্বপ্রথম মৌলিক গ্রন্থ। এ গ্রন্থটির বিষয়বস্ত্ত আলোচনার পূর্বে লেখকের মূল্যায়ন বিষয়ক অভিযোগ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

বর্তমান যুগেও আরবী, বাংলা ও অন্যান্য ভাষার গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে বিতর্ক উত্থাপিত হচ্ছে। অনেক অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে এ বিষয়ক অস্পষ্টতা বা প্রশ্ন থাকতে পারে। এজন্য তাঁর জীবনী অতি সংক্ষেপে আলোচনা করে তাঁর মূল্যায়ন বিতর্কটি বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করলাম।

১. যুগ পরিচিতি

মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ফকীহের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (৮০-১৫০ হি) প্রথম। তিনি ছিলেন তাবিয়ী প্রজন্মের। ইমাম মালিক ইবন আনাস (৯৩-১৭৯ হি) ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস শাফিয়ী (১৫০-২০৪ হি) উভয়ে তাবি-তাবিয়ী প্রজন্মের। আর ইমাম আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাম্বাল (১৬৪-২৪১হি) ছিলেন তাবি-তাবিয়ীদের ছাত্র পর্যায়ের। রাহিমাহুমুল্লাহু: মহান আল্লাহ তাঁদেরকে রহমত করুন। বস্ত্তত তাবিয়ী যুগের ফকীহগণের মধ্যে একমাত্র ইমাম আবূ হানীফাই এরূপ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।

৪১ হিজরী সালে মুআবিয়া (রা)-এর খিলাফত গ্রহণের মাধ্যমে উমাইয়া যুগের শুরু। ৬০ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইয়াযিদ ইবন মুআবিয়া প্রায় চার বৎসর শাসন করেন (৬০-৬৪ হি)। তার মৃত্যুর পর কয়েক মাস তার পুত্র মুআবিয়া এবং বৎসর খানেক মারওয়ান ইবনুল হাকাম রাজত্ব করেন (৬৪-৬৫ হি)। তার পর তার পুত্র আব্দুল মালিক প্রায় ২১ বৎসর রাজত্ব করেন (৬৫-৮৬ হি)। ১৩২ হিজরী পর্যন্ত পরবর্তী প্রায় ৪৬ বৎসর আব্দুল মালিকের পুত্র, পৌত্র, ভাতিজাগণ রাজত্ব পরিচালনা করেন। ৯৯ থেকে ১০১ হিজরী সাল: প্রায় তিন বৎসর উমার ইবন আব্দুল আযীয খিলাফত পরিচালনা করেন। তাঁর শাসনামল ‘‘খিলাফাতে রাশেদার’’ পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য।

৯৯ হিজরী সাল থেকেই ‘‘নবী-বংশের রাজত্ব’’ শ্লোগানে গোপনে আববাসী আন্দোলন শুরু হয়। ১২৭ হিজরী থেকে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও যুদ্ধ শুরু হয়। ১৩২ হিজরীতে উমাইয়া খিলাফতের পতন ঘটে ও আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠা পায়। প্রথম আববাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফ্ফাহ প্রায় চার বৎসর (১৩২-১৩৬ হি) এরপর আবূ জাফর মানসূর প্রায় ২২ বৎসর (১৩৬-১৫৮ হি) রাজত্ব করেন। রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতন, অস্থিরতা ও পরিবর্তনের পাশাপাশি ধর্মীয় বিশ্বাস ও কর্মেও নানা দল-উপদল জন্ম নেয় এ সময়েই। আভ্যন্তরীণ সমস্যাদি সত্ত্বেও মুসলিম রাষ্ট্র তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। চীন, রাশিয়া ও ভারতের কিছু অংশ থেকে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন পর্যন্ত- তৎকালীন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি- মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে।

ইমাম আবূ হানীফার জন্মের পূর্বেই আলী (রা)-এর খিলাফতের সময়ে খারিজী ও শীয়া দুটি রাজনৈতিক-ধর্মীয় ফিরকার জন্ম হয়। উমাইয়া যুগের মাঝামাঝি সময় থেকে কাদারিয়া, মুরজিয়া, জাহমিয়া, মুতাযিলা প্রভৃতি ফিরকার উদ্ভব ঘটে। এ সময়েই উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিকের রাজত্বকালে ইমাম আবূ হানীফার জন্ম ও আববাসী খলীফা মানসূরের সময়ে তাঁর ওফাত।

২. সংক্ষিপ্ত জীবনী

২. ১. বংশ ও জন্ম

ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) পূর্ণ নাম ‘আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত ইবন যূতা। তাঁর পৌত্র ইসমাঈল তাঁর বংশ বর্ণনায় বলেন, আমি ইসমাঈল ইবন হাম্মাদ ইবন নুমান ইবন সাবিত ইবন নুমান ইবন মারযুবান। আমরা পারস্য বংশোদ্ভূত এবং কখনো দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হই নি। আমার দাদা ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। সাবিত শৈশবকালে আলী (রা)-এর নিকট উপস্থিত হন এবং তিনি তাঁর ও তাঁর বংশের মঙ্গলের জন্য দুআ’ করেছিলেন । আমরা আশা করি তাঁর ঐ দুআ নিষ্ফল হয় নি।

তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কেউ ৬০ হি. এবং কেউ ৭০ হি. সাল উল্লেখ করেছেন। তবে অধিকাংশের মতে তিনি ৮০হি. (৬৯৯ খৃ.) সালে জন্ম গ্রহণ করেন।

২. ২. শিক্ষাজীবন ও উস্তাদগণ

ইমাম আবূ হানীফা তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরুতে কুরআন কারীম মুখস্থ করেন। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কুরআন কারীমের প্রসিদ্ধ ৭ কারীর অন্যতম কারী আসিম ইবন আবিন নাজূদ (১২৮ হি)-এর নিকট ইলমুল কিরাআত শিক্ষা করেন।[3] পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন।

আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সাহাবীদের কেউ কেউ ১১০ হিজরী সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কাজেই ইমাম আবূ হানীফার জন্য কোনো কোনো সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করা ও শিক্ষা গ্রহণ করা খুবই সম্ভব ছিল। বাস্তবে কতজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। হানাফী জীবনীকারগণ দাবি করেছেন যে, কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। পক্ষান্তরে দু-একজন বিরোধী দাবি করেছেন যে, কোনো সাহাবীর সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি। এ প্রসঙ্গে সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও শাফিয়ী ফকীহ ইবন খাল্লিকান আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম (৬০৮-৬৮১ হি) বলেন:

وأدرك أبو حنيفة أربعة من الصحابة، رضوان الله عليهم وهم: أنس بن مالك وعبد الله بن أبي أوفى بالكوفة، وسهل بن سعد الساعدي بالمدينة، وأبو الطفيل عامر بن واثلة بكمة، ولم يلق أحداً منهم ولا أخذ عنه، وأصحابه يقولون: لقي جماعة من الصحابة وروى عنهم، ولم يثبت ذلك عند أهل النقل.

‘‘আবূ হানীফা চার জন সাহাবীর (রা) সময় পেয়েছিলেন: (১) (বসরায়) আনাস ইবন মালিক (৯২ হি), (২) কূফায় আব্দুল্লাহ ইবন আবী আওফা (৮৭ হি), (৩) মদীনায় সাহল ইবন সা’দ সায়িদী (৮৮ হি) এবং (৪) মক্কায় আবুত তুফাইল আমির ইবন ওয়াসিলা (১১০ হি)। তাঁদের কারো সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি এবং কারো থেকেই তিনি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তাঁর অনুসারীরা বলেন যে, কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি তাঁদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণের নিকট এ বিষয় প্রমাণিত হয় নি।’’

হানাফী জীবনীকারগণের বর্ণনায় ৭ জন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল:

(১) জাবির ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন হারাম আনসারী খাযরাজী মাদানী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৭০ হিজরীর পর)

(২) আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস. রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৫ হি বা তাঁর পূর্বে)

(৩) ওয়াসিলা ইবনুল আসকা ইবন কা’ব ইবন আমির লাইসী শামী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৫ হি)

(৪) আব্দুল্লাহ ইবন আবী আওফা: আলকামা ইবন খালিদ ইবনুল হারিস আসলামী কূফী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৭ হি)

(৫) আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিস ইবন জুয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মা’দীকারিব যাবীদী মিসরী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৮ হি)

(৬) আনাস ইবন মালিক ইবনুন নাদর ইবন দামদাম ইবন যাইদ হারাম আনসারী নাজ্জারী মাদানী, রাদিয়াল্লাহ আনহু (৯২/৯৩ হি)

(৭) আয়েশা বিনত আজরাদ। তাঁর মৃত্যু তারিখ এবং অন্যান্য পরিচয় জানা যায় না। তিনি ইবন আব্বাস ও অন্যান্য সাহাবী থেকে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিক ও রিজালবিদগণ তাঁকে তাবিয়ী হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে সাহাবী বলে গণ্য করেছেন।

এ প্রসঙ্গে নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও হানাফী ফকীহ আল্লামা মাহমূদ ইবন আহমদ বদরুদ্দীন আইনী (৭৬২-৮৫৫ হি) বলেন: জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনাটি বাহ্যতই সঠিক নয়। তবে অন্যান্যদের সাথে তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। যেহেতু তাঁর জীবনীকারগণ তা উল্লেখ করেছেন সেহেতু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া তা অস্বীকার করা অযৌক্তিক পক্ষপাতমূলক আচরণ বলে গণ্য।

বাস্তবে প্রায় সকল জীবনীকার, রিজালবিদ ও ঐতিহাসিক একমত যে সাহাবী আনাস ইবন মালিক (রা)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। আল্লামা আইনী বলেন:

كان أبو حنيفة، رضى الله عنه، من سادات التابعين، رأى أنس بن مالك، ولا يشك فيه إلا جاهل وحاسد. قال ابن كثير فى تاريخه: أبو حنيفة .... أدرك عصر الصحابة، ورأى أنس بن مالك، قيل: وغيره. وذكر الخطيب فى تاريخ بغداد أن أبا حنيفة رأى أنس بن مالك. وذكر المزى فى التهذيب أنه رأى أنس بن مالك، وكذا ذكر الذهبى فى الكاشف، وغيرهم من العلماء،

‘‘আবূ হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাবিয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। এ বিষয়ে একমাত্র কোনো মুর্খ বা হিংসুক ছাড়া কেউ সন্দেহ করেন নি। ইবন কাসীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে বলেন: আবূ হানীফা ... সাহাবীদের যুগ পেয়েছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। বলা হয় যে তিনি অন্য সাহাবীকেও দেখেছেন। খাতীব বাগদাদী তারীখ বাগদাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবূ হানীফা আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। মিয্যী তাঁর তাহযীবুল কামাল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। যাহাবী তাঁর ‘আল-কাশিফ’ গ্রন্থে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য আলিমও একই কথা লিখেছেন।’’

এছাড়া আবূ হানীফা (রাহ) তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের, বিশেষত ইরাকের সকল প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম থেকে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (৮৫৫ হি) উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আযমের শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির সংকলন ‘‘মুসনাদ আবী হানীফা’’ গ্রন্থের মধ্যে তাঁর তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী উস্তাদগণের সংখ্যা প্রায় ২০০।

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, রিজালবিদ ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম ইউসূফ ইবন আব্দুর রাহমান আবুল হাজ্জাজ মিয্যী (৭৪২ হি) সিহাহ-সিত্তাহ গ্রন্থগুলোর রাবীগণের জীবনীমূলক ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর হাদীসের উসতাদগণের মধ্যে ৭৭ জনের নাম উল্লেখ করেছেন, যাদের সূত্রে বর্ণিত ইমাম আবূ হানীফার হাদীস বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত। তাঁদের অধিকাংশই তাবিয়ী। কেউ কেউ ইমাম আযমের সমসাময়িক এবং কেউ কেউ তাবি-তাবিয়ী। এদের অধিকাংশই তৎকালীন যুগের সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাদীসের ইমাম বলে গণ্য ছিলেন। এদের অধিকাংশের বর্ণিত হাদীস বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থে সংকলিত।

২. ৩. অধ্যাপনা ও ছাত্রগণ

উস্তাদদের জীবদ্দশাতেই ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত ফিকহে তাঁর প্রধান উস্তাদ প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান (১২০ হি)-এর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং কূফার শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পরবর্তী ত্রিশ বৎসর তিনি গবেষণা ও অধ্যাপনায় অতিবাহিত করেন। ইমাম আবূ হানীফার মূল্যায়ন বিষয়ক পরিচ্ছেদে আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মত তাঁর জীবদ্দশাতেই মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাবিয়ী যুগের আর কোনো ফকীহ এরূপ প্রসিদ্ধি লাভ করেন নি। স্বভাবতই মুসলিম বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতেন। তাঁর ৯৭ জন মুহাদ্দিস ছাত্রের একটি তালিকা পেশ করেছেন ইমাম মিয্যী। তাঁদের অধিকাংশই সে যুগের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন এবং তাঁদের বর্ণিত হাদীস সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত। এছাড়া ইমাম আবূ হানীফার এ সকল ছাত্রের অনেকেই পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবৎ কূফা, বসরা, বাগদাদ, শীরায, ওয়াসিত, রাই, খুরাসানসহ মুসলিম বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ জনপদের বিচারক বা কাযির দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের সকলেই ১৫০ থেকে ২৩০ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন।

আল্লামা আইনী এ সকল ছাত্রের বাইরে আরে ২৬০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করেছেন যারা ইমাম আযম থেকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা করেছিলেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন প্রসিদ্ধ প্রতিটি শহরের নাম উল্লেখ করে তথাকার কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলিমের নাম উল্লেখ করেছেন যারা ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা করে এ সকল শহর ও নগরে ইলম প্রচারে রত থেকেছেন। তাঁদের অনেকেই এ সকল শহরের বিচারপতি, ইমাম বা প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। এভাবে দেখা যায় যে, তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি শহরেই ইমাম আবূ হানীফার অনেক প্রসিদ্ধ ছাত্র ছিলেন।

২. ৪. আখলাক

ইমাম আবূ হানীফার আখলাক ও ইবাদত সে মুবারক যুগের নেককারদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আরবী ভাষায় উচ্চাঙ্গের সাহিত্য প্রতিভা ও প্রাঞ্জল ভাষার অধিকারী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য শ্রোতাকে আকর্ষণ করত। যখন কথা বলতেন তখন মনে হতো সকল মানুষের মধ্যে তিনিই সবেচেয়ে ভাল কথা বলতে পারেন এবং তাঁর কথাই সবচেয়ে সুমিষ্ট। সহজেই তিনি নিজের বক্তব্য শ্রোতাকে বুঝাতে পারতেন। তাঁর দেহের রঙ ছিল সুন্দর এবং কিছুটা বাদামী। মুখমন্ডল ও অবয়ব ছিল সুন্দর ও আকর্ষণীয়। তিনি সুন্দর ও পরিপাটি পোশাক পরিধান করতেন এবং সর্বদা সুগন্ধময় থাকতেন। এমনকি তিনি যখন বাড়ি থেকে বেরোতেন তখন তাঁকে দেখার আগেই তাঁর সুগন্ধির মাধ্যমে তার আগমন বুঝা যেত। তাঁর ছাত্র আবূ ইউসুফ তার বর্ণনা দিয়ে বলেন:

كان أبو حنيفة ربعا من الرجال، ليس بالقصير ولا بالطويل، وكان أحسن الناس منطقا وأحلاهم نغمة، وأنبههم على ما يريد

‘‘আবূ হানীফা ছিলেন মাঝারি আকৃতির মানুষ, বেঁটেও নন এবং বেশি লম্বাও নন। মানুষদের মধ্যে কথাবার্তায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর, তাঁর কথার মাধুর্য্য ছিল সবচেয়ে বেশি এবং তিনি তাঁর মনের উদ্দেশ্য সবার চেয়ে ভাল বুঝাতে পারতেন।’’

তাঁর বিষয়ে উমার ইবনু হাম্মাদ বলেন:

إن أبا حنيفة كان طوالا، تعلوه سمرة، وكان لبسا، حسن الهيئة، كثير التعطر يعرف بريح الطيب إذا أقبل وإذا خرج من منزله قبل أن تراه

‘‘আবূ হানীফা কিছুটা লম্বা ছিলেন। তাঁর গায়ের রঙ ছিল কিছুটা বাদামী। তিনি পরিপাটি পোশাক পরিধান করতেন। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ ও অবয়ব ছিল সুন্দর। তিনি আতর ব্যবহার খুবই পছন্দ করতেন। তিনি যখন কোথাও যেতেন বা বাড়ি থেকে বের হতেন তখন তাঁকে দেখার আগেই সুগন্ধি থেকেই তাঁর আগমন বুঝা যেত।’’

হাইসামী বলেন: লম্বা হওয়া ও মাঝারি হওয়ার মধ্যে মূলত বৈপরীত্য নেই। এ দুটি বর্ণনার সমন্বয় হলো যে, তিনি বেশি লম্বা ছিলেন না, কাজেই তাকে মাঝারিই বলতে হবে। তবে মাঝারিদের মধ্যে তিনি লম্বা বলে বিবেচিত ছিলেন।

তাঁর অন্য ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক বলেন:

كان حسن السمت، حسن الوجه، حسن الثوب

‘‘তাঁর বাহ্যিক প্রকাশ ও অবয়ব ছিল সুন্দর, মুখমন্ডল ছিল সুন্দর এবং পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল সুন্দর।’’

তাঁর অন্য ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নুআইম ফাদল ইবনু দুকাইন বলেন:

كان أبو حنيفة حسن الوجه، والثوب، والنعل، وكثير البر والمؤاساة لكل من أطاف به

‘‘আবূ হানীফার মুখন্ডল, পোশাক, জুতা সবই ছিল সুন্দর। তাঁর আশেপাশে যারা থাকতেন তাদের প্রত্যেকের উপকার, কল্যাণ ও সহমর্মিতায় তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।’’

ইমাম আবূ হানীফা বড় ব্যবসায়ী ও ধনী ছিলেন। আর তাঁর ধনসম্পদ মানুষের জন্য, বিশেষত আলিমদের জন্য ব্যয় করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদারহস্ত। তিনি নিজের পরিবারের জন্য যেভাবে খরচ করতেন সেভাবেই খরচ করতেন আলিম, তালিবুল ইলম ও ছাত্রদের জন্য।। নিজের জন্য কাপড় কিনলে তাদের জন্যও কিনতেন। ফলমূল বা খাদ্যাদি ক্রয় করলে তিনি আলিম ও ছাত্রদের জন্য আগে ক্রয় করে তারপর নিজের পরিবারের জন্য ক্রয় করতেন। আর হাদীয়া, দান, অনুদান ও পরোপকারের জন্য যখন কিছু ক্রয় করতেন তখন তাঁর সর্বোচ্চ সাধ্যানুসারে তা ক্রয় করতেন। নিজের বা পরিবারের জন্য কিছু নিম্নমানের দ্রব্য ক্রয় করলেও অন্যদের জন্য তা করতেন না। আর ছাত্রদের তিনি নিজেই ভরণপোষণ করতেন। এমনকি অনেক দরিদ্র ছাত্র তার সাহচার্যে এসে সচ্ছল হয়ে যায়। তাঁর প্রিয় ছাত্র আবূ ইউসুফ ও তার পরিবারকে তিনি দশ বৎসর প্রতিপালন করেন।

তৎকালীন সুপ্রসিদ্ধ আলিম ও বুজুর্গ ফুদাইল ইবনু ইয়াদ (১৮৭ হি) বলেন:

كان أبو حنيفة معروفا بكثرة الأفعال، وقلة الكلام وإكرام العلم وأهله

‘‘আবূ হানীফা অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি কাজ বেশি করতেন এবং কথা কম বলতেন। তিনি ইলম এবং আলিমগণকে অত্যন্ত সম্মান করতেন।’’

তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অসাধারণ ইবাদত, তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল্লাইল।[19] পাশাপাশি তিনি ছিলেন হক্কের বিষয়ে আপোষহীন। ইমাম আবূ হানীফার প্রকৃতি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন ইমাম আবূ ইউসূফ। খলীফা হারূন রাশীদ (খিলাফাত ১৭০-১৯৩ হি) বিচারপতি আবূ ইউসুফকে বলেন: আবূ হানীফার আখলাক ও প্রকৃতির একটি বিবরণ আমাকে বলনু তো। তখন ইমাম আবূ ইউসুফ বলেন:

أنه كان شديد الذب عن محارم الله أن تؤتى، شديد الورع أن ينطق في دين الله بما لا يعلم، يحب أن يطاع الله ولا يعصى، مجانبا لأهل الدنيا في زمانهم، لا ينافس في عزها، طويل الصمت، دائم الفكر، على علم واسع، لم يكن مهذارا، ولا ثرثارا، إن سئل عن مسألة كان عنده فيها علم، نطق وأجاب فيها بما سمع، وإن كان غير ذلك قاس على الحق واتبعه، صائنا نفسه ودينه، بذولا للعلم والمال، مستغنيا بنفسه عن جميع الناس، لا يميل إلى طمع، بعيدا عن الغيبة، لا يذكر أحدا إلا بخير

‘‘আল্লাহর দীন বিরোধী সকল কিছুকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি অত্যন্ত পরহেযগার ও আল্লাহভীরু ছিলেন। দীনের বিষয়ে না জেনে কিছুই বলতেন না। তিনি চাইতেন যে, আল্লাহর আনুগত্য করা হোক এবং তার অবাধ্যতা না হোক। তিনি তাঁর যুগের দুনিয়ামুখি মানুষদেরকে পরিহার করে চলতেন। জাগতিক সম্মান-মর্যাদা নিয়ে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন না। গভীর জ্ঞানের অধীকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং চিন্তা-গবেষণায় রত থাকতেন। বেশি কথা বলা বা বাজে কথা বলার কোনো স্বভাব তাঁর ছিল না। কোনো মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি শ্রুতি বা হাদীসের ভিত্তিতে তার জবাব দিতেন। সে বিষয়ে কোনো শ্রুতি না থাকলে সঠিক কিয়াসের মাধ্যমে উত্তর দিতেন ও তা অনুসরণ করতেন। তিনি তাঁর নিজেকে ও তাঁর দীনকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁর জ্ঞান ও সম্পদ তিনি অকাতরে খরচ করতেন। তিনি সকল মানুষের থেকে নিজেকে অমুখাপেক্ষী রাখতেন। কোনো লোভ তাকে স্পর্শ করতো না। তিনি গীবত বা পরচর্চা থেকে দূরে থাকতেন। কারো কথা উল্লেখ করলে শুধু ভাল কথাই বলতেন।’’

তাঁর আপোষহীনতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন ছিল রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা গ্রহণে অস্বীকৃতি। শত চাপাচাপি ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি এ সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি কারো মুখ চেয়ে বিচার করতে বা অন্যায় বিচারের দায়ভার নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাযির হতে রাযি ছিলেন না। রাবী ইবনু আসিম বলেন, উমাইয়া সরকারের গভর্নর ইয়াযিদ ইবনু উমার ইবনু হুবাইরা (১৩২ হি)-এর নির্দেশে আবি আবূ হানীফাকে তার কার্যালয়ে নিয়ে আসি। তিনি তাকে বাইতুল মালের দায়িত্ব গ্রহণ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু আবূ হানীফা তা অস্বীকার করেন। একারণে ইবনু হুবাইরা তাকে ২০ টি বেত্রাঘাত করেন। ইবন হুবাইরা তাঁকে বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করেন।

এ ঘটনা ঘটে ১৩০ হিজরী সালের দিকে, যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫০ বৎসর। আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় আববাসী খলীফা মানসূর ১৫০ হিজরীতে ইমাম আবূ হানীফাকে বাগদাদে ডেকে বিচারপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। তিনি অস্বীকার করলে ক্রুদ্ধ খলীফা তাকে কারারুদ্ধ করেন এবং কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়।

ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হৃদয়ের প্রশস্ততা। তিনি বলতেন:

اللهم من ضاق بنا صدره فان قلوبنا قد اتسعت له

‘‘হে আল্লাহ, আমাদের বিষয়ে যার অন্তর সংকীর্ণ হয়েছে, তার বিষয়ে আমাদের অন্তর প্রশস্ত হয়েছে।’’

আব্দুস সামাদ ইবনু হাস্সান বলেন:

كان بين سفيان الثوري وأبى حنيفة شئ فكان أبو حنيفة أكفهما لسانا

‘‘সুফইয়ান সাওরী ও আবূ হানীফার মধ্যে বিরোধ-সমস্যা ছিল। এক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে আবূ হানীফা অধিক বাকসংযমী ছিলেন।’’

ইয়াযিদ ইবনু হারূন বলেন:

ما رأيت أحداً أحلم من أبي حنيفة... إن إنساناً استطال على أبي حنيفة وقال له: يا زنديق، فقال أبو حنيفة: غفر الله لك هو يعلم مني خلاف ما تقول

‘‘আমি আবূ হানীফার চেয়ে অধিক স্থিরচিত্ত ও প্রশস্তহৃদয় আর কাউকে দেখিনি। .... একবার এক ব্যক্তি তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তাঁকে বলে: হে যিন্দীক। তিনি উত্তরে বলেন: আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তিনি জানেন যে তুমি যা বলেছ আমি তা নই।’’

২. ৫. মৃত্যু

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ১৫০ হিজরী সালের মধ্য শাবানের রজনীতে বাগদাদের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। বাগদাদের খাইযুরান কবরস্থানে তাঁর দাফন হয়। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭০ বৎসর।

৩. মর্যাদা ও মূল্যায়ন: গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা

কোনো মানুষের ইমাম বা ওলী-বুজুর্গ হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তিনি নির্ভুল বা মানবীয় দুর্বলতার ঊর্দ্ধে। মানবীয় দুর্বলতায় কেউ কোনো ভুল বা অন্যায় কথা বলেছেন প্রমাণিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তিনি ওলী বা ইমাম নন, অথবা তাঁর সব কথাই ভুল।

ইসলামী বিশ্বাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আর কেউই মাসূম অর্থাৎ নিষ্পাপ বা অভ্রান্ত নন। সকল আলিম, ইমাম ও ওলী মানবীয় দুর্বলতার অধীন ছিলেন। ক্রোধান্বিত হয়ে, ভুল বুঝে একে অপরের বিরুদ্ধে বলেছেন, এমনকি যুদ্ধও করেছেন। কখনো ভুল বুঝতে পারলে বা ক্রোধ দূরীভূত হলে ক্ষমা চেয়েছেন বা ভুল স্বীকার করেছেন। কখনো তিনি ভুল বুঝতে পারেন নি। তাঁরা আল্লাহর দীন, ওহীর ইলম ও সুন্নাতের পালন ও প্রচারে নিজেদের জীবন অকাতরে ব্যয় করেছেন, তাঁদের ইজতিহাদ অনুসারে যা সত্য, সঠিক বা হক্ক বলে বুঝতে পেরেছেন তা রক্ষায় কোনো আপোস করেন নি। পাশাপাশি কখনো কখনো তাঁরা ইজতিহাদে ভুল করেছেন।

মুহাদ্দিসগণ এবং জারহ-তাদীলের ইমামগণ অন্যান্য মুহাদ্দিস ও হাদীসের রাবীদের মূল্যায়নে সর্বাত্মক নিরপেক্ষতার সাথে সচেষ্ট থেকেছেন। একজন মুহাদ্দিসের বর্ণিত হাদীসগুলো অন্যান্য মুহাদ্দিসদের বর্ণনার সাথে তুলনা ও নিরপেক্ষ নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মূল্যায়ন করেছেন। নিজের পিতা, সন্তান বা উস্তাদের বিরুদ্ধেও তাঁরা মত ব্যক্ত করেছেন। আবার কখনো কখনো মানবীয় দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়ে কারো অল্প ভুলকে বড় করে দেখেছেন বা কারো অনেক ভুলকে হালকা করে দেখেছেন। পূর্ববর্তী কারো সিদ্ধান্ত ভুল বা পক্ষপাতদুষ্ট হলে তা পরবর্তীগণ উল্লেখ করেছেন। হাদীস, ফিকহ, আকীদা কোনো বিষয়েই মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ পূর্ববর্তী আলিমগণকে নিষ্পাপ বা নির্ভুল বলে গণ্য করেন নি এবং অবমূল্যায়নও করেন নি। তাঁদের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধা-সহ তাঁদের কোনো সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রতীয়মান হলে তাঁরা তা উল্লেখ করেছেন। আমার লেখা ‘‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’’ এবং ‘‘বুহূসুন ফী উলূমিল হাদীস’’ পাঠ করলে পাঠক মুহাদ্দিসগণের সমালোচনার মূলনীতি জানতে পারবেন।

অনেক প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে বলেছেন। আমরা তাঁদের বক্তব্য সমর্থন বা খন্ডন করব। সমর্থন অর্থ অন্ধ সমর্থন নয়। আবার খন্ডনের অর্থ এ নয় যে, আমরা উক্ত আলিমের ইলম, তাকওয়া বা খিদমতের প্রতি কটাক্ষ করছি। কক্ষনো নয়! আমরা উম্মাতের সকল আলিম, ইমাম ও বুজুর্গকে ভালবাসি।

আমরা তাঁদেরকে তাঁদের ব্যক্তিত্বের জন্য নয়, বরং আল্লাহর জন্য ভালবাসি। আমরা ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম বুখারী বা অন্য কাউকে হক্ক-বাতিলের মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করছি না। বরং সবাইকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। আমরা বিশ্বাস করি যে, তাঁরা ইসলামের জন্য, কুরআন ও হাদীসের ইলমের জন্য তাঁদের জীবনকে কুরবানি করেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই আমরা দীন পেয়েছি। আল্লাহ তাঁদের সকলকে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করুন। তবে তাদের কাউকে আমরা নিষ্পাপ বা নির্ভুল মনে করি না। তাঁদের কোনো সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রমাণিত হলে তা উল্লেখ করায় তাঁদের অবমূল্যায়ন হয় না।

৪. দ্বিতীয় শতকের মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে আবূ হানীফা

হিজরী দ্বিতীয় শতকে মুসলিম বিশ্ব ছিল তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের বরকতময় যুগ। হাদীস, ফিকহ ও অন্যান্য সকল ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী ইমামগণের বিচরণে পরিপূর্ণ ছিল মক্কা, মদীনা, কুফা, বসরা, দামিশক, বাগদাদ ও সে যুগের অন্যান্য জনপদ। এ সকল প্রসিদ্ধ আলিমগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা ও প্রসিদ্ধি আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যখন আমরা দেখি যে, উমাইয়া ও আববাসীয় উভয় সরকার তাঁকে বিচারক পদে পেতে উদগ্রীব ছিল। উমাইয়া খিলাফতের শেষ দিকে, যখন ইমাম আবূ হানীফার বয়স ৫০-এর কোঠায় তখনই তাঁর প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে ইরাকের উমাইয়া গভর্নর ইবন হুবাইরা (১৩২ হি) তাঁকে বিচারক পদ গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। আববাসী খিলাফাত প্রতিষ্ঠার পর খলীফা মানসূর (রাজত্ব ১৩৬-১৫৮ হি) তাঁর খিলাফাতের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য ইমাম আবূ হানীফাকে বিচারপতির দায়িত্ব প্রদানের জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে বাধ্য করতে চেষ্টা করেন এবং কারারুদ্ধ করেন।

দ্বিতীয় একটি বিষয় লক্ষণীয়। ইমাম আবূ হানীফার পক্ষের ও বিপক্ষের সকল মতের মুহাদ্দিস, ফকীহ ও গবেষক একমত যে, ইমাম আবূ ইউসূফ (১১৩-১৮২ হি) তৎকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ, নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলিম বিশ্বে ‘‘কাযিল কুযাত’’, অর্থাৎ ‘প্রধান বিচারপতি’ উপাধি লাভ করেন। তিনজন আববাসী খলীফা মাহদী, হাদী ও হারূন রশীদের শাসনামলে প্রায় ২৪ বৎসর তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং দায়িত্বরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এ যুগশ্রেষ্ঠ আলিম নিজেকে আবু হানীফার ছাত্র হিসেবে গৌরবান্বিত মনে করতেন এবং তাঁর মতের পক্ষে ফিকহী ও উসূলী অনেক গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। এ থেকেও আমরা ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা খুব সহজেই অনুভব করতে পারি।

তৃতীয় আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। ইমাম আবূ হানীফা কূফার মানুষ ছিলেন। খলীফা মানসূরের ডাকে তিনি বাগদাদের গমন করেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনের বিষয়ে খলীফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলে তাঁকে কারাগারে রাখা হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তৎকালীন পরিবেশে কুফা ও বাগদাদ সম্পূর্ণ পৃথক দুটি দেশের মত। এজন্য কুফায় তাঁর জনপ্রিয়তা থাকলেও বাগদাদে নবাগত ও খলীফা কর্তৃক কারারুদ্ধ এরূপ ব্যক্তির জনপ্রিয়তা থাকার কথা নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর সালাতুল জানাযায় এত প্রচন্ড ভীড় হয় যে, ছয় বার তাঁর জানাযা পড়া হয়। দাফনের পর খলীফা মনসূর নিজে কবরের পাশে জানাযা পড়েন। এরপর প্রায় ২০ দিন মানুষেরা কবরের পাশে সালাতুল জানাযা আদায় করে।

ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর নিজ দেশ ছাড়িয়ে কিভাবে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তা আমরা এ ঘটনা থেকে অনুভব করতে পারছি। এরপরও আমরা তাঁর সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ কতিপয় আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।

(১) মুগীরাহ ইবন মিকসাম দাববী কূফী (১৩৬ হি)

ইমাম আবূ হানীফার শিক্ষক পর্যায়ের সুপ্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ মুগীরাহ ইবন মিকসাম। তিনি কুফার বাসিন্দা ছিলেন। বুখারী ও মুসলিমসহ সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তাঁর ছাত্র প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বিচারপতি জারীর ইবন আব্দুল হামীদ দাববী (১৮৮ হি)। বুখারী, মুসলিম ও সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। সাইমারী, যাহাবী, ইবন হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁদের সনদে তাঁর থেকে উদ্ধৃত করেছেন:

قال لي مغيرة: جالس أبا حنيفة تفقه فإن إبراهيم النخعي لو كان حياً لجالسه. ... والله يحسن أن يتكلم في الحلال والحرام

‘‘আমাকে মুগীরাহ বলেন: তুমি আবূ হানীফার মাজলিসে বসবে, তাহলে ফিকহ শিখতে পারবে। কারণ (কুফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ, মুগীরার উস্তাদ) ইবরাহীম নাখয়ী (৯৫ হি) যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিও আবূ হানীফার মাজলিসে বসতেন। ... আল্লাহর কসম! হালাল ও হারামের বিষয়ে সে ভালভাবে কথা বলার যোগ্যতা রাখে।’’[2]

(২) সুলাইমান ইবন মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৮ হি)

কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাবিয়ী সুলাইমান ইবন মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৮ হি)। ইমাম আবূ হানীফা তাঁর নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা করেন। তিনি অনেক সময় ইমাম আবূ হানীফাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি এ মাসআলাটি কোন দলিলের ভিত্তিতে বলেছ? আবূ হানীফা উত্তর করতেন, আপনার বর্ণিত অমুক হাদীসটির ভিত্তিতে। তখন তিনি অবাক হয়ে বলতেন,

يا معشر الفقهاء أنتم الأطباء ونحن الصيادلة

‘‘হে ফকীহগণ! তোমরা ডাক্তার আর আমরা ফার্মাসিস্ট!’’

আ’মাশ যখন হজ্জে যান তখন তিনি তাঁর ছাত্র আলী ইবন মুসহিরকে বলেন, আবূ হানীফার কাছ থেকে আমাদের জন্য হজ্জের নিয়মকানুন লিখে আন। তাঁকে ফিকহী মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন:

إنما يحسن الجواب فى هذا ومثله النعمان بن ثابت الخزاز وأراه بورك له فى علمه

‘‘এগুলোর উত্তর তো কেবল কাপড় ব্যবসায়ী নুমান ইবন সাবিতই বলতে পারে। আমার ধারণা তার ইলমে বরকত প্রদান করা হয়েছে।’’

(৩) মিসআর ইবন কিদাম ইবন যাহীর কূফী (১৫৫ হি)

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কুফার সুপ্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ইমাম মিসআর ইবন কিদাম। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল ইমাম তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে বলেন:

ما أحسد أحدا بالكوفة إلا رجلين أبو حنيفة في فقهه والحسن بن صالح في زهده ... من جعل أبا حنيفة بينه وبين الله رجوت أن لا يخاف ولا يكون فرط في الاحتياط لنفسه

‘‘কূফার দু ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আমি ঈর্ষার যোগ্য বলে মনে করি না: আবূ হানীফাকে তাঁর ফিকহের জন্য এবং হাসান ইবন সালিহকে তাঁর যুহদের জন্য। ... যদি কোনো ব্যক্তি তার ও আল্লাহর মাঝে আবূ হানীফাকে রাখে- অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতের জন্য আবূ হানীফার ফিকহী মতের উপর নির্ভর করে- তাহলে আমি আশা করি যে, তাকে ভয় পেতে হবে না এবং সে আত্মরক্ষার সাবধানতায় অবহেলাকারী বলে গণ্য হবে না।

(৪) শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ (১৬০ হি)

আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস নামে প্রসিদ্ধ দ্বিতীয় হিজরী শতকের জারহ-তা’দীলের শ্রেষ্ঠতম ইমাম শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ। তিনি ইমাম আবূ হানীফাকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর প্রশংসায় তিনি কবিতা পাঠ করতেন:

إذا ما الناس يوما قايسونا بآبدة من الفتوى طريفـــة

اتيناهم بمقياس صلــيب مصيب من طراز أبى حنيفة

‘‘মানুষেরা যখন আমাদেরকে কোনো কঠিন কিয়াসের ফাতওয়া দিয়ে আটকায় আমরা তখন তাদেরকে আবূ হানীফার পদ্ধতির সুদৃঢ় বিশুদ্ধ কিয়াসের শর দিয়ে আঘাত করি।’’

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে শুবা বলেন:

كان والله حسن الفهم جيد الحفظ

‘‘আল্লাহর কসম! তাঁর অনুধাবন সুন্দর এবং তাঁর মুখস্থ শক্তি ভাল ছিল।’’

আবূ হানীফার নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে শুবা ইবনুল হাজ্জাজের মতামত ব্যাখ্যা করে ইমাম ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (২৩৩ হি) বলেন:

هذا شعبة بن الحجاج يكتب إليه أن يحدث، وشعبة شعبة".

‘‘এই তো শুবা ইবনুল হাজ্জাজ তিনি হাদীস বর্ণনার অনুরোধ করে আবূ হানীফাকে পত্র লিখেছেন। আর শু’বা তো শু’বাই।’’

ইমাম আবূ হানীফার ওফাতের খবর পেয়ে শুবা বলেন:

لقد ذهب معه فقه الكوفة تفضل الله علينا وعليه برحمته

‘‘তাঁর সাথে কূফার ফিকহও চলে গেল, আল্লাহ আমাদেরকে ও তাঁকে রহমত করুন।’’

(৫) ইসরাঈল ইবন ইউনূস ইবন আবী ইসহাক সাবীয়ী (১৬০ হি)

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্য একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও সমালোচক ইসরাঈল ইবন ইউনূস। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:

كان نعم الرجل النعمان ما كان أحفظه لكل حديث فيه فقه وأشد فحصه عنه وأعلمه بما فيه من الفقه وكان قد ضبط عن حماد فأحسن الضبط عنه فأكرمه الخلفاء والأمراء والوزراء

‘‘নুমান খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। যে সকল হাদীসের মধ্যে ফিকহ রয়েছে সেগুলি তিনি খুব ভালভাবে ও পরিপূর্ণভাবে মুখস্থ রাখতেন, সেগুলির বিষয়ে সর্বোচ্চ অনুসন্ধান করতেন এবং সেগুলির মধ্যে বিদ্যমান ফিকহী নির্দেশনাও তিনি সবেচেয়ে ভাল জানতেন। এ বিষয়ে তাঁর স্মৃতি, অনুসন্ধান ও জ্ঞান ছিল অবাক করার মত। তিনি হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান থেকে ফিকহ সংরক্ষণ করেন এবং খুব ভালভাবেই সংরক্ষণ করেন। ফলে খলীফাগণ, আমীরগণ ও উযীরগণ তাঁকে সম্মান করেছেন।’’

(৬) হাসান ইবন সালিহ (১০০-১৬৯ হি)

কূফার অন্য প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী হাসান ইবন সালিহ (১০০-১৬৯ হি)। বুখারী (আদাব গ্রন্থে), মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তাঁর ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবন আদম (২০৩ হি) বলেন, হাসান ইবন সালিহ বলেন:

كان النعمان بن ثابت فهما عالما متثبتا فى علمه اذا صح عنده الخبر عن رسول الله ﷺ لم يعده إلى غيره

‘‘নুমান ইবন সাবিত বিজ্ঞ আলিম ছিলেন, ইলমের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে সচেতন ছিলেন। কোনো বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হলে তিনি তা পরিত্যাগ করে অন্য দিকে যেতেন না।’’

(৭) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১১৮-১৮১ হি)

দ্বিতীয় শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, যাহিদ ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক খুরাসানী (১১৮- ১৮১ হি)। তিনি ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র ছিলেন, তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ফিকহী বিষয়ে তাঁর মত অনুসরণ করতেন। ইসমাঈল ইবন দাউদ বলেন:

كان ابن المبارك يذكر عن أبى حنيفة كل خير ويزكيه... ويثنى عليه

ইবনুল মুবারাক আবূ হানীফা সম্পর্কে সবসময়ই ভাল বলতেন, তাঁর বিশ্বস্ততা ও বুজুর্গির কথা বলতেন এবং তাঁর প্রশংসা করতেন।’’

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলতেন:

لا نكذب الله في أنفسنا إمامنا في الفقه أبو حنيفة وفي الحديث سفيان فإذا اتفقا لا أبالي بمن خالفهما. ... لولا أن أغاثني الله بأبي حنيفة وسفيان كنت كسائر الناس. ... أبو حنيفة أفقه الناس.

‘‘আমাদের নিজেদের বিষয়ে আল্লাহকে মিথ্যা বলব না! ফিকহের বিষয়ে আমাদের ইমাম আবূ হানীফা এবং হাদীসের বিষয়ে আমাদের ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর যখন দুজন কোনো বিষয়ে একমত হন তখন আমরা তাঁদের বিপরীতে আর কাউকে পরোয়া করি না।’’... ‘‘আল্লাহ যদি আমাকে আবূ হানীফা এবং সুফইয়ান সাওরী দ্বারা উদ্ধার না করতেন তাহলে আমি সাধারণ মানুষই থাকতাম।’’ ‘‘আবূ হানীফা মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ।’’

ইমাম সুফইয়ান (ইবন সাঈদ ইবন মাসরূক) সাওরী (৯৭-১৬১ হি) ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ। দুজনের মধ্যে আকীদা ও ফিকহী অনেক বিষয়ে মতভেদ ছিল এবং অনেক ভুল বুঝাবুঝিও ছিল। ইবনুল মুবারক দুজনেরই ছাত্র এবং দুজনের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট তিনি এভাবে তুলে ধরেছেন।

(৮) কাযী আবূ ইউসূফ ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম (১১৩-১৮২ হি)

আমরা বলেছি যে, আবূ ইউসূফ তাঁর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ও ফকীহ ছিলেন বলে সকলেই স্বীকার করেছেন। হাদীস বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা বর্ণনা করে তিনি বলেন:

ما رأيت أحدا أعلم بتفسير الحديث ومواضع النكت التي فيه من الفقه من أبي حنيفة ... ما خالفت أبا حنيفة في شيء قط فتدبرته إلا رأيت مذهبه الذي ذهب إليه أنجى في الآخرة وكنت ربما ملت إلى الحديث وكان هو أبصر بالحديث الصحيح مني ... إني لأدعو لأبي حنيفة قبل أبوي ولقد سمعت أبا حنيفة يقول إني لأدعو لحماد مع أبوي.

‘‘হাদীসের ব্যাখ্যায় এবং হাদীসের মধ্যে ফিকহের যে সকল নির্দেশনা রয়েছে তা অনুধাবন করায় আবূ হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও পারদর্শী আমি কাউকে দেখি নি। .... যে বিষয়েই আমি আবূ হানীফার সাথে বিরোধিতা করেছি সে বিষয়েই আমি পরে চিন্তা করে দেখেছি যে, আবূ হানীফার মতই আখিরাতে নাজাতের অধিক উপযোগী। অনেক সময় আমি হাদীসের দিকে ঝুঁকে পড়েছি, কিন্তু তিনি সহীহ হাদীসের বিষয়ে আমার চেয়ে অধিক সমঝদার ছিলেন। .... আমি আমার পিতামাতার জন্য দুআ করার আগে আবূ হানীফার জন্য দুআ করি। আর আমি শুনেছি, আবূ হানীফা বলতেন, আমি আমার পিতামাতার সাথে হাম্মাদের জন্য দুআ করি।’’

(৯) ফুদাইল ইবন ইয়াদ (১৮৭ হি)

তৎকালীন সময়ের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, সমালোচক ও বুজুর্গ ইমাম ফুদাইল ইবন ইয়াদ খুরাসানী মাক্কী (১৮৭হি)। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁর গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন:

كان أبو حنيفة رجلا فقيها معروفا بالفقه مشهورا بالورع واسع المال معروفا بالأفضال على كل من يطيف به صبورا على تعليم العلم بالليل والنهار حسن الليل كثير الصمت قليل الكلام حتى ترد مسألة في حلال أو حرام فكان يحسن ان يدل على الحق هاربا من مال السلطان ... وكان إذا وردت عليه مسألة فيها حديث صحيح أتبعه وإن كان عن الصحابة والتابعين وإلا قاس وأحسن القياس.

‘‘আবূ হানীফা সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ছিলেন। তাঁর তাকওয়া ছিল অতি প্রসিদ্ধ। তিনি সম্পদশালী ছিলেন এবং বদান্যতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। রাতদিন সার্বক্ষণিক ইলম শিক্ষা দানে তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। রাতের ইবাদতে মাশগুল থাকতেন। অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং কম কথা বলতেন। তবে যখন হালাল-হারামের কোনো মাসআলা তাঁর কাছে আসত তখন তিনি কথা বলতেন এবং খুব ভালভাবেই হক্ক প্রমাণ করতে পারতেন। তিনি শাসকদের সম্পদ থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। ... যখন তাঁর কাছে কোনো মাসআলা আসত তখন তিনি সে বিষয়ে সহীহ হাদীস থাকলে তা অনুসরণ করতেন, অথবা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মত। তা না হলে তিনি কিয়াস করতেন এবং তিনি সুন্দর কিয়াস করতেন।’’

(১০) হাফস ইবন গিয়াস (১৯৫হি)

কূফার অন্য একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ হাফস ইবন গিয়াস নাখয়ী কূফী (১৯৫হি) তিনি প্রথমে কূফা ও পরে বাগদাদের কাযীর দায়িত্ব পালন করেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:

كلام أبي حنيفة في الفقه أدق من الشعر لا يعيبه إلا جاهل.

‘‘ফিকহের বিষয়ে আবূ হানীফার বক্তব্য চুলের চেয়েও সুক্ষ্ম। জাহিল-মুর্খ ছাড়া কেউ তাঁকে খারাপ বলে না।’’

(১১) আবূ মুআবিয়া দারীর মুহাম্মাদ ইবন খাযিম (১১৩-১৯৫ হি)

কূফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবন খাযিম আবূ মুআবিয়া দারীর। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:

حب أبي حنيفة من السنة

‘‘সুন্নাতপন্থী হওয়ার একটি বিষয় আবূ হানীফাকে ভালবাসা।’’

(১২) ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (১৯৭ হি)

শুবা ইবনুল হাজ্জাজের পরে দ্বিতীয় শতকের ইলম হাদীস ও জারহ-তাদীলের অন্যতম দুই দিকপাল: ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান ও ইবন মাহদী। উভয়েই বসরার অধিবাসী ছিলেন। কাত্তান বলেন:

لا نكذب الله ما سمعنا أحسن من رأى أبى حنيفة، وقد أخذنا بأكثر أقواله. قال يحيى بن معين: وكان يحيى بن سعيد يذهب في الفتوى إلى مذهب (قول) الكوفيين ويختار قوله من أقوالهم ويتبع رأيه من بين أصحابه.

‘‘আল্লাহকে মিথ্যা বলব না! আবূ হানীফার মতের চেয়ে উত্তম মত আমি শুনি নি। অধিকাংশ বিষয়ে আমরা তাঁর মত অনুসরণ করি। (তাঁর ছাত্র) ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন: ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ ফাতওয়ার বিষয়ে কূফীদের মাযহাব অনুসরণ করতেন, কূফীদের মধ্য থেকে আবূ হানীফার বক্তব্য পছন্দ করতেন এবং তাঁর মত অনুসরণ করতেন।’’

(১৩) ওকী ইবনুল জার্রাহ ইবন মালীহ (১৯৭ হি)

কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ওকী ইবনুল জার্রাহ। ইমাম আহমদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস বলে গণ্য করেছেন। তাঁর ছাত্র ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন:

ما رأيت أحدا أقدمه على وكيع، وكان يفتي برأي أبي حنيفة، وكان يحفظ حديثه كله، وكان قد سمع من أبي حنيفة حديثا كثيرا.

আমি ওকী-এর উপরে স্থান দেওয়ার মত কোনো মুহাদ্দিস দেখি নি। তিনি আবূ হানীফার মত অনুসারে ফাতওয়া দিতেন। তিনি তাঁর সব হাদীস মুখস্থ রাখতেন। তিনি আবূ হানীফা থেকে অনেক হাদীস শুনেন।

এ থেকে জানা যায় যে, ইমাম ওকী শুধু ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মতই অনুসরণ করতেন না, উপরন্তু তিনি তাঁকে হাদীসের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করতেন এবং তাঁর সকল হাদীস মুখস্থ রাখতেন।

(১৪) আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী (১৩৫-১৯৮ হি)

এ সময়ের ইলম হাদীস ও জারহ-তাদীলের অন্য দিকপাল ইবন মাহদী। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ লিখেছেন, আমি আমার পিতার মুখে শুনেছি, তাঁর উস্তাদ ইবন মাহদী বলতেন:

من حسن علم الرجل أن ينظر في رأي أبي حنيفة

‘‘একজন মানুষের ইলমের সৌন্দর্য এই যে, সে আবূ হানীফার ‘রায়’ বা মাযহাব অধ্যয়ন করবে।’’

৫. এ সময়ের দুটি অভিযোগ

এ যুগের আরো অনেক ফকীহ, মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ থেকে ইমাম আবূ হানীফার প্রশংসা বর্ণিত। আমরা এখানে শুধু প্রসিদ্ধ ফকীহ, মুহাদ্দিস ও জারহ-তাদীলের ইমামগণের বক্তব্য উদ্ধৃত করলাম। এ থেকে আমরা দেখলাম যে, তাঁর সমসাময়িক, তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন বা জেনেছেন এমন সকল ফকীহ, মুহাদ্দিস, আবিদ ও আলিম তাঁর যোগ্যতা ও মর্যাদার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁর ফিকহী মতের অসাধারণত্বের পাশাপাশি হাদীসের বর্ণনায় তাঁর নির্ভরযোগ্যতা ও ফিকহী হাদীসসমূহে তাঁর পান্ডিত্য ও হাদীসের ফিকহী নির্দেশনা অনুধাবনে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার সাক্ষ্য তাঁরা দিয়েছেন।

এ সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কেউ দুটি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন: (১) ফিকহী বিষয়ে গভীর মনোযোগের কারণে তিনি কম হাদীস বর্ণনা করেন এবং (২) কিছু ফিকহী বিষয়ে তৎকালীন কতিপয় ফকীহের সাথে তাঁর মতভেদ ছিল।

৫. ১. হাদীসের ময়দানে তাঁর পদচারণা কম

উম্মাতের ফকীহগণ হাদীস বর্ণনার চেয়ে হাদীসের আলোকে ফিকহী মাসআলা নির্ধারণের জন্য সদা চিন্তিত ও ব্যস্ত থাকতেন। পক্ষান্তরে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের সনদ ও মতনের শব্দ, বাক্য, বর্ণনার পার্থক্য, এগুলির হুবহু বর্ণনা ইত্যাদি নিয়ে সদা চিন্তিত ও ব্যস্ত থাকতেন। এজন্য ফকীহগণ হাদীস বর্ণনা করতেন কম। মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো এ বিষয়ে ফকীহগণকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করতেন। ইমাম আবূ হানীফা প্রসঙ্গে ইবনুল মুবারাকের নিম্নের কথাটিও এ জাতীয়:

كان أبو حنيفة مسكينا في الحديث

‘‘আবূ হানীফা হাদীসের বিষয়ে মিসকীন ছিলেন।’’

ইবনুল মুবারাকের এ কথাটিকে অনেকেই হাদীস বর্ণনায় আবূ হানীফার দুর্বলতা বা অগ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য মোটেও তা নয়। সুফইয়ান ইবন উয়াইনা (১৯৮ হি) বলেন:

كنا إذا رأينا طالبا للحديث يغشى ثلاثة ضحكنا منه ربيعة ومحمد بن أبي بكر بن حزم وجعفر بن محمد، لانهم كانوا لا يتقنون الحديث ولا يحفظونه.

‘‘আমরা যখন কোনো হাদীসের ছাত্রকে তিন ব্যক্তির কারো কাছে যেতে দেখতাম তখন আমরা হাসতাম: রাবীয়াহ, মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর ইবন হাযম, জাফর ইবন মুহাম্মাদ; কারণ তারা কেউই হাদীস ভাল পারতেন না এবং মুখস্থও রাখতেন না।’’

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক এ তিন ফকীহের পরিচয় দেখুন:

(১) মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম রাবীয়াহ ইবন আবী আব্দুর রাহমান ফার্রূখ (১৪২ হি)। তিনি ‘‘রাবীয়াহ আর-রাই’’ অর্থাৎ কিয়াসপন্থী রাবীয়াহ বলে প্রসিদ্ধ। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে নির্ভরযোগ্য রাবী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

(২) মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও মদীনার কাযী মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর ইবন মুহাম্মাদ ইবন আমর ইবন হাযম (৬০-১৩২ হি)। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

(৩) ইমাম জাফর সাদিক ইবন মুহাম্মাদ বাকির (৮০-১৪৮)। নবী-বংশের অন্যতম ইমাম ও মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ। ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

এভাবে আমরা দেখছি যে, এ তিনজনকেই মুহাদ্দিসগণ নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। ইবনুল মুবারাক তো ইমাম আবূ হানীফাকে মিসকীন বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে দুর্বল বলেন নি। পক্ষান্তরে সুফইয়ান ইবন উয়াইনা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ‘এরা তিনজন হাদীস ভাল পারতেন না এবং মুখস্থ রাখতে পারতেন না।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও মুহাদ্দিসগণ তাঁর কথাকে এঁদের দুর্বলতা বা অগ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করলেন না কেন?

কারণ এ কথার অর্থ হলো, এ তিনজন মূলত ফিকহ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁরা কম হাদীস জানতেন। ফিকহী হাদীসগুলি নিয়েই তাঁরা বেশি সময় কাটাতেন। এছাড়া ফিকহী ব্যস্ততার কারণে হাদীসের সনদ ও মতন রাতদিন চর্চা করার সময় তাঁদের হতো না। ফলে মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁরা এক্ষেত্রে কিছু বেশি ভুল করতেন।

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাকের কথার অর্থ হুবহু এক। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ইবনুল মুবারাক বারবার বলেছেন যে, ফিকহে তাঁর ইমাম আবূ হানীফা এবং হাদীসে তাঁর ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর এ অর্থেই তিনি বলেছেন যে, মুহাদ্দিসগণের তুলনায় তিনি হাদীস কম জানতেন বা কম বলতেন। কাজেই ইবনুল মুবারাকের এ বক্তব্যকে যারা ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার সাক্ষ্য বলে গণ্য করেছেন তারা বিষয়টি ভুল বুঝেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ আমাদেরকে ও উম্মাতের সকল আলিমকে ক্ষমা করুন।

৫. ২. ফিকহ ও আকীদা বিষয়ে তাঁর মতের বিরোধিতা

সে যুগের অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহের সাথে ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মতপার্থক্য ছিল। পাশাপাশি আকীদার খুটিনাটি কয়েকটি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ ছিল। এগুলির অন্যতম ঈমানের সংজ্ঞা। অধিকাংশ মুহাদ্দিস আমলকে ঈমানের অংশ গণ্য করতেন। পক্ষান্তরে কিছু মুহাদ্দিস ও ফকীহ আমলকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য পরিপূরক গণ্য করতেন। ইমাম আবূ হানীফা ছিলেন এদের মধ্যে। অনেক মুহাদ্দিস ও ফকীহ এজন্য তাঁকে ‘মুরজিয়া’ বলে কটাক্ষ করেছেন।

সমসাময়িক যারা এভাবে তাঁর প্রতি কটাক্ষ করেছেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন (১) কুফার তাবিয়ী মুহাদ্দিস শরীক ইবন আব্দুল্লাহ (১৪০ হি), (২) কুফার তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম সুফইয়ান সাওরী (৯৭-১৬১ হি), এবং (৩) সিরিয়ার প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম আওযায়ী (১৫৭ হি)। তাঁরা এবং আরো কতিপয় সমসাময়িক ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছেন যা ক্রোধ ও ক্ষোভের প্রকাশ। এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে ২য় শতকের এ সকল মুহাদ্দিস বা ফকীহের খুব কম বক্তব্যই সহীহ বা নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে। সমসাময়িক আলিমদের এরূপ মতবিরোধ বা শত্রুতা খুবই স্বাভাবিক। প্রসিদ্ধ চার ইমাম এবং সকল প্রসিদ্ধ আলিম, মুহাদ্দিস ও ফকীহের বিষয়েই এরূপ কঠিন বিরূপ মন্তব্য করেছেন তৎকালীন কোনো কোনো প্রসিদ্ধ আলিম।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম যে, ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক ও নিকটবর্তী যুগের প্রসিদ্ধ ফকীহ, মুহাদ্দিস, আবিদ, ও জারহ-তাদীলের সমালোচক ইমামগণ তাঁকে ফিকহের ইমাম, শ্রেষ্ঠতম ফকীহ এবং হাদীস বর্ণনায় বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর ফিকহী মত সহীহ হাদীস নির্ভর বলেও তাঁরা বারবার মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি কয়েকজন আলিম তাঁকে মুরজিয়া বলেছেন বা তাঁর ফিকহী মতের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

এ জাতীয় বিরূপ মন্তব্য সম্ভবত খুবই কম ছিল অথবা তৎকালীন মুসলিমদের মধ্যে তা কোনোরূপ গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। কারণ, বাস্তবে আমরা দেখি যে, ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মত হাদীস ও ফিকহের সে স্বর্ণযুগে দ্রুত প্রসার লাভ করে। হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষ দিক থেকেই হানাফী ফিকহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত ফিকহী মতে পরিণত হয়। এ বিষয়ে কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ সুফইয়ান ইবন উয়াইনা (১০৭-১৯৮ হি) বলেন:

شيئان ما ظننتهما يجاوزان قنطرة الكوفة: قراءة حمزة، وفقه أبي حنيفة، وقد بلغا الآفاق

‘‘দুটি বিষয়ে আমি কল্পনা করি নি যে, তারা কুফার সেতু পার হবে; হামযার কিরাআত ও আবূ হানীফার ফিকহ; অথচ ইতোমধ্যেই এ দুটি বিষয় সকল দিগন্তে পৌঁছে গিয়েছে।’’

৬. তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশের সমালোচকদের মূল্যায়ন

এ ছিল হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষ পর্যন্ত ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে আলিমগণের অভিমত ও তাঁর ফিকহী মতের প্রসারতা। কিন্তু হিজরী তৃতীয় শতক থেকে চিত্র পরিবর্তন হতে লাগল। এ সময় থেকে অনেক আলিম ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠিন অভিযোগ করেছেন। এ অভিযোগের ধারা শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে থাকে। বস্ত্তত মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ ইমামগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা যত আক্রমণ ও চরিত্র হননের শিকার হয়েছেন তেমন বোধ হয় অন্য কেউ হন নি। এ বিষয়ে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (২৩৩ হি) বলেন:

أصحابنا يفرطون في أبي حنيفة وأصحابه.

আমাদের সাথীরা, অর্থাৎ মুহাদ্দিসগণ আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করেন।’’

কেন এ সীমালঙ্ঘন তা পর্যালোচনার আগে ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে তৃতীয় শতকের প্রথমাংশের বা প্রথম দশকের কয়েকজন মুহাদ্দিস, ফকীহ ও সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন আলোচনা করব।

(১) ইমাম শাফিয়ী মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস (১৫০-২০৪ হি)

ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস শাফিয়ী ইমাম আবূ হানীফার পরের শ্রেষ্ঠতম ফকীহ। দ্বিতীয় হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বিভিন্ন উসূলী ও ফিকহী বিষয়ে তিনি ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রদের মতামত প্রত্যাখ্যান করেন। ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফার শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব বিষয়ে তিনি বলেন:

الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة.

‘‘ফিকহের ক্ষেত্রে মানুষেরা আবূ হানীফার উপর নির্ভরশীল।’’

(২) ইয়াযিদ ইবন হারূন (১১৭-২০৬ হি)

এ সময়ের প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও আবিদ ইয়াযিদ ইবন হারূন ওয়াসিতী। ইমাম আহমদ তাঁকে হাফিযুল হাদীস বলতেন। ইবনুল মাদীনী বলেন, তাঁর চেয়ে বড় হাফিযুল হাদীস আমি দেখি নি। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:

كان أبو حنيفة تقيا نقيا زاهدا عالما صدوق اللسان أحفظ أهل زمانه سمعت كل من أدركته من أهل زمانه يقول إنه ما رأى أفقه منه

‘‘আবূ হানীফা আল্লাহ-ভীরু, পবিত্র ও সংসারবিরাগী আলিম ছিলেন। তিনি সত্যপরায়ণ এবং তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় হাফিযে হাদীস ছিলেন। তাঁর যুগের যত মানুষকে আমি পেয়েছি সকলকেই বলতে শুনেছি: তিনি ফিকহের বিষয়ে আবূ হানীফার চেয়ে অধিক পারদর্শী আর কাউকে দেখেন নি।’’[3]

(৩) আব্দুল্লাহ ইবন দাউদ আল-খুরাইবী (১২৬-২১৩ হি)

দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও আবিদ আবূ আব্দুর রাহমান আব্দুল্লাহ ইবন দাউদ ইবন আমির কূফী। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:

من أراد ان يخرج من ذل العمى والجهل ويجد لذة الفقه فلينظر في كتب أبي حنيفة. ما يقع في أبي حنيفة إلا حاسد أو جاهل. ينبغي للناس أن يدعوا في صلاتهم لابي حنيفة، لحفظه الفقه والسنن عليهم.

‘‘যদি কেউ অন্ধত্ব ও মুর্খতার লাঞ্ছনা থেকে বের হতে চায় এবং ফিকহের স্বাদ লাভ করতে চায় তবে তাকে আবূ হানীফার বইগুলো পড়তে হবে। হিংসুক অথবা জাহিল এ দুয়ের একজন ছাড়া কেউ আবূ হানীফার বিষয়ে মন্দ বলে না। মানুষদের উচিত তাদের সালাতের মধ্যে আবূ হানীফার জন্য দুআ করা; কারণ তিনিই মানুষদের জন্য ফিকহ এবং সুন্নাহ (হাদীস) সংরক্ষণ করেছেন।’’

৭. ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষাপট

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, তৃতীয় শতকে ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে প্রচারণা ব্যাপকতা লাভ করে। বিশেষত মুতাযিলী শাসনের অবসানের পরে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। বাহ্যত এর কারণগুলি নিম্নরূপ:

৭. ১. প্রসারতা ও ক্ষমতার ঈর্ষা

আমরা আগেই বলেছি যে, তাবিয়ী যুগের অন্য কোনো ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার মত প্রসিদ্ধি ও মর্যাদা লাভ করেন নি। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর মত প্রসিদ্ধি লাভ করে। আববাসী খলীফা মাহদীর যুগ (১৫৮-১৬৯হি) থেকে হানাফী ফিকহ রাষ্ট্রীয় ফিকহে পরিণত হয়। এ ফিকহে পারদর্শীগণই বিভিন্ন বিচারিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। পরবর্তী শতাব্দীর পর শতাব্দী এ নেতৃত্বের ও কর্তৃত্বের ধারা অব্যাহত থাকে। হানাফী বিরোধীদের ক্ষোভ এতে বাড়তে থাকে এবং তাঁদের বৈরী প্রচারণাও ব্যাপক হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ প্রচারণা হানাফী ফিকহের বিরুদ্ধে না হয়ে ব্যক্তি আবূ হানীফার চরিত্র হননের দিকে ধাবিত হয়।

৭. ২. মুতাযিলী ফিতনা ও সম্পৃক্তি

২০০ হিজরীর দিকে আববাসী খলীফা মামুন (রাজত্ব ১৯৮-২১৮ হি) মুতাযিলী ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করেন এবং একে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তী খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ (২১৮-২২৭ হি) ও ওয়াসিক বিল্লাহ (২২৮-২৩২ হি) এ মতবাদ অনুসরণ করেন। গ্রীক দর্শন নির্ভর এ মতবাদে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন বিশ্বাস বিদ্যমান। এ সকল বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে ‘‘কুরআন সৃষ্ট বা মাখলূক’’। এ ছাড়া মুতাযিলীগণ আল্লাহর ‘‘বিশেষণগুলো’’ ব্যাখ্যা করে অস্বীকার করেন। এ মত প্রতিষ্ঠায় এ তিন খলীফা ছিলেন অনমনীয়। এ মত গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী আলিমদেরকে গ্রেফতার করে তাঁরা অবর্ণনীয় অত্যাচার করতে থাকেন। পরবর্তী শাসক মুতাওয়াক্কিল (২৩২-২৪৭ হি) এ অত্যাচারের অবসান ঘটান। সকলেই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও পালনের সুযোগ পান।

প্রায় ত্রিশ বৎসরের মুতাযিলী শাসনের সময়ে স্বভাবতই প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় হানাফী ফকীহগণ ছিলেন। তাঁদের অনেকেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মুতাযিলীদের সাথে সহযোগিতা করেছেন বা তাদের মত গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষত খলীফা মামুনের মুতাযিলী ফিতনার মূল স্থম্ভ বিশর আল-মারীসী: বিশর ইবন গিয়াস ইবন আবী কারীমা আব্দুর রাহমান (২১৮ হি) এবং বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুওয়াদ (আবী দাউদ) ইবন জারীর (১৬০-২৪০ হি) উভয়েই ফিকহী মতে ইমাম আবূ হানীফার অনুসারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মুতাযিলী মতের প্রচার-প্রসার, দেশের সকল আলিমকে খলীফার দরবারে ডেকে মুতাযিলী মত গ্রহণে বাধ্য করা এবং ইমাম আহমদ ও মুতাযিলা মতবিরোধী অন্যান্য প্রসিদ্ধ ইমামগণের উপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের মূল হোতা ছিলেন তাঁরা।

মুতাযিলী অত্যাচারের অবসানের পরেও হানাফী ফকীহগণ বিচারিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। এছাড়া মুতাযিলীগণ ‘হানাফী’ নামের ছত্রছায়ায় তাদের মত প্রচার করতে থাকেন। অপরদিকে হানাফী বিরোধীগণ আহলুস সুন্নাতের নামে, বিদআত বিরোধিতা বা মুতাযিলী বিরোধিতার নামে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন। অনেকে এ বিষয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিতে থাকেন। অনেক সরলপ্রাণ প্রাজ্ঞ আলিমও এরূপ অপপ্রচারে প্রভাবিত হন।

৭. ৩. বিচার ও শাসন বনাম ইলম ও কলম

আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষ দিক থেকেই হানাফী ফিকহ রাষ্ট্রীয় ফিকহে পরিণত হয়। হানাফী ফকীহগণ ফিকহ ও বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তৃতীয় হিজরী শতক থেকে হাদীস চর্চায় হানাফী ফকীহগণের সম্পৃক্তি কমতে থাকে। এছাড়া ফিকহী বিষয়ে অতিরিক্ত মনোসংযোগের কারণে হাদীস বিষয়ে তাদের দুর্বলতা বাড়তে থাকে। এভাবে তাদের সাথে মুহাদ্দিসগণের দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে।

৭. ৪. মাযহাবী গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ

চতুর্থ হিজরী শতক থেকে মাযহাবী গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে। এ সময়ে তিনটি মাযহাব প্রসিদ্ধ ছিল: হানাফী, মালিকী ও শাফিয়ী। মালিকী মাযহাব উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে বিস্তার লাভ করে। মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র মিসর, ইরাক ও পারস্যে হানাফী-শাফিয়ী দ্বন্ধ ব্যাপক রূপ গ্রহণ করে। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও প্রসারতা ছিল হানাফীদের বেশি। কিন্তু হাদীস চর্চা ও লিখনীতে শাফিয়ীগণ অগ্রগামী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শাফিয়ী মাযহাব প্রসার লাভ করে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হানাফীদের ‘ঘায়েল’ করার জন্য তাদের ইমামকে ছোট করতে চেষ্টা করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে সত্য, মিথ্যা, জাল-বানোয়াট সবকিছু সংকলন করেন।

এ প্রচারণার কারণে তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে তাঁর প্রতি কঠোর আপত্তি ও বিদ্বেষের ভাব জন্ম নিতে থাকে। এ সময়ে ‘‘আহলুস সুন্নাহ’’ ও মুহাদ্দিসদের মধ্যে বিদ্যমান অনুভূতি অনেকটা নিম্নরূপ: যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস অস্বীকার করত!! হাদীসের বিপরীতে নিজের মত দিয়ে দীন তৈরি করত!!! সকল বিদআতী আকীদার প্রচারক ছিল!! সে কিভাবে এত প্রসিদ্ধি লাভ করল? তার মত কেন এত প্রসার লাভ করল? কোনো অজুহাতেই তাকে সহ্য করা যায় না!!!!

হানাফীগণ এ সকল অভিযোগ খন্ডন করেছেন। তবে মুহাদ্দিসগণের সাথে দূরত্বের কারণে তাঁদের মধ্যে তা তেমন প্রভাব বিস্তার করে নি। এছাড়া হানাফীগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে অনেক সময় ইলমী প্রতিবাদের চেয়ে শক্তির প্রতিবাদ বেশি জোরদার হয়েছে। কখনো বা ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন করতে যেয়ে প্রতিপক্ষকে ছোট করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কখনো তাঁর মর্যাদা প্রমাণ করার নামে তাঁর নামে প্রচলিত সবকিছু নির্ভুল ও নির্বিচারে গ্রহণযোগ্য বলে দাবি করা হয়েছে। পক্ষের-বিপক্ষের সকলেই আবেগ ও বাড়াবাড়িতে আক্রান্ত হয়েছেন।

আমরা জানি, ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বলা আর তাঁর অন্ধ অনুসরণকে হক্ক বলা এক নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বলার অর্থ তাঁকে নিষ্পাপ বা নির্ভুল বলা নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে ভাল বলতে যেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যারা আপত্তিকর কথা বলেছেন তাদেরকে মন্দ বলাও ঠিক নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বাতিলের মাপকাঠি বানিয়ে দেওয়াও ঠিক নয়।

এভাবে অভিযোগ ও প্রতিবাদ প্রক্রিয়া মাযহাবী আক্রোশের গন্ডি থেকে বের হতে পারে নি। হিজরী ৫ম শতক থেকে অন্য মাযহাবের কতিপয় আলিম এ সব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। এদের অন্যতম প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল বার্র (৩৬৮-৪৬৩ হি)। তিনি ‘‘আল-ইন্তিকা ফী ফাদায়িলিল আয়িম্মাতিস সালাসাহ’’ নামক গ্রন্থে তিন ইমাম: আবূ হানীফা, মালিক ও শাফিয়ীর মর্যাদা ব্যাখ্যা করেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার জ্ঞানবৃত্তিকভাবে খন্ডন করেন।

পরবর্তীকালে অন্যান্য মাযহাবের কতিপয় ফকীহ, মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞ নিরপেক্ষ বিচার ও পর্যালোচনার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ও মুজতাহিদ শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া আহমদ ইবন আব্দুল হালীম (৬৬১-৭২৮ হি), তাঁর তিন ছাত্র: প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবন আব্দুর রাহমান, আবুল হাজ্জাজ আল-মিয্যী (৬৫৪-৭৪২ হি), প্রসিদ্ধ শাফিয়ী-হাম্বালী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম যাহাবী: মুহাম্মাদ ইবন আহমদ (৬৭৩-৭৪৮ হি), প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকহী ও মুহাদ্দিস আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবন উমার ইবন কাসীর (৭০১-৭৭৪ হি) এবং অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবন হাজার আসকালানী: আহমদ ইবন আলী (৭৭৩-৮৫২ হি)।

৮. ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগ সংকলন

তৃতীয় হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। অনেকেই এ সকল অভিযোগ সংকলন করেছেন। তাঁদের অন্যতম:

৮. ১. আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বাল (২১৩-২৯০ হি)

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুমাল্লাহু) তৃতীয় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ আলিম। তিনি ‘আস-সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থের বিষয় ‘‘আহলুস সুন্নাত’’ বা ‘‘সুন্নী’’ আকীদা ব্যাখ্যা করা। এ গ্রন্থের প্রথম দিকের একটি অধ্যায়: (ما حفظت عن أبي وغيره من المشايخ في أبي حنيفة): ‘‘আবূ হানীফার বিষয়ে আমি আমার পিতা ও অন্যান্য মাশায়িখ থেকে যা মুখস্থ করেছি।’’ এ অধ্যায়ে তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের বিভিন্ন আবিদ, ফকীহ ও মুহাদ্দিস থেকে ইমাম আবূ হানীফার নিন্দায় ১৮২টি বক্তব্য সংকলন করেছেন। এ সকল বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য তাঁর আকীদার বিভ্রান্তি ও তাঁর দীন ও ইলম সম্পর্কে কটাক্ষ।

৮. ২. খতীব বাগদাদী (৩৯২- ৪৬৩ হি)

৫ম হিজরী শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও শাফিয়ী ফকীহ আহমদ ইবন আলী খতীব বাগদাদী (রাহ)। ফিকহ, হাদীস, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর রচিত অনেক গ্রন্থ এখনো ইলমুল হাদীস, জারহ-তাদীল ও ইতিহাস বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর অন্যতম তথ্যসূত্র। তাঁর রচিত ‘‘তারীখ বাগদাদ’’ গ্রন্থে তিনি বাগদাদের ইতিহাস ছাড়াও বাগদাদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৮ হাজার মানুষের জীবনী সংকলন করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় জীবনী ইমাম আবূ হানীফার ১৩১ পৃষ্ঠা ব্যাপী। প্রথমে প্রায় ১২ পৃষ্ঠা তিনি তাঁর জীবনী আলোচনা করেন। এরপর প্রায় ৩৫ পৃষ্ঠা তিনি ইমাম আবূ হানীফার প্রশংসায় পূর্ববর্তী আলিমদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। এরপর প্রায় ৮৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী তিনি ইমাম আবূ হানীফার নিন্দায় বর্ণিত পূর্ববর্তী আলিমদের বক্তব্য সংকলন করেন। এ সকল বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য ইমাম আবূ হানীফার আকীদার ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি, ফিকহী দুর্বলতা এবং ব্যক্তিগত চরিত্র হনন।

আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, খতীব বাগদাদী ও অন্যান্যদের সংকলিত এ সকল অভিযোগ ও নিন্দা সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

(ক) সনদ যাচাই ছাড়া এ বক্তব্যগুলো গ্রহণ করলে একজন মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে, ইমাম আবূ হানীফার মত ইসলামের এত বড় শত্রু ও এত বড় বিভ্রান্ত মানুষ বোধহয় কখনোই জন্ম গ্রহণ করেন নি!! শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া বলেন, যারা মুসলিম উম্মাহর কোনো ইমামের বিরুদ্ধে এ সকল কথা বলেন তারা মূলত মুসলিম উম্মাহকেই বিভ্রান্ত বলে প্রমাণ করতে চান। আমরা তাঁর বক্তব্য পরে আলোচনা করব।

(খ) এ সকল বর্ণনার অধিকাংশই সনদ বিচারে জাল, বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল। এমনকি ইমাম ইবন হিববান ও খতীব বাগদাদী নিজে যাদেরকে জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের অনেকের বর্ণনা এক্ষেত্রে সংকলন করেছেন।

(গ) দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের ফকীহ বা মুহাদ্দিসদের যে বক্তব্যগুলো সনদ বিচারে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হয় সেগুলোর অধিকাংশ মূলত তাঁর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আলিমের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ প্রকাশ। যেমন, তিনি কাফির, ইসলামের শত্রু, ইসলাম ধ্বংস করতেন, তিনি অভিশপ্ত, ক্রীতদাস ইত্যাদি। এগুলো মূলত আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিতের মর্যাদাহানী করে নি; বরং যারা এসব কথা বলেছেন তাদের ঈমানী, ইসলামী ও আখলাকী দুর্বলতা প্রকাশ করেছে।

(ঘ) ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়: (১) আকীদা বিষয়ক, (২) হাদীস বিষয়ক এবং (১) ফিকহ বিষয়ক।

৯. আকীদা বিষয়ক অভিযোগ

ঈমানের সংজ্ঞা কেন্দ্রিক খুঁটিনাটি কয়েকটি বিষয় ছাড়া ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক আলিমগণ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে আকীদা বিষয়ক কোনো অভিযোগ ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে আকীদাগত কোনো আপত্তি না থাকার বড় প্রমাণ যে, তাঁর সমসাময়িক ও তাঁর ছাত্র পর্যায়ের প্রায় সকল প্রসিদ্ধ ফকীহ, ইমাম, ও মুহাদ্দিস তাঁর গ্রহণযোগ্যতার সাক্ষ্য দিয়েছেন, অনেকেই তাঁকে নিজেদের ইমাম বলে উল্লেখ করেছেন, সাধারণ মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেছে, তাঁর মত ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, উমাইয়া ও আববাসী প্রশাসন তাঁকে বিচারক পদে বসানোকে নিজেদের সম্মানের বিষয় বলে গণ্য করেছে। কিন্তু এরপরও তৃতীয় শতক থেকে আকীদা বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ উত্থাপিত হতে লাগল। যেমন, তিনি বিদআতী আকীদার উদ্ভাবক, মুতাযিলী, মুরজিয়া, হাদীস অমান্যকারী..., অস্ত্রধারণে বিশ্বাসী... ইত্যাদি। বস্ত্তত আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, ইবন হিববান, ইবন আদী ও খতীব বাগদাদী ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ সংকলন করেছেন সনদ যাচাই না করে সেগুলো গ্রহণ করলে মনে হবে, ইসলামী আকীদার এমন কোনো খারাপ বিষয় নেই যা ইমাম আবূ হানীফার মধ্যে ছিল না। অভিযোগগুলো পর্যালোচনার আগে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:

(১) ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে বর্ণিত এ সকল অভিযোগের অধিকাংশই সনদ বিচারে জাল বা বাতিল। নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা, বিদ্বেষ চরিতার্থ করা বা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলের প্রিয়ভাজন হতে অনেক জালিয়াত এ সকল জাল কাহিনী প্রচার করেছে।

(২) সমসাময়িক আলিমদের মধ্যকার মতবিরোধ একটি দুঃখজনক কিন্তু স্বাভাবিক বিষয়। খুঁুটিনাটি কয়েকটি আকীদাগত মতভেদের কারণে সমসাময়িক কয়েকজন মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অনেক কঠোর মন্তব্য করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা তাঁর মতের ভুল ব্যাখ্যা করে তাঁকে নিন্দা করেছেন। আমরা পরবর্তীতে দেখব যে, এ সকল ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা নীরবতা, ভদ্রতা ও ধৈর্য অবলম্বন করতেন।

(৩) সমকালীন আলিমদের মধ্যকার মতবিরোধ উস্কে দিতে বা অপব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকে অনেক বিভ্রান্ত, দুর্বল ঈমান বা চাটুকার। ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে বর্ণিত ঘটনাগুলোতে আমরা এর অনেক উদাহরণ দেখতে পাই। এরূপ অনেক ব্যক্তি নিজের বিভ্রান্তির ছাফাই গাইতে, তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে বা বিরোধী আলিমের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য তাঁর নামে বিরোধী আলিমের কাছে তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বা সম্পূর্ণ মিথ্যা এমন কথা বলেছে যা কখনোই তিনি বলেন নি। আর এরূপ কথা শুনে উক্ত বিরোধী আলিম ইমাম আবূ হানীফার প্রতি আরো বিক্ষুদ্ধ হয়েছেন ও বিরূপ মন্তব্য করেছেন। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।

৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও আকীদা বিশেষজ্ঞ ইমাম শাহরাস্তানী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল কারীম ইবন আহমদ (৪৬৭-৫৪৮ হি) মুরজিয়া ফিরকার ‘‘গাস্সানিয়া’ নামক দলের প্রধান কূফার ‘গাস্সান’ নামক ব্যক্তির বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন:

ومن العجيب أن غسان كان يحكي عن أبي حنيفة رحمه الله مثل مذهبه ويعده من المرجئة ولعله كذب كذلك عليه

‘‘আশ্চর্য বিষয় যে, গাস্সান প্রচার করত যে, আবূ হানীফা (রাহ)-এর মত তাঁর মতেরই মত এবং সে তাঁকে মুরজিয়া হিসেবে প্রচার করত। সম্ভবত এগুলিও তাঁর নামে এ ব্যক্তির মিথ্যাচার।’’

আমরা সামান্য কয়েকটি অভিযোগ পর্যালোচনা করব।

৯. ১. ইমাম বুখারী (২৫৬ হি)

হাদীস বিষয়ক অভিযোগ আলোচনায় আমরা দেখব যে, ইমাম বুখারী (রাহ) ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-কে ‘‘মুরজিয়া’’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। অন্যত্র তিনি বলেন:

قال لي ضرار بن صرد حدثنا سليم سمع سفيان: قال لي حماد بن أبي سليمان أبلغ أبا حنيفة المشرك أني برئ منه قال: وكان يقول: القرآن مخلوق

‘‘দিরার ইবন সুরাদ আমাকে বলেন, আমাদেরকে সালীম বলেছেন, তিনি সুফইয়ান সাওরীকে বলতে শুনেছেন, আমাকে হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান বলেন, আবূ হানীফা নামক মুশরিককে আমার পক্ষ থেকে জানাও যে, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন: আবূ হানীফা বলে: কুরআন সৃষ্ট।’’

আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফা ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থে কুরআনকে সৃষ্ট বলার বিরুদ্ধে অনেক কথা লিখেছেন। কুরআনকে সৃষ্ট বলার বিরুদ্ধে যিনি কলম ধরেন তাঁর নামে ‘‘কুরআন সৃষ্ট’’ বলার অভিযোগ, তাও তাঁর প্রিয়তম ও নিকটতম উস্তাদের নামে! এ কাহিনীটির একমাত্র বর্ণনাকারী আবূ নুআইম দিরার ইবন সুরাদ। তিনি কুফার একজন বড় আবিদ-বুজুর্গ ছিলেন; কিন্তু তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন। হক্কের পক্ষে বুজুর্গদের মিথ্যাচার সম্পর্কে ‘‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি। ইবন মায়ীন বলেন: কূফায় দুজন মহা-মিথ্যাবাদী আছে: একজন আবূ নুআইম নাখয়ী, অন্যজন আবূ নুআইম দিরার ইবন সুরাদ। ইমাম নাসায়ী বলেন: (متروك الحديث) সে পরিত্যক্ত হাদীস বর্ণনাকারী। নাসায়ীর পরিভাষায় পরিত্যক্ত অর্থ মিথ্যাবাদী। অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একই কথা বলেছেন। ইমাম বুখারী নিজেও তাকে মাতরূক অর্থাৎ পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী বলেছেন। কেউ কেউ তাকে দুর্বল বলেছেন।

সুস্পষ্টতই এটি এ ব্যক্তির বানানো একটি জাল গল্প। তারপরও ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ গল্পটি ও এরূপ অনেক গল্প উদ্ধৃত করেছেন। তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে ইমাম আযমের বিরুদ্ধে অপপ্রচার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা আমরা এ থেকে বুঝতে পারছি। ইমাম বুখারী তাঁর ‘আত-তারীখ আস-সগীর’ গ্রন্থে বলেন:

سمعت إسماعيل بن عرعرة يقول قال أبو حنيفة جاءت امرأة جهم إلينا ههنا فأدبت نساءنا

‘‘আমি ইসমাঈল ইবন আরআরাকে বলতে শুনেছি, আবূ হানীফা বলেন: জাহম (ইবন সাফওয়ান)-এর স্ত্রী আমাদের এখানে এসে আমাদের মহিলাদেরকে শিক্ষা দান করে।’’

আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, জাহম ইবন সাফওয়ান (১২৮ হি) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভিন্ন কুফরী-বিদআতী আকীদা প্রচলন করেন। এ কাহিনীতে পরোক্ষভাবে ইমাম আবূ হানীফাকে জাহমের অনুসারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তাঁকে জাহমী বলে অভিযুক্ত করে আরো অনেক বর্ণনা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বাল, ইবন হিববান, ইবন আদী, খতীব বাগদাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। সনদগতভাবে এ সকল বর্ণনা সবই জাল বা অত্যন্ত দুর্বল সনদে বর্ণিত। অর্থগতভাবে অভিযোগগুলো আমরা একটু পরে পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। এ বর্ণনার কথক ইসমাঈল ইবন আরআরা একেবারেই অপরিচিত ব্যক্তি। জারহ-তাদীল বিষয়ক বা অন্য কোনো জীবনী বা ইতিহাস গ্রন্থে তার বর্ণনার গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে কিছু পাওয়া যায় না। ইমাম বুখারী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি তাঁর থেকে কোনো কিছু বর্ণনা করেছেন, অথবা তিনি কোনো আলিমের কাছ থেকে কিছু শিখেছেন বলেও কোথাও কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। বাহ্যত তিনি ইমাম আবূ হানীফা থেকে সরাসরি কোনো কথা শুনেন নি। আদৌ তিনি তাঁকে দেখেছেন বলে প্রমাণিত নয়। সমাজে প্রচলিত একটি কথা তিনি ইমাম বুখারীকে শুনিয়েছেন মাত্র।

৯. ২. মুহাম্মাদ ইবন উসমান ইবন আবী শাইবা (২৯৭ হি)

ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তিনি ফাসিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বৈধ বলেছেন। তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ জাফর মুহাম্মাদ ইবন উসমান ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবী শাইবা কূফী (২৯৭ হি)। তিনি লিখেছেন:

سمعت أبي يقول سالت أبا نعيم يا أبا نعيم من هؤلاء الذين تركتهم من أهل الكوفة كانوا يرون السيف والخروج على السلطان فقال على رأسهم أبو حنيفة وكان مرجئا يرى السيف

‘‘আমি আমার পিতা (উসমান ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবী শাইবা ১৫৬-২৩৯ হি)-কে বলতে শুনেছি, আমি আবূ নুআইম (ফাদল ইবন দুকাইন: ১৩০-২১৮ হি)-কে প্রশ্ন করলাম, হে আবূ নুআইম, অস্ত্রে বিশ্বাস করে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা সমর্থন করে কুফায় এরূপ কাদেরকে রেখে এসেছেন? তিনি বলেন: এদের প্রধান আবূ হানীফা। তিনি মুরজিয়া ছিলেন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ সমর্থন করতেন।’’

মুহাম্মাদ ইবন উসমান ইবন আবী শাইবা (রাহ) কূফার প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। তবে তার সততা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সালিহ জাযরাহ ও মাসলামা ইবন কাসিম বলেন: তিনি গ্রহণযোগ্য। ইবন আদী বলেন: তার বিষয়ে সমস্যা নেই। কুফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফিয মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ মুতাইয়ান কুফী (২০২-২৯৭) বলেন: তিনি মিথ্যাবাদী। আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বাল বলেন: তিনি মিথ্যাবাদী। ইবন খিরাশ বলেন: তিনি জালিয়াতি করতেন। বারকানী বলেন: আমি সবসময়ই শুনতাম যে, তিনি অনির্ভরযোগ্য। জাফর তায়ালিসী, আব্দুল্লাহ ইবন ইবরাহীম ইবন কুতাইবা, জাফর ইবন হুযাইল, মুহাম্মাদ ইবন আহমদ আদাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন।

৯. ৩. ইমামুল হারামাইন (৪১৯-৪৭৮ হি)

পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম শাফিয়ী ফকীহ আবুল মাআলী আব্দুল মালিক ইবন আব্দুল্লাহ আল-জুআইনী (রাহ)। সে যুগের শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে তাঁকে ‘‘ইমামুল হারামাইন’’ বা মক্কা-মদীনার ইমাম বলে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি ছিলেন ‘‘আশআরী’’ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবুল হাসান আশআরী: আলী ইবন ইসমাঈল ইবন ইসহাক (২৬০-৩২৪ হি)-এর প্রসিদ্ধ ও বিশিষ্ট ছাত্র এবং ইমাম গাযালীর খাস উস্তাদ। তিনি তাঁর ‘‘আল-বুরহান’’ নামক উসূল ফিকহের গ্রন্থে ইমাম শাফিয়ীকে সর্বশ্রেষ্ঠ ইমাম বলে প্রমাণ করতে যেয়ে ইমাম মালিক ও ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুমাল্লাহ)-এর অনেক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। বিশেষত ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে তিনি বলেন:

وأما أبو حنيفة فما كان من المجتهدين أصلا لأنه لم يعرف العربية... ولم يعرف الأحاديث حتى رضي بقبول كل سقيم ومخالفة كل صحيح ولم يعرف الأصول حتى قدم الأقيسة على الأحاديث ولعدم فقه نفسه اضطرب مذهبه وتناقض وتهافت..وكان يقول لا يضر مع الإيمان معصية كما لا ينفع مع الكفر طاعة... فإن هذا مذهب المرجئة فكيف يظن وحاله هذا مجتهدا؟!

‘‘আর আবূ হানীফা তো মূলত মুজতাহিদই ছিলেন না। কারণ তিনি আরবী ভাষাই জানতেন না।... তিনি হাদীসও জানতেন না; এজন্য তিনি সকল বাতিল হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং সকল সহীহ হাদীসের বিরোধিতা করেছেন। তিনি উসূলুল ফিকহও জানতেন না; এজন্য তিনি কিয়াসকে হাদীসের উপর স্থান দিয়েছেন। তাঁর মন-মানসিকতায় ফিকহ ছিল না; যে কারণে তাঁর মাযহাবে বৈপরীত্য, স্ববিরোধিতা ও দুর্বলতা বিদ্যমান।... তিনি বলতেন: ঈমান ঠিক থাকলে পাপ করলে কোনো অসুবিধা নেই; যেমন কাফিরের নেক কর্ম তার কাজে লাগবে না।... এ হলো মুরজিয়া মত। আর যে ব্যক্তির অবস্থা এরূপ তিনি কিভাবে মুজতাহিদ হতে পারেন!’’

মাযহাবী কোন্দল ও বিদ্বেষ সে যুগে কি নোংরা পর্যায়ে গিয়েছিল তা আমরা বুঝতে পারছি ইমামুল হারামাইনের এ বক্তব্য থেকে। ইমাম আবূ হানীফা নিজে, ইমাম তাহাবী এবং সকল হানাফী ফকীহ তাঁদের আকীদা বিষয়ক গ্রন্থে মুরজিয়াদের উপরোক্ত মতের বিরুদ্ধে অনেক কথা লিখেছেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও ইমামুল হারামাইন এ কথাগুলি ইমাম আবূ হানীফার নামে বললেন! আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা ও রহমত করুন।

৯. ৪. আব্দুল কাদির জীলানী (৪৭১-৫৬১ হি)

৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম বুজুর্গ ও হাম্বলী ফকীহ শাইখ জীলানীর পরিচয় কারোই অজানা নয়। তিনি ‘‘গুনিয়াতুত তালিবীন’’ গ্রন্থে বিভ্রান্ত মুরজিয়া ফিরকার মধ্যে ‘‘হানাফিয়া’’ ফিরকার কথা উল্লেখ করে বলেন:

أما المرجئة ففرقها اثنتا عشرة فرقة الجهمية والصالحية والشمرية واليونسية والثوبانية والنجارية والغيلانية والشبيبية والحنفية والمعاذية والمريسية والكرامية

‘‘মুরজিয়ারা ১২টি ফিরকা: জাহমিয়্যাহ, সালিহিয়্যাহ, শাম্মারিয়্যাহ, ইউনুসিয়্যাহ, সাওবানিয়্যাহ, নাজ্জারিয়্যাহ, গাইলানিয়্যাহ, শাবীবিয়্যাহ, হানাফিয়্যাহ, মুআযিয়্যাহ, মারীসিয়্যাহ ও কার্রামিয়্যাহ।’’

এরপর হানাফিয়্যাহ ফিরকার বর্ণনায় বলেন:

وأما الحنفية فهم أصحاب أبي حنيفة النعمان بن ثابت زعموا أن الإيمان هو المعرفة والإقرار بالله ورسوله وبما جاء من عنده جملة على ما ذكره البرهوتي

‘‘হানাফী ফিরকার মানুষেরা আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিতের অনুসারী। তারা মনে করে যে, ঈমান হলো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর নিকট থেকে যা কিছু এসেছে তা সামগ্রিকভাবে জানা (হৃদয়ের জ্ঞান) ও মুখে স্বীকার করা (অন্তরের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকারোক্তিই ঈমান, কর্ম ঈমানের অংশ নয়)। বারহূতী তা উল্লেখ করেছেন।’’

১০. আকীদা বিষয়ক অভিযোগ পর্যালোচনা

দ্বিতীয় পর্বে আমরা আকীদার এসকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। এখানে আমরা সংক্ষেপে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করব। আমরা দেখেছি তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মূলত পাঁচটি: (১) মুতাযিলী, (২) জাহমী, (৩) শীয়া, (৪) মুরজিয়া ও (৫) রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের বৈধতায় বিশ্বাস।

১০. ১. মুতাযিলী, জাহমী ও শীয়া আকীদা

দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পরবর্তী শতাব্দীর অনেক আলিম থেকে বর্ণিত যে, ইমাম আবূ হানীফা মুতাযীলী ও জাহমী আকীদার অনুসারী বা প্রবর্তক ছিলেন। আবার প্রাচীন ও আধুনিক কোনো কোনো আলিম অভিযোগ করেছেন যে, তিনি শীয়া মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। এ সকল অভিযোগ সবই সনদগতভাবেই বাতিল। আর যদি কোনো আলিম থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয় যে, তিনি ইমাম আবূ হানীফাকে মুতাযিলী, জাহমী বা শীয়া মতবাদের অনুসারী বা তাদের প্রতি আকৃষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন তবে তা উক্ত অভিযোগকারী আলিমের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলে গণ্য হবে। কারণ:

প্রথমত: ইমাম আবূ হানীফার বিরোধীরা যাই বলুন না কেন, ইমাম আবূ হানীফার জীবদ্দশা থেকেই তাঁর আকীদা ও ফিকহ মুসলিম বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে। তাঁর শত শত ছাত্র তাঁর মত পালন ও প্রচার করেছেন, তাঁর গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করেছেন। বিরোধীদের সকল বিরোধিতা উপেক্ষা করে তাঁরা ইমামের আকীদা ও ফিকহ গ্রহণ, প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় রত থেকেছেন। যদি তিনি মুতাযিলী বা জাহমীদের কোনো আকীদা গ্রহণ করতেন তবে তাঁর ছাত্ররা অবশ্যই এগুলো প্রচার করতেন এবং এর পক্ষে কিছু বলতেন। অথচ বাস্তবে আমরা দেখছি যে, ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র ও অনুসারীগণ এ সকল আকীদার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সোচ্চার থেকেছেন।

দ্বিতীয়ত: ইমাম আবূ হানীফা তাঁর নিজের লেখায় এ সকল আকীদার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে এ সকল অভিযোগ মিথ্যা; অভিযোগকারী বা বর্ণনাকারী না জেনে বা জেনে মিথ্যা বলেছেন।

১০. ২. মুরজিয়া আকীদা

ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অভিযোগ যে তিনি মুরজিয়া ছিলেন। দ্বিতীয় পর্বে আমরা মুরজিয়া মতের বিরুদ্ধে ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, মুরজিয়া অর্থ বিলম্বিতকারী, স্থগিতকারী অথবা আশাপ্রদানকারী দল। খারিজীগণ পাপী মুসলিমকে কাফির এবং অনন্তকাল জাহান্নামী বলে বিশ্বাস করেন। মুতাযিলী বিশ্বাসও প্রায় একই। দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকে খারিজী ও মুতাযিলীদের বিপরীত অন্য ফিরকার উদ্ভব হয় যারা বলে, ঈমানের সাথে আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈমান থেকে আমল বা কর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও পৃথক। ঈমানের জন্য শুধু অন্তরের ভক্তি বা বিশ্বাসই যথেষ্ট। ইসলামের কোনো বিধিবিধান পালন না করেও একব্যক্তি ঈমানের পূর্ণতার শিখরে আরোহণ করতে পারে। আর এরূপ ঈমানদার ব্যক্তির কবীরা গোনাহ তার কোনো ক্ষতি করে না। যত গোনাহই করুক না কেন সে জান্নাতী। এদেরকে মুরজিয়া বলার কারণ: (১) এরা বিশ্বাস করে যে, কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন না বা তার শাস্তি স্থগিত রাখবেন এজন্য তাদেরকে মুরজিয়াহ বলা হয়। (২) এরা আমল বা কর্মকে ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে বা স্থগিত করেছে এজন্য এদেরকে মুরজিয়া বলা হয়। (৩) এরা কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে জান্নাতের আশা প্রদান করেছে এজন্য তাদেরকে মুরজিয়া বলা হয়।

এ দু প্রান্তিক ধারার মধ্যবর্তী স্থানে ছিলেন মূলধারার আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, পাপ ঈমানের ক্ষতি করে, তবে ঈমানকে ধ্বংস করে না বা শুধু পাপের কারণেই মুমিন ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হন না। বরং তার বিষয়টি আল্লাহর উপর অর্পিত। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করবেন এবং ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিবেন। একারণে মুতাযিলী ও খারিজীগণ আহলুস সুন্নাত-কে মুরজিয়া বলে আখ্যায়িত করত। কারণ তারা কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে অনন্তকাল জাহান্নামী না বলে তার বিষয়টি বিলম্বিত ও স্থগিত করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতেন। পাশাপাশি তাঁরা আমলকে ঈমান থেকে কিছুটা পিছিয়ে দিতেন বা অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য অংশ বলে গণ্য করতেন না। এভাবে আহলুস সুন্নাতের সকলেই মুতাযিলী ও খারিজীদের দৃষ্টিতে ‘‘মুরজিয়া’’।

অন্য দিকে শীয়াগণও ‘আহলুস সুন্নাহ’-কে ঢালাওভাবে মুরজিয়া বলতেন। শীয়া ধর্মমতে আলী (রা)-এর মর্যাদায় বিশ্বাসই ঈমান ও ইসলামের মূল বিষয়। তাঁদের মতে আলী (রা) সাহাবীগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। যেহেতু আহলুস সুন্নাত তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ না বলে চতুর্থ শ্রেষ্ঠ বলেন, অর্থাৎ তাঁকে আবূ বকর (রা), উমার (রা) ও উসমান (রা)-এর পরে স্থান দেন সেহেতু তারা ‘মুরজিয়া’, অর্থাৎ আলী (রা)-এর মর্যাদা বিলম্বিতকারী।

ইমাম আবূ হানীফাকে ‘‘মুরজিয়া’’ আখ্যায়িত করার বিষয়ে ইমাম শাহরাস্তানী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল কারীম ইবন আহমদ (৪৬৭-৫৪৮ হি) বলেন:

كان يقال لأبي حنيفة وأصحابه مرجئة السنة وعده كثير من أصحاب المقالات من جملة المرجئة ولعل السبب فيه أنه لما كان يقول: الإيمان هو التصديق بالقلب وهو لا يزيد ولا ينقص ظنوا أنه يؤخر العمل عن الإيمان والرجل مع تجرده في العمل (تبحره في العلم) كيف يفتي بترك العمل. وله سبب آخر وهو أنه كان يخالف القدرية والمعتزلة الذين ظهروا في الصدر الأول. والمعتزلة كانوا يلقبون كل من خالفهم في القدر مرجئا وكذلك الوعيدية من الخوارج. فلا يبعد أن اللقب إنما لزمه من فريقي المعتزلة والخوارج...

‘‘আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদেরকে সুন্নী মুরজিয়া বলা হতো। অনেক লেখক তাঁকে মূল মুরজিয়াদের অন্তর্ভুক্ত করে উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত এর কারণ যে, তিনি বলতেন: ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস এবং ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। এজন্য তারা ধারণা করেছেন যে, তিনি আমলকে ঈমান থেকে বিচ্চিন্ন করেছেন। যে মানুষ এত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, এত বেশি আমল করতেন তিনি কিভাবে আমল বর্জনের ফাতওয়া দিতে পারেন!? এর অন্য একটি কারণ রয়েছে। প্রথম যুগে (তাঁর যুগে) প্রকাশিত কাদারিয়া ও মুতাযিলীদের তিনি বিরোধিতা করতেন। আর কাদারিয়া মতের বিষয়ে যারাই মুতাযিলীদের বিরোধিতা করত তাদের সকলকেই মুরজিয়া বলত। খারিজীগণও তাই করত। এজন্য খুবই সম্ভব যে, মুরজিয়া আখ্যাটি ইমাম আবূ হানীফা মুতাযিলী ও খারিজীগণ থেকেই পেয়েছেন।...’’

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত একমত যে, আমল (কর্ম) ঈমানের (বিশ্বাসের) অবিভাজ্য অংশ নয় এবং শুধু কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে মুমিন কাফির বলে গণ্য হন না। তাহলে ঈমান ও আমলের সাথে সম্পর্ক কী? মূলধারার মুহাদ্দিসগণের মতে আমল ঈমানের অংশ, তবে অবিভাজ্য অংশ নয়, বিভাজ্য অংশ। আমল বা কর্মের ত্রুটিতে ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে বিনষ্ট হয় না। কর্মের বৃদ্ধি ও পূর্ণতায় ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং পাপের কারণে ঈমান হ্রাস পায়। তবে কোনোভাবেই কোনো কবীরা গোনাহের কারণেই মুমিন কাফির হন না।

পক্ষান্তরে প্রথম হিজরী শতকের শেষ দিক থেকে অনেক ফকীহ বলেন: আমল বা কর্ম ঈমানের অংশ নয়, বরং পরিপূরক। আমলের ত্রুটিতে ঈমান বিনষ্ট হয় না তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঈমান শুধু বিশ্বাসের নাম। আর বিশ্বাসের বিষয় সর্বদা এক। এজন্য এতে কোনো হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। কর্মের হ্রাসবৃদ্ধির কারণে মুমিনের দীন, ইসলাম ও ঈমানের গভীরতায় হ্রাসবৃদ্ধি হয় মূল ঈমানের বিষয়বস্ত্তর হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। এ সকল ফকীহকে তাঁদের বিরোধীরা ‘‘মুরজিয়া’’ বলে আখ্যায়িত করতেন। ইমাম আবূ হানীফা ছিলেন দ্বিতীয় ধারার অনুসারী। এ বিষয়ে তাঁর মত আমরা ফিকহুল আকবার গ্রন্থে দেখব। আমরা আরো দেখব যে, খারিজী ও মুতাযিলীদের প্রান্তিকতা, পাপী মুমিনকে কাফির-কথন প্রতিরোধ এবং জালিম বা ফাসিক রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ প্রতিরোধের জন্য ফকীহগণ এ মত গ্রহণ করেন।

তাহলে আমরা দেখছি যে, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের মধ্যে যে মতভেদ তা একান্তই ‘পরিভাষাগত’। খারিজী-মুতাযিলী প্রান্তিকতার প্রতিবাদে তাঁরা একমত যে, কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুমিন কাফির নয়। মুরজিয়া প্রান্তিকতার প্রতিবাদে তাঁরা একমত যে, কবীরা গোনাহ মুমিনের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক। মধ্যবর্তী সমন্বয়ে তারা দুটি বিষয়ে মতভেদ করেছেন: (১) কর্ম (আমল) বিশ্বাসের (ঈমানের) অংশ কি না এবং (২) আমলের কারণে মূল ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না, ঈমানের শক্তি ও গভীরতার হ্রাসবৃদ্ধি হয়।

তৃতীয় একটি বিষয় এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তা হলো ঈমানের ঘোষণার সাথে ‘ইনশা আল্লাহ’ বলা। মুহাদ্দিসগণ বলতেন, মুমিন যেহেতু তার নিজের পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানে না, এজন্য তার বলা উচিত: ‘ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন’। আর ফকীহগণ বলতেন, ইনশা আল্লাহ মূলত সন্দেহ প্রকাশ করে। আর একজন মুমিন যদি নিজের বর্তমান ঈমান সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে তাহলে ঈমানই অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। এজন্য বর্তমান ঈমানের অবস্থা বলতে মুমিন ‘ইনশা আল্লাহ’ ছাড়াই বলবেন; ‘আমি মুমিন’। তবে যদি তিনি তার ঈমানের ভবিষ্যত পরিণতির দিকে লক্ষ্য করে ‘ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন’ বলেন তাহলে অসুবিধা নেই।

এ সামান্য বিষয়গুলো নিয়ে দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে ইমাম আবূ হানীফাকে মুরজিয়া, বিদআতী, কাফির ইত্যাদি বলে অনেক গালিগালাজ করা হয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুৎ ‘ইনশা আল্লাহ’-র বিষয়। এ বিষয়টির সাথে কুরআন ও সুন্নাহর কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। ঈমানের ঘোষণার সাথে ‘ইনশা আল্লাহ’ বলতে হবে বা হবে না- এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে কোনোরূপ নির্দেশনা নেই। বিষয়টি একেবারেই ইজতিহাদী। তা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অনেক কঠোর কথা বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, ইবন হিববান, ইবন আদী, খতীব বাগদাদী প্রমুখের গ্রন্থে পাঠক তা দেখবেন। আমরা আগেই বলেছি, ইমাম আবূ হানীফা এ ধারার অনুসারী ছিলেন, প্রবর্তক ছিলেন না। ইমাম আবূ হানীফার পূর্বেই অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহ এ মত গ্রহণ ও প্রচার করেন। হাদীস বিষয়ক অভিযোগ পর্যালোচনায় আমরা হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের অনেক প্রসিদ্ধ মুরজিয়া মুহাদ্দিস ও ফকীহের নাম দেখব। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা যেমন আক্রমণ ও চরিত্র হননের শিকার হয়েছেন তেমন আর কেউ হন নি। বাহ্যত এর কারণ প্রসিদ্ধির ঈর্ষা, মাযহাবী কোন্দল ও প্রতিহিংসা।

১০. ৩. পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ

ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বৈধতায় বিশ্বাস করতেন। আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বাল উদ্ধৃত করেছেন:

ابن المبارك يقول سمعت الأوزاعي يقول احتملنا عن أبي حنيفة كذا ... واحتملنا عنه كذا ... واحتملنا عنه كذا ... العيوب حتى جاء السيف على أمة محمد ﷺ فلما جاء السيف على أمة محمد ﷺ لم نقدر أن نحتمله

‘‘ইবনুল মুবারাক বলেন, আমি আওযায়ীকে বলতে শুনেছি: আমরা আবূ হানীফার অমুক অন্যায়-ত্রুটি সহ্য করলাম,... অমুক ত্রুটি সহ্য করলাম, ... অমুক অন্যায়-ত্রুটি সহ্য করলাম... কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর অস্ত্র নিয়ে আসলেন!! যখন তিনি উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে অস্ত্র নিয়ে আসলেন তখন আর আমরা তাকে সহ্য করতে পারলাম না।’’

এরূপ অনেক কথা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, ইবন হিববান, ইবন আদী, খতীব বাগদাদী প্রমুখের গ্রন্থে পাঠক দেখবেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তাঁর বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগ যে, তিনি পাপী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদে কখনোই অংশগ্রহণ করেন নি। অর্থাৎ কেউ তাঁকে বিদ্রোহের পক্ষে বলে অভিযুক্ত করছেন। পক্ষান্তরে কেউ তাঁকে বিদ্রোহের বিপক্ষে বলে অভিযুক্ত করছেন। অর্থাৎ যে যেভাবে পারছেন তাঁকে অভিযুক্ত করছেন। এ বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য আমরা ফিকহুল আকবারের অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় দেখব। আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফা নিজে ও তাঁর আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম তাহাবী খুব সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন যে, পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ইসলামী আকীদার পরিপন্থী ও অবৈধ। এখানে আমরা শুধু বুঝার চেষ্টা করি যে, তিনি যদি এরূপ বৈধতা দিয়েও থাকেন তাহলে তা কত বড় অপরাধ ছিল? সত্যই কি তিনিই প্রথম উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে অস্ত্র নিয়ে আগমন করেছিলেন?

প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ‘‘রাষ্ট্র’’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও মূল আরবের বাসিন্দারা কখনো ‘‘রাষ্ট্র’’ ব্যবস্থার অধীনে বাস করেন নি। তারা রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বুঝতেন না, বুঝতেন গোত্রীয় আনুগত্য। গোত্রের বাইরে কারো আনুগত্যকে তারা অবমাননাকর মনে করতেন। এছাড়া ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ তাদেরকে তাদের মতের বাইরে সকল সিদ্ধান্ত অমান্য করতে প্রেরণা দিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বিচ্ছিন্ন জাতিকে প্রথমবারের মত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আনেন। তিনি তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও আনুগত্যের মধ্যে অবস্থান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শাসক-প্রশাসক পাপী হলেও তার পাপের প্রতি ঘৃণা, আপত্তি ও প্রতিবাদসহ তার আনুগত্য ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বর্জন করা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা করা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বাইরে বা রাষ্ট্রহীনভাবে বাস করাকে তিনি জাহিলী জীবন ও এ প্রকারের মৃত্যুকে জাহিলী মৃত্যু বলেছেন। পরবর্তীতে আমরা এগুলো বিস্তারিত দেখব, ইনশা আল্লাহ।

রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিষয়ক কুরআন-হাদীসের এ সকল নির্দেশনা অনুধাবন ও প্রয়োগ ঘটে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে বসবাসের সাথে সাথে। এ জাতীয় একটি বিষয় ‘‘পাপী রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য’’ বনাম ‘‘পাপের প্রতিবাদ’’। কুরআন ও হাদীসে বারবার ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখতে ও বিদ্রোহ বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উভয় নির্দেশের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রথম যুগের সাহাবী-তাবিয়ীগণের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য ও কর্মপার্থক্য ঘটে। অধিকাংশ সাহাবী-তাবিয়ী সর্বাবস্থায় রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখা ফরয এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ হারাম বলে গণ্য করেছেন।

পক্ষান্তরে তাঁদের যুগে কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে কেউ কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন। ইয়াযিদের সময়ে ইমাম হুসাইনের (রা) ঘটনায়, মদীনার বিদ্রোহে ও ইবন যুবাইরের ঘটনায় কয়েকজন সাহাবী ও অনেক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী অস্ত্রধারণ করেন। আব্দুল মালিকের (খিলাফাত ৬৫-৮৬) বিরুদ্ধে আব্দুর রাহমান ইবন মুহাম্মাদ ইবনুল আস‘আসের (৮৫ হি) বিদ্রোহে, উমাইয়া খলীফাদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের পৌত্র যাইদ ইবন আলীর (১২২ হি) যুদ্ধে এবং আববাসী খলীফা মানসূরের বিরুদ্ধে আলী (রা)-এর বংশধর, ‘নাফস যাকিয়্যাহ’ নামে পরিচিত প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ (৯২-১৪৭ হি)-এর বিদ্রোহে অনেক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী ইমাম ও আলিম অংশগ্রহণ করেন বা বৈধতা প্রদান করেন। কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে তাঁরা তা করেছেন তা আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। তবে লক্ষণীয় যে, মূলধারার সাহাবী-তাবিয়ীগণ এরূপ বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছেন, তবে অংশগ্রহণকারী বা বৈধতাদানকারীদেরকে বিভ্রান্ত বলেন নি। বরং তাঁরা ইজতিহাদে ভুল করেছেন বলে গণ্য করেছেন এবং তাঁদের জন্য দুআ করেছেন।

এভাবে হিজরী প্রথম শতাব্দী ও দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত কোনো কোনো তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ পাপী সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদে অস্ত্রধারণ বৈধ বলে গণ্য করেছেন। একে তারা ‘‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের’’ অংশ বলে গণ্য করতেন। দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ একমত হয়ে যান যে, জালিম বা পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বৈধ নয়। খারিজী ও মুতাযিলীদের আকীদার মূলনীতি ছিল ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ ও জিহাদের নামে পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ। পক্ষান্তরে মূলধারার মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদার মধ্যে পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অবৈধতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

তাহলে নুমান ইবন সাবিত প্রথম উম্মাতের মধ্যে অস্ত্র নিয়ে আগমন করেন নি। তাঁর পূর্বে ও সমসাময়িক অনেক সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের বৈধতায় বিশ্বাস করেছেন। এ বিষয়ক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আগে, তাঁর যুগের কাউকে এ মত পোষণের জন্য বিভ্রান্ত বলা যায় না। ইবন হাজার আসকালানী বলেন:

وقولهم كان يرى السيف يعني كان يرى الخروج بالسيف على أئمة الجور وهذا مذهب للسلف قديم لكن استقر الامر على ترك ذلك... بمثل هذا الرأى لا يقدح في رجل قد ثبتت عدالته واشتهر بالحفظ والاتقان والورع التام.

‘‘অস্ত্রে বিশ্বাস করতেন, অর্থাৎ জালিম-ফাসিক শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বৈধ বলে বিশ্বাস করতেন। প্রাচীন সালফ সালিহীনের মধ্যে এ মতটি বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে এটি বর্জন করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।...যার সততা প্রমাণিত এবং হাদীস মুখস্থ রাখা ও পরিপূর্ণ তাকওয়ার বিষয়ে যিনি প্রসিদ্ধ এ মতটি তাঁর ত্রুটি প্রমাণ করে না।’’

১১. হাদীস বিষয়ক অভিযোগ

ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হাদীস বিষয়ক অভিযোগ দ্বিবিধ: (১) তিনি হাদীসের জ্ঞান ও বর্ণনায় দুর্বল ছিলেন এবং (২) তিনি হাদীস বিরোধী ফিকহের জনক ছিলেন। ইনশা আল্লাহ, দ্বিতীয় বিষয়টি আমরা ফিকহ বিষয়ক অভিযোগ প্রসঙ্গে আলোচনা করব। এখানে আমরা প্রথম বিষয়টি আলোচনা করতে চাই।

আমরা বলেছি যে, তৃতীয় শতক থেকে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা বিরোধী প্রচারণা ছিল ব্যাপক। তারপরও আমরা দেখি যে, তৃতীয় শতকের প্রথম দিকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞগণ তাঁর নির্ভরযোগ্যতার কথা বলেছেন। পরবর্তীগণ তাঁর দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন।

১১. ১. ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (১৫৮-২৩৩ হি)

ইতোপূর্বে ইবন মায়ীন (রাহ)-এর কথায় আমরা দেখেছি যে, তাঁর যুগেই মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করতেন। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, তাঁর যুগেই মুতাযিলী বিরোধিতা, মুরজিয়া বিরোধিতা, বিদআতী আকীদা বিরোধিতা ও হাদীস অস্বীকার বিরোধিতার নামে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে প্রচারণা তুঙ্গে উঠেছে। ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে ইবন মায়ীনের গ্রন্থে ও তাঁর থেকে বর্ণিত বক্তব্যগুলোতে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো দেখি:

(ক) তিনি পূর্ববর্তী আলিমগণ থেকে ইমাম আবূ হানীফার পক্ষে কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। এরূপ একটি বর্ণনা নিম্নরূপ:

يحيى بن ضريس يقول شهدت سفيان وأتاه رجل (رجل له مقدار في العلم والعبادة) فقال ما تنقم على أبي حنيفة قال وماله قال سمعته يقول قولا فيه إنصاف وحجة: آخذ بكتاب الله فما لم أجد فبسنة رسول الله ﷺ (والآثار الصحاح عنه التي فشت في أيدي الثقات عن الثقات) فإن لم أجد في كتاب الله ولا سنة آخذ بقول أصحابه آخذ بقول من شئت منهم وأدع قول من شئت ولا أخرج من قولهم إلى قول غيرهم فإذا ما انتهى الأمر إلى إبراهيم والشعبي وابن سيرين والحسن ... فقوم اجتهدوا فأجتهد كما اجتهدوا قال فسكت سفيان طويلا ثم قال ... نسمع التشديد من الحديث فنخافه ونسمع اللين فنرجوه لا نحاسب الأحياء ولا نقضي على الأموات نسلم ما سمعنا ونكل ما لم نعلم إلى عالمه ونتهم رأينا لرأيهم

‘‘ইয়াহইয়া ইবন দুরাইস বলেন, আমি সুফইয়ান সাওরীর কাছে বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় একব্যক্তি তাঁর নিকট আসলেন, যিনি ইলম ও ইবাদতে বড় মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি বললেন, আপনি কেন আবূ হানীফার প্রতি বিরক্ত? তিনি বলেন: কেন? তাঁর কি হয়েছে? লোকটি বলে: আমি তাঁকে যা বলতে শুনেছি তা ইনসাফ ও দলিলপূর্ণ। তিনি বলেন: ‘‘আমি আল্লাহর কিতাবের উপর নির্ভর করি। আল্লাহর কিতাবে যা না পাই সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সুন্নাত ও নির্ভরযোগ্য রাবীদের সূত্রে নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলোর উপর নির্ভর করি। কিতাব ও সুন্নাতে যা না পাই সে বিষয়ে সাহাবীগণের বক্তব্যের উপর নির্ভর করি। তাঁদের মধ্য থেকে যার মত ইচ্ছা গ্রহণ করি এবং যার মত ইচ্ছা বাদ দেই, তবে তাঁদের মত ছেড়ে অন্য কারো কথার দিকে যাই না। আর যখন বিষয়টি ইবরাহীম নাখয়ী, শা’বী, ইবন সীরীন, ... তাবিয়ীদের পর্যায়ে আসে তখন তাঁরা যেমন ইজতিহাদ করেছেন আমিও তেমন ইজতিহাদ করি।’’ এ কথা শুনে সাওরী দীর্ঘসময় চুপ করে থাকেন। ... এরপর বলেন: আমরা অনেক সময় কঠিন বা খারাপ কথা শুনি, তখন তাতে ভীত হই, কখনো নরম কথা শুনি তখন আশাবাদী হই। আমরা জীবিতদের হিসাব লই না এবং মৃতদের বিচারও করি না। যা শুনি তা মেনে নিই এবং যা না জানি তা যিনি জানেন তার উপর ছেড়ে দিই। তাঁদের মতের বিপরীতে আমাদের মতকেই অভিযুক্ত করি।’’

এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, অনেক সময় মানুষেরা ইমাম সাওরীর কাছে যেয়ে, ইমাম আবূ হানীফার নামে এমন সব কথা বলত যে তিনি তাঁর ঈমানী চেতনায় ক্রুদ্ধ ও ক্ষুদ্ধ হয়ে বিরূপ মন্তব্য করতেন। আবার যখন তিনি ভাল কথা শুনতেন তখন তাঁর প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করতেন। ইবন মায়ীন শুধু ভাল বিষয়ই উল্লেখ করেছেন।

(খ) তিনি তাঁর উস্তাদ দ্বিতীয় শতকের জারহ-তাদীলের ইমাম ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি আবূ হানীফার প্রশংসা করতেন এবং ফিকহী মতে তাঁর অনুসরণ করতেন। এ বিষয়ক একটি উদ্ধৃতি আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। অন্য বক্তব্যে ইবন মায়ীন বলেন: আমি ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তানকে বলতে শুনেছি:

لا نكذب الله ربما رأينا الشيء من رأى أبي حنيفة فاستحسناه فقلنا به

‘‘আমরা আল্লাহকে মিথ্য বলব না, অনেক সময় আমরা আবূ হানীফার মতের কিছু বিষয় দেখি যা আমাদের ভাল লাগে, তখন আমরা সে কথা মতই ফাতওয়া প্রদান করি।’’

(গ) ইবন মায়ীন নিজেও ইমাম আবূ হানীফার ফিকহের অনুসারী বা ভক্ত ছিলেন। তাঁর ছাত্র আব্বাস ইবন মুহাম্মাদ আদ-দূরী (১৮৩-২৭১হি) বলেন:

قال يحيى قال ابن وهب عن مالك بن أنس في المرأة يكون وليها ضعيفا أو يكون غائبا أو لا يكون لها ولي فتولي أمرها رجلا فيزوجها قال جائز وقال ابن وهب لا إلا بولي قلت ليحيى هذا يوافق قول أبي حنيفة قال نعم يعنى قول مالك.

ইয়াহইয়া বলেন: (মিসরের প্রসিদ্ধ ফকীহ আব্দুল্লাহ) ইবন ওয়াহব (১৯৭ হি) মালিক ইবন আনাস (১৭৯ হি) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যদি কোনো মহিলার অভিভাবক দুর্বল হয় বা অনুপস্থিত থাকে, অথবা তার অভিভাবক না থাকে এবং সে মহিলা অন্য কোনো পুরুষকে দায়িত্ব প্রদান করে এবং সে তার বিবাহ সম্পাদন করে তবে সে বিবাহ বৈধ হবে। আর ইবন ওয়াহাবের নিজের মত হলো, এ বিবাহ বৈধ হবে না, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হবে না। তখন আমি ইয়াহইয়া ইবন মায়ীনকে বললাম, মালিকের এ মত কি আবূ হানীফার মতের সাথে মিলে? তিনি বললেন: হ্যাঁ।’’

এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, ইবন মায়ীন ইমাম আবূ হানীফার ফিকহ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বলে বিবেচিত হতেন, যে কারণে কোনো বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার মাযহাব জানতে তাঁকে প্রশ্ন করা হতো।

(ঘ) ৪র্থ-৫ম শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ হুসাইন ইবন আলী সাইমারী (৩৫১-৪৩৬হি) তাঁর সনদে উদ্ধৃত করেন, ইবন মায়ীন বলেন:

القراءة عندي قراءة حمزة والفقه فقه أبي حنيفة على هذا أدركت الناس

‘‘আমার মতে কিরাআত হলো হামযার কিরাআত এবং ফিকহ হলো আবূ হানীফার ফিকহ। আমি মানুষদেরকে এ সিদ্ধামেত্মর উপরেই পেয়েছি।’’

এ উক্তি থেকেও জানা যায় যে, ইবন মায়ীন হানাফী ফিকহকেই অনুকরণীয় বিশুদ্ধ ফিকহ বলে গণ্য করতেন।

(ঙ) ৪র্থ শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আযদী (৩৭৪ হি) ও ৫ম শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবন আব্দুল বারর (৩৬৮-৪৬৩ হি) তাঁদের সনদে উদ্ধৃত করেছেন:

قال يحيى: وقد سمعت من أبي يوسف الجامع الصغير

‘‘ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন, আমি আবূ ইউসূফের নিকট থেকে ‘‘জামি সাগীর’’ গ্রন্থটি শুনেছি।’’

‘‘জামি সাগীর’’ হানাফী ফিকহের অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ, যাতে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শাইবানী (১৩১-১৮৯ হি) ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসূফ ও তাঁর নিজের ফিকহী মতামত সংকলন করেন। এ কথাটিও প্রমাণ করে যে, ইবন মায়ীন হানাফী ফিকহের প্রতি আকৃষ্ট ও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

(চ) তিনি ইমাম আবূ হানীফার নির্ভরযোগ্যতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করেন। আযদী ও ইবন আব্দুল বারর তাঁদের সনদে উদ্ধৃত করেছেন:

قيل ليحيى بن معين: أيما أحب إليك أبو حنيفة أو الشافعي ...؟ فقال: أما الشافعي فلا أحب حديثه، وأما أبو حنيفة فقد حدث عنه قوم صالحون، وأبو حنيفة لم يكن من أهل الكذب وكان صدوقا، ولكن ليس أرى حديثه يجزئ.

‘‘ইবন মায়ীনকে বলা হয়: আপনার নিকট কে প্রিয়তর? আবূ হানীফা, না শাফিয়ী...? তিনি বলেন: শফিয়ীর বিষয় হলো, তাঁর হাদীস আমি পছন্দ করি না। আর আবূ হানীফার বিষয় হলো, তাঁর থেকে অনেক নেককার মানুষ হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবূ হানীফা মিথ্যাবাদী ছিলেন না। তিনি সত্যপরায়ণ ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় তাঁর হাদীস যথেষ্ট নয়।’’

এখানে ইবন মায়ীন বলছেন যে, তিনি ইমাম শাফিয়ীর হাদীস পছন্দ করেন না, বরং হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে ইমাম আবূ হানীফা শক্তিশালী ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এরপরও বলছেন যে, তাঁর হাদীস যথেষ্ট নয়। এ বক্তব্যকে ইমাম শাফিয়ীর অগ্রহণযোগ্যতা ও ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতা বা দুর্বলতার দলীল হিসেবে পেশ করা ঠিক নয়। কিয়াসপন্থী রাবীয়াহ, কাযী মুহাম্মাদ ইবন হাযম, ইমাম জাফর সাদিক সম্পর্কে ইবন উয়াইনাহর বক্তব্য এবং ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে ইবনুল মুবারাকের বক্তব্যের অর্থ আর এ বক্তব্যের অর্থ একই বলে প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ ফিকহী বিষয়ে ব্যস্ততার কারণে মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁদের হাদীসে ভুলভ্রান্তি বেশি হতো অথবা তাঁদের বর্ণিত হাদীসের পরিমাণ কম ছিল। এর মধ্যে ইবন মায়ীনের দৃষ্টিতে ইমাম আবূ হানীফা ইমাম শাফিয়ীর চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য।

(ছ) ইবন আদী (৩৬৫ হি) ও খতীব বাদগাদী (৪৬৩ হি) আহমদ ইবন সাদ ইবন আবী মরিয়ম (২৫৩ হি) থেকে উদ্ধৃত করেছেন:

سألت يحيى بن معين عن أبى حنيفة قال لا تكتب حديثه

‘‘আমি ইয়াহইয়া ইবন মায়ীনকে আবূ হানীফার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন, তুমি তাঁর হাদীস লিখ না।’’

শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেন, এ কথা থেকে বুঝা যায় যে, ইবন মায়ীন আবূ হানীফাকে দুর্বল বলে গণ্য করছেন। পক্ষান্তরে শাইখ আব্দুর রাহমান ইবন ইয়াহইয়া মুআল্লিমী (১৩৮৬ হি) বলেন:

(لا تكتب حديثه) ليست بصريحة في الجرح فقد يكون ابن معين ... علم أن أحمد قد استكثر من سماع الحديث ويمكنه أن يشتغل بما هو أنفع له من تتبع أحاديث أبي حنفية

‘‘(তুমি তাঁর হাদীস লিখ না) এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে দুর্বলতা প্রকাশক নয়। হতে পারে যে, ইবন মায়ীন জানতেন যে, ইবন আবী মরিয়ম হাদীস শিক্ষায় অনেক অগ্রবর্তী, কাজেই আবূ হানীফার বর্ণিত হাদীস অনুসন্ধান না করে অন্যান্য উপযোগী বিষয়ে ব্যস্ত হওয়া তাঁর জন্য সম্ভব।’’

অর্থাৎ ফিকহে অত্যধিক ব্যস্ততার কারণে ইমাম আবূ হানীফার বর্ণিত হাদীস তুলনামূলকভাবে কম। কাজেই ইবন মায়ীনের মতে ইবন আবী মরিয়মের জন্য তাঁর হাদীস না লিখলেও চলবে। উলেস্নখ্য যে, ইমাম আবূ হানীফার মুহাদ্দিস ছাত্রদের সংখ্যা এবং তাঁর কিতাবুল আসার ও মুসনাদ গ্রন্থের হাদীসের সংখ্যার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তাঁর বর্ণিত হাদীস তাঁর প্রজন্মের মুহাদ্দিসদের তুলনায় কম ছিল না।

(জ) ইবন মায়ীনের মারিফাতুর রিজাল গ্রন্থের বর্ণনাকারী তাঁর ছাত্র আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন কাসিম ইবন মুহরিয বলেন:

سمعت يحيى بن معين يقول كان أبو حنيفة لا بأس به وكان لا يكذب ... وسمعت يحيى يقول مرة أخرى أبو حنيفة عندنا من أهل الصدق ولم يتهم بالكذب ولقد ضربه ابن هبيرة على القضاء فأبى أن يكون قاضيا

‘‘আমি ইয়াহইয়া ইবন মায়ীনকে বলতে শুনেছি, আবূ হানীফার বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। তিনি মিথ্যা বলতেন না। ... আমি ইয়াহইয়াকে অন্য একবার বলতে শুনেছি: আবূ হানীফা আমাদের নিকট সত্যপরায়ণ, তাঁকে মিথ্যায় অভিযুক্ত করা হয় নি। (ইরাকের উমাইয়া গভর্নর) ইবন হুবাইরা (১৩২ হি) তাঁকে বিচারক পদ গ্রহণে বাধ্য করতে প্রহার করেন; তা সত্ত্বেও তিনি বিচারকের পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।’’

এ কথাগুলোও বাহ্যত উপরের অর্থেই, তবে অধিক শক্তিশালী। কারণ মুহাদ্দিসগণ জানেন যে, ইবন মায়ীনের পরিভাষায় ‘‘আপত্তি নেই’’ অর্থ তিনি ‘সিকাহ’ বা বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।

(ঝ) ইবন আব্দুল বার্র (৩৬৮-৪৬৩ হি) তাঁর সনদে ইবন মায়ীনের ছাত্র আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন ইবরাহীম দাওরাকী (২৭৬ হি) থেকে উদ্ধৃত করেন:

سئل يحيى بن معين وأنا اسمع عن أبى حنيفة فقال ثقة ما سمعت أحدا ضعفه هذا شعبة بن الحجاج يكتب اليه أن يحدث ويأمره وشعبة شعبة

‘‘আমার উপস্থিতিতে ইয়াইয়া ইবন মায়ীনকে আবূ হানীফা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, আমি শুনছিলাম, তিনি বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য-বিশ্বস্ত। কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন বলে আমি শুনি নি। এ তো শুবা ইবনুল হাজ্জাজ, তিনি আবূ হানীফাকে হাদীস বর্ণনা করতে লিখেন এবং অনুরোধ করেন। আর শুবা তো শুবাই।’’

এখানে খুব স্পষ্ট করে ইবন মায়ীন তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, তাঁকে দুর্বল বলেছে এমন একজনকেও তিনি জানেন না। উপরন্তু শুবার মতকে তিনি প্রমাণ হিসেবে পেশ করছেন।

(ঞ) ইমাম মিয্যী (৭৪২হি), ইমাম যাহাবী (৭৪৮ হি), ইবন হাজার আসকালানী (৮৫২ হি) প্রমুখ রিজালবিদ ইবন মায়ীনের ছাত্র মুহাম্মাদ ইবন সাদ আল-আউফী থেকে উদ্ধৃত করেন, আমি ইবন মায়ীনকে বলতে শুনেছি:

كان أبو حنيفة ثقة في الحديث، كان لا يحدث بالحديث إلا بما يحفظه، ولا يحدث بما لا يحفظ.

‘‘আবূ হানীফা হাদীসে নির্ভরযোগ্য-বিশ্বস্ত ছিলেন। যে হাদীস তাঁর মুখস্থ সে হাদীস ছাড়া কোনো হাদীস তিনি বলতেন না। যা তাঁর মুখস্থ নয় তা তিনি বলতেন না।’’

এছাড়া তাঁরা ইবন মায়ীনের অন্য ছাত্র সালিহ ইবন মুহাম্মাদ আসাদী জাযরাহ (২৯৩ হি) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেন, ইবন মায়ীন বলেন:

كان أبو حنيفة ثقةً في الحديث

‘‘আবূ হানীফা হাদীসে নির্ভরযোগ্য ছিলেন।’’

এভাবে আমরা দেখছি যে, ইবন মায়ীন সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ববর্তী কোনো মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফাকে দুর্বল বলেন নি। অধিকাংশ বক্তব্যে তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। কখনো বা তাঁকে কিছুটা দুর্বল বলেছেন। বাহ্যত এ দুর্বলতা ফিকহী বিষয়ে ব্যস্ততার জন্য হাদীস বর্ণনায় গুরুত্ব কম দেওয়ার কারণে। এক্ষেত্রে তিনি ইমাম শাফিয়ীর চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে ইবন মায়ীন বলেছেন।

১১. ২. ইবনুল মাদীনী: আলী ইবন আব্দুল্লাহ (১৬১-২৩৪হি)

তৃতীয় শতকের জারহ-তাদীলের অন্য দিকপাল ইমাম ইবনুল মাদীনী (রাহ)। আয্দী ও ইবন আব্দুল বার্র তাঁদের সনদে উদ্ধৃত করেছেন, ইবনুল মাদীনী বলেন:

أبو حنيفة روى عنه الثوري وابن المبارك وحماد بن زيد وهشيم ووكيع بن الجراح وعباد بن العوام وجعفر بن عون وهو ثقة لا بأس به.

‘‘আবূ হানীফা থেকে সুফইয়ান সাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক, হাম্মাদ ইবন যাইদ, হুশাইম, ওকী ইবনুল জার্রাহ, আববাদ ইবনুল আউয়াম, জাফর ইবন আউন প্রমুখ হাদীস শিক্ষা করেছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য, তাঁর বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই।’’

এখানে ইবনুল মাদীনী নিজে ইমাম আবূ হানীফাকে নির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করা ছাড়াও অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি যাদের নাম উল্লেখ করেছেন এরা সকলেই দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ও জারহ-তাদীলের ইমাম ছিলেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁদের হাদীস গ্রহণ করেছেন। এরা সকলেই ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীস শিখেছেন। এর অর্থ দ্বিতীয় শতকের মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবূ হানীফাকে নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস বলে গণ্য করতেন। আমরা দেখেছি যে, ইবন মায়ীনও এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন: ‘‘আবূ হানীফা থেকে অনেক নেককার মানুষ হাদীস শিক্ষা করেছেন।’’

অন্য বর্ণনায় ইবনুল মাদীনী ইমাম আবূ হানীফাকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। খতীব বাগদাদী ইবনুল মাদীনীর ছেলে আব্দুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন:

سألته يعني أباه عن أبي حنيفة صاحب الرأي فضعفه جدا وقال ... وروى خمسين حديثا أخطأ فيها

আমি আমার পিতা ইবনুল মাদীনীকে ‘রায়’ বা ‘কিয়াসপন্থী’ আবূ হানীফা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তখন তিনি তাঁকে খুব দুর্বল বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন: তিনি ৫০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন যেগুলোতে ভুল করেছেন।’’

উভয় বক্তব্যের মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট। আমরা জানি না কোন্টি তাঁর সর্বশেষ বক্তব্য। তবে বাহ্যত ‘‘কিয়াসপন্থী’’ হওয়া তাঁর প্রতি মুহাদ্দিসদের বিরক্তির অন্যতম কারণ।

১১. ৩. ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি)

ইমাম আহমদ (রাহ)ও ‘কিয়াসপন্থী’ হওয়ার কারণে ইমাম আবূ হানীফার উপরে বিক্ষুদ্ধ ছিলেন। তাঁর পুত্র বলেন: আমার পিতাকে প্রশ্ন করা হয়, এক স্থানে কিয়াসপন্থীরা রয়েছেন এবং কয়েকজন হাদীসপন্থী রয়েছেন যারা হাদীসের সহীহ-যয়ীফ বুঝেন না, সেখানে যদি কেউ দীন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে চায় তবে কাকে প্রশ্ন করবে? তিনি বলেন:

يسأل أصحاب الحديث ولا يسأل اصحاب الرأي الضعيف الحديث خير من رأي أبي حنيفة... حديث أبي حنيفة ضعيف ورأيه ضعيف

‘‘মুহাদ্দিসদেরকে প্রশ্ন করবে, কিন্তু কিয়াসপন্থীদেরকে (ফকীহদেরকে) প্রশ্ন করবে না; আবূ হানীফার কিয়াসের চেয়ে যয়ীফ হাদীস উত্তম .... আবূ হানীফার হাদীস যয়ীফ এবং তাঁর রায় (ফিকহী মত)-ও যয়ীফ।’’

ইমাম আহমদ অন্যত্র বলেন:

وكنا نلعن أصحاب الرأي ويلعوننا حتى جاء الشافعي، فخرج بيننا.

‘‘আমরা ‘রায়’-পন্থী বা কিয়াসপন্থীদেরকে (ফকীহদেরকে) অভিশাপ করতাম এবং তাঁরাও আমাদেরকে অভিশাপ করতেন। এরপর শাফিয়ী আমাদের কাছে আসলেন, তখন তিনি আমাদের মধ্যে যোগসূত্র গড়লেন।’’

অর্থাৎ হাদীস ও ফিকহের মধ্যে তথাকথিত যে শত্রুতা ছিল ইমাম আহমদ তাতে প্রভাবিত ছিলেন। ইমাম শাফিয়ীর সাথে সাক্ষাত ও শিক্ষা গ্রহণের পর তাঁর এ ভিত্তিহীন বিদ্বেষ দূরীভূত হয়। উল্লেখ্য যে, ইমাম শাফিয়ীও আহল রায় হিসেবে মুহাদ্দিসদের বিরাগভাজন হয়েছেন। ইবন মায়ীনের অভিযোগ আমরা দেখেছি। বুখারী ও মুসলিম তাঁর হাদীস প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন নি। ফিকহী ব্যস্ততার কারণে হাদীস বিষয়ে তাঁর অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতার বিষয় ব্যক্ত করে তিনি ইমাম আহমদকে বলেন:

أنتم أعلم بالأخبار الصحاح منا فإذا كان خبر صحيح فأعلمني حتى أذهب إليه

‘‘সহীহ হাদীসের বিষয়ে আপনারা-মুহাদ্দিসগণ আমাদের-ফকীহগণের চেয়ে অধিক অভিজ্ঞ। যদি কোনো সহীহ হাদীস থাকে তবে আমাকে জানান, যেন আমি তা গ্রহণ করতে পারি।

এখানে অন্য আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের উপর নির্মম অত্যাচারের হোতা মুতাযিলী গুরু, খলীফা মামুন, মু’তাসিম ও ওয়াসিকের প্রধান মন্ত্রণাদাতা বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুওয়াদ ছিলেন প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ। তার উপস্থিতিতে এবং বারবার তারই ইন্ধনে খলীফা মু‘তাসিম ইমাম আহমদকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেন। তৎকালীন সময়ের মুতাযিলীগণ সকলেই ফিকহী বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার অনুসরণ করতেন এবং আকীদার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁদের পক্ষে ছিলেন বলে প্রমাণের চেষ্টা করতেন। কাজেই ইমাম আহমদের মনে সামগ্রিকভাবে হানাফী ফকীহগণ, হানাফী ফিকহ ও ইমাম আবূ হানীফার প্রতি বিরক্তি ও ক্ষোভ থাকাই স্বাভাবিক।

১১. ৪. ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হি)

ইমাম বুখারী মুসলিম উম্মাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ। সহীহ বুখারী ছাড়াও হাদীস বর্ণনাকারী রাবী ও মুহাদ্দিসগণের গ্রহণযোগ্যতা, দুর্বলতা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। রাবীগণের সমালোচনায় ইমাম বুখারীর দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়:

প্রথমত: পরিভাষার বিনম্রতা। অন্যান্য মুহাদ্দিস যাকে ‘‘মিথ্যাবাদী’’ বা ‘‘জালিয়াত’’ বলেছেন, তিনি তার বিষয়ে বলেছেন: ‘‘তার বিষয়ে আপত্তি আছে’’, ‘‘আপত্তিকর’’, ‘‘পরিত্যক্ত’’, তাকে মুহাদ্দিসগণ পরিত্যাগ করেছেন’’, ‘‘তার বিষয়ে তারা নীরব থেকেছেন’’, ‘‘মুখ ফিরিয়েছেন’’ ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত: সমালোচনার বিনম্রতা। অন্যান্য মুহাদ্দিস যাদেরকে অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করেছেন, তাদের অনেককে তিনি অল্প দুর্বল বা কোনো রকম গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।

এ বিনম্র সমালোচক ইমাম আবূ হানীফার ক্ষেত্রে বিনম্রতা রাখতে পারেন নি। তিনি ‘আত-তারীখ আস-সগীর’ গ্রন্থে তাঁর উস্তাদ নুআইম ইবন হাম্মাদ (২২৮ হি)-এর সূত্রে ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অনেক বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। একটি বক্তব্য দেখুন:

حدثنا نعيم بن حماد قال حدثنا الفزاري قال كنت عند سفيان فنعى النعمان فقال الحمد لله كان ينقض الاسلام عروة عروة ما ولد في الاسلام أشأم منه

‘‘আমাদেরকে নুআইম ইবন হাম্মাদ বলেন, আমাদেরকে আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ ফাযারী বলেন, আমি সুফইয়ান সাওরীর কাছে ছিলাম, এমতাবস্থায় নু’মানের মৃত্যু সংবাদ আসল। তখন তিনি বলেন: আল-হামদু লিল্লাহ, সে ইসলামকে ধ্বংস করত, একটি একটি করে রশি ছিন্ন করে!! ইসলামের মধ্যে তার চেয়ে অধিক অশুভ আর কেউ জন্মগ্রহণ করে নি।’’

এ কাহিনীর বর্ণনাকারী নুআইম ইবন হাম্মাদ সুন্নাতের পক্ষে এবং বিদআতের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। হানাফীদেরকে তিনি বিদআতী, মুতাযিলী, মুরজিয়া, এবং হাদীস বিরোধী কিয়াস পন্থী ‘আহলুর রায়’ বলে প্রচার করতেন। এজন্য জাল-জালিয়াতিও তিনি পরোয়া করতেন না। কিয়াস-পন্থীদেরকে বা হানাফীদেরকে ৭৩ ফিরকার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফিরকা বলে উল্লেখ করে একটি হাদীস তিনি বর্ণনা করেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে হাদীসটি ভিত্তিহীন জাল। তবে অনেক মুহাদ্দিস তার প্রতি শ্রদ্ধাবশত বলেছেন যে, তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুল করেছেন। অন্য অনেকে বলেছেন এটি তার জালিয়াতি। তাঁর সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেন:

كان يضع الحديث في تقوية السنة وحكايات في ثلب أبي حنيفة كلها كذب

‘‘তিনি সুন্নাতকে শক্তিশালী করার জন্য জাল হাদীস তৈরি করতেন এবং আবূ হানীফার নিন্দায় কাহিনী তৈরি করতেন যা সবই মিথ্যা।’’

নুআইমের এ বর্ণনা সত্য হলে ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতা প্রমাণ হতো না, সুফিয়ান সাওরীর দুর্বলতা প্রমান হতো। আমাদেরকে বলতে হতো, সুফইয়ান সাওরী এ কথা বলে পাপে লিপ্ত হয়েছিলেন। কারণ কোনো মানুষকে ‘অশুভ’ বলা হাদীসে নিষিদ্ধ হারাম। কোনো ব্যক্তির কর্মের বা মতের দলিলভিত্তিক সমালোচনা করা যায়। কিন্তু কোনো আলিম তো দূরের কথা একজন সাধারণ পাপী মুসলিমকেও ‘‘অশুভ’’ বলা বা এভাবে ঢালাও অভিযোগ করা বৈধ নয়। তবে বাহ্যত এ কাহিনী সত্য নয় বরং নুআইম ইবন হাম্মাদের বানানো। আল্লাহ আমাদেরকে ও পূর্ববর্তী আলিমদেরকে ক্ষমা করুন এবং দীনের জন্য তাঁদের খিদমাত কবুল করুন।

‘‘আত-তারীখ আল-কাবীর’’ গ্রন্থে ইমাম বুখারী বলেন:

نعمان بن ثابت أبو حنيفة ... كان مرجئا سكتوا عنه وعن رأيه وعن حديثه

‘‘নুমান ইবন সাবিত আবূ হানীফা কূফী ... তিনি মুরজিয়া ছিলেন; তাঁরা (মুহাদ্দিসগণ) তাঁর থেকে, তাঁর মত থেকে এবং তাঁর হাদীস থেকে নীরব হয়েছেন।’’

অন্যত্র কাযি আবূ ইউসূফের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

يعقوب بن ابراهيم أبو يوسف القاضي ... وصاحبه أبو حنيفة تركوه

‘‘ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম কাযী আবূ ইউসূফ ... তাঁর সাথী আবূ হানীফাকে মুহাদ্দিসগণ পরিত্যাগ করেছেন।’’

এখানে কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনাযোগ্য:

(১) ইমাম বুখারী বলেছেন যে, মুহাদ্দিসগণ আবূ হানীফা থেকে নীরব হয়েছেন। ইমাম বুখারীর পরিভাষায় ‘‘নীরব থাকা’’-র অর্থ মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবূ হানীফাকে পরিত্যাগ করেছেন এবং তাঁরা তাঁকে মিথ্যাবাদী পর্যায়ের বলে গণ্য করেছেন।

(২) ইমাম বুখারীর বক্তব্য থেকে বুঝা যায় ইমাম আবূ হানীফার একমাত্র অপরাধ যে, তিনি মুরজিয়া ছিলেন, যে কারণে মুহাদ্দিসগণ তাঁকে, তাঁর ফিকহী মত এবং ‘তাঁর বর্ণিত হাদীস’ পরিত্যাগ করেছেন। মুরজিয়া হওয়া ছাড়া অন্য কোনো অপরাধের কথা তিনি উল্লেখ করেন নি।

আবূ হানীফা মুরজিয়া ছিলেন কিনা তা আমরা পরে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। তবে মুরজিয়া হওয়ার কারণে কোনো মুহাদ্দিস দুর্বল বা পরিত্যাক্ত হন না। নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিগত সততা ও বর্ণিত হাদীসের নির্ভুলতা প্রমাণ করা মুহাদ্দিসের গ্রণযোগ্যতার মূল ভিত্তি। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে অনেক মুরজিয়া, কাদারিয়া, খারিজী ও অন্যান্য ফিরকার মুহাদ্দিসের হাদীস সংকলন করেছেন। এখানে ইমাম আবূ হানীফার পূর্বের ও সমসাময়িক অল্প কয়েকজন প্রসিদ্ধ মুরজিয়া মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করছি যাদের বর্ণিত হাদীস বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন।

(১) বসরার তাবিয়ী তাল্ক ইবন হাবীব আল-আনাযী (৯০ হি)।

(২) কুফার তাবি-তাবিয়ী যার্র ইবন আব্দুল্লাহ মুরহাবী (১০০ হি)

(৩) কুফার তাবি-তাবিয়ী কাইস ইবন মুসলিম আল-জাদালী (১২০হি)

(৪) কূফার তাবিয়ী আমর ইবন মুর্রা জামালী (১২৮ হি)

(৪) কুফার তাবিয়ী খালিদ ইবন সালামাহ ইবনুল আস আল-ফা’ফা’ (১৩২ হি)।

(৫) হার্রানের তাবি-তাবিয়ী সালিম ইবন আজলান আল-আফতাস (১৩২ হি)

(৬) কুফার তাবিয়ী আসিম ইবন কুলাইব আল-জারমী (১৩৫ হি)।

(৭) কুফার তাবি-তাবিয়ী উমার ইবন যুর্র ইবন আব্দুল্লাহ (১৫৩ হি)

এদের সকলেই মুরজিয়া ছিলেন, কেউ মুরজিয়াদের নেতা ছিলেন, কাউকে সমকালীন কোনো কোনো মুহাদ্দিস পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এদের বর্ণিত হাদীস এবং এদের মত শতশত মুরজিয়া মুহাদ্দিসের হাদীস সহীহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

ইমাম মিয্যীর তাহযীবুল কামাল, হাফিয ইবন হাজারের তাহযীবুত তাহযীব ও অন্যান্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে আমরা এরূপ শতশত রাবীর পরিচয় পাই, যারা মুরজিয়া হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একারণে তাকে ‘‘পরিত্যাগ’’ করলেও সামগ্রিক বিচারে বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁদেরকে নির্ভরযোগ্য বলে নিশ্চিত করেছেন। ইমাম বুখারীর অনেক উসতাদও মুরজিয়া বলে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন।

(৩) ইমাম বুখারীর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, সকল মুহাদ্দিস আবূ হানীফাকে পরিত্যাগ করেছেন। তিনি বলতে পারতেন, অমুক অমুক মুহাদ্দিস তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন, তাহলে ইলমের আমানত আদায় হতো। অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই তিনি এরূপ বলেছেন। কিন্তু আবূ হানীফার ক্ষেত্রে তা না বলে তিনি বললেন: মুহাদ্দিসগণ তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, শুবা, ইবনুল মুবারাক, ইসরাঈল ইবন ইউনূস, ইয়াহইয়া ইবন আদাম, হাসান ইবন সালিহ, ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান, ইবন মাহদী, আবূ দাউদ খুরাইবী, প্রমুখ জারহ-তাদীলের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম সুস্পষ্টভাবে তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন। এমনকি ইমাম বুখারীর উসতাদ ইবন মায়ীন ও ইবনুল মাদীনী তাকে বিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ইবন মায়ীন বলেছেন যে, তিনি একজনকেও আবূ হানীফাকে দুর্বল বলতে শুনেন নি। তাহলে কে তাঁকে পরিত্যাগ করল? আমরা দেখেছি যে, তৃতীয় শতকের কেউ কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন। কিন্তু ইমাম বুখারীর পূর্বে কেউই তাকে পরিত্যক্ত বলেন নি।

এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, তৃতীয় শতকের ‘আবূ হানীফা বিরোধী’ যে প্রচারণার কথা আমরা বলেছি, যে প্রচারণার অন্যতম এক দিকপাল ছিলেন ইমাম বুখারীর এক উস্তাদ নুআইম ইবন হাম্মাদ, সে প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে ইমাম আবূ হানীফার প্রতি ইমাম বুখারী অত্যন্ত বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন। তাঁর মন্তব্যে তাঁর মনের এ গভীর বিরক্তি ও আপত্তিই প্রকাশ পেয়েছে। নিরপেক্ষ জ্ঞানবৃত্তিক বিচারে ইমাম বুখারীর কথা মোটেও ঠিক নয়। আবূ হানীফাকে কখনোই সকল মুহাদ্দিস পরিত্যাগ করেন নি। এমনকি একজন প্রসিদ্ধ সমালোচক মুহাদ্দিসও তাঁকে ‘‘পরিত্যক্ত’’ বলেন নি। মহান আল্লাহ তাঁর দীন ও তাঁর নবীর (ﷺ) সুন্নাতের খিদমাতে ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম বুখারীর অবদান কবুল করুন, তাঁদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করুন, তাঁদের উভয়কে উম্মাতের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।

প্রসিদ্ধ সৌদি আলিম আলী ইবন নাইফ আশ-শাহ্হূদ জারহ-তাদীলের বিভিন্ন পরিভাষা আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম বুখারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন:

ولا يعاب استعمالها منهم فيمن قالوها فيه، إلا قول البخاري في (أبي حنيفة النعمان بن ثابت الإمام الفقيه): "سكتوا عنه وعن رأيه وعن حديثه". فهذه حكاية من البخاري عن أهل الحديث، ومن تأمَّل فاحصاً منصفاً متبرئاً من العصبية وجد هذا القول خطأ، وذلك- بإيجاز- من جهتين :

الأولى: دلالة الاستقراء على أن أهل الحديث قد اختلفت عباراتهم في أبي حنيفة، بين معدِّل وجارح، علماً أن الجرح عند من جرح لم يفسر بسبب حديثه، فكيف سكتوا عنه، وفيهم من أثنى عليه وأطراه ورفع من شأنه .

والثانية: أن عبارات الجارحين وقع فيها من المبالغة والتَّهويل، وذلك بسبب الشِّقاق الذي كان بين أهل الرأي وأهل الحديث في تلك الفترة، علماً بأن كثيراً من تلك الأقاويل لا تصح نسبتها إلى من عزيت إليه.

وأبو حنيفة شغله الفقه عن الحديث، ولعله لو اشتغل به اشتغال كثير من أهل زمانه، لم يمكن مما مُكِّن فيه من الفقه، ومع ذلك فإنه قد روى وحدث، نعم، ليس بالكثير على التحقيق؛ للعلة التي ذكرنا، وهي انصرافه إلى فقه النصوص دون روايتها... وفي طبقات الشافعية للتاج السبكي 1/188 : ... الصواب أن من ثبتت إمامته وعدالته ، وكثر مادحوه وندر جارحه ، وكانت هناك قرينة دالّة على سبب جرحه من تعصب مذهبي أو غيره لم يلتفت إلى جرحه ...

‘‘(سكتوا عنه) ‘তাঁরা তার থেকে নীরব হয়েছেন’-এ পরিভাষাটি তারা যাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন তাদের ব্যবহার আপত্তিকর নয়। শুধু আপত্তিকর ইমাম ফকীহ আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিত-এর বিষয়ে বুখারীর বক্তব্য: ‘তাঁরা তাঁর থেকে, .... নীরব হয়েছেন।’ এখানে বুখারী মুহাদ্দিসগণের মত উদ্ধৃত করেছেন। যদি কেউ বিদ্বেষ বা পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ইনসাফের সাথে বিবেচনা করেন তবে তিনি নিশ্চিত হবেন যে, এ কথাটি ভুল। সংক্ষেপে দু কারণে এ কথাটি ভুল:

প্রথমত: মুহাদ্দিসগণের মত একত্র করলে দেখা যায় যে, তাঁর বিষয়ে তাঁদের মতভেদ রয়েছে। কেউ তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন, কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন। তবে লক্ষণীয় যে, যারা তাঁকে দুর্বল বলেছেন তাঁরা তাঁর হাদীসের ত্রুটি ব্যাখ্যা করে দুর্বল বলেন নি; তাহলে তাঁরা নীরব থাকলেন কিভাবে? অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর প্রশংসা করেছেন, গুণকীর্তন করেছেন এবং তাঁর উচ্চ মর্যাদার সাক্ষ্য দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত: যারা তাঁকে দুর্বল বলেছেন তাঁদের বক্তব্যে অনেক বাড়াবাড়ি ও অতিকথন রয়েছে। এর কারণ ‘আহলুর রায়’ বা ফকীহগণ ও ‘আহলুল হাদীস’ বা মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সে যুগে বিদ্যমান মতভেদ ও বিভক্তি। সর্বোপরি এ সকল বক্তব্যের অধিকাংশই সনদ বিচারে সহীহ নয়।

আবূ হানীফা হাদীসের চেয়ে ফিকহ বিষয়ে বেশি মাশগুল থেকেছেন। তিনি যদি তাঁর যুগের মুহাদ্দিসদের মত হাদীস নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তাহলে তিনি ফিকহে যে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন তা হয়ত অর্জন করতে পারতেন না। তা সত্ত্বেও তিনি হাদীস সংগ্রহ ও বর্ণনা করেছেন। তবে গবেষণা প্রমাণ করে যে, তাঁর বর্ণিত হাদীস বেশি নয়। এর কারণ আমরা যা বলেছি; অর্থাৎ তিনি হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষাদানের পরিবর্তে হাদীসের ফিকহী নির্দেশনা অনুধাবন ও শিক্ষাদানে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করেন।..... (সুপ্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস) তাজুদ্দীন সুবকী (৭২৭-৭৭১ হি) তাঁর ‘তাবাকাতুশ শাফিয়ীয়্যাহ ১/১৮৮ পৃষ্ঠায় বলেন: ‘‘... সঠিক কথা হলো, যার ইমামত ও নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে, যার প্রশংসাকারীর সংখ্যা বেশি, কিন্তু খুব কম ব্যক্তিই তাঁকে দুর্বল বলেছেন, পারিপার্শিক অবস্থা থেকে প্রমাণিত হয় যে, যারা তাঁকে দুর্বল বলেছেন তাঁরা মাযহাবী বা মতভেদগত পক্ষপাতের কারণে দুর্বল বলেছেন, তাহলে তাঁর দুর্বলতার বিষয়ে কথিত এ সকল বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না।....’’

১১. ৫. ইমাম নাসায়ী আহমদ ইবন শুআইব (২১৫-৩০৩ হি)

সময়ের আবর্তনে আবূ হানীফা বিরোধী প্রচারণা বাড়তে থাকে। ফলে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে বিরূপ ধারণা প্রসার পেতে থাকে এবং অনেকেই তাঁর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এখানে প্রসিদ্ধ কয়েকজনের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। ইমাম নাসায়ী (রাহ) ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বিষয়ে বলেন:

نعمان بن ثابت أبو حنيفة ليس بالقوي في الحديث

‘‘নুমান ইবন সাবিত আবূ হানীফা হাদীসে শক্তিশালী নন।’’

তৃতীয় শতকে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে বিদ্যমান ‘আবূ হানীফা বিরোধী প্রচারণা’ পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম নাসায়ীর এ বক্তব্য ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে তাঁর সিদ্ধান্ত। ইমাম নাসায়ীর পরিভাষার সাথে পরিচিতরা জানেন যে, (শক্তিশালী নন) বলতে তিনি বুঝান যে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের হাফিযে হাদীস নন, কিছু ভুল হয়। আর দুর্বল বুঝাতে তিনি ‘যয়ীফ’ বা ‘দুর্বল’ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এজন্য রিজাল গ্রন্থসমূহে আমরা দেখি যে, শত শত রাবীকে ইমাম নাসায়ী (শক্তিশালী নন) বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসায়ী নিজে ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁদের হাদীস সহীহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উলেস্নখ্য যে, ইমাম নাসায়ী ইমাম আবূ হানীফার হাদীস তাঁর সুনান গ্রন্থে গ্রহণ করেছেন। আর তিনি তাঁর সুনান গ্রন্থে রাবীগণের বিষয়ে বুখারী-মুসলিম সমপর্যায়ের বা কাছাকাছি কড়াকড়ি করতেন বলে প্রসিদ্ধ।

১১. ৬. ইমাম ইবন হিব্বান মুহাম্মাদ আল-বুসতী (৩৫৪ হি)

তৃতীয় শতকের মুহাদ্দিসগণের মধ্যে বিদ্যমান ‘আবূ হানীফা’ বিরোধী প্রচারণা আরো ব্যাপকতা লাভ করে চতুর্থ শতকে। আমরা দেখি যে, এ শতক থেকে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মাযহাবী তাকলীদ প্রসার লাভ করে এবং অধিকাংশ মুহাদ্দিসই শাফিয়ী মাযহাব অনুসরণ করতেন। তৎকালীন পরিবেশে মাযহাবী কোন্দল দ্বারা তাঁরা কমবেশি প্রভাবিত হতে লাগলেন। এর প্রভাব আমরা তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে দেখতে পাই। এর বড় উদাহরণ ইবন হিব্বান (রাহ)। তিনি ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে বলেন:

وكان رجلا جدلا ظاهر الورع لم يكن الحديث صناعته، حدث بمائة وثلاثين حديثا مسانيد ماله حديث في الدنيا غيرها أخطأ منها في مائة وعشرين حديثا. إما أن يكون أقلب إسناده أو غير متنه من حيث لا يعلم فلما غلب خطؤه على صوابه استحق ترك الاحتجاج به في الاخبار.

‘‘তিনি একজন ঝগড়াটে-তার্কিক লোক ছিলেন, বাহ্যিক পরহেযগার ছিলেন। হাদীস তাঁর বিদ্যার মধ্যে ছিল না। তিনি মোট ১৩০টি সনদসহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। দুনিয়ায় তাঁর বর্ণিত আর কোনো হাদীস নেই। এগুলির মধ্যে ১২০টি হাদীসে তিনি ভুল করেছেন। না জেনে হয় সনদ উল্টে দিয়েছেন অথবা মতন পাল্টে দিয়েছেন। এভাবে নির্ভুল বর্ণনার চেয়ে ভুল বর্ণনার আধিক্যের কারণে তিনি হাদীস বর্ণনায় পরিত্যক্ত বলে গণ্য হন।’’

উল্লেখ্য যে, তৎকালীন হানাফীদের সাথে শাফিয়ী ফকীহ ইমাম ইবন হিববানের অত্যন্ত কঠিন শত্রুতা ছিল। হানাফীগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়াতে তাদের অত্যাচারও বেশি ছিল। ফলে তিনি ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অত্যন্ত নোংরাভাবে বিষোদ্গার করেছেন। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে বড় বড় বই লিখেছেন এবং ‘‘মাজরূহীন’’ গ্রন্থের সবচেয়ে বড় অনুচ্ছেদটি তিনি ইমাম আবূ হানীফার কলঙ্ক বর্ণনার জন্য নির্ধারণ করেছেন। তিনি নিজে যে সকল রাবীকে জালিয়াত বলেছেন, এ অনুচ্ছেদে তাদের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। কোনো মুহাদ্দিস যখন অন্য মুহাদ্দিসের ‘জারহ’ বা ত্রুটি বর্ণনা করেন এবং পারিপার্শিক প্রমাণ থেকে বুঝা যায় যে, তা আকীদা বা মাযহাবী ক্ষোভজড়িত, তাহলে সে ‘জারহ’ বাতিল বলে গণ্য হয়। এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ইমাম সুবকীর বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। সর্বোপরি, ইমাম ইবন হিব্বান (রাহ)-এর বিষয়ে ইলমুল হাদীসের সাথে পরিচিত সকলেই জানেন যে তাঁর বক্তব্য, সমালোচনা বা ‘‘জারহ’ সাধারণভাবে কঠিন যাচাই ছাড়া গৃহীত হয় না। ইমাম যাহাবী প্রায়ই ইবন হিববানের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করেছেন। একস্থানে তিনি বলেন:

ابن حبان ربما قَصَبَ (جَرَحَ) الثقةَ حتى كأنه لا يدري ما يخرج من رأسه

‘‘ইবন হিব্বান প্রায়ই নির্ভরযোগ্যকে দুর্বল বলেন; এমনকি মনে হয়, তাঁর মাথা থেকে কি বের হচ্ছে তা তিনি নিজেই বুঝেন না।’’

১১. ৭. ইমাম ইবন আদী (২৭৭-৩৬৫হি)

এ যুগের অন্য প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম আবূ আহমদ আব্দুল্লাহ ইবন আদী (রাহ)। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বিষয়ে তিনি বলেন:

وأبو حنيفة له أحاديث صالحة، وعامة ما يرويه غلط وتصاحيف وزيادات في أسانيدها ومتونها، وتصاحيف في الرجال، وعامة ما يرويه كذلك، ولم يصح له في جميع ما يرويه إلا بضعة عشر حديثاً، وقد روى من الحديث لعله أرجح من ثلاثمائة حديث من مشاهير وغرائب، وكله على هذه الصورة؛ لأنه ليس هو من أهل الحديث، ولا يحمل على من تكون هذه صورته في الحديث.

‘‘আবূ হানীফা কিছু গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ হাদীসই ভুল, বিকৃতি, সনদ বা মতনে সংযোজন, রাবীর নামের পরিবর্তন। তাঁর অধিকাংশ হাদীসই এরূপ। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ১৫-২০টি হাদীস সহীহভাবে বর্ণিত। সম্ভবত তিনি পরিচিত ও অপরিচিত সব মিলিয়ে সর্বমোট তিনশতের মত হাদীস বর্ণনা করেছেন। সবগুলোরই এ অবস্থা; কারণ তিনি মুহাদ্দিস ছিলেন না। আর হাদীস বর্ণনায় যার এ অবস্থা তাঁর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।’’

পাঠক দেখছেন যে, দুজনের প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে বেজায় ফারাক। এখানে উল্লেখ্য যে, ইবন আদী সাধারণভাবে সুবিবেচক বলে গণ্য এবং তাঁর মতের গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কি এখানে সুবিবেচনার সাথে কথা বলেছেন? প্রসিদ্ধ সৌদি মুহাদ্দিস ও জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞ আলী ইবন নাইফ আশ-শাহ্হূদ ইমাম ইবন আদীর মাযহাবী পক্ষপাতদুষ্ট ও মাযহাবী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা প্রসঙ্গে বলেন:

أو ما قاله في ترجمة الإمام أبي حنيفة رحمه الله... وأبو حنيفة له أحاديث صالحة ... أقول: هذا الكلام غير صحيح، قال الإمام الذهبي في تذكرة الحفاظ ১/১৬৮: أبو حنيفة الإمام الأعظم ، فقيه العراق ... وكان إماماً ورعاً عالماً عاملاً، متعبدا، كبير الشأن، لا يقبل جوائز السلطان قال ابن المبارك: أبو حنيفة أفقه الناس، وقال الشافعي: الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة ... عن ابن معين قال: لا بأس به ... قال السبكي في طبقات الشافعية ১/১৯০: قد عرفناك أن الجارح لا يقبل فيه الجرح وإن فسّره في حق من غلبت طاعاته على معصيته، ومادحوه على ذاميّه ومزكوّه على جارحيه، إذا كانت هناك قرينة تشهد بأن مثلها حامل على الوقيعة فيه من تعصب مذهبي أو منافسة دنيوية وحينئذ فلا يلتفت لكلام الثوري في أبي حنيفة، وابن أبي ذئب وغيره في مالك، وابن معين في الشافعي، والنسائي في أحمد بن صالح ونحوه ... إذ ما من إمام إلا وقد طعن فيه طاعنون، وهلك فيه هالكون... وترجمه الحافظ ابن حجر في التهذيب ترجمة مطولة ولم يذكر رواية واحدة تطعن في روايته وعدالته ، بل أثبت عدالته وثقته ... وهذا هو الحق والمذهب الحنفي مملوء بآلاف الأحاديث المستدل بها على الأبواب وهذا يرد على كل من يطعن في مذهب الإمام أبي حنيفة رحمه الله وكل جرح لا يستند إلى أسس موضوعية سليمة مرفوض مهما كان قائله إذ لايعصم عن الخطأ إلا الأنبياء.

‘‘ইবন আদীর পক্ষপাতদূষ্ট মন্তব্যের আরেকটি উদাহরণ ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহুর বিষয়ে তাঁর মন্তব্য। তিনি বলেন: ‘‘আবূ হানীফা কিছু গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ হাদীসই ভুল... গ্রহণযোগ্য নয়।’’ আমি বলব যে, এ কথাটি সঠিক নয়। ইমাম যাহাবী তাযকিরাতুল হুফায গ্রন্থের ১/১৬৮ পৃষ্ঠায় বলেন: আবূ হানীফা ইমাম আযম, ইরাকের ফকীহ... তিনি ছিলেন ইমাম, অত্যন্ত পরহেযগার, আলিম, আমলকারী, আবিদ, বড় মর্যাদার অধিকারী। তিনি শাসকদের কোনো হাদীয়া গ্রহণ করতেন না। ইবনুল মুবারাক বলেন: আবূ হানীফা মানুষদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ। শাফিয়ী বলেন: ফিকহের বিষয়ে মানুষ আবূ হানীফার উপর নির্ভরশীল। ... ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন: তাঁর বিষয়ে আপত্তি নেই। সুবকী ‘তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ গ্রন্থে ১/১৯০ পৃষ্ঠায় বলেন: আমরা আপনাকে বলেছি যে, জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞ সমালোচক যদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও কারণ উল্লেখ করেও কারো ত্রুটি বর্ণনা করেন তাহলেও তার ত্রুটি বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি উক্ত মুহাদ্দিস তাকওয়া ও সততায় প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং তার নিন্দাকারীর চেয়ে প্রশংসাকারী এবং অবমূল্যায়নকারীর চেয়ে মূল্যায়নকারীর সংখ্যা বেশি হয়, যদি অবস্থার আলোকে বুঝা যায় যে, সমালোচক ত্রুটি বর্ণনার ক্ষেত্রে মাযহাবী কোন্দল, বা জাগতিক কোনো প্রতিযোগিতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আর এজন্যই আবূ হানীফার বিষয়ে সুফইয়ান সাওরীর বক্তব্য, মালিকের বিষয়ে ইবন আবী যিব ও অন্যান্যদের বক্তব্য, শাফিয়ীর বিষয়ে ইবন মায়ীনের বক্তব্য, নাসায়ীর বিষয়ে আহমদ ইবন সালিহের বক্তব্য এবং অনুরূপ সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। ... কারণ এমন কোনো ইমাম বা প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব নেই যার বিষয়ে অন্য কিছু লোক খারাপ মন্তব্য করেন নি বা ধ্বংসাত্মক কথা বলেন নি।’ ... ইবন হাজার তাহযীবুত তাহযীব গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি সেখানে তাঁর ত্রুটি বর্ণনামূলক একটি বর্ণনাও সংকলন করেন নি; বরং তাঁর বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। ... আর এটিই হলো হক্ক বা সত্য। হানাফী মাযহাব হাজার হাজার হাদীস দ্বারা পূর্ণ যেগুলি দ্বারা তাঁরা তাঁদের ফিকহী অধ্যায়গুলিতে প্রমাণ পেশ করেছেন। যারা ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর মাযহাবের নিন্দা-মন্দ বলেন তাদের সকলের বক্তব্যই এ বিষয়টি খন্ডন ও বাতিল করে দেয়। আর যে সমালোচনা বস্ত্তনিষ্ঠ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ প্রমাণের উপর নির্ভরশীল নয় সে সমালোচনা প্রত্যাখ্যাত, এরূপ সমালোচক যত বড় মর্যাদার অধিকারীই হোন না কেন। কারণ নবীগণ ছাড়া কেউই ভুল থেকে মাসূম বা সংরক্ষিত নন।’’

আমি ইবন আদীর এ গ্রন্থটির উপরে একটি আরবী প্রবন্ধ লিখেছিলাম, যা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা জার্নালের ২০০১ সালের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমি দেখেছি যে, ইবন আদী সাধারণভাবে নিরপেক্ষ হলেও মাযহাবী কোন্দলে খুবই প্রভাবিত ছিলেন। ইমাম শাফিয়ীর ঘনিষ্ঠতম উস্তাদ ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবী ইয়াহইয়ার (১৮৪ হি) আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখি যে, তিনি একজন মুতাযিলী, শীয়া, রাফিযী, কাদারী ও জাহমী ছিলেন। সকল মুহাদ্দিস তাকে দুর্বল বলেছেন এবং মালিক ইবন আনাস, ইয়াহইয়া আল-কাত্তান, ইবন মায়ীন, আলী ইবনুল মাদীনী ও অন্যান্য অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। কিন্তু ইমাম ইবন আদী বিভিন্ন অজুহাতে তাকে গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।

পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা, তাঁর বংশধর ও অনুসারীদের বিষয়ে তার আক্রোশ খুবই স্পষ্ট। এখানে শুধু ইমাম আবূ হানীফার প্রসঙ্গটি সামান্য পর্যালোচনা করব।

আমরা বলেছি যে, মুহাদ্দিসের মূল্যায়নে মুহাদ্দিসগণ আদালতের সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাইয়ের পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এখানে মূল বিষয় মুহাদ্দিস বর্ণিত হাদীসগুলোর তুলনামূলক নিরীক্ষা। একজন মুহাদ্দিস বর্ণিত হাদীসগুলো অন্যান্য মুহাদ্দিসের বর্ণনার সাথে তুলনা করার মাধ্যমে মুহাদ্দিসের নির্ভুল হাদীস বর্ণনা শক্তি নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য মুহাদ্দিসের মত ও উক্ত মুহাদ্দিসের ছাত্রগণের মান লক্ষ্য রাখা হয়। প্রত্যেক মুহাদ্দিসই কিছু ভুল করেন। যদি তুলনায় দেখা যায় যে, একজন মুহাদ্দিস অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসদের বর্ণনার ব্যক্তিক্রম করেন তবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি হাদীস বর্ণনায় দুর্বল। এরূপ দুর্বলতার পরিমাণ, অনুপাত ও গভীরতার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসের গ্রহণযোগ্যতা ও দুর্বলতা নির্ধারিত হয়।

এ মূলনীতির ভিত্তিতেই ইবন আদী তাঁর ‘‘আল-কামিল’’ গ্রন্থে রাবীগণের দুর্বলতা প্রমাণের জন্য প্রত্যেক দুর্বল রাবীর বর্ণিত কিছু দুর্বল হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতা প্রমাণ করতে তিনি তাঁর বর্ণিত ছয়টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। ইবন আদীর দাবি অনুযায়ী ইমাম আবূ হানীফা বর্ণিত ৩০০ হাদীসের মধ্যে ২৮০টি ভুল। বাহ্যত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও নিশ্চিত ভুল এ ছয়টি হাদীসে বিদ্যমান; এজন্যই তাঁর দুর্বলতা প্রমাণে তিনি এগুলো উল্লেখ করেছেন। আমরা এ ছয়টি হাদীস আলোচনা করব।

(ক) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত প্রথম হাদীস

عن أبى حنيفة عن موسى بن أبى عائشة عن عبد الله بن شداد بن الهاد عن جابر بن عبد الله عن رسول الله ﷺ أنه قال من صلى خلف امام كان قرآنه له قراءة

‘‘আবূ হানীফা থেকে, তিনি মূসা ইবন আবী আয়িশা থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ ইবনুল হাদ থেকে, তিনি জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে, তিনি বলেন: যদি কেউ ইমামের পিছনে সালাত আদায় করে তাহলে ইমামের কুরআন তিলাওয়াতই তার কিরাআত।

ইবন আদী বলেন, এ হাদীসটি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ এ সনদে তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ থেকে ‘‘মুরসাল’’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ তাবিয়ী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন। মাঝে সাহাবী জাবিরের (রা) নাম বলেন নি। শুধু ইমাম আবূ হানীফা সাহাবীর নাম বলেছেন। সকল নির্ভরযোগ্য রাবীর বিপরীতে এভাবে সনদের মধ্যে সাহাবীর নাম বৃদ্ধি করা প্রমাণ করে যে, তিনি হাদীস সঠিকভাবে মুখস্থ রাখতে পারতেন না। উপরন্তু ইবন আদী পরোক্ষভাবে জালিয়াতির অভিযোগ করে বলেন:

زاد أبو حنيفة في إسناده جابر بن عبد الله ليحتج به في إسقاط الحمد عن المأمومين... ووافقه الحسن بن عمارة وهو أضعف منه

আবূ হানীফা সনদের মধ্যে জাবির ইবন আব্দুল্লাহকে সংযোজন করলেন; যেন এদ্বারা তিনি মুক্তাদিদের জন্য ফাতিহা পাঠ বাদ দিতে পারেন। .... (সমসাময়িক আরেক প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ, বাগদাদের কাযী ও হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দুর্বল) হাসান ইবন উমারাহ (১৫৩ হি) তাঁরই মত জাবিরের (রা) নাম উল্লেখ করেছেন, তিনি তো আরো বেশি দুর্বল।’’

এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:

(১) মুক্তাদীর জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ বাদ দিতে কি ইমাম আবূ হানীফার হাদীসের সনদে বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজন ছিল? হাদীস ও ফিকহে যার ন্যূনতম জ্ঞান আছে তিনি জানেন যে, মুরসাল হাদীস, বিশেষত আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ (মৃত্যু ৮০ হি)-এর মত প্রথম যুগের প্রসিদ্ধ তাবিয়ীর মুরসাল হাদীস সকল ফকীহের নিকট দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। ইমাম আবূ হানীফার যুগে বিষয়টি প্রসিদ্ধ ও ঐকমত্যের বিষয় ছিল।

(২) ইমাম আবূ হানীফা এবং অন্যান্য ইমাম কখনোই সকল মাসআলা হাদীস থেকে গ্রহণ করেন নি। হাদীসের পাশাপাশি সাহাবী ও তাবিয়ীগণের কর্ম ও ফাতওয়ার উপর তাঁরা নির্ভর করেছেন। মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ না করার বিষয়েও ইমাম আবূ হানীফা পূর্ববর্তী কয়েকজন সাহাবী-তাবিয়ীর মতের উপর নির্ভর করেছেন। কাজেই এজন্য মুরসাল হাদীসকে মুত্তাসিল বানানোর কোনো প্রয়োজন তাঁর ছিল না।

(৩) ইমাম আবূ হানীফার কয়েকজন ছাত্র হাদীসটির সনদে জাবিরের (রা) নাম বলেছেন, পক্ষান্তরে ইবনুল মুবারাক হাদীসটি তাঁর সূত্রেই মুরসাল হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। এতে বুঝা যায় তিনিও হাদীসটি মুরসাল বর্ণনা করতেন। মুত্তাসিল বর্ণনার দোষটি তাঁকে না দিয়ে তাঁর ছাত্রদের দেওয়া যেত। কিন্তু ইবন আদী তাঁকে দোষারোপ করতে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন।

(৪) সর্বোপরি হাদীসটি আরো কয়েকজন মুহাদ্দিস সাহাবীর নাম-সহ বর্ণনা করেছেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্যদের উস্তাদ, ৩য় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম আহমদ ইবন মানী (২৪৪ হি) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে বলেন:

أَنْبَأَنَا إِسْحَاقُ الأَزْرَقُ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ وَشَرِيْكٌ عَنْ مُوسَى بْنِ أَبِي عَائِشَةَ عَنْ عَبْدِ الله بْنِ شَدَّادٍ عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ الله ﷺ: مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ.

‘‘আমাদেরকে ইসহাক আল-আযরাক বলেন, আমাদেরকে সুফইয়ান ও শারীক বলেন, তাঁরা মূসা ইবন আবী আয়িশা থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ থেকে, তিনি জাবির থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: যদি কারো ইমাম থাকে তবে ইমামের কিরাআতই তার কিরাআত।’’

ইসহাক ইবন ইউসূফ আল-আযরাক (১৯৫ হি) বুখারী-মুসলিম স্বীকৃত প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, তিনি হাদীসটি সুফইয়ান ও শারীকের সূত্রে ইমাম জাবিরের (রা) নাম-সহ বর্ণনা করেছেন। তাহলে আবূ হানীফা ছাড়াও সুফইয়ান সাওরী ও শারীক এ বর্ণনায় হাদীসটি মুত্তাসিল বর্ণনা করেছেন। এজন্য ইমাম বূসীরী বলেন, হাদীসটির সনদ বুখারী-মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ। এছাড়া মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি হাসান ইবন সালিহ থেকে লাইস ইবন আবী সুলাইম ও জাবির আল-জুফী থেকে আবুয যুবাইর থেকে জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন। জাবির আল-জুফী খুবই দুর্বল রাবী, তবে লাইস ইবন আবী সুলাইম কিছুটা দুর্বল হলেও তাঁর হাদীস ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন। ইবন আবী শাইবা হাদীসটি সহীহ সনদে জাবির আল-জুফীর মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি হাসান ইবন সালিহ থেকে আবুয যুবাইর থেকে জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন।[9]

(খ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত দ্বিতীয় হাদীস

عن أبي حنيفة عن أبي سفيان عن أبي نضرة عن أبي سعيد عن النبي ﷺ قال: "مفتاح الصلاة الطهور، وتحريمها التكبير، وتحليلها التسليم، وفي كل ركعتين تسليم..، ولا تجزئ صلاة إلا بفاتحة الكتاب ومعها شيء"،

আবূ হানীফা থেকে, তিনি আবূ সুফইয়ান থেকে তিনি আবূ নাদরাহ থেকে তিনি আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘পবিত্রতা সালাতের চাবি, তাকবীর তার তাহরীম-শুরু, সালাম তার তাহলীল-শেষ, প্রতি দু রাকাতে সালাম, সূরা ফাতিহা ও তার সাথে কিছু (কুরআন তিলাওয়াত) ছাড়া সালাত বৈধ হবে না।’’

ইবন আদী বলেন:

زاد أبو حنيفة في هذا المتن: "وفي كل ركعتين تسليم....

‘প্রতি দু রাকাতে সালাম’ এ কথাটি আবূ হানীফা বাড়িয়েছেন। অর্থাৎ যে সকল নির্ভরযোগ্য রাবী হাদীসটি এ সনদে বর্ণনা করেছেন তাঁদের বর্ণনায় এ বাক্যটি নেই; শুধু আবূ হানীফা এ কথাটি বাড়িয়েছেন; এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি হাদীসের সনদ বা মতন ঠিকমত মুখস্থ রাখতে পারতেন না, অনেক কিছু বেশি কম করে ফেলতেন।

এখানেও ইবন আদী ভুল তথ্য দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা ছাড়াও অন্যান্য রাবী হাদীসটির মধ্যে এ বাক্যটি উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবূ ইয়ালা মাউসিলী আলী ইবন মুসহির থেকে আবূ সুফইয়ান থেকে এ সনদে এ বাক্যসহ হাদীসটি সংকলন করেছেন। আলী ইবন মুসহির বুখারী-মুসলিম স্বীকৃত প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য রাবী। এতে প্রমাণ হয় ইমাম আবূ হানীফা হাদীসটি খুব ভালভাবেই মুখস্থ রেখেছিলেন।

ইমাম বাইহাকী বলেন:

قَالَ أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ فَقُلْتُ لأَبِى حَنِيفَةَ : مَا يَعْنِى فِى كُلِّ رَكْعَتَيْنِ تَسْلِيمٌ؟ قَالَ : يَعْنِى التَّشَهُّدَ. وَكَذَلِكَ رَوَاهُ عَلِىُّ بْنُ مُسْهِرٍ وَغَيْرُهُ عَنْ أَبِى سُفْيَانَ.

‘‘(ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীসটির বর্ণনাকারী) আবূ আব্দুর রাহমান বলেন: আমি আবূ হানীফাকে প্রশ্ন করলাম: ‘প্রত্যেক দু রাকাতে সালাম’- এ কথার অর্থ কী? তিনি বললেন: তাশাহ্হূদ পাঠ। বাইহাকী বলেন: আলী ইবন মুসহির ও অন্যান্য রাবীও হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন।

(গ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত তৃতীয় হাদীস

عن أبي حنيفة: ثنا أبو حجية، عن ابن بريدة عن أبي الأسود الدئلي عن أبي ذر عن النبي ﷺ: "إن أحسن ما غيرتم به الشعر الحناء والكتم

আবূ হানীফা থেকে, তিনি বলেন: আমাদেরকে আবূ হুজাইয়াহ বলেন, তিনি ইবন বুরাইদা থেকে, তিনি আবুল আসওয়াদ দুয়িলী থেকে, তিনি আবূ যার গিফারী (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে, তিনি বলেন: তোমাদের চূল (চুলের শুভ্রতা) পরিবর্তনের জন্য যা ব্যবহার কর তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো মেন্দি এবং কাতম।’’

ইবন আদী বলেন: ‘‘এ হাদীসটি আবূ হানীফা থেকে কেউ কেউ এভাবে বর্ণনা করেছেন। মুআফী তাঁর থেকে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন: আবূ হানীফা একব্যক্তি থেকে... তিনি আবূ বুরাইদা থেকে তিনি আবুল আসওয়াদ থেকে...। হাসান ইবন যিয়াদ, মাক্কী ও ইবন বাযী হাদীসটি নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন: আবূ হানীফা আবূ হুজ্জিয়া থেকে, তিনি আবুল আসওয়াদ থেকে ..., এ সনদে ইবন বুরাইদার কথা উল্লেখ করেন নি। এভাবে এ সনদটি আবূ হানীফা থেকে বিভিন্নরূপে বর্ণিত।’’

এখানে ইবন আদী প্রমাণ করছেন যে, এ হাদীসটির সনদ ইমাম আবূ হানীফা ঠিকমত মুখস্থ রাখতে পারেন নি। যে কারণে একেক ছাত্রকে একেকভাবে বলেছেন।

কোনো হাদীস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা রাবীর দুর্বলতা প্রকাশ করে। তবে এরূপ ভিন্নতার জন্য শিক্ষক বা ছাত্র দায়ী হতে পারে। এছাড়া প্রত্যেক নির্ভরযোগ্য রাবীই এরূপ ব্যতিক্রমের মধ্যে নিপতিত হন। বুখারী সংকলিত একটি হাদীস নিম্নরূপ:

اقْرَءُوا الْقُرْآنَ مَا ائْتَلَفَتْ عَلَيْهِ قُلُوبُكُمْ ، فَإِذَا اخْتَلَفْتُمْ فَقُومُوا عَنْهُ

‘‘তোমরা কুরআন পাঠ কর যতক্ষণ তোমাদের অন্তরগুলো মিল-মহববতে থাকবে। যখন তোমরা মতভেদ করবে তখন উঠে যাবে।’’

ইমাম বুখারী এ হাদীসের সনদ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, হাদীসটি সকলেই প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য তাবিয়ী মুহাদ্দিস আবূ ইমরান জাওনী আব্দুল মালিক ইবন হাবীব (১২৮ হি) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি কখনো সাহাবী জুনদুব ইবন আব্দুল্লাহ থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস হিসেবে, কখনো জুনদুব (রা)-এর নিজের বক্তব্য হিসেবে এবং কখনো তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনুস সামিতের সূত্রে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেব।

ইমাম বুখারী সংকলিত আরেকটি হাদীস নিম্নরূপ:

مَا بَعَثَ اللَّهُ مِنْ نَبِىٍّ وَلاَ اسْتَخْلَفَ مِنْ خَلِيفَةٍ ، إِلاَّ كَانَتْ لَهُ بِطَانَتَانِ ، بِطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالْمَعْرُوفِ وَتَحُضُّهُ عَلَيْهِ ، وَبِطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالشَّرِّ وَتَحُضُّهُ عَلَيْه

আল্লাহ কোনো নবী প্রেরণ করলে বা কাউকে শাসকের দায়িত্ব প্রদান করলে তার দু প্রকারের পরামর্শক থাকে: একদল পরামর্শক তাকে ভাল কাজের আদেশ ও উৎসাহ দেয় এবং একদল তাকে খারাপ কাজের আদেশ ও উৎসাহ দেয়।

ইমাম বুখারী উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ইমাম ইবন শিহাব যুহরী (১২৫ হি) থেকে তাঁর ছাত্ররা তিনভাবে বর্ণনা করেছেন: (১) ইউনুস ইবন শিহাব থেকে আবূ সালামাহ থেকে আবূ সায়ীদ খুদরী থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী হিসেবে, (২) শুআইব যুহরী থেকে আবূ সালামাহ থেকে আবূ সায়ীদ থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে এবং (৩) আওযায়ী ও মুআবিয়া ইবন সাল্লাম যুহরী থেকে আবূ সালামাহ থেকে আবূ হুরাইরা থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী হিসেবে।[16]

(ঘ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত চতুর্থ হাদীস

أَبُو حَنِيفَةَ عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ مَرْثَدٍ عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ (بريدة بن الحصيب) أنَّه قَالَ : قَالَ رَسُولُ الله ﷺ: الدَّالُّ عَلَى الْخَيْرِ كَفَاعِلِهِ.

‘‘আবূ হানীফা আলকামা ইবন মারসাদ থেকে, তিনি সুলাইমান ইবন বুরাইদাহ থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: কল্যাণ কর্মের নির্দেশক তা পালনকারীর মতই (সাওয়াব পাবেন)।’’

ইবন আদী বলেন:

هذا حديث لا يجود إسناده غير أبى حنيفة... وتابعه حفص بن سليمان روى عن علقمة أحاديث مناكير لا يرويها غيره ...

‘‘এ হাদীসটি এ সনদে আলকামা থেকে আবূ হানীফা ছাড়া কেউ বর্ণনা করেন নি। ... হাফস ইবন সুলাইমানও তাঁরই মত এটি আলকামা থেকে বর্ণনা করেছেন। হাফস আলকামার সূত্রে কয়েকটি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা অন্য কেউ বর্ণনা করেন না।

এ অর্থের হাদীস অন্যান্য সহীহ সনদে আনাস (রা) ও আবূ মাসঊদ (রা) থেকে বর্নিত। এ সনদে হাদীসটি অন্য কেউ বর্ণনা করেন নি। ইমাম আবূ হানীফার সূত্রে হাদীসটি ইমাম আহমদ, আবূ ইয়ালা মাউসিলী, ইমাম তাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। শাইখ শুআইব আরনাউত বলেন:

إسناده صحيح رجاله ثقات رجال الصحيح غير أبي حنيفة النعمان بن ثابت الإمام الثقة المشهور فقد روى له الترمذي والنسائي

‘‘হাদীসটির সনদ সহীহ, সনদের রাবীগণ বুখারী-মুসলিমের রাবী, শুধু ইমাম আবূ হানীফা ছাড়া। তিনি প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য-বিশ্বস্ত রাবী। তিরমিযী ও নাসায়ী তাঁর বর্ণনা সংকলন করেছেন।’’

(ঙ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত পঞ্চম হাদীস

أبو حنيفة: حدثنا عطاء بن أبي رباح عن أبي هريرة عن النبي ﷺ قال إذا ارتفع النجم ارتفعت العاهة عن أهل كل بلد

‘‘আবূ হানীফা: আমাদেরকে আতা ইবন আবী রাবাহ বলেছেন, তিনি আবূ হুরাইরা (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে, তিনি বলেন: ‘‘যখন সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জ (Pleiades) বা সপ্তর্ষিম-ল উর্দ্ধে উঠে তখন সকল জনপদের ফল-ফসলের বিপদ চলে যায়।’’

অর্থাৎ গ্রীষ্মের শুরুতে বা মে মাসের মাঝামাঝি যখন আরবে বা হেজাজে সুরাইয়া (Pleiades) নক্ষত্রমন্ডল (সপ্তর্ষিমন্ডল) প্রভাতে বা সকালে উদিত হয় তখন গাছের ফল মোটামুটি পরিপক্ক হয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের বিপদাপদ কেটে যায়। এখানে মূল শর্ত ফল-ফসলের পরিপক্কতা, নক্ষত্রের উদয় শুধু পরিপক্কতার মৌসূম শুরুর আলামত। এজন্য বিভিন্ন সহীহ হাদীসে সুরাইয়া নক্ষত্র উদয়ের পূর্বে ফল বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, পরিপক্কতার আগে ফল বিক্রয় করলে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ইবন আদী বলেন:

ولا يحفظ عن عطاء إلا من رواية أبى حنيفة عنه وروى عن عسل عن عطاء مسندا وموقوفا وعسل وأبو حنيفة سيان في الضعف على أن عسل مع ضعفه أحسن ضبطا للحديث منه

‘‘এ হাদীসটি আতা-এর সূত্রে পূর্ণ সনদে আবূ হানীফা ছাড়া আর কারো মাধ্যমে জানা যায় না। শুধু (ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক অন্য রাবী) ইসল ইবন সুফইয়ানও হাদীসটি আতা-এর সূত্রে মারফূ এবং মাউকূফ দুভাবে বর্ণনা করেছেন। আবূ হানীফা ও ইসল উভয়ে দুর্বলতায় সমান; তবে ইসল তার দুর্বলতা সত্ত্বেও হাদীস নির্ভুল বর্ণনায় আবূ হানীফার চেয়ে উত্তম।’’

এ হাদীসটিকেও ইবন আদী ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করলেন, অথচ তিনিই বলছেন যে, তাঁর চেয়ে শক্তিশালী একজন রাবী হাদীসটি একই সনদে বর্ণনা করেছেন। তাঁর কথা থেকে সুস্পষ্ট যে, এ হাদীসটিকে ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যায় না। কারণ একাধিক মুহাদ্দিস যখন একই সনদ বা মতন বলেন এবং একজন থেকে অন্যজন গ্রহণ করেছেন বলে প্রমাণ না পাওয়া যায় তখন প্রমাণ হয় যে, এ সনদ বা মতনের একটি ভিত্তি আছে।

উল্লেখ্য যে, ইসলের সনদে হাদীসটি মুসনাদে আহমাদের সংকলিত। ইসলকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস দুর্বল ও ইবন হিব্বান নির্ভরযোগ্য বলেছেন। সমকালীন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শাইখ শুআইব আননাঊত হাদীসটিকে ‘‘হাসান’’ বলেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফার হাদীসটিকে তিনি সহীহ বলেছেন। তিনি বলেন:

روى محمد بن الحسن في الآثار عن أبي حنيفة...يرفعه "إذا طلع النجم ذا صباح... " وإسناده صحيح.

মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান কিতাবুল আসারে আবূ হানীফা থেকে ... রাসূলুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন: যখন সুরাইয়া নক্ষত্র প্রভাতে বা সকালে উদিত হয় ... ফল-ফসলের বিপদ চলে যায়।’’ এ হাদীসটির সনদ সহীহ।

(চ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত ষষ্ঠ হাদীস

ইবন আদী বলেন,

ثنا عبدان ثنا زيد بن الحريش ثنا أبو همام الأهوازي عن مروان بن سالم عن أبي حنيفة عن حماد عن إبراهيم عن علقمة عن عبد الله أن النبي ﷺ أكل ذبيحة امرأة" ... لم يروه موصولاً غير أبي حنيفة، زاد فيه علقمة وعبد الله والنبي ﷺ.. يرويه منصور، ومغيرة عن إبراهيم قوله"

‘‘আমাদেরকে আবদান বলেছেন, আমাদেরকে যাইদ ইবনুল হুরাইশ বলেছেন, আমাদেরকে আবূ হাম্মাম বলেছেন, আমাদেরকে মারওয়ান ইবন সালিম বলেছেন, আবূ হানীফা থেকে, হাম্মাদ থেকে, ইবরাহীম নাখয়ী থেকে, আলকামা থেকে ইবন মাসঊদ থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একজন মহিলার জবাইকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করেন।’’... এ হাদীসটি এভাবে সনদসহ আবূ হানীফা ছাড়া কেউ বলেন নি। তিনি এর সনদে আলকামা, ইবন মাসঊদ ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নাম বৃদ্ধি করেছেন। মানসূর ও মুগীরা এটিকে ইবরাহীমের নিজের কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।’’

তাহলে এ হাদীসটি অন্যান্য রাবী ইবরাহীম নাখয়ীর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন, পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেছেন। ইবন আদীর মতে এতে প্রমাণ হয় যে, তিনি হাদীসের সনদ-মতন মুখস্থ রাখতে পারতেন না; যে কারণে এভাবে সনদের মধ্যে কমবেশি করতেন।

পাঠক লক্ষ্য করেছেন যে, উপরে আমি ইবন আদী থেকে ইমাম আবূ হানীফা পর্যন্ত সনদ উল্লেখ করেছি, যা অন্যান্য হাদীসের ক্ষেত্রে করি নি। এর কারণ ইমাম আবূ হানীফা থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ‘‘মারওয়ান ইবন সালিম’’। ইবন আদী নিজেই তাঁর এ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এ ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী। তাহলে এ হাদীসের ত্রুটির দায়ভার এ অতি দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবীর উপর না চাপিয়ে ইমাম আবূ হানীফার উপরে চাপানোর কারণ কি? অথচ ইবন আদী নিজে অন্যান্য রাবীর ক্ষেত্রে বারংবার বলেছেন, তাঁর হাদীসের মধ্যে যে ভুলভ্রান্তি পাওয়া যায় তা সম্ভবত তার থেকে যারা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাদের কারণে।

ইবন আদীর সমালোচনায় এ বিষয়টি ছাড়াও নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

(১) ইবন আদী অন্যান্য মুহাদ্দিসের ক্ষেত্রে তাঁর ছাত্রদের বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। কোনো মুহাদ্দিস থেকে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের হাদীস শিক্ষা তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বলে গণ্য করেছেন। এমনকি তার হাদীসের ভুলভ্রান্তি ও অন্যান্য মুহাদ্দিসদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি তাকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। আমরা দেখেছি যে, ইবন মায়ীন ও ইবনুল মাদীনী ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে এ বিষয়টি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী ও অন্যান্যরা উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা থেকে শতাধিক মুহাদ্দিস হাদীস শিক্ষা করেছেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন সে যুগের তাবি-তাবিয়ী পর্যায়ের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস। কিন্তু ইবন আদী তাঁর ক্ষেত্রে এ বিষয়টির মোটেও গুরুত্ব দেন নি।

(২) ইবন আদীর নিরপেক্ষতা ও সুচিন্তিত মতামতের একটি অতি পরিচিত চিত্র যে, তিনি মুহাদ্দিসগণের ভুলভ্রান্তির ওজর পেশ করেছেন। এমনকি অন্যান্য মুহাদ্দিস যাকে দুর্বল বলেছেন, তিনি তার পক্ষে ওযর পেশ করেছেন। যেমন শারীক ইবন আব্দুল্লাহ নাখয়ী (১৭৮ হি)-কে অধিকাংশ মুহাদ্দিস দুর্বল বলেছেন। ইবন আদী তাঁদের মত উদ্ধৃত করেন এবং শারীকের ভুলত্রটির অনেক নমুনাও উল্লেখ করেন। এরপর বলেন:

والذي يقع في حديثه من النكرة إنما أتي فيه من سوء حفظه، لا أنه يتعمد في الحديث شيئاً مما يستحق أن ينسب فيه إلى شيء من الضعف"

‘‘শারীকের বর্ণিত হাদীসের যে ভুলভ্রান্তি তা তাঁর দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে; এমন না যে তিনি ইচ্ছা করে হাদীসের মধ্যে পরিবর্তন করতেন; কাজেই তাঁকে কোনোরূপ দুর্বলতার সাথে সম্পৃক্ত করা যায় না।

বুখারী-মুসলিম স্বীকৃত প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আফ্ফান ইবন মুসলিম আবূ উসমান (২১৯ হি)। তিনি নির্ভরযোগ্য রাবী, তবে কিছু ভুল তাঁর হতো। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাঁকে দুর্বল বলেছেন। ইবন আদী বলেন:

وعفان أشهر وأوثق وأصدق من أن يقال فيه شيء مما فيه ينسب إلى الضعف.. ولا أعلم لعفان إلا أحاديث....... مراسيل فوصلها، وأحاديث موقوفة فرفعها وهذا مما لا يتنقصه؛ لأن الثقة وإن كان ثقة قد يهم في الشيء بعد الشيء

‘‘আফ্ফান এমন পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য ও সত্যপরায়ণ যে তাঁকে কোনোরূপ দুর্বলতায় আখ্যায়িত করা যায় না। আমার জানা মতে আফ্ফানের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু মুরাসাল হাদীস রয়েছে যেগুলি তিনি মুত্তাসিল বানিয়ে দিয়েছেন এবং কিছু মাউকূফ (সাহাবীর বক্তব্য) আছে যেগুলিকে তিনি মারফূ (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য) বানিয়েছেন। এর কারণে তাঁর মর্যাদা কমে না। কারণ নির্ভরযোগ্য রাবীও মাঝে মাঝে কিছু ভুলভ্রান্তি ও ধারণা-অনুমানের মধ্যে নিপতিত হন।...’’

আমরা ইবন আদীর সাথে একমত যে, একজন রাবীকে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ঢালাওভাবে দুর্বল বলা যায় না। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস স্বীকৃত শতশত রাবী রয়েছেন যারা নির্ভরযোগ্য রাবীদের বিপরীতে মুরসাল হাদীসকে মুত্তাসিল বর্ণনা করেছেন, সনদে বা মতনে কিছু পরিবর্তন করেছেন। এগুলোকে তাদের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করে তাদেরকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন ইবন আদীর নিরপেক্ষতা নিয়ে। তিনি বললেন যে, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা, অনিচ্ছাকৃত ভুল, মুরসালকে মুত্তাসিল বা মাউকূফকে মারফূ বানানোর কারণে মুহাদ্দিসকে দুর্বল বলা যায় না। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে তিনি এ মূলনীতি পুরোপুরিই লঙ্ঘন করে শুধু একারণেই তিনি তাঁকে দুর্বল বলেছেন।

আমরা ওজরখাহি বাদ দিয়ে ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতা যাচাই করি। উপরের ছয়টি হাদীসের মধ্যে ১ম, ২য় ও ৫ম হাদীস কোনো অবস্থাতেই তাঁর দুর্বলতার প্রমাণ নয়; বরং তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। কারণ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রাবী- ইবন আদীর ভাষায় আবূ হানীফার চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য রাবী- তাঁর মতই বর্ণনা করেছেন। ৬ষ্ঠ হাদীসটিও কোনোভাবেই তাঁর দুর্বলতার প্রমাণ নয়; কারণ এ হাদীসটি তাঁর নামে প্রচার করেছে একজন পরিত্যক্ত রাবী। তৃতীয় হাদীসটির সনদ তাঁর ছাত্ররা বিভিন্নভাবে বলেছেন। এর জন্য তিনি বা তাঁর ছাত্ররা দায়ী হতে পারেন। আমরা দেখলাম যে, বুখারী সংকলিত হাদীসেও প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো এরূপ করেছেন।

৪র্থ হাদীসটি তাঁর চেয়ে শক্তিশালী কেউ বর্ণনা করেন নি। আর কোনো মুহাদ্দিসের ক্ষেত্রে যদি প্রমাণিত হয় যে, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল বর্ণনা করেন, তাহলে যে হাদীসগুলো তিনি একক বর্ণনা করেন সেগুলোও সহীহ বলে গণ্য হয়। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল গ্রন্থে এরূপ অনেক সহীহ ‘‘গরীব’’ হাদীস বিদ্যমান। এজন্য অন্যান্য হাদীসে তাঁর দুর্বলতা প্রমাণিত না হলে এ হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমরা শাইখ আরনাউতের মন্তব্যে তা দেখেছি।

ইমাম ইবন আদীর দাবি অনুসারে ইমাম আবূ হানীফা ৩০০ হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেগুলির মধ্যে ২৮০টিতে ভুল করেছেন এবং সে ভুল প্রমাণ করতে তিনি তাঁর বর্ণিত সবচেয়ে মারাত্মক ভুলের ছয়টি প্রমাণ পেশ করেছেন। আমরা দেখলাম এগুলোর ৪টিই বাতিল প্রমাণ, বাকি দুটোও নিরেট প্রমাণ নয়। এথেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাকী ২৭৬টি ভুল হাদীসের অবস্থাও এর থেকে ভিন্ন হবে না।

এখানে উল্লেখ্য যে, ইমাম আবূ হানীফাকে যারা দুর্বল বলেছেন তাঁরা মূলত উপরের ছয়টি হাদীসের কয়েকটি বা সবকয়টি উল্লেখ করেছেন। আর এগুলোর অবস্থা আমরা দেখছি। এথেকে প্রতীয়মান হয় যে, তৃতীয় শতক ও পরবর্তী শতকগুলোতে যারা তাঁকে হাদীস বর্ণনায় দুর্বল বলেছেন তাঁরা ইনসাফ করেন নি।

১১. ৮. পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ

আমরা দেখলাম যে, ৩য় হিজরী শতক থেকে কয়েক শতাব্দী যাবৎ ফিকহ ও আকীদার মতভেদজনিত বিদ্বেষের প্রভাবে ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অনেক মুহাদ্দিস কথা বলেছেন। নিরপেক্ষ বিচারে তাদের বক্তব্য সঠিক বলার কোনো পথ আমরা দেখি না। এজন্য ৮ম হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ এরূপ বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠার চেষ্টা করেছেন। এদের অন্যতম ইমাম ইবন তাইমিয়া (৭২৮হি) ও তাঁর ছাত্রগণ: ইমাম মিয্যী (৭৪২ হি), ইমাম যাহাবী (৭৪৮হি) ও ইমাম ইবন কাসীর (৭৭৪ হি)। ইমাম যাহাবী দুর্বল রাবীদের বিষয়ে সংকলিত তাঁর গ্রন্থগুলোতে ইনসাফ বা বে-ইনসাফ করে যাদেরকেই কেউ দুর্বল বলেছেন তাদের সকলের নাম একত্রিত করেছেন। এজন্য এ সকল বইয়ে অনেক প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য রাবীর নাম রয়েছে। এগুলোতে ইমাম আবূ হানীফার প্রসঙ্গে তাঁর বিষয়ে কথিত দু-একটি উদ্ধৃyুত দেখা যায় । এছাড়া মিয্যী, যাহাবী ও ইবন হাজার রিজাল বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে ইমাম আবূ হানীফার নির্ভরযোগ্যতার পক্ষে বর্ণিত বক্তব্যগুলো উদ্ধৃত করেছেন এবং তাঁর নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। তাঁরা তাঁর দুর্বলতায় বর্ণিত বক্তব্যগুলো উদ্ধৃতই করেন নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, এগুলোকে সনদ বা মতনের দিক থেকে তাঁরা গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি অথবা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণ বিশ্বস্ততার সাক্ষ্যর বিপরীতে পরবর্তীতের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।

১১. ৯. বর্তমান যুগের মুহাদ্দিসগণ

বর্তমান যুগেও সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশে অন্যান্য মাযহাব ও মতের অনেক মুহাদ্দিস তাঁকে হাদীস বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা ইতোপূর্বে এরূপ দু-একটি বক্তব্য দেখেছি। পাশাপাশি কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফাকে দুর্বল বলে প্রমাণ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। এদের অন্যতম বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহ)। তিনি ইমাম আবূ হানীফাকে হাদীস বর্ণনায় দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। তিনি প্রমাণ হিসেবে ইতোপূর্বে উদ্ধৃত ইবনুল মুবারাক, ইমাম আহমদ, বুখারী, নাসায়ী, ইবন হিব্বান, ইবন আদী প্রমুখের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন।

শাইখ আলবানী (রাহ)-এর বক্তব্যে আমরা দুটি বিষয় লক্ষ্য করি:

(১) তিনি বলেছেন যে, ইমাম আযমের সত্যবাদিতা, ফিকহী মর্যাদা ও তাকওয়া সন্দেহাতীত ও প্রশ্নাতীত, তবে তিনি হাদীস মুখস্থ রাখায় দুর্বল ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মতের পক্ষে যাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন: ইমাম আহমদ, বুখারী, ইবন হিব্বান, ইবন আদী প্রমুখ তাঁকে শুধু হাদীসে দুর্বল বলেন নি, বরং তাঁরা তাঁকে হাদীসে, ফিকহে, আকীদায়, ঈমানে, ইসলামে, তাকওয়ায়, সত্যবাদিতায়- সর্বদিক দিয়ে দুর্বল বলেছেন এবং কেউ কেউ তাঁকে ইসলামের শত্রু বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা জানি না, তিনি তাঁদের কিছু কথা গ্রহণ এবং বাকি মত বাতিল করলেন কেন? ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে তাঁদের এ সকল বক্তব্য যদি বিদ্বেষপ্রসূত বলে তাঁর নিকট প্রমাণিত হয় তাহলে ইলম হাদীসের মূলনীতি অনুসারে তাঁর হাদীসের দুর্বলতার বিষয়েও তাঁদের মত অগ্রহণযোগ্য। আর যদি তিনি মনে করেন যে, তাঁদের মতগুলো ইনসাফভিত্তিক তাহলে তো পুরোটাই গ্রহণ করা জরুরী ছিল।

(২) ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে শু’বা, কাত্তান, ইবন মাহদী, ইবন মায়ীন ও দ্বিতীয় শতকের অন্যান্য মুহাদ্দিসের বক্তব্য পর্যালোচনা করেন নি।

শাইখ আলবানীর এ মত তাঁর অনেক পাঠক ও ভক্তকে প্রভাবিত করছে।

১২. অভিযোগের ভিত্তিতে মূল্যায়ন

১২. ১. মুহাদ্দিসের মূল্যায়ন-পদ্ধতি ও নমুনা

পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি যে, কোনো মুহাদ্দিস হাদীস বর্ণনায় ভুল করেছেন কিনা তা নির্ণয় করার জন্য তাঁর বর্ণিত হাদীস অন্যান্য মুহাদ্দিসের বর্ণিত হাদীসের সাথে তুলনা ও নিরীক্ষা করা হয়। এরূপ নিরীক্ষায় প্রত্যেক মুহাদ্দিসেরই কম বেশি কিছু ভুল ধরা পড়ে। কারণ শতশত বা হাজারহাজার হাদীস শুনেছেন, লিখেছেন, মুখস্ত করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে মুহাদ্দিস, তার বর্ণনার মধ্যে মাঝে মধ্যে কিছু ভুল হতেই পারে। এরূপ ভুলের পরিমাণ, তার বর্ণিত মোট হাদীসের মধ্যে ভুলের অনুপাত ও ভুলের গুরুত্ব অনুসারে মুহাদ্দিসের মান নির্ধারণ করেন সমালোচকগণ। আর এক্ষেত্রেই কখনো কখনো মতভেদ হয় তাদের।

মুহাদ্দিসগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) আমানত রক্ষার্থে সর্বোত্তম নিরপেক্ষতার সাথে এরূপ যাচাই বাছাই করেছেন। পাশাপাশি প্রত্যেকেই মানবীয় দুর্বলতায় মাঝে মাঝে ভুল করেছেন। সমালোচনার পদ্ধতি, বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ি, ব্যক্তিগত বা আঞ্চলিক বিদ্বেষ, আকীদা বা ফিকহ বিষয়ে মতপার্থক্য ইত্যাদি কারণে কখনো একজন মুহাদ্দিস অন্য মুহাদ্দিসের সামান্য ত্রুটিকে বড় করে ধরেছেন। কখনো বা অনেক বেশি ভুলকে তিনি ছোট করে দেখেছেন।

আগেই বলেছি মুহাদ্দিসদের সমালোচনা কোর্টের বিচারের মতই দলিলভিত্তিক। ‘অমুক মুহাদ্দিস অনেক ভুল করেন’- একথা বলার সাথে সাথে উক্ত মুহাদ্দিস বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করে সে ভুল প্রমাণ করতে হয় এবং ভুলের অনুপাতও বলতে হয়। এজন্য কোনো মুহাদ্দিস এভাবে ভুল বা একপেশে কথা বললে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ চেষ্টা করলে তা ধরতে পারেন। কারণ উক্ত মুহাদ্দিসের বর্ণিত হাদীসগুলো হাদীসগ্রন্থগুলোতে সংরক্ষিত। যে কোনো মুহাদ্দিস যে কোনো সময়ে ইচ্ছা করলে এগুলোর নিরীক্ষা করতে পারেন। তবে এরূপ নিরীক্ষা গভীর পান্ডিত্য ও ব্যাপক অধ্যয়নের মাধ্যমেই সম্ভব। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ পূর্ববর্তীগণের মত ও সামগ্রিক অধ্যয়নের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দশটি নমুনা এখানে উল্লেখ করছি।

(১) হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান (১২০ হি)

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে অভিযোগগুলো অনুধাবনের জন্য তাঁর উস্তাদ হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমানকে বুঝতে হবে। ছাত্রের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ সবই উসতাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, কিন্তু ছাত্র যত আক্রমণ ও চরিত্র হননের শিকার হয়েছেন উস্তাদ তত হন নি। কারণ সম্ভবত একটিই: ছাত্রের প্রসিদ্ধির প্রতি বিরোধীদের ঈর্ষা।

তাঁর বিষয়ে ইবন মায়ীন বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য। শুবা বলেন: তিনি সত্যপরায়ণ। অন্য বর্ণনায় শুবা বলেন: তিনি হাদীস মুখস্থ রাখতে পারেন না। ফিকহ নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন ফলে হাদীস মুখস্থ করার তাওফীক হয় নি। ইজলী বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য। নাসায়ী বলে: তিনি নির্ভরযোগ্য তবে তিনি মুরজিয়া। ইবন আদী বলেন: তিনি হাদীস বর্ণনায় মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। আবূ হাতিম রাযী বলেন: তিনি সত্যপরায়ণ, তবে তাঁর হাদীস প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি ফিকহে সুদৃঢ়, তবে হাদীস বলতে গুলিয়ে ফেলেন। আবূ বকর ইবন আইয়াশ বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য নন। ইবন সাদ বলেন: তিনি হাদীসে দুর্বল ছিলেন। তিনি মুরজিয়া ছিলেন। যখন ফিকহী মাসআলা বলতেন তখন সঠিক বলতেন আর যখন হাদীস বলতেন তখন ভুল করতেন। যুহলী বলেন: তিনি খুব বেশি ভুল করেন।

এখানে আমরা দেখছি যে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, তিনি ফিকহের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ছিলেন, কিন্তু ফিকহী বিষয়ে অত্যধিক ব্যস্ত থাকার কারণে হাদীস বর্ণনায় কিছু দুর্বলতা ছিল। কিন্তু সে দুর্বলতার মান নির্ধারণে তাঁরা মতভেদ করছেন। কেউ বলছেন তাঁর হাদীস মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ বলছেন তা গ্রহণযোগ্য। সামগ্রিক বিচারে ইমাম যাহাবী বলছেন: (ثقة إمام مجتهد): তিনি নির্ভরযোগ্য এবং মুজতাহিদ ইমাম। ইবন হাজার বলেন: (فقيه صدوق له أوهام و رمى بالإرجاء): তিনি ফকীহ সত্যপরায়ণ, তাঁর ভুলভ্রান্তি আছে, তিনি মুরজিয়া হিসেবে অভিযুক্ত।

বুখারীর আদাব গ্রন্থে, মুসলিমের সহীহ গ্রন্থে ও সুনান গ্রন্থসমূহে তাঁর হাদীস সংকলিত। অর্থাৎ মুহাদ্দিসগণ তাঁর হাদীস সহীহ ও হাসান বলে গণ্য করেছেন।[1]

(২) শারীক ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আবী নামির (১৪০ হি)

তিনি কূফার বাসিন্দা ছিলেন, পরে মদীনায় বসবাস করেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফার বিরোধী ছিলেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কেউ তাঁকে গ্রহণযোগ্য এবং কেউ তাঁকে দুবল বলেছেন। ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান তাঁকে পরিত্যাগ করেন। ইবন মায়ীন বলেন: (لا بأس به) ‘তাঁর বিষয়ে অসুবিধা নেই’। নাসায়ী বলেন: (ليس بالقوى) তিনি শক্তিশালী নন। আবূ দাউদ বলেন: (ثقة) তিনি নির্ভরযোগ্য। ইবনুল জারূদ বলেন: (ليس به بأس و ليس بالقوى) তাঁর বিষয়ে অসুবিধা নেই, তবে তিনি শক্তিশালী নন। সাজী বলেন: তিনি কাদারিয়া আকীদার অনুসারী ছিলেন। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার বলেন: (صدوق يخطىء) সত্যপরায়ণ ভুল করেন। বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর বর্ণিত হাদীস সহীহ বলে গণ্য।

(৩) শারীক ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আবী শারীক নাখয়ী (১৭৮ হি)

তিনি কূফার কাযি ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে তাঁর হাদীসে ভুলভ্রান্তি খুবই বেশি। তাঁর সমসাময়িক জারহ-তাদীলের প্রসিদ্ধতম ইমাম কাত্তান ও ইবন মাহদী তাঁকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন এবং তাঁর থেকে হাদীস গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। কাত্তান বলেন: আমি তাঁর পাণ্ডুলিপিতে গোঁজামিল ও গোলমাল দেখেছি। তিনি বলেন: শারীক কিছুই নয়, অর্থাৎ একেবারেই পরিত্যক্ত। পক্ষান্তরে ইবন মায়ীন বলেন: শারীক নির্ভরযোগ্য, তবে তিনি হাদীস ভাল পারেন না এবং ভুল করেন। ইয়াকূব ইবন শাইবা বলেন: তিনি সত্যপরায়ণ তবে মুখস্থশক্তি খুবই দুর্বল। আয্দী ও জূযজানী বলেন: শারীকের মুখস্থ শক্তি খারাপ, তাঁর হাদীস এলোমেলো এবং সে নিজে বিপথগামী। আবূ যুরআ বলেন: শারীক খুবই ভুল করেন। নাসাঈ একস্থানে বলেন: তাঁর বিষয়ে ক্ষতি নেই। অন্যত্র বলেন: তিনি শক্তিশালী নন। দারাকুতনী বলেন: তিনি শক্তিশালী নন। জাওহারী বলেন: তিনি ৪০০ হাদীসের বর্ণনায় ভুল করেছেন। আহমদ ইবন হাম্বাল বলেন: শরীক হাদীস বলার ক্ষেত্রে যা খুশি তাই বলেন, তবে তিনি বিদআতীদের বিরুদ্ধে খুব কঠোর ছিলেন। সামগ্রিক মূল্যায়নে ইবন হাজার বলেন: (صدوق يخطىء كثيرا، تغير حفظه منذ ولى القضاء بالكوفة): সত্যপরায়ণ, খুব বেশি ভুল করেন, কুফার কাযির দায়িত্ব গ্রহণের পর তার স্মৃতি পরিবর্তন হয়ে যায়।’’

এখানে আমরা দেখছি যে, অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাঁকে দুর্বল বলেছেন এবং সকলেই বলেছেন যে, হাদীস নির্ভুলভাবে বলার ক্ষেত্রে তাঁর ভুলভ্রান্তি খুবই বেশি। আর সামগ্রিক মুল্যায়নে তিনি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। ইমাম বুখারীও তালীকের জন্য তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস সহীহ বা হাসান বলে গণ্য করেছেন।

(৪) উসামা ইবন যাইদ লাইসী (১৫৩ হি)

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক মদীনার একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস উসামা ইবন যাইদ লাইসী (১৫৩ হি)। ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ কাত্তান তাঁকে দুর্বল বলেন এবং শেষ দিকে পরিত্যাগ করেন। অর্থাৎ তাঁর বিচারে তিনি (متروك); পরিত্যক্ত। আহমদ বলেন: (ليس بشئ): একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এক বর্ণনায় ইবন মায়ীন তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। দারিমী বলেন: (ليس به بأس): তাঁর বিষয়ে অসুবিধা নেই। নাসায়ী বলেন: (ليس بالقوي): শক্তিশালী নন। ইজলী বলেন: (ثقة): নির্ভরযোগ্য। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার বলেন: (صدوق يهم): সত্যপরায়ণ, ভুল করেন। বুখারী (তালীকে), মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

(৫) হাস্সান ইবন ইবরাহীম ইবন আব্দুল্লাহ কিরমানী (৮৬-১৮৬হি)

তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ হাস্সান ইবন ইবরাহীম কিরমান প্রদেশের কাযী ছিলেন। আহমদ তাঁকে সত্যপরায়ণ বলেছেন এবং তাঁর কিছু হাদীস মুনকার বলেছেন। ইবন মায়ীন তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। নাসায়ী বলেছেন: ‘‘(ليس بالقوي): তিনি শক্তিশালী নন’’। ইবন আদী বলেন: তিনি সত্যপরায়ণ, তবে তিনি ভুল করতেন, ইচ্ছা করে নয়।’’ উকাইলী, ইবন হিব্বান ও অন্যান্যরাও অনুরূপ বলেছেন। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার বলেন: ‘(صدوق يخطىء): সত্যপরায়ণ ভুল করতেন।’ বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণিত হাদীস ‘সহীহ’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

(৬) ইবরাহীম ইবন মুহাজির ইবন জাবির আল-বাজলী

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্য প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস ইবরাহীম ইবন মুহাজির ইবন জাবির। তাঁর বিষয়ে কাত্তান বলেন: (ضعيف): দুর্বল। আহমদ বলেন: (لا بأس به): অসুবিধা নেই। ইজলী বলেন: (جائز الحديث) তাঁর হাদীস গ্রহণ করা জায়েয। নাসায়ী বলেন: (ليس بالقوي في الحديث): তিনি হাদীসে শক্তিশালী নন। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার আসকালানী বলেন: (صدوق لين الحفظ): সত্যপরায়ণ, মুখস্থে দুর্বল। ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

(৭) কাসীর ইবন শিনযীর মাযিনী, আবূ কুর্রা

সমসাময়িক বসরার অন্য তাবি-তাবিয়ী কাসীর ইবন শিনযীর। কাত্তান তাঁকে অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করতেন। ইবন মাহদী তাঁর হাদীস বর্ণনা করতেন। ইবন মায়ীন বলেন (ليس بشئ): একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আহমদ ইবন হাম্বাল বলেন: চলনসই... রাবীগণ তাঁকে মেনে নিয়েছেন। আবূ যুরআ বলেন (لين): দুর্বল। নাসায়ী বলেন: (ليس بالقوي): শক্তিশালী নন। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার বলেন (صدوق يخطىء): সত্যপারয়ণ ভুল করেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর বর্ণিত হাদীস ‘সহীহ’ বলে গণ্য করেছেন তাঁরা।

(৮) ইবরাহীম ইবন ইউসূফ ইবন ইসহাক (১৯৮ হি)

ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র পর্যায়ের কুফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবরাহীম ইবন ইউসূফ ইবন ইসহাক (১৯৮ হি)। তাঁর বিষয়ে ইবন মায়ীন বলেন: (ليس بشئ) কিছুই নয়, একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। নাসায়ী বলেন: (ليس بالقوي): শক্তিশালী নয়। জূযজানী বলেন: (ضعيف الحديث): হাদীসে দুর্বল। আবূ হাতিম বলেন: (حسن الحديث) তিনি গ্রহণযোগ্য বা হাসান হাদীস বর্ণনাকারী। ইবন আদী তাঁকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। দারাকুতনী তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। আবূ দাউদ তাঁকে দুর্বল বলেছেন। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার বলেন: (صدوق يهم): সত্যপরায়ণ, ভুল করেন। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। অর্থৎ তাঁর বর্ণিত হাদীসকে তাঁরা সহীহ হিসেবে গণ্য করেছেন।

(৯) উবাই ইবন আব্বাস ইবন সাহল

মদীনার একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস উবাই ইবন আব্বাস ইবন সাহল ইবন সা’দ আনসারী। তাঁর বিষয়ে দূলাবী বলেন: (ليس بالقوى): শক্তিশালী নন। ইবন মায়ীন বলেন: (ضعيف): দুর্বল। আহমদ ইবন হাম্বাল বলেন: (منكر الحديث): আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। নাসায়ী বলেন: (ليس بالقوى) শক্তিশালী নয়। বুখারীও বলেছেন: (ليس بالقوي): শক্তিশালী নয়। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার বলেন: (فيه ضعف): তাঁর মধ্যে দুর্বলতা বিদ্যমান। ইমাম বুখারী তাঁর একটি হাদীস গ্রহণ করেছেন।

(১০) আসবাত ইবন নাসর, আবূ ইউসূফ হামদানী

ইমাম আবূ হানীফার পরের যুগের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আসবাত ইবন নাসর। তাঁর বিষয়ে ইমাম আহমদ বলেন: দুর্বল। আবূ নুআইম ফাদল ইবন দুকাইন বলেন: তাঁর হাদীসগুলি অগ্রহণযোগ্য, সনদগুলি উল্টানো। নাসায়ী বলেন: তিনি শক্তিশালী নন। ইবন মায়ীন বলেন: একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। অন্য একবার নির্ভরযোগ্য বলেন। বুখারী বলেন: সত্যপরায়ণ। সামগ্রিক বিচারে ইবন হাজার বলেন: (صدوق كثير الخطأ يغرب): সত্যপরায়ণ, খুব বেশি ভুল করেন, উদ্ভট হাদীস বলেন। ইমাম বুখারী তালীক হিসেবে তাঁর একটি হাদীস গ্রহণ করেছেন। ইমাম মুসলিম তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

১২. ২. ইমাম আবূ হানীফার মূল্যায়ন

এভাবে আমরা নিশ্চিত হই যে, মুহাদ্দিস বা রাবীর বিচার দু-একজন বা অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মন্তব্যের ভিত্তিতে হয় না; বরং সামগ্রিক বিচারের মাধ্যমে হয়। আমরা যদি ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে শুবা ইবনুল হাজ্জাজ, ইয়াহইয়া কাত্তান, ইবন মাহদী, ইবন মায়ীন, ইমাম আহমদ, ইমাম বুখারী, নাসায়ী, ইবন হিব্বান, ইবন আদী, উকাইলী সকলের মত সমানভাবে গ্রহণ করি তবে তাঁর বিষয়ে বলতে হবে (صدوق رمي بالإرجاء) সত্যপরায়ণ, মুরজিয়া বলে অভিযুক্ত, অথবা (صدوق له أوهام): সত্যপরায়ণ, তাঁর কিছু ভুল আছে। এক্ষেত্রে তাঁর বর্ণিত হাদীস সহীহ বা হাসান বলে গণ্য হবে।

তবে মুহাদ্দিসগণের নীতিমালার দাবি যে, সমসাময়িক সমালোচকগণের স্বীকৃতি প্রসিদ্ধ হওয়ার পরে কোনো মুহাদ্দিসকে কেউ অনির্ভরযোগ্য বললে তা গ্রহণযোগ্য হয় না, বিশেষত যদি প্রমাণ হয় যে, তা আকীদা বা মাযহাবী বিরোধিতার কারণে। এজন্য দ্বিতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের মতের বিপরীতে ইমাম আহমদ, বুখারী, নাসাঈ, উকাইলী, ইবন হিব্বান, ইবন আদী প্রমুখের মত গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয় শতকের জারহ-তাদীলের ইমামগণের বক্তব্যের আলোকে ইমাম আবূ হানীফাকে ‘সিকাহ’ বা নির্ভরযোগ্য বলা ছাড়া উপাই নেই। বাহ্যত এজন্যই ইবন তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়িম, মিযযী, সুবকী, ইবন হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফাকে প্রসিদ্ধ ফকীহ, ইমাম, হাদীসের ইমাম বা মুসলিমদের ইমাম বলে উল্লেখ করেছেন।[1]

কোনো অবস্থাতেই তাঁকে এবং তাঁর বর্ণিত হাদীস ‘‘দুর্বল’’ বলে গণ্য করা জারহ-তাদীলের মূলনীতি অনুসারে সঠিক নয়। শুবা, ইসরাঈল, ইবনুল মুবারাক, আবূ ইউসূফ, কাত্তান, ইবন মাহদী, ইবন মায়ীন ও দ্বিতীয় শতকের প্রসিদ্ধ ইমামগণের মূল্যায়ন বিচার না করে তৃতীয় বা পরবর্তী শতকগুলোর মুহাদ্দিসদের কয়েক ডজন বক্তব্য একত্র করে ইমাম আবূ হানীফাকে দুর্বল বলা কখনোই ইলমুল হাদীসের মূলনীতি সমর্থিত নয়। এরূপ বিচার করলে বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস কর্তৃক ‘‘নির্ভরযোগ্য’’ বলে স্বীকৃত অনেক রাবীকেই দুর্বল বলতে হবে এবং সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অনেক হাদীসকেই দুর্বল বলতে হবে।

১৪. ফিকহ বিষয়ক অভিযোগ পর্যালোচনা

ফিকহী অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে নিম্নের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:

(১) ইমাম আবূ হানীফা তাঁর সকল মতই কোনো না কোনো তাবিয়ী বা সাহাবী থেকে গ্রহণ করেছেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল বলেন:

إنما كان أبو حنيفة تابعة ما اخترع قولا ولا أنشر خلافه لان أهل الكوفة إبراهيم التيمى والشعبي والحكم وغيرهم

‘‘আবূ হানীফা তো একান্তই অনুসারী ছিলেন, তিনি কোনো মত উদ্ভাবন করেন নি এবং কোনো মতভেদও সৃষ্টি করেন নি। কারণ ইবরাহীম নাখয়ী, শা’বী, হাকাম ও কূফার অন্যান্য আলিমের তিনি অনুসারী ছিলেন।’’

যে মত ইবরাহীম নাখয়ী, আলকামা, হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান প্রমুখ তাবিয়ী আবূ হানীফার পূর্বেই গ্রহণ করেছেন, অথবা রাবীয়াহ, সুফইয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারাক প্রমুখ ফকীহ গ্রহণ করেছেন সে মতের জন্য আবূ হানীফা নিন্দিত হলেন, কিন্তু অন্যরা হলেন না!

(২) ইমাম আবূ হানীফার বিরোধীগণ তাঁর নামে এমন কিছু মত উল্লেখ করেছেন যা তিনি কখনোই বলেন নি। তাঁর মত ভুল বুঝে বা ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা করে তাঁর নামে এ সকল মত প্রচার করা হয়েছে।

(৩) ইমাম আবূ হানীফার যে সকল মত হাদীস বিরোধী বলে প্রচার করা হয়েছে এগুলির অধিকাংশের ক্ষেত্রে তাঁর মতের পক্ষে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। কিছু মতের পক্ষে হাদীস না থাকলেও কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর মত বা কর্ম বিদ্যমান। প্রসিদ্ধ চার ইমাম ও অন্য সকল ফকীহের মাযহাব বা মতের মধ্যেই আমরা এরূপ কিছু মত দেখতে পাই, যার পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস নেই বা তার বিরুদ্ধে সহীহ হাদীস রয়েছে। এ সকল ক্ষেত্রে ফকীহ মূলত সাহাবী বা তাবিয়ীগণের মতের উপর নির্ভর করেছেন।

(৪) ইমাম মালিক, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম আহমদ, ইমাম আওযায়ী ও অন্য সকল ফকীহের ক্ষেত্রে অনেক সহীহ হাদীস পাওয়া যায় যেগুলি তাঁরা গ্রহণ করেন নি। বিভিন্ন অজুহাতে, যুক্তিতে বা কারণে তাঁরা তা বর্জন করেছেন। শুধু হাদীসগুলো উল্লেখ করে উক্ত ইমাম হাদীসটির বিরোধিতা করেছেন বলে লিখলে তা অজ্ঞতা বা বিদ্বেষের প্রকাশ বলে গণ্য হবে।

(৫) প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবন আব্দুল বার্র (৪৬৩ হি) বলেন:

أفرط أصحاب الحديث في ذم أبي حنيفة وتجاوزوا الحد في ذلك والسبب والموجب لذلك عندهم إدخاله الرأي والقياس على الآثار واعتبارهما... وكان رده لما رد من أخبار الآحاد بتأويل محتمل، وكثير منه قد تقدمه إليه غيره، وتابعه عليه مثله ممن قال بالرأي وجل ما يوجد له من ذلك ما كان منه اتباعا لأهل بلده كإبراهيم النخعي وأصحاب ابن مسعود إلا أنه أغرق وأفرط في تنزيل النوازل هو وأصحابه والجواب فيها برأيهم واستحسانهم فأتى منه من ذلك خلاف كبير للسلف.. وما أعلم أحدا من أهل العلم إلا وله تأويل في آية أو مذهب في سنة رد من أجل ذلك المذهب سنة أخرى بتأويل سائغ أو ادعاء نسخ... عن الليث بن سعد أنه قال: أحصيت على مالك بن أنس سبعين مسألة كلها مخالفة لسنة النبي ﷺ مما قال مالك فيها برأيه.. ليس لأحد من علماء الأمة يثبت حديثا عن النبي ﷺ ثم يرده دون ادعاء نسخ عليه بأثر مثله أو بإجماع أو بعمل يجب على أصله الانقياد إليه أو طعن في سنده ولو فعل ذلك أحد سقطت عدالته فضلا عن أن يتخذ إماما ولزمه إثم الفسق.

মুহাদ্দিসগণ আবূ হানীফার নিন্দায় বাড়াবাড়ি করেছেন এবং এ বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করেছেন। এর কারণ মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে তিনি কিয়াস ও ইজতিহাদকে হাদীসের মধ্যে ঢুকিয়েছিলেন এবং এদুটিকে গ্রহণ করেছিলেন। ... তিনি যে সকল হাদীস প্রত্যাখ্যান করেছেন তা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই করেছেন। তাঁর এ সকল মতের (যেগুলিকে হাদীস বিরোধী বলে প্রচার করা হয়) অধিকাংশই তাঁর পূর্বে অনেক আলিম গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর পরেও যারা কিয়াস ও ফিকহ নিয়ে কথা বলেছেন তাদের অনেকেই এ সকল মত গ্রহণ করেছেন। তাঁর মাযহাবে হাদীস বিরোধী বলে কথিত যা কিছু রয়েছে তার প্রায় সবগুলিতেই তিনি ইবরাহীম নাখয়ী, আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদের ছাত্রগণ বা তাঁর দেশের (কূফার) অনুরূপ আলিমদের অনুসরণ করেছেন। তবে তিনি ও তাঁর সাথীরা এ সকল মতের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে সাম্ভাব্য ঘটনা ও শাখাপ্রশাখা বের করে সাম্ভাব্য সমস্যার সমাধান বলার গভীরে প্রবেশ করেছেন ও বেশি পরিমাণে করেছেন।... আমার জানা মতে প্রত্যেক আলিমেরই কুরআনের কোনো আয়াত বা কোনো হাদীসের ক্ষেত্রে নিজস্ব মাযহাব বা মত রয়েছে যার ভিত্তিতে তিনি অন্য একটি হাদীস গ্রহণযোগ্য একটি ব্যাখ্য করে বা নাসখ দাবী করে প্রত্যাখ্যান করেন। ... (মিসরের প্রসিদ্ধ ফকীহ) লাইস ইবন সাদ বলেন: আমি মালিক ইবন আনাসের ৭০টি মাসআলা বাছাই করেছি, যেগুলিতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসের বিরুদ্ধে নিজের মত অনুসারে ফাতওয়া দিয়েছেন। .... উম্মাতের কোনো আলিমই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে একটি হাদীস তাঁর নিকট প্রমাণিত হওয়ার পরে তা কোনো কারণ ছাড়া প্রত্যাখ্যান করেন না। তিনি অন্য একটি হাদীসের কারণে এ হাদীস রহিত হয়েছে বলে দাবি করেন, অথবা ইজমার দাবিতে হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেন, অথবা এমন একটি কর্মের কারণে হাদীসটি পরিত্যাগ করেন, যে কর্মকে গ্রহণ করা তাঁর মূলনীতি অনুসারে জরুরী, অথবা তিনি হাদীসটির সনদ ত্রুটিযুক্ত বলে দাবি করেন। যদি কেউ কোনো কারণ ছাড়া কোনো সহীহ হাদীস প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে সে পাপী বলে গণ্য হবে। তার ন্যূনতম দীনদারীই বিনষ্ট হয়ে যাবে, ইমাম হিসেবে স্বীকৃত হওয়া তো অনেক দূরের কথা।’’

প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ইবন তাইমিয়া (৭২৮ হি) বলেন:

وَمَنْ ظَنَّ بِأَبِي حَنِيفَةَ أَوْ غَيْرِهِ مِنْ أَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ أَنَّهُمْ يَتَعَمَّدُونَ مُخَالَفَةَ الْحَدِيثِ الصَّحِيحِ لِقِيَاسِ أَوْ غَيْرِهِ فَقَدْ أَخْطَأَ عَلَيْهِمْ وَتَكَلَّمَ إمَّا بِظَنِّ وَإِمَّا بِهَوَى

‘‘যদি কেউ ধারণা করে যে, আবূ হানীফা অথবা মুসলিমদের অন্য কোনো ইমাম কিয়াস বা অন্য কোনো অজুহাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সহীহ হাদীসের বিরোধিতা করেছেন তবে তার ধারণাটি অন্যায় ও ভুল বলে গণ্য। ঐ ব্যক্তি হয় আন্দাজে, অথবা প্রবৃত্তির তাড়নায় এরূপ কথা বলেছে।’’

প্রসিদ্ধ সৌদি মুহাদ্দিস শাইখ আলী ইবন নাইফ আশ-শাহ্হূদ বলেন:

ما اشتهر من أن أهل الرأي بضاعتهم في الحديث مزجاة كلام غير صحيح، ولا يدعمه الدليل ... فاتهامهم بأنهم أصحابُ رأي، وأنَّ بضاعتهم في الحديث مزجاةٌ فيه شططٌ كبيرٌ، وعصبيةٌ مقيتة. ... مثال ذلك : كان الإمام أبو بكر بن أبي شيبة من المخالفين لأهل الرأي، شديد التمسك بالأثر، ومن ثم فقد أحصى المسائل التي خالف فيها أبو حنيفة، رحمه الله السنَّة فبلغت- على حدِّ زعمه- مئة وأربعاً وعشرين مسألة لا غير... ومعنى هذا أن الإمام أبا حنيفة ... قد وافق السنَّة فيما سوى هذه المسائل القليلة وهي بعشرات الآلاف. ولو نظرنا في هذه المسائل التي ذكرها ابن أبي شيبة في ردِّه على الإمام أبي حنيفة رحمه الله لوجدنا ما يلي : أ - معظمها أمور مختلف فيها منذ عهد الصحابة لم ينفرد فيها الإمام أبو حنيفة . ب- أو أمور وجد ما هو أقوى منها فلم يعمل بها .

‘‘একটি কথা প্রসিদ্ধ যে, ‘আহলুর রায়’ (কিয়াসপন্থী বা হানাফীগণ) হাদীস কম জানেন। কথাটি সঠিক নয়। দলীল এ কথা সমর্থন করে না।... তাঁদেরকে কিয়াসপন্থী বলে অভিযোগ করা, হাদীস বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান কম বলে দাবি করা বড় অন্যায়, সীমালঙ্ঘন ও ঘৃণ্য মাযহাবী কোন্দলের প্রকাশ। একটি উদাহরণ দেখুন। ইমাম আবূ বকর ইবন আবী শাইবা আহলুর রায় বা কিয়াসপন্থীদের ঘোর বিরোধী ছিলেন, হাদীস পালন করার বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ যে বিষয়গুলিতে হাদীসের বিরোধিতা করেছেন সে বিষয়গুলি তিনি গণনাকরে একত্রিত করেছেন। ইবন আবী শাইবার মতানুসারে আবূ হানীফা শুধুমাত্র ১২৪টি মাসআলাতে হাদীসের বিরোধিতা করেছেন। ... এর অর্থ ইমাম আবূ হানীফা মাত্র সামান্য এই কটি মাসআলা ছাড়া বাকি সকল মাসআলায়, হাজার হাজার মাসআলায় হাদীস অনুসরণ করেছেন। ইবন আবী শাইবা উল্লেখকৃত এ মাসআলাগুলি, যেগুলিতে তিনি ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহর মত খন্ডন করেছেন সেগুলি যাচাই করলে আমরা দেখি (১) এগুলির অধিকাংশই সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদীয় মাসআলা, কোনোটিই ইমাম আবূ হানীফার একক মত নয়। অথবা (২) এগুলির মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলিতে ইমাম আবূ হানীফা ইবন আবী শাইবার উল্লেখ করা হাদীসের চেয়ে শক্তিশালী অন্য দলিল পেয়েছেন, যে কারণে তিনি এ হাদীস গ্রহণ করেন নি।’’

এরপর শাইখ শাহ্হূদ কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন, যেগুলিতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ইমাম ইবন আবী শাইবা যে মাসআলার জন্য ইমাম আবূ হানীফাকে অভিযুক্ত করেছেন, তিনি নিজেই মুসান্নাফ গ্রন্থের অন্যত্র এ মত অনেক সাহাবী-তাবিয়ী থেকে উদ্ধৃত করেছেন এবং এ সকল মতের পক্ষে অন্য হাদীস রয়েছে।

১৫. ফিকহ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা

আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, ইবন হিব্বান, খতীব বাগদাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীসের বিরুদ্ধে ও কিয়াসের পক্ষে এমন কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যা কোনো তাবিয়ী ফকীহ তো দূরের কথা কোনো ফাসিক মুমিনও বলতে পারেন না। সনদ বিচারে এগুলো জাল। তবে এগুলির সনদ বিচার জরুরী নয়। যদি কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিও বর্ণনা করেন যে, ইমাম আবূ হানীফা এরূপ কথা বলেছেন, তবে তা উক্ত নির্ভরযোগ্য রাবীর নির্ভরযোগ্যতা নষ্ট করবে এবং তার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলে গণ্য হবে। কারণ আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। অগণিত তাবি-তাবিয়ী আলিম তাঁর নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র তাঁর মত প্রচার করেন। তাঁর ছাত্র ও অনুসারীরা তাঁর সকল মত সংরক্ষণ ও প্রচারে আপোষহীন ছিলেন। তাঁরা তাঁর থেকে যে সকল বক্তব্য বর্ণনা করেছেন সেগুলোর বিপরীত উদ্ভট বর্ণনাগুলো ভিত্তিহীন বলে গণ্য। এখানে তাঁর ছাত্র ও অনুসারীদের সূত্রে বর্ণিত ফিকহ, হাদীস, মাযহাব, তাকলীদ ইত্যাদি বিষয়ক তাঁর কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।

১৫. ১. হাদীস ও কিয়াসের ক্ষেত্র

তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে আমরা দেখি যে, সহীহ হাদীসকেই তিনি তাঁর মাযহাবের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এমনকি তাঁর মত বা মাযহাবের বিপরীতে কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে তা অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি কিয়াস অপছন্দ করতেন। যেখানে কোনো আয়াত, হাদীস বা সাহাবীর মত নেই সেখানেই শুধু কিয়াস করতেন। ইতোপূর্বে এ বিষয়ে তাঁর কিছু বক্তব্য আমরা দেখেছি। এ প্রসঙ্গে তাঁর আরো অনেক বক্তব্য তাঁর ছাত্র ও অনুসারীরা উদ্ধৃত করেছেন। কয়েকটি বক্তব্য দেখুন:

إذا صح الحديث فهو مذهبي

১. ‘‘কোনো হাদীস সহীহ প্রমাণিত হলে সেটিই আমার মাযহাব।’’

البول في المسجد أحسن من بعض القياس

২. ‘‘অনেক কিয়াস আছে যার চেয়ে মসজিদে পেশাব করা উত্তম।’’

إياكم والقول في دين الله تعالى بالرأي عليكم باتباع السنة فمن خرج عنها ضل... لولا السنة ما فهم أحد منا القرآن ... لم تزل الناس في صلاح ما دام فيهم من يطلب الحديث فإذا طلبوا العلم بلا حديث فسدوا

৩. ‘‘খবরদার! আল্লাহর দীনের বিষয়ে যুক্তি-কিয়াস বা নিজস্ব মত দিয়ে কথা বলবে না। তোমরা অবশ্যই সুন্নাতের অনুসরণ করবে। যে ব্যক্তি সুন্নাতের বাইরে যাবে সে বিভ্রান্ত হবে। ... সুন্নাত না হলে আমাদের মধ্যে কেউই কুরআন বুঝতো না। .... যতদিন পর্যন্ত মানুষদের মধ্যে হাদীস শিক্ষাকারী বিদ্যমান থাকবে ততদিন তারা ভাল থাকবে। যখন তারা হাদীস বাদ দিয়ে ইলম চর্চা করবে তখন তারা নষ্ট হয়ে যাবে।’’

كذب والله وافترى علينا من يقول: إننا نقدم القياس على النص، وهل يحتاج بعد النص إلى قياس! أننا ننظر في دليل المسألة من الكتاب والسنة أو أقضية الصحابة ، فإن لم نجد دليلا قسنا حينئذ مسكوتا عنه على منطوق به.

৪. ‘‘যারা বলেন যে, আমরা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের উপর কিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি- আল্লাহর কসম! তারা আমাদের নামে মিথ্যা বলেন এবং অপবাদ প্রদান করেন। কুরআন হাদীসের বক্তব্য বা নস্স থাকলে কি কিয়াসের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে?! আমরা মাসআলার দলীল দেখি আল্লাহর কিতাব বা সুন্নাতের মধ্যে অথবা সাহাবীগণের ফয়সালার মধ্যে। যখন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো দলীল না পাই তখন কুরআন-সুন্নাহে বর্ণিত কোনো বিধানের উপর সংশ্লিষ্ট বিষয়কে কিয়াস করি।’’

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ মুরতাযা যাবীদী (১২০৬হি) বলেন:

نسب إلى إمامنا أنه يقدم القياس على النص... هذه النسبة إليه غير صحيحة فإن الصحيح المنقول في مذهبه تقديم النص على القياس.

‘‘আমাদের ইমামের নামে বলা হয়েছে যে, তিনি কিয়াসকে ‘নস’ (কুরআন-হাদীসের বক্তব্য বা ওহীর কথা)-এর উপরে স্থান দেন। এ কথাটি সঠিক নয়। কারণ তাঁর মাযহাবে সহীহভাবে বর্ণিত মত হলো ‘নস’-কে অর্থাৎ কুরআন বা হাদীসের বক্তব্যকে ‘কিয়াস’-এর চেয়ে অগ্রগণ্য করা।’’

মোল্লা আলী কারী বলেন:

وسموا الحنفية أصحاب الرأي على ظن أنهم ما يعملون بالحديث بل ولا يعلمون الرواية والتحديث لا في القديم ولا في الحديث مع أن مذهبهم القوي تقديم الحديث الضعيف على القياس المجرد الذي يحتمل التزييف

‘‘বিরোধীরা হানাফীদেরকে ‘রায়পন্থী’ (কিয়াসপন্থী) বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তাঁদের ধারণা যে, হানাফীগণ হাদীস পালন করেন না; বরং তারা হাদীস জানেন না; অতীতেও না বর্তমানেও না; অথচ হানাফীগণের শক্তিশালী মাযহাব হলো যয়ীফ হাদীসকে কিয়াসের বিপরীতে অগ্রগণ্য ও গ্রহণ করা কারণ কিয়াসে বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতার সম্ভাবনা বিদ্যমান।’’

আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪হি) ইমাম শারানী (৯৭৩হি)-এর সূত্রে বলেন:

قد أطال الإمام أبو جعفر الكلام في تبرئة أبي حنيفة من القياس بغير ضرورة ورد على من نسب إلى الإمام تقديم القياس على النص وقال : إنما الرواية الصحيحة عنه تقديم الحديث ثم الآثار ثم يقيس بعد ذلك ولا خصوصية للإمام في القياس بشرطه المذكور بل جميع العلماء يقيسون في مذائق الأحوال إذا لم يجدوا في المسئلة نصا انتهى وفيه أيضا : اعتقادنا واعتقاد كل منصف في أبي حنيفة أنه لو عاش حتى دونت أحاديث الشريعة وبعد رحيل الحفاظ في جمعها من البلاد والثغور وظفر بها لأخذ بها وترك كل قياس كان قاسه وكان القياس قل في مذهبه كما قل في مذهب غيره لكن لما كانت أدلة الشريعة متفرقة في عصره مع التابعين وتبع التابعين في المدائن والقرى كثر القياس في مذهبه بالنسبة إلى غيره من الأئمة ضرورة لعدم وجود النص في تلك المسائل التي قاس فيها

‘‘ইমাম আবূ হানীফা প্রয়োজন ছাড়া কিয়াস করেছেন বা কিয়াসকে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের উপরে স্থান দিয়েছেন বলে যে অভিযোগ করা হয় ইমাম আবূ জা’ফর তাহাবী বিস্তারিতভাবে তা খন্ডন করেছেন। তিনি বলেন: তাঁর থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, হাদীসকে সর্বপ্রথম এবং এরপর সাহাবী-তাবিয়ীগণের মতামত অগ্রগণ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এরপর তিনি কিয়াস করতেন। আর এরূপ কিয়াস করা ইমাম আবূ হানীফার একক বৈশিষ্ট্য নয়; বরং সকল আলিমই এরূপ অবস্থায় কিয়াস করেন; যখন তাঁরা সংশ্লিষ্ট মাসআলায় কুরআন-হাদীসের বক্তব্য পান না। ... আবূ হানীফার বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস এবং সকল নিরপেক্ষ মানুষের বিশ্বাস যে, তিনি যদি শরীয়তের হাদীসগুলো সংকলিত ও গ্রন্থায়িত হওয়া পর্যন্ত এবং মুহাদ্দিসগণ মুসলিম বিশ্বের সকল দেশ থেকে হাদীস সংগ্রহ করার পরেও বেঁচে থাকতেন এবং সেগুলো তাঁর হস্তগত হতো তবে তিনি যত কিয়াস করেছিলেন সকল কিয়াস পরিত্যাগ করতেন এবং অন্যান্য ইমামের মাযহাবের মতই তাঁর মাযহাবে কিয়াস কমে যেত। কিন্তু তাঁর যুগে শরীয়তের দলীলগুলো বিভিন্ন দেশে ও শহরে বিদ্যমান তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের নিকট বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল এজন্য তাঁর মাযহাবে অন্যান্য মাযহাবের চেয়ে কিয়াস-এর পরিমাণ বেশি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মাসাইলে কুরআন-হাদীসের বক্তব্য না পাওয়ার কারণেই তাঁকে বাধ্য হয়ে কিয়াস করতে হয়েছে।’’

আল্লামা সাখাবী (৮৩১-৯০২ হি) বলেন:

المرسل يحتج به إذا لم يوجد دلالة سواه .... جميع الحنفيه على أن مذهب إمامهم أيضا ضعيف الحديث أولى عنده من الرأي والقياس ... قول ابن منده على أنه أريد بالضعيف هذا الحديث الحسن

‘‘অন্য দলীল না থাকলে মুরসাল হাদীস প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হবে (অর্থাৎ মুরসাল হাদীস একটু দুর্বল হলেও কিয়াস বা যুক্তির চেয়ে উত্তম) ... হানাফী ফকীহগণ সকলেই বলেছেন, তাঁদের ইমামের মত হলো কিয়াসে চেয়ে দুর্বল হাদীস উত্তম। ... ইবন মান্দহ বলেছেন: এক্ষেত্রে ‘যায়ীফ’ (দুর্বল) হাদীস বলতে ‘হাসান’ (সামান্য দুর্বল গ্রহণযোগ্য) হাদীস বুঝানো হয়।’’

১৫. ২. হাদীসের সনদ যাচাই

ইবন মান্দাহ এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করেছেন। যয়ীফ হাদীসকে কিয়াসের উপর অগ্রগণ্য করা থেকে কেউ হয়ত বুঝেন যে, ইমাম আবূ হানীফা হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে ঢিলেমি করতেন। বিষয়টি ঠিক উল্টো। তিনি হাদীসের সনদ যাচাইয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। যে বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই সে বিষয়ে সামান্য দুর্বল ‘‘হাসান’’ বা ‘‘মুরসাল’’ হাদীস তিনি এবং সে যুগের সকল ফকীহই গ্রহণ করতেন। যে হাদীস ‘‘সহীহ’’ হাদীসের ৫টি শর্তই পূরণ করে, কিন্তু বর্ণনাকারীর স্মৃতি ও নির্ভুল বর্ণনা শক্তির কিছু দুর্বলতা ছিল, এরূপ হাদীসকে ‘‘হাসান’’ বলা হয়। তৃতীয় হিজরী শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘‘হাসান’’ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হতো না। সহীহ হাদীসের শর্ত পূরণ করে না এরূপ সকল হাদীসকেই ‘‘যয়ীফ’’ বলা হতো। এজন্য ‘‘হাসান’’-ও যয়ীফের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতো।

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ মুরতাযা যাবীদী বলেন:

يروى عنه أنه كان يقول: ضعيف الحديث أحب إلي من آراء الرجال، وكأن المراد منه الضعيف الذي من قبل سوء حفظ راويه...

‘‘ইমাম আবূ হানীফা থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন, ‘মানুষের ইজতিহাদী মতের চেয়ে যয়ীফ (দুর্বল) হাদীস আমার নিকট অধিক প্রিয়।’ এখানে যয়ীফ বলতে সে হাদীস বুঝানো হয়েছে যার দুর্বলতা শুধু রাবীর মুখস্থ শক্তির কারণে।’’

হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়ে তাঁর কঠোরতার কারণে তিনি হাদীস শ্রবণের সময় থেকে বর্ণনার সময় পর্যন্ত পুরোপুরি মুখস্থ রাখাকে হাদীস বর্ণনার বৈধতার শর্ত বলে গণ্য করতেন। তিনি বলেন:

لا يَنْبَغِي لِلرَّجُلِ أَنْ يُحَدِّثَ مِنْ الْحَدِيثِ إلا بِمَا يَحْفَظُهُ يَوْمَ سَمِعَهُ إلَى يَوْمِ يُحَدِّثُ بِهِ

‘‘যে হাদীস শ্রবণের দিন থেকে বর্ণনার দিন পর্যন্ত মুখস্থ আছে সে হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস বর্ণনা করা কোনো মানুষের জন্য সঠিক নয়।’’

শুধুই সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসের উপর নির্ভর করার বিষয়ে তিনি বলেন:

إذا جاء الحديث الصحيح الاسناد عن النبي ﷺ عن الثقات أخذنا به فإذا جاء عن أصحابه لم نخرج عن أقاويلهم فإذا جاء عن التابعين زاحمتهم

‘‘যখন নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো হাদীস সহীহ সনদে আমাদের কাছে আসে তখন আমরা তা গ্রহণ করি। যখন এরূপ কথা সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হয় তখন আমরা তাঁদের কথার বাইরে যাই না। আর যখন তাবিয়ীগণের কথা বর্ণিত হয় তখন আমরা তাঁদের সাথে ভীড়ের মধ্যে প্রবেশ করি।’’

তিনি দুর্বল মুহাদ্দিস বা রাবীদের শুধু বর্জনই করতেন না, উপরন্তু তাদের মিথ্যাচার বা দুর্বলতা প্রকাশ করে হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় সবাইকে সচেতন করতেন। কয়েকজন দুর্বল রাবী সম্পর্কে তিনি বলেন:

ما رأيت فيمن رأيت أفضل من عطاء وما لقيت فيمن لقيت أكذب من جابر الجعفي ما أتبته قط بشئ من رأي الا جاءني فيه بحديث وزعم ان عنده كذا وكذا ألف حديث عن رسول الله ﷺ لم يظهرها...

‘‘আমি যাদেরকে দেখেছি তাদের মধ্যে আতা ইবন আবী রাবাহের চেয়ে উত্তম কাউকে দেখি নি এবং জাবির জুফীর চেয়ে অধিক মিথ্যাবাদী আর কাউকে দেখি নি। আমি যে কোনো কিয়াসী মাসআলা তাকে বললেই সে তার পক্ষে একটি হাদীস বলে দিত। সে দাবী করত যে, তার কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এত হাজার হাদীস রয়েছে, যা সে এখনো প্রকাশ করে নি।’’

সাইমারী (৪৬৩হি) তাঁর সনদে ইবনুল মুবারাক থেকে উদ্ধৃত করেছেন:

قدم محمد بن واسع إلى خراسان ... فاجتمع عليه قوم فسألوه عن أشياء من الفقه فقال إن الفقه صناعة لشاب بالكوفة يكنى أبا حنيفة فقالوا له إنه ليس يعرف الحديث فقال ابن المبارك كيف تقولون له لا يعرف لقد سئل عن الرطب بالتمر قال لا بأس به فقالوا حديث سعد فقال ذاك حديث شاذ لا يؤخذ برواية زيد أبي عياش (مداره على زيد بن عياش وهو مجهول).. فمن تكلم بهذا لم يكن يعرف الحديث

‘‘(ইরাকের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস) মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি (১২৩ হি) খুরাসানে আগমন করেন। তখন কিছু মানুষ তাঁর নিকট সমবেত হয়ে ফিকহের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন: ফিকহের বিষয়ে পারদর্শী কূফার আবূ হানীফা নামক এক যুবক। তারা বলেন: তিনি তো হাদীস জানেন না। তখন ইবনুল মুবারাক বলেন: আপনারা কিভাবে বলছেন তিনি হাদীস জানেন না? খুরমা খেজুরের বিনিময়ে গাছ পাকা খেুজর ক্রয় করার বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: এতে অসুবিধা নেই। তখন তাঁকে বলা হয়, সা’দ (রা)-এর হাদীসে এর আপত্তি রয়েছে? তিনি বলেন: এ হাদীসটি শায (দুর্বল); যাইদ আবী আইয়াশের বর্ণনা গ্রহণ করা যায় না।’- এ হাদীসের একমাত্র রাবী যাইদ ইবন আইয়াশ, তিনি অজ্ঞাতপরিচয়।- ইবনুল মুবারাক বলেন: যে ব্যক্তি এভাবে সনদ যাচাই করতে পারে তাঁর বিষয়ে কিভাবে বলা যায় যে, তিনি হাদীস জানতেন না?’’

উল্লেখ্য যে, এ বিষয়ক হাদীসটি ইমাম মালিক, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবন মাজাহ ও তিরমিযী সংকলন করেছেন। হাদীসটির সনদের সকল রাবী নির্ভরযোগ্য, শুধু তাবিয়ী যাইদ ইবন আইয়াশ আবূ আইয়াশ কিছুটা অপরিচিত। এজন্য ইমাম আবূ হানীফা ছাড়াও প্রসিদ্ধ যাহিরী ফকীহ ইবন হাযম তাঁকে অজ্ঞাত পরিচয় বলেছেন এবং হাদীসটিকে যয়ীফ বলে গণ্য করেছেন। আর শুধু এ রাবীর কারণেই বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি গ্রহণ করেন নি। এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসের সনদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফার শর্ত অনেকক্ষেত্রে বুখারী ও মুসলিমের শর্তের মতই।

আরো লক্ষণীয় যে, ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধতম দু ছাত্র আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ এ হাদীসটিকে গ্রহণ করেছেন এবং টাটকা গাছপাকা খেজুরের বিনিময়ে খুরমা খেজুর ক্রয়বিক্রয় নিষেধ করেছেন। এ জাতীয় হাদীসের মান-নির্ধারণে হাদীসতাত্ত্বিকভাবে এরূপ মতভেদ হওয়া স্বাভাবিক।

১৫. ৩. মাযহাব ও তাকলীদ

আলিম-গবেষকদের জন্য ইজতিহাদী মাসাইলে ইমামের সব কথা নির্বিচারে গ্রহণ করা বা ‘নির্বিচার তাকলীদ’ করার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি করতেন ইমাম আবূ হানীফা। ইমাম ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (১৫৮-২৩৩ হি) তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে তাঁর উস্তাদ আবূ নুআইম ফাদল ইবন দুকাইন (১৩০-২১৮ হি)-এর নিম্নের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন:

زفر ثقة... وسمعت زفر يقول كنا نختلف إلى أبي حنيفة ومعنا أبو يوسف ومحمد بن الحسن فكنا نكتب عنه... فقال يوما أبو حنيفة لأبي يوسف ويحك يا يعقوب لا تكتب كل ما تسمع مني فإني قد أرى الرأي اليوم وأتركه غدا وأرى الرأي غدا وأتركه بعد غد

‘‘যুফার নির্ভরযোগ্য।... আমি যুফারকে বলতে শুনেছি, আমরা আবূ হানীফার নিকট যাতায়াত করতাম, আমাদের সাথে আবূ ইউসূফ এবং মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানও থাকতেন। তখন আমরা তাঁর বলা মাস্আলাগুলো লিখতাম। একদিন তিনি আবূ ইউসূফকে বললেন: ইয়াকূব, তোমার কপাল পুড়ুক! আমার থেকে যা কিছু শোনো সব লিখো না। কারণ আমি আজ একটি বিষয় সঠিক মনে করি কিন্তু আগামীকাল তা পরিত্যাগ করি। আবার আগামীকাল যে মত গ্রহণ করব পরশু তা পরিত্যাগ করব।’’

তাঁর মত গ্রহণ বা তাকলীদ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলতেন:

هذا رأي النعمان بن ثابت يعني نفسه وهو أحسن ما قدرنا عليه فمن جاء بأحسن منه فهو أولى بالصواب

‘‘এ হলো নুমান ইবন সাবিতের (অর্থাৎ তাঁর নিজের) মত। আমাদের ক্ষমতা ও সাধ্যের মধ্যে আমরা এ মতটিই সবচেয়ে ভাল বলে মনে করেছি। কেউ যদি এর চেয়ে ভাল মত দিতে পারেন তবে সেটিই অধিক গ্রহণযোগ্য ও সঠিক বলে গণ্য হবে।’’

ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রগণ বলেছেন যে, মুফতী বা আলিমের জন্য কোনো ফাতওয়া বা মাসআলার জন্য কুরআন, হাদীস বা ইজতিহাদের দলীলটি না জেনে শুধু ফাতওয়ার বই থেকে ফাতওয়া দেওয়া নিষিদ্ধ। ইমাম আবূ হানীফা বলেন:

لا ينبغي لمن لم يعرف دليلي أن يفتي بكلامي

‘‘যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে নি তার জন্য আমার বক্তব্য বা মাযহাব অনুসারে ফাতওয়া দেওয়া সঠিক নয়।’’

ইমাম যুফার বলেন, আমি ইমাম আবূ হানীফাকে বলতে শুনেছি:

لا يحل لمن يفتى من كتبي أن يفتي حتى يعلم من اين قلت

‘‘আমি কোন্ দলীলের ভিত্তিতে আমার মত গ্রহণ করেছি তা না জানা পর্যন্ত আমার বই থেকে ফাতওয়া দেওয়া কারো জন্য হালাল নয়।’’

এজন্য তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন:

إنْ تَوَجَّهَ لَكُمْ دَلِيلٌ فَقُولُوا بِهِ

‘‘যদি তোমরা কোনো দলীলকে গ্রহণযোগ্য বলে দেখতে পাও তবে সে দলীলের ভিত্তিতেই মত প্রদান করবে।’’

সাধারণ মানুষের জন্যও হাদীস শুনে তা পালনের বিষয়ে ইমাম আযম তাঁর অনেক ছাত্রের চেয়ে অধিক আগ্রহী ছিলেন। আল্লামা ইবন নুজাইম (৯৭০ হি) বলেন:

لَوْ احْتَجَمَ .. فَظَنَّ أَنَّهُ يُفَطِّرُهُ ثُمَّ أَكَلَ .. وَإِنْ لَمْ يَسْتَفْتِ وَلَكِنْ بَلَغَهُ الْخَبَرُ.. أَفْطَرَ الْحَاجِمُ وَالْمَحْجُومُ... وَلَمْ يَعْرِفْ النَّسْخَ وَلا تَأْوِيلَهُ فَلا كَفَّارَةَ عَلَيْهِ عِنْدَهُمَا؛ لأَنَّ ظَاهِرَ الْحَدِيثِ وَاجِبُ الْعَمَلِ بِهِ خِلافًا لأَبِي يُوسُفَ؛ لأَنَّهُ لَيْسَ لِلْعَامِّيِّ الْعَمَلُ بِالْحَدِيثِ لِعَدَمِ عِلْمِهِ بِالنَّاسِخِ وَالْمَنْسُوخِ... وَقَدْ عُلِمَ مِنْ هذا أَنَّ مَذْهَبَ الْعَامِّيِّ فَتْوَى مُفْتِيهِ من غَيْرِ تَقْيِيدٍ بِمَذْهَبٍ

‘‘যদি এরূপ সাধারণ মানুষ রোযা-অবস্থায় রক্তমোক্ষণ করে ... তবে সে যদি কারো কাছে ফাতওয়া জিজ্ঞাসা না করে, কিন্তু ‘‘রক্তমোক্ষণকারী ও রক্তমোক্ষণকৃতের রোযা ভেঙ্গে যাবে’’- এ হাদীসটি সে শুনে এবং এ হাদীসের ভিত্তিতে তার রোযা ভেঙ্গে গিয়েছে ভেবে সে পানাহার করে তবে ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদের মতানুসারে তাকে কোনো কাফ্ফারা দিতে হবে না। কারণ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ থেকে যা জানা যায় তদানুসারে আমল করা ওয়াজিব। ইমাম আবূ ইউসুফের মতে তাকে কাফ্ফারা দিতে হবে; কারণ একজন অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের জন্য হাদীস অনুসারে আমল করার বিধান নয়; কারণ সে একাধিক হাদীসের মধ্যে কোন্টি দ্বারা কোনটি রহিত তা জানে না।... এ থেকে জানা যায় যে, সাধারণ মানুষের মাযহাব হলো তার মুফতীর ফাতওয়া, এক্ষেত্রে কোনো একটি মাযহাব নির্ধারণ প্রয়োজনীয় নয়।’’

উলেস্নখ্য যে, এটি সুনানগ্রন্থগুলোতে সংকলিত সহীহ হাদীস। এর বিপরীতে বুখারী সংকলিত হাদীসে ইবন আব্বাস (রা) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিয়াম অবস্থার রক্তমোক্ষণ করেন।’’ অর্থাৎ সিয়াম অবস্থায় রক্তমোÿণে সিয়াম ভাঙ্গবে না।

লক্ষণীয় যে, ইমাম আবূ হানীফা এ ব্যক্তির অপরাধ গৌণ বলে গণ্য করেছেন। তবে মূলত এটি অপরাধ। হাদীসটি সহীহ কি না এবং এর বিপরীতে সহীহ হাদীস আছে কিনা তা গবেষণা না করে একটি হাদীসকে সহীহ শুনেই গ্রহণ করা মুমিনকে বিভ্রান্ত করতে পারে। ফিকহী মাসআলার ন্যায় হাদীসের মান নির্ধারণে অন্ধ তাকলীদও নিন্দনীয়।

১৫. ৪. পরবর্তী যুগের হানাফী ফকীহগণ

এভাবে আমরা দেখছি যে, ইমাম আবূ হানীফা তাঁর ছাত্র ও অনুসারীদেরকে নির্বিচার তাকলীদ থেকে মুক্ত হয়ে দলীলভিত্তিক তাকলীদ, দলীল অনুসন্ধান ও দলীল অনুসরণের জন্য তাকীদ দিয়েছেন। বাস্তবে আমরা দেখি যে, ইমামের মতের বিপরীতে ভিন্নমত পোষণ করার প্রবণতা হানাফী মাযহাবের মধ্যে যেভাবে আছে অন্য কোনো মাযহাবে সেরূপ নেই। মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বালী মাযহাবে ইমামের মতের বিপরীত কোনো মত মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত নেই। ইমামের একাধিক মতের মধ্যে একটি গ্রহণের বিষয়ে এবং যে বিষয়ে ইমামের মত নেই সে বিষয়ে এ সকল মাযহাবের আলিমগণ ইজতিহাদ করেছেন। পক্ষান্তরে হানাফী মাযহাবের প্রথম কয়েক প্রজন্মের আলিমগণ ইমামের মতের বিপরীতে মত প্রকাশ করেছেন এবং এরূপ ভিন্নমতকে মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ ইমাম নিজেই তাঁদেরকে এরূপ স্বাধীন ইজতিহাদ ও দলীল নির্ভরতা শিক্ষা দিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা দলিলভিত্তিক তাকলীদ সমর্থন করেছেন, দলীল না জেনে ইমামের মতানুসারে ফাতওয়া প্রদান অবৈধ বলেছেন এবং সহীহ হাদীসের কারণে ইমামের মত পরিত্যাগ করাও তাকলীদের অংশ বলে উল্লেখ করেছেন।

ইমাম আবূ ইউসূফ, ইমাম যুফার ও অন্যান্য ফকীহের প্রসিদ্ধ ছাত্র, হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম ইসাম ইবন ইউসূফ ইবন মাইমূন বালখী (২১৫ হি)। তিনি বলেন:

كنت فى مأتم وقد اجتمع فيه أربعة من أصحاب أبي حنيفة رضي الله عنه زفر وأبو يوسف وعافية وآخر فأجمعوا على أنه لا يحل لأحد أن يفتي بقولنا حتى يعلم من أين قلنا

‘‘আমি একটি জমায়েতে উপস্থিত ছিলাম, সেখানে ইমাম আবূ হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর চার সাথী উপস্থিত ছিলেন: যুফার, আবূ ইউসূফ, আফিয়া ও অন্য একজন, তাঁরা সকলে ঐকমত্য প্রকাশ করলেন যে, আমরা আমাদের বক্তব্য কোন্ দলিল থেকে গ্রহণ করেছি সে দলিল না জানা পর্যন্ত আমাদের বক্তব্য অনুসারে ফাতওয়া দেওয়া কারো জন্য হালাল নয়।’’

ইমামের মতের বিপরীতে দলীল পাওয়া গেলে তা অনুসরণ করার বিষয়ে ইমাম আযমের নির্দেশ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন আবিদীন বলেন:

وَكَانَ كَذَلِكَ، فَحَصَلَ الْمُخَالَفَةُ مِنْ الصَّاحِبَيْنِ فِي نَحْوِ ثُلُثِ الْمَذْهَبِ

‘‘ইমামের এ কথার ভিত্তিতে তাঁর ছাত্রগণ এভাবেই চলতেন, একারণে ইমাম আবূ ইউসূফ ও ইমাম মুহাম্মাদ মাযহাবের প্রায় তিনভাগের একভাগ মাসআলাতে ইমাম আযমের বিরোধিতা করেছেন।’’

ইমাম ইসাম ইবন ইউসুফের সূত্রে ইমাম আবূ ইউসুফ, যুফার ও অন্যদের বক্তব্য উপরে উদ্ধৃত করেছি। ইমাম ইসাম অনেক মাসআলাতে ইমাম আবূ হানীফার মতের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেন। তাঁকে এ বিষয়ে আপত্তি করা হলে তিনি বলেন:

لأن أبا حنيفة أوتي من الفهم ما لم نؤت ، فأدرك بفهمه ما لم ندركه، ولا يسعنا أن نفتي بقوله ما لم نفهم

‘‘ইমাম আবূ হানীফার সাথে আমাদের মতপার্থক্য হওয়ার কারণ আবূ হানীফা এমন জ্ঞান ও পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন যা আমরা অর্জন করতে পরি নি। তিনি তাঁর জ্ঞান ও পান্ডিত্য দিয়ে যা বুঝতেন আমরা তা বুঝতে পারি না। আর না বুঝে তাঁর মতানুসারে ফাতওয়া দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। (যে বিষয়ে ইমামের দলীল বুঝতে পারি না সে বিষয়ে তাঁর মতের বিরুদ্ধে ফাতওয়া প্রদান করি।)’’

আল্লামা ইবন নুজাইম হানাফী (৯২৬-৯৭০ হি) বলেন:

فَإِنْ قُلْتَ: كَيْفَ جَازَ لِلْمَشَايِخِ الإِفْتَاءُ بِغَيْرِ قَوْلِ الإِمَامِ الأَعْظَمِ مَعَ أَنَّهُمْ مُقَلِّدُونَ؟ قُلْتُ: قَدْ أَشْكَلَ عَلَيَّ ذَلِكَ مُدَّةً طَوِيلَةً وَلَمْ أَرَ فِيهِ جَوَابًا إلا مَا فَهِمْته الآنَ مِنْ كَلامِهِمْ، وَهُوَ أَنَّهُمْ نَقَلُوا عَنْ أَصْحَابِنَا أَنَّهُ لا يَحِلُّ لأَحَدٍ أَنْ يُفْتِيَ بِقَوْلِنَا حَتَّى يَعْلَمَ مِنْ أَيْنَ قُلْنَا حَتَّى نُقِلَ فِي السِّرَاجِيَّةِ أَنَّ هَذَا سَبَبُ مُخَالَفَةِ عِصَامٍ لِلإِمَامِ، وَكَانَ يُفْتِي بِخِلافِ قَوْلِهِ كَثِيرًا؛ لأَنَّهُ لَمْ يَعْلَمْ الدَّلِيلَ، وَكَانَ يَظْهَرُ لَهُ دَلِيلٌ غَيْرُهُ فَيُفْتِيَ بِهِ

‘‘যদি প্রশ্ন করেন, মাযহাবের পূর্ববর্তী ফকীহগণ মুকাল্লিদ ছিলেন, তাঁদের জন্য ইমাম আযমের মত বাদ দিয়ে বিপরীত ফাতওয়া দেওয়া কিভাবে বৈধ হলো? এর উত্তরে আমি বলব: অনেক দিন যাবৎ বিষয়টি আমার মনে খটকা সৃষ্টি করে রেখেছিল। আমি এর কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না। এখন আমি তাঁদের কথা থেকে যা বুঝলাম তার মধ্যে এর উত্তর রয়েছে। তাহলো, তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, আমাদের সাথীরা (অর্থাৎ ইমামগণ) বলেছেন: ‘‘আমরা আমাদের মত কোন্ দলিল থেকে গ্রহণ করেছি সে দলিল না জানা পর্যন্ত আমাদের বক্তব্য অনুসারে ফাতওয়া দেওয়া কারো জন্য হালাল নয়।’’ সিরাজিয়া গ্রন্থে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, এ কারণেই ইমাম ইসাম (ইবন ইউসুফ) ইমাম আযমের বিরোধিতা করতেন। তিনি অনেক বিষয়ে ইমাম আযমের মতের বিরুদ্ধে ফাতওয়া দিতেন। কারণ তিনি ইমাম আযমের দলীল জানতে পারেন নি এবং তাঁর কাছে অন্য দলীল জোরালো বলে প্রমাণিত হয়েছে, তখন তিনি উক্ত দলীল অনুসারে ফাতওয়া দিয়েছেন।’’

ইমাম ইসাম এবং তাঁর ভাই ইবরাহীম (২২৯ হি) হানাফী মাযহাবের তৃতীয় প্রজন্মের প্রসিদ্ধতম ইমাম ও ফকীহ। তঁদের বিষয়ে হানাফী ফকীহগণ লিখেছেন:

كان إبراهيم بن يوسف شيخاً جليلاً فقيهاً، من أصحاب أبي حنيفة... محمد بن داود الفرعي يقول: حلفت أن لا أكتب إلا عن من يقول: الإيمان قول وعمل. فأتيت إبراهيم بن يوسف، فقال: اكتب عني فإني أقول: الإيمان قول وعمل. وكان عصام بن يوسف، أخو إبراهيم هذا يرفع يديه عند الركوع، وعند الرفع، وكان إبراهيم لا يرفع. وكانا شيخين فى زمانهما غير مدافع

ইবরাহীম ইবন ইউসূফ ইমাম আবূ হানীফার অনুসারী অত্যন্ত বড় ও মর্যাদাসম্পন্ন ফকীহ ও শাইখ ছিলেন ... মুহাম্মাদ ইবন দাউদ ফারয়ী বলেন, আমি কসম করেছিলাম যে, যে ব্যক্তি ঈমান বলতে মুখের স্বীকৃতি ও কর্ম উভয়কেই বুঝায় শুধু তার থেকেই হাদীস শিক্ষা করব। আমি যখন ইবরাহীম ইবন ইউসূফের নিকট আগমন করলাম তখন তিনি বললেন, তুমি আমার থেকে হাদীস শিখতে পার; কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, ঈমান হলো মুখের স্বীকৃতি ও কর্ম। ইবরাহীম ইবন ইউসুফের ভাই ইসাম ইবন ইউসুফ। ইসাম রুকুতে গমনের সময় এবং রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় হস্তদ্বয় উঠাতেন (রাফউল ইয়াদাইন করতেন), কিন্তু তাঁর ভাই ইবরাহীম তা করতেন না। তাঁরা দুজন তাঁদের যুগের অবিসংবাদিত শাইখ (হানাফী ফকীহ) ছিলেন।’’

প্রথম চার বরকতময় যুগের পরে, বিশেষত ক্রুসেড ও তাতার যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজগুলোতে মাযহাব বিষয়ে অনেক গোঁড়ামি জন্ম নেয়। কিন্তু তারপরও অনেক হানাফী ফকীহ ইমাম আযম ও তাঁর ছাত্রদের এ মত অনুসরণ করতে থাকেন এবং সহীহ হাদীসের সাথে ফিকহের সমন্বয়কে গুরুত্ব দিতে থাকেন। ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম হানাফী ফকীহ আল্লামা ইবন আবিদীন শামী (১২৫২ হি) বলেন:।

صَحَّ عَنْ الإِمَامِ أَنَّهُ قَالَ: إذَا صَحَّ الْحَدِيثُ فَهُوَ مَذْهَبِي وَنَظِيرُ هَذَا مَا نَقَلَهُ ... عَنْ شَرْحِ الْهِدَايَةِ لابْنِ الشِّحْنَةِ، وَنَصُّهُ: إذَا صَحَّ الْحَدِيثُ وَكَانَ عَلَى خِلافِ الْمَذْهَبِ عُمِلَ بِالْحَدِيثِ، وَيَكُونُ ذَلِكَ مَذْهَبَهُ وَلا يَخْرُجُ مُقَلِّدُهُ عَنْ كَوْنِهِ حَنَفِيًّا بِالْعَمَلِ بِهِ، فَقَدْ صَحَّ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ: إذَا صَحَّ الْحَدِيثُ فَهُوَ مَذْهَبِي.

ইমাম আযম থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত, তিনি বলেছেন: যখন কোনো হাদীস সহীহ প্রমাণিত হয় তখন সেটিই আমার মাযহাব। এর নমুনা নিম্নরূপ: ... (হিজরী নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা ইমাম মুহিববুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মাহমূদ ইবন গাযী হালাবী) ইবন শিহনাহ (৮০৪-৮৯০ হি) হেদায়া গ্রন্থের ব্যাখ্যায় (নিহায়াতুন নিহায়াহ নামক গ্রন্থে) বলেন: ‘‘যদি কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয় এবং তা মাযহাবের বিপরীত হয় তবে হাদীস অনুসারে কর্ম করতে হবে এবং তা-ই ইমামের মাযহাব বলে গণ্য হবে। সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে মাযহাবের বিপরীতে কর্ম করার কারণে মুকাল্লিদের তাকলীদ নষ্ট হবে না এবং তার হানাফী হওয়াও নষ্ট হবে না। কারণ ইমাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: যখন কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হবে তখন সেটিই আমার মাযহাব বলে গণ্য হবে।’’

মুকাল্লিদের জন্য হাদীসের ভিত্তিতে ভিন্নমত অনুসরণ প্রসঙ্গে আল্লামা শামী বলেন:

وَلا بُعْدَ فِيهِ عِنْدَنَا لأَنَّ مَا صَحَّ فِيهِ الْخَبَرُ بِلا مُعَارِضٍ فَهُوَ مَذْهَبٌ لِلْمُجْتَهِدِ وَإِنْ لَمْ يُنَصَّ عَلَيْهِ، لِمَا قَدَّمْنَاهُ فِي الْخُطْبَةِ عَنْ الْحَافِظِ ابْنِ عَبْدِ الْبَرِّ وَالْعَارِفِ الشَّعْرَانِيِّ عَنْ كُلٍّ مِنْ الأَئِمَّةِ الأَرْبَعَةِ أَنَّهُ قَالَ: إذَا صَحَّ الْحَدِيثُ فَهُوَ مَذْهَبِي

‘‘এরূপ করা আমাদের নিকটও স্বীকৃত। কারণ যদি কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয় এবং তার বিপরীতে কেনো সহীহ হাদীস না থাকে তবে সে হাদীসটিই মুজতাহিদ ইমামের মাযহাব বলে গণ্য, যদিও ইমাম এ বিষয়ে কোনো কিছু না বলে থাকেন। কারণ আমরা ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছি যে, চার মাযহাবের চার ইমামই বলেছেন: ‘‘কোনো হাদীস যখন সহীহ বলে প্রমাণিত হয় তখন সেটিই আমার মাযহাব।’’ হাফিয ইবন আব্দুল বার্র এবং শাইখ সূফী শা’রানী এ বক্তব্য প্রত্যেক ইমাম থেকে উদ্ধৃত করেছেন।’’

অর্থাৎ কোনো মুকাল্লিদ যদি একটি হাদীসকে নিজের অধ্যয়নে সহীহ বলে এবং বিপরীতে সহীহ হাদীস নেই বলে নিশ্চিত হন তবে তিনি উক্ত বিশেষ মাসআলায় সহীহ হাদীস নির্ভর মতটি গ্রহণ করতে পারেন। এরূপ করা তাকলীদের পরিপন্থীন নয়।

যেখানে হাদীস নেই, বিভিন্ন মাযহাবের ইমামগণ ইজতিহাদের ভিত্তিতে মত প্রকাশ করেছেন সেখানেও সাধারণ মানুষের জন্য যে কোনো মত গ্রহণের অবকাশ রয়েছে বলে কোনো কোনো হানাফী ফকীহ উল্লেখ করেছেন। কাযা সালাত আদায় প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন নুজাইম হানাফী (৯৭০ হি) বলেন:

وَإِنْ كَانَ عَامِّيًّا لَيْسَ لَهُ مَذْهَبٌ مُعَيَّنٌ فَمَذْهَبُهُ فَتْوَى مُفْتِيهِ كَمَا صَرَّحُوا بِهِ فَإِنْ أَفْتَاهُ حَنَفِيٌّ أَعَادَ الْعَصْرَ وَالْمَغْرِبَ وَإِنْ أَفْتَاهُ شَافِعِيٌّ فَلا يُعِيدُهُمَا وَلا عِبْرَةَ بِرَأْيِهِ وَإِنْ لَمْ يَسْتَفْتِ أَحَدًا وَصَادَفَ الصِّحَّةَ عَلَى مَذْهَبٍ مُجْتَهِدٍ أَجْزَأَهُ وَلا إعَادَةَ عَلَيْهِ

‘‘সাধারণ মানুষ, যার কোনো মাযহাব নেই, যে মুফতীকে সে প্রশ্ন করেছে তার মতই তার মাযহাব। হানাফী ফকীহগণ এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। কাজেই যদি কোনো হানাফী ফকীহ তাকে ফাতওয়া দেন তবে তাকে যোহর ও আসরের সালাত পুনরায় পড়তে হবে। আর যদি কোনো শাফিয়ী ফকীহ তাকে ফাতওয়া দেন তবে তাকে তা পুনরায় আদায় করতে হবে না। এখানে তার নিজের মতের কোনো মূল্য নেই। আর যদি সে কোনো ফকীহের কাছে জিজ্ঞাসা না করে আমল করে এবং তার আমল কোনো একটি মাযহাব অনুসারে সঠিক বলে গণ্য হয় তাহলেও চলবে, তাকে কোনো সালাত পুনরায় আদায় করতে হবে না।’’

মাযহাব ও হাদীসের সমন্বয়ের বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রদের নির্দেশিত এ ধারা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন প্রসিদ্ধ ভারতীয় সংস্কারক, মুহাদ্দিস ও হানাফী ফকীহ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (১১৭৬ হি/১৭৬২খৃ)। তাঁর বক্তব্য আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে আলোচনা করব, ইনশা আল্লহ। তাঁর পুত্র শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবীর (১২৩৯হি) শিষ্য ও খলীফা (স্থলাভিষিক্ত) ভারতের সুপ্রসিদ্ধ সূফী সংস্কারক সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী (১২৪৬হি) এ প্রসঙ্গে বলেন:

‘‘আমলের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রচলিত চার মাযহাবের অনুসরণ করা খুবই ভাল। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইলমকে এক ব্যক্তির ইলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না জানা উচিত। বরং তাঁর ইলম সমস্ত জগতের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সময়ের অনুপাতে প্রত্যেকের নিকট ইলম পৌঁছেছে। যে সময় কিতাবাদি লেখা হয়েছে তখন এ ইলমের সংকলন প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং যে মাসআলার ব্যাপারে সহীহ, সুস্পষ্ট ও গাইর মানসূখ (অ-রহিত) হাদীস পাওয়া যাবে সে মাসআলায় কোনো মুজতাহিদের অনুসরণ করবে না। আহলে হাদীস (মুহাদ্দিসগণ)-কে নিজের নেতা জেনে অন্তর থেকে তাঁদের মহববত করবে। তাঁদের সম্মান করাকে নিজের জন্য জরুরী মনে করবে। কেননা এমন ব্যক্তি পয়গম্বর (ﷺ)-এর ইলম বহনকারী। এভাবে সে তাঁর সাহচর্য লাভ করে তাঁর নিকট মকবুল হয়ে গিয়েছে। আর মুকাল্লিদগণ তো মুজতাহিদের সম্মান ও মর্যাদা ভালরূপেই জানে। তাদের সাবধান করবার প্রয়োজন হয় না।’’

সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর ছাত্র বাংলার সুপ্রসিদ্ধ সংস্কারক ও হানাফী ফকহী মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (১২৮৯হি/ ১৮৭২খৃ) বলেন: ‘‘মুর্শিদে বরহক হযরত সায়্যেদ আহমদ (কু. রু)-এর জামানায় দুই প্রকারের লোক ছিল। এক প্রকার যাহারা এলমে হাদীসের শিক্ষা দেওয়া ও শিক্ষা করাকে অনর্থক মনে করিত এবং উহার কোন মূল্য বুঝিত না। আর দ্বিতীয় প্রকারের লোক ছিল যাহারা ফেকাহর উপর আমল করা এবং নির্দিষ্ট এক ব্যক্তির অনুসরণ করাকে অস্বীকার করিত এবং এই চার মাযহাবকে বেদআত বলিত। কাজেই উভয় দলকে বুঝাইবার উদ্দেশ্যে এমন জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করা হইয়াছে যাহাতে উভয় দল মন্দ না বলে এবং নিজেদের বাহুল্য কথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আহলে সুন্নাতুল জামাতের আকিদা (বিশ্বাস) অনুযায়ী নিজেদের আকিদাকে ঠিক করিয়া নেয়। এই কথার সমর্থনে আমি (সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী রচিত) ‘সেরাতুল মোস্তাকিম’ কিতাবের দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের প্রথম হেদায়েতের তৃতীয় ভুমিকার বর্ণনা লিখিয়া দিতেছি, মন দিয়া শোন। ‘শরীয়তের হুকুম আহকাম আমল করিবার মধ্যে চার মাযহাবের অনুকরণ করা সমস্ত মুসলমানদের মধ্যে প্রচলন আছে। কিন্তু ঈমানের মধ্যে তাকলীদ (অন্যের অনুসরণ) জায়েয নয় বরং সৃষ্টিকর্তাকে নিজে বুঝিয়া সুঝিয়া বিশ্বাস করা ঈমানের শর্ত। যে নিজে মোজতাহেদ নয় এমন ব্যক্তির আমলের মধ্যে কোন এক মোজতাহেদের কিম্বা নির্দিষ্ট চার মাযহাবের এক মাযহাবের অনুসারী হওয়া জায়েয আছে। তাহারা নিজ নিজ ইমামের মাযহাবের তাকলীদ করিতেছে এবং অন্য ইমামের মাযহাবের তাকলীদকে অস্বীকার করে না এবং এই চার মাযহাব ব্যতীত পঞ্চম মাযহাবকে হক বা সত্য বলিয়া জানে না এবং পঞ্চম মাযহাবের তাকলীদকে জায়েয মনে করে না। মোট কথা, যে মোজতাহেদ নয় তাহার জন্য এইরূপ তাকলীদ ভাল। তাকলীদ আসলে রসূলুল্লাহ ﷺ-এর তাবেদারী, কিন্তু যাহার এজতেহাদ (প্রচেষ্টা) করার ক্ষমতা আছে সে পয়গম্বর (ﷺ)-এর মোজতাহেদগণের মধ্যে শুধু একজনের এলেমের উপর নিজকে সীমাবদ্ধ রাখিবে না; কেননা ইহাতে অন্য মাযহাব বাতেল হওয়া বুঝা যায়, যেহেতু এলমে নববী সমস্ত আলেমদের মধ্যেই বিস্তার লাভ করিয়াছে। সময়ের চাহিদার অনুপাতে প্রত্যেকের নিকট এলেম পৌঁছিয়াছে। যে সময় হুজুর (ﷺ) ‘রফাইয়াদাইন’ করিতেন ঐ সময়ের হাদীস ইমাম শাফী (রহ)-এর নিকট পৌঁছিয়াছে। পরবর্তী সময়ে হাদীসের কিতাবাদি লেখা হইয়াছে এবং উহাতে সমস্ত এলেম একত্রীকরণ করা হইয়াছে। সুতরাং যে মাসআলার ব্যাপারে সহীহ হাদীস পাওয়া যায় এবং যাহার অর্থ পরিস্কার বুঝা যায় এবং উহা বিলুপ্তকৃত নয় এবং অন্যের নিকট শোনার প্রয়োজন হয় না, বরং সে নিজেই সহীহ, গায়ের মানসুখ (বিলুপ্তকৃত নয়) ইত্যাদি বুঝিতে পারে, তাহার জন্য সেই মাসআলার ব্যাপারে কাহারো অনুসরণ করিবার প্রয়োজন নাই। কেননা সেই মাসআলার মধ্যে সে নিজেই মোজতাহেদ। আর মোজতাহেদের জন্য অন্যের অনুকরণ করা জায়েয নয়। এই জামানায় এমন অনেক ব্যক্তি আছে যে আহলে হাদীসকে নিজের নেতা বা পরিচালক বলিয়া মানে এবং মনে প্রাণে তাহার প্রতি মহববত রাখে এবং তাহার সম্মান করাকে জরুরী মনে করে। কেননা এমন ব্যক্তি পয়গম্বর (ﷺ)-এর এলেমের আমলকারী এবং কোন প্রকারে পয়গাম্বর (ﷺ)-এর বন্ধুত্ব লাভ করিয়া জনাবে রসূলুল্লাহর (ﷺ) নৈকট্য হাছেল করিতে চায়। আর মোকাল্লেদগণ মোজতাহেদের সম্মান ও মর্যাদা ভালরূপেই জানে। তাহাদের সাবধান করিবার প্রয়োজন হয় না।’’

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪ হি) সহীহ হাদীসের কারণে ইমামের মত পরিত্যাগ করাকেই প্রকৃত তাকলীদ আখ্যায়িত করে বলেন:

طائفة قد تعصبوا في الحنفية تعصبا شديدا والتزموا بما في الفتاوى التزاما سديدا وإن وجدوا حديثا صحيحا أو أثرا صريحا على خلافه وزعموا أنه لو كان هذا الحديث صحيحا لأخذ به صاحب المذهب ولم يحكم بخلافه وهذا جهل منهم بما روته الثقات عن أبي حنيفة من تقديم الأحاديث والآثار على أقواله الشريفة فترك ما خالف الحديث الصحيح رأي سديد وهو عين تقليد الإمام لا ترك التقليد

‘‘একদল মানুষ হানাফী হওয়ার বিষয়ে প্রচন্ড গোঁড়ামি করেছেন। সহীহ কোনো হাদীস বা সাহাবী-তাবিয়ীর মত পেলেও তার বিপরীতে ফাতওয়া-মাসাইলে যা পেয়েছেন তা হুবহু অনুসরণ করেছেন। তারা ধারণা করেন যে, এ হাদীস যদি সহীহ হতো তবে মাযহাবের ইমাম তা গ্রহণ করতেন এবং এর বিপরীতে মত দিতেন না। এটি তাদের অজ্ঞতার কারণে। ইমামের কথার উপরে হাদীসকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে ইমামের নিজের বক্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই তারা এরূপ করেছেন। নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ ইমাম আবূ হানীফা থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, সহীহ হাদীস ও আসারকে তাঁর বক্তব্যের উপরে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য সহীহ হাদীসের বিপরীত সবকিছু পরিত্যাগ করা সঠিক মত। আর হাদীসের কারণে ইমামের মত পরিত্যাগ করলে তাকলীদ পরিত্যাগ করা হয় না; বরং এরূপ করাই ইমামের প্রকৃত তাকলীদ।’’

আব্দুল হা্ই লাখনবী আরো বলেন:

واعلم أنه قد كثر النقل عن الإمام أبي حنيفة وأصحابه بل وعن جميع الأئمة في الاهتداء إلى ترك آرائهم إذا وجد نص صحيح صريح مخالف لأقوالهم. وقال علي القاري... : قال إمامنا الأعظم: لا يحل لأحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعرف مأخذه من الكتاب والسنة أو إجماع الأمة أو القياس الجلي في المسئلة. وإذا عرفت هذا فاعلم أنه لو لم يكن للإمام نص على المرام لكان من المتعين على أتباعه الكرام- فضلا عن العوام- أن يعملوا بما صح عن رسول الله ﷺ. وكذا لو صح عن الإمام نفي الإشارة وصح إثباتها عن صاحب البشارة فلا شك في ترجيح المثبت المسند إلى رسول الله ﷺ ... فبناء على هذا أمكن لنا أن نورد تقسيما آخر للمسائل فنقول : الفروع المذكورة في الكتب على طبقات: الأولى: المسائل الموافقة للأصول الشرعية المنصوصة في الآيات أو السنن النبوية أو الموافقة لإجماع الأمة أو قياسات أئمة الملة من غير أن يظهر على خلافها نص شرعي جلي أو خفي.

والثانية: المسائل التي دخلت في أصول شرعية ودلت عليها بعض آيات أوأحاديث نبوية مع ورود بعض آيات دالة على عكسه وأحاديث ناصة على نقضه لكن دخولها في الأصول من طريق أصح وأقوى وما يخالفها وروده من سبيل أضعف وأخفى وحكم هذين القسمين هو القبول كما دل عليه المعقول والمنقول. والثالثة: التي دخلت في أصول شرعية مع ورود ما يخالفها بطرق صحيحة قوية والحكم فيه لمن أوتي العلم والحكمة اختيار الأرجح بعد وسعة النظر ودقة الفكرة ومن لم يتيسر له ذلك فهو مجاز في ما هنالك. والرابعة: التي لم يستخرج إلا من القياس وخالفه دليل فوقه غير قابل للاندراس وحكمه ترك الأدنى واختيار الأعلى وهو عين التقليد في صورة ترك التقليد.

والخامسة: التي لم يدل عليها دليل شرعي لا كتاب ولا حديث ولا إجماع ولا قياس مجتهد جلي أو خفي لا بالصراحة ولا بالدلالة بل هي من مخترعات المتأخرين الذين يقلدون طرق آبائهم ومشايخهم المتقدمين وحكمه الطرح والجرح فاحفظ هذا التفصيل فإنه قل من اطلع عليه وبإهماله ضل كثير عن سواء السبيل

‘‘জেনে রাখ! ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীদের থেকে, বরং সকল ইমাম থেকে বহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কোনো সুস্পষ্ট সহীহ হাদীস তাঁদের মতের বিপরীতে পাওয়া যায় তবে তাঁদের মত বাদ দিতে হবে। মোল্লা আলী কারী বলেন: ‘আমাদের ইমাম আযম বলেছেন: ‘কারো জন্য আমাদের মত গ্রহণ করা বৈধ নয়; যতক্ষণ না সে উক্ত মাসআলাতে আমাদের মতের দলীল কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা বা সুস্পষ্ট কিয়াস থেকে জানতে পারবে।’ ইমাম আযমের এ কথার ভিত্তিতে তোমাকে বুঝতে হবে যে, কোনো বিষয়ে যদি ইমামের কোনো মত বর্ণিত না থাকে তবে ইমামের অনুসারী মুকাল্লিদ আলিম ও সাধারণ মানুষ সকলের সুনিশ্চিত দায়িত্ব রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস অনুসারে কর্ম করা। আর যদি ইমাম থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি (তাশাহ্হূদের সময়) ইশারা করতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু এর বিপরীতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত হয় যে তিনি ইশারা করেছেন, তবে নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত মতটিই অগ্রাধিকার লাভ করবে।’... লাখনবী বলেন, উপরের এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে আমরা মাযহাবের মাসাআলাগুলোকে নিম্নরূপ বিন্যাস করতে পারি। মাযহাবের ফিকহী গ্রন্থগুলিতে সংকলিত মাস্আলাগুলো কয়েকটি পর্যায়ের:

মাযহাবের ফিকহী গ্রন্থগুলিতে সংকলিত মাস্আলাগুলো কয়েকটি পর্যায়ের

প্রথমত: শরীয়তের মূলভিত্তি কুরআনের আয়াত বা হাদীসে নববীর বক্তব্যের সাথে, অথবা উম্মাতের ইজমা বা ইমামগণের কিয়াসের সাথে সুসমঞ্জস মাসআলা, যার বিপরীতে সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট হাদীস বা ‘নস্’ নেই।

দ্বিতীয়ত: শরীয়তের মূলভিত্তির অন্তর্ভুক্ত মাসাইল, যেগুলোর পক্ষে কুরআনের আয়াত বা হাদীসে নববীর প্রমাণ রয়েছে, কিন্তু এগুলোর বিপরীতেও কিছু আয়াত বা হাদীস রয়েছে। তবে এ সকল মাসাইলের পক্ষের আয়াত বা হাদীসের নির্দেশনা অধিক সহীহ ও অধিক শক্তিশালী, পক্ষান্তরে এগুলোর বিপরীত আয়াত বা হাদীসের নির্দেশনা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অস্পষ্ট। উপরের দু পর্যায়ের মাযহাবী মাসাইলের বিধান হলো, এগুলোকে গ্রহণ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ ও বুদ্ধি-বিবেক সবই তা নির্দেশ করে।

তৃতীয়ত: শরীয়তের মূলভিত্তির অন্তর্ভুক্ত মাসাইল। কিন্তু এগুলির বিপরীত দলীলও সহীহ ও শক্তিশালী সনদে বর্ণিত। এরূপ মাসাইলের বিধান হলো, যার ইলম ও প্রজ্ঞা আছে তিনি বিস্তারিতভাবে এবং গভীরভাবে এগুলি অধ্যয়ন করবেন এবং অধিকতর শক্তিশালী মতটি গ্রহণ করবেন। আর যে ব্যক্তি এরূপ গবেষণায় অক্ষম তার জন্য এরূপ বিষয়ে মাযহাবের মতটি গ্রহণের অনুমোদন রয়েছে।

চতুর্থত: যে সকল মাসাইল শুধু কিয়াসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছে এবং সেগুলির বিপরীতে কিয়াসের ঊর্ধ্বের চিরন্তন কোনো দলীল (আয়াত বা হাদীস) বিদ্যমান। এ সকল মাসাইলের বিধান হলো, নিম্নমানের (কিয়াস ভিত্তিক) মত পরিত্যাগ করে উচ্চমানের (হাদীস ভিত্তিক) মত গ্রহণ করা। বিষয়টি বাহ্যত তাকলীদ পরিত্যাগ করা বলে মনে হলেও, তা তাকলীদ পরিত্যাগ নয়, বরং এটিই হলো প্রকৃত তাকলীদ।

পঞ্চমত: এমন কিছু মাসাইল মাযহাবের মধ্যে রয়েছে যেগুলোর পক্ষে কুরআন, হাদীস, ইজমা, বা কোনো মুজতাহিদের সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো কিয়াস বিদ্যমান নেই, সুস্পষ্টভাবে বা প্রাসঙ্গিভাবে কোনোভাবেই তা শরীয়তের এ সকল দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং এগুলো পরবর্তী যুগের মানুষদের আবিষ্কার মাত্র, যারা তাদের পিতা-পিতামহ ও শাইখ-মাশাইখদের অন্ধ অনুসরণ করেন। এ সকল মাসাইলের বিধান হলো এগুলি পরিত্যাগ করতে হবে এবং এগুলির ত্রুটি বর্ণনা করতে হবে।

লাখনবী বলেন, এ বিশ্লেষণটি ভালকরে আয়ত্ব করুন। কারণ খুব কম মানুষই এটি বুঝেন এবং এটি না বুঝার কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছেন।’’

উল্লেখ্য যে, অন্যান্য মাযহাবের ফকীহগণও কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রশস্ততা অবলম্বন করেছেন। তাকলীদের পাশাপাশি হাদীস অনুসরণ বা মতভেদীয় মাসআলায় ভিন্ন মাযহাব অনুসরণের বৈধতা দিয়েছেন তাঁরা। প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম নববী (৬৭৬ হি) ‘‘আল-মাজমূ’’ নামক শাফিয়ী ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থে লিখেছেন:

قَالَ الشَّيْخُ أَبُو عَمْرٍو: فَمَن وَجَدَ مِنَ الشَّافِعِيَّةِ حَدِيثًا يُخَالِفُ مَذْهَبَهُ نَظَرَ إنْ كَمُلَتْ آلاتُ الاجْتِهَادِ فِيهِ مُطْلَقًا أَوْ فِي ذَلِكَ الْبَابِ أَوْ الْمَسْأَلَةِ كَانَ لَهُ الاسْتِقْلَالُ بِالْعَمَلِ بِهِ. وَإِنْ لَمْ يَكْمُلْ وَشَقَّ عَلَيْهِ مُخَالَفَةُ الْحَدِيثِ بَعْدَ أَنْ بَحَثَ فَلَمْ يَجِدْ لِمُخَالَفَتِهِ عَنهُ جَوَابًا شَافِيًا فَلَهُ الْعَمَلُ بِهِ إنْ كَانَ عَمِلَ بِهِ إمَامٌ مُسْتَقِلٌّ غَيْرَ الشَّافِعِيِّ وَيَكُونُ هَذَا عُذْرًا لَهُ فِي تَرْكِ مَذْهَبِ إمَامِهِ هُنَا. وَهَذَا الَّذِي قَالَهُ حَسَنٌ مُتَعَيَّنٌ وَاَللَّهُ أَعْلَمُ

‘‘শাইখ আবূ আমর ইবনুস সালাহ (৬৪৩ হি) বলেন: যদি কোনো শাফিয়ী মুকাল্লিদ একটি হাদীসের সন্ধান পান যা তার মাযহাবের বিরোধী তাহলে দেখতে হবে, যদি তিনি পূর্ণভাবে অথবা শুধু একটি বিশেষ অধ্যায়ে বা শুধু একটি বিশেষ মাসআলাতে ইজতিহাদ করতে সক্ষম হন তবে তিনি এ হাদীসটি গ্রহণ ও পালন করবেন। আর যদি তার কোনোরূপ ইজতিহাদ-গবেষণা করার ক্ষমতা না থকে, কিন্তু হাদীসটির বিরোধিতা করা তার জন্য কষ্টকর হয় তবে সেক্ষেত্রেও তিনি মাযহাব বর্জন করে হাদীসটি পালন করবেন, যদি (দুটি শর্ত পূরণ হয়): (১) হাদীসটি বর্জন করার পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর তিনি খুঁজে না পান এবং (২) ইমাম শাফিয়ী হাদীসটি গ্রহণ না করলেও অন্য কোনো মুজতাহিদ ইমাম উক্ত হাদীসটি গ্রহণ করে থাকেন। এ মাসআলায় ইমামের মাযহাবের বাইরে যাওয়ার জন্য হাদীসটি তার ওজর হিসেবে গণ্য হবে।’ ইমাম নববী বলেন: এ কথাটি সুন্দর ও এটিই একমাত্র নিশ্চিত বিষয়।’’

১৫. ৫. ক্রসেড-তাতার যুদ্ধোত্তর যুগের অবস্থা

উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে আমরা কিয়াস, হাদীস, মাযহাব ইত্যাদি বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা, তাঁর ছাত্রগণ ও প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহগণের বক্তব্য জানতে পারলাম। এগুলি নিশ্চিত করে যে, তাঁদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে হিজরী পঞ্চম-সপ্তম শতকে ক্রুসেড যুদ্ধে বিধ্বস্ত এবং এরপর ৭ম হিজরী শতাব্দীতে তাতার আক্রমণে বিধ্বস্ত ও ছিন্নভিন্ন[1] মুসলিম দেশগুলোতে ইলম চর্চা স্থবির হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ও সামাজিক সমর্থন খুবই কমে যায়। এ সময়ে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানচর্চায় স্থবিরতা আসে। এ সকল যুগেও অনেক প্রাজ্ঞ আলিম ছিলেন। তবে অধিকাংশ আলিমই জ্ঞানগত দৈন্যে নিপতিত হন। এ সময়ে অনেক হানাফী ফকীহ এমন সব মন্তব্য করেছেন যা হানাফী মাযহাবের এ মৌলিক বিষয়টিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে এবং বিরোধীদের অপপ্রচারকে শক্তিশালী করে। সকল মাযহাবেরই একই অবস্থা হয়ে যায়।

এ যুগের ফকীহগণ ইমামগণের কথা ও শতশত বৎসর পরের ফকীহদের কথা সবই ‘‘ইমামের মাযহাব’’ বলে চালাতে থাকেন। বরং ইমামদের কথার চেয়ে পরবর্তী ফকীহদের কথাই বেশি গ্রহণযোগ্য হতে থাকে। এছাড়া মুসতাহাব পর্যায়ের মতভেদকে তারা হালাল-হারাম বানিয়ে ফেলেন। আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রগণ বলেছেন যে, মুফতীর জন্য ইমামের মতের দলীল না জেনে ফাতওয়া দেওয়া হারাম। কয়েক শত বৎসর পরে কোনো কোনো আলিম বললেন, দলীল না জানলেও ফাতওয়া দেওয়া জায়েয হতে পারে। আরো কয়েক শত বৎসর পরে কেউ কেউ বলতে লাগলেন: মুকাল্লিদ বা মাযহাব অনুসারীর জন্য দলীল জানাই হারাম!! এ প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ তুর্কি হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ পীর আলী বারকাবী (৯৮১ হি)-এর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মুসতাফা হুসাইনী খাদমী হানাফী (১১৭৬ হি) বলেন:

دليل المقلد قول المجتهد لا النصوص... إذا تعارض النص وقول الفقهاء يؤخذ بقول الفقهاء إذ يحتمل كون النص اجتهاديا وله معارض قوي وتأويل وتخصيص وناسخ وغيرها مما يختص بمعرفته المجتهد

‘‘কুরআন-হাদীস মুকাল্লিদের দলীল নয়, মুকাল্লিদের দলীল হলো মুজতাহিদের কথা! ... যদি কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট কথা ফকীহদের কথার বিপরীত হয় তবে ফকীহদের কথা গ্রহণ করতে হবে!!! কারণ হতে পারে যে, কুরআন-হাদীসের কথাটি ইজতিহাদী! এর বিপরীতে কোনো শক্তিশালী দলীল বা ব্যাখ্যা আছে যা হয়ত মুজতাহিদ জানতেন!!!’’[2]

কী দুর্ভাগ্যজনক কথা! নিজেদের অজ্ঞতা ঢাকতে তারা এ সকল সম্ভাবনা দিয়ে হাদীসের নির্দেশনা বাতিল করছেন, অথচ অনুরূপ কিছু সম্ভাবনা দিয়ে ইমামের কথা বাতিল করতে রাজি নন! এ তো সাধারণ মুর্খ মানুষদের কথা। আলিম বা মুফতীর জন্য তো ফরয দায়িত্ব এ সম্ভাবনাগুলো নিশ্চিত করা। তিনি তাঁর ইমামের দলীল জানবেন, বুঝবেন ও প্রমাণ করবেন। বিভিন্ন সম্ভাবনা দিয়ে হাদীস বাতিল করার চেয়ে বিভিন্ন সম্ভাবনা দিয়ে ফকীহের কথা বাতিল করা কি সহজতর নয়? হয়ত ফকীহ হাদীসটি জানতেন না, হয়ত তাঁর ইজতিহাদী ভুল হয়েছিল...।

ইমাম আযম বলছেন, আমার মতের দলীল না জানলে তুমি তা অনুসরণ করবে না, বরং তুমি যে দলীলটি জেনেছ তা অনুসরণ করবে। আমার মতের বিপরীতে দলীল প্রমাণিত হলে তা অনুসরণ করবে। আর এরা বলছেন যে, ইমামের মতের দলীল জানাও তোমার জন্য নিষিদ্ধ! হাদীস মানাও তোমার জন্য নিষিদ্ধ!! আমরাও তোমাকে তাঁর মতের দলীলটি খুঁজে দিতে প্রস্ত্তত নই। বরং আমরা ‘ইমামের মত’ বলে যে কথাটি তোমাকে জানাচ্ছি তা অন্ধভাবে অনুসরণ করা তোমাদের জন্য ফরয!!!

এ সকল যুগের অবস্থা সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১১৭৬হি) বলেন:

فنشأت بعدهم قرون على التقليد الصرف لا يميزون الحق من الباطل ولا الجدل عن الاستنباط ... ولم يأت قرن بعد ذلك إلا وهو أكثر فتنة وأوفر تقليدا وأشد انتزاعا للامانة من صدور الرجال حتى اطمأنوا بترك الخوض في أمر الدين وبأن - يقولوا إنا وجدنا آباءنا على أمة وإنا على آثارهم متقدون - وإلى الله المشتكى وهو المستعان وبه الثقة وعليه التكلان.

‘‘তাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো ঢালাও অন্ধ তাকলীদের উপরে লালিত হতে লাগল। তারা হক্ব ও বাতিলের মধ্যে এবং বিতর্ক ও ইলমী গবেষণার মধ্যে পার্থক্য বুঝতো না। ...প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্ম তার পূর্বের প্রজন্ম থেকে অধিকতর ফিতনাগ্রস্ত এবং তাকলীদে আক্রান্ত হতে লাগল। এভাবে মানুষের হৃদয় থেকে তারা আমানত ছিনিয়ে নিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তারা দীনের বিষয়ে গবেষণা ছেড়ে দিল এবং (কুরআনের ভাষায় প্রাচীন কাফিরদের মত) এ কথা বলেই পরিতৃপ্ত হতে লাগল যে, আমরা আমাদের পিতা-পিতামহ-পূর্বপুরুষদের থেকে এ ধর্ম গ্রহণ করেছি এবং আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।’’[3] একমাত্র আল্লাহর কাছেই এ বেদনা জানানো যায়, তিনিই একমাত্র সাহায্যকারী, তাঁরই উপর নির্ভরতা।’’[4]

এ সকল যুগের ফকীহদের ভুলভ্রান্তি কিভাবে ইমাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি তৈরি করে সে প্রসঙ্গে আব্দুল হাই লাখনবী বলেন:

وكذلك مسألة الإشارة في التشهد فإن كثيرا من كتب الفتاوى متواردة على منعها وكراهتها فيظن الناظرون فيها أنه مذهب أبي حنيفة وصاحبيه فيشكل عليهم الأمر بورود أحاديث متعددة قولية وفعلية تدل على جوازها وسنيتها قال علي القاري المكي في رسالته تزيين العبارة لتحسين الإشارة بعدما ذكر الأخبار الدالة على الإشارة: لم يعلم من الصحابة ولا من علماء السلف خلاف في هذه المسألة ولا في جواز الإشارة بل قال به إمامنا الأعظم وصاحباه وكذا مالك والشافعي وأحمد وسائر علماء الأمصار والأعصار ... فلا اعتداد لما ترك هذه السنة الأكثرون من سكان ما وراء النهر وأهل خراسان والعراق وبلاد الهند ممن غلب عليهم التقليد وفاتهم التحقيق... وقد أغرب الكيداني حيث قال: والعاشر من المحرمات الإشارة بالسبابة: كأهل الحديث أي مثل إشارة جماعة يجمعهم العلم بحديث رسول الله ﷺ وهذا منه خطأ عظيم وجرم جسيم ... ولو لا حسن الظن به وتأويل كلامه بسبب لكان كفره صحيحا وارتداده صريحا فهل يحل لمؤمن أن يحرم ما ثبت عن رسول الله ﷺ ما كاد أن يكون متواترا في نقله؟ .... فظهر منه أن قول النهي المذكور في الفتاوى إنما هو من مخرجات المشايخ لا من مذهب صاحب المذهب وقس عليه أمثاله وهي كثيرة... وإذا عرفت هذا فحينئذ يسهل الأمر في دفع طعن المعاندين على الإمام أبى حنيفة وصاحبيه فإنهم طعنوا في كثير من المسائل المدرجة في فتاوى الحنفية أنها مخالفة للأحاديث الصحيحة أو أنها ليست متأصلة على أصل شرعي ونحو ذلك وجعلوا ذلك ذريعة إلى طعن الأئمة الثلاثة ظنا منهم أنها مسائلهم ومذاهبهم وليس كذلك بل هي من تفريعات المشايخ استنبطوها من الأصول المنقولة عن الأئمة فوقعت مخالفة للأحاديث الصحيحة فلا طعن بها على الأئمة الثلاثة بل ولا على المشايخ أيضا فإنهم لم يقرروها مع علمهم بكونها مخالفة للأحاديث إذ لم يكونوا متلاعبين في الدين بل من كبراء المسلمين بهم وصل ما وصل إلينا من فروع الدين بل لم يبلغهم تلك الأحاديث ولو بلغتهم لم يقرروا على خلافها فهم في ذلك معذورون ومأجورون.

‘‘এখানে একটি উদাহরণ সালাতের মধ্যে তাশাহ্হূদের সময় ইশারা করা। হানাফী ফিকহের অনেক ফাতওয়ার গ্রন্থেই ইশারা করতে নিষেধ করা হয়েছে বা মাকরূহ বলা হয়েছে। পাঠকগণ মনে করবেন যে, এটিই ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর দু ছাত্রের মত। তখন বিষয়টি তার কাছে সমস্যা মনে হয়; কারণ অনেকগুলো হাদীস দ্বারা এরূপ ইশারা করা সুন্নাত বলে প্রমাণিত। মোল্লা আলী কারী ‘তাযয়ীনুল ইবারাতি লিতাহসীনিল ইশারাতি’ পুস্তিকায় এ বিষয়ক হাদীসগুলো উল্লেখ করে বলেন: সাহাবীদের মধ্যে এবং পূর্ববর্তী আলিমদের মধ্যে তাশাহ্হুদের সময় ইশারা করার বৈধতার বিষয়ে কোনো মতভেদ ছিল না। আমাদের ইমাম আ’যম, তাঁর দু সঙ্গী (আবূ ইউসূফ ও মুহাম্মাদ), ইমাম মালিক, শাফিয়ী, আহমদ এবং সকল দেশের ও সকল যুগের আলিমগণ এ মত পোষণ করেছেন। পরবর্তী যুগে পারস্য, মধ্য এশিয়া ও ভারতের অধিকাংশ হানাফী আলিম এ সুন্নাতটি বর্জন করেছেন। তাকলীদের প্রাধান্য ও গবেষণার অনুপস্থিতির কারণেই তারা এরূপ করেছেন। তাদের কর্ম ও মত গুরুত্বহীন ও অগ্রহণযোগ্য। ....

(নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা লুৎফুল্লাহ নাসাফী ফাযিল) কীদানী (৯০০ হি) অবাক ও উদ্ভট কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: ‘সালাতের মধ্যে হারাম কর্মগুলোর দশম কর্ম শাহাদাত আঙুল দিয়ে ইশারা করা, যেভাবে আহলে হাদীসরা করে।’ (আলী কারী বলেনHappy অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস বিষয়ক জ্ঞান যাদেরকে একত্রিত করেছে তারা যেভাবে ইশারা করেন সেভাবে ইশারা করা হারাম। এটি তাঁর একটি ভয়ঙ্কর ভুল ও কঠিন অপরাধ। তাঁর বিষয়ে সুধারণা না থাকলে এবং তাঁর কথার ব্যাখ্যা না করলে তার এ কথাটি সন্দেহাতীত কুফর এবং সুস্পষ্ট ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হতো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত কোনো বিষয়কে হারাম বলা কোনো মুমিনের জন্য কি বৈধ হতে পারে? বিশেষত যে বিষয়টি প্রায় মুতাওয়াতির?...’’

লাখনবী বলেন, এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ফাতওয়ার গ্রন্থসমূহে এরূপ ইশারা করতে নিষেধ করে যে মত উল্লেখ করা হয়েছে তা পরবর্তী যুগের ফকীহগণের মত মাত্র; তা ইমাম আবূ হানীফার মাযহাব নয়। আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যা অবিকল এরূপ।... ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের বিষয়ে বিরোধীরা যে অভিযোগ করেন তার স্বরূপ বুঝা এখন সহজ হয়ে গেল। হানাফী ফাতওয়া বা ফিকহের গ্রন্থে অনেক মাসাইল রয়েছে যেগুলো সহীহ হাদীসের বিপরীত বা কোনো প্রসিদ্ধ শরয়ী মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত নয়। বিরোধীরা এ সকল মাসআলাকে ইমাম ত্রয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁরা ধারণা করেন যে, এগুলো বোধ হয় ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের মত। প্রকৃতপক্ষে এগুলো তাঁদের মত নয়। এগুলো পরবর্তী যুগের হানাফী ফকীহগণের মত। তাঁরা ইমামগণ থেকে বর্ণিত মূলনীতির ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে এ সকল মত প্রকাশ করেছেন। এগুলোর জন্য ইমামত্রয়কে অভিযুক্ত করা যায় না। এমনকি পরবর্তী ফকীহগণকেও এজন্য অভিযুক্ত করা যায় না। কারণ তাঁরাও জেনেশুনে হাদীস বিরোধী ফাতওয়া দেন নি। তাঁরা দীন নিয়ে তামাশা করতেন না; বরং তাঁরা মুসলিমগণের নেতৃপর্যায়ের আলিম ছিলেন এবং তাঁদের মাধ্যমেই আমরা দীনের মাস্আলাগুলো জানতে পেরেছি। মূলত পরবর্তী এ সকল ফকীহ এ বিষয়ক হাদীসগুলো জানতেন না। যদি তাঁরা এ সকল মাসআলায় হাদীস জানতেন তবে হাদীসের বিরুদ্ধে ফাতওয়া দিতেন না। কাজেই তাঁরা মাযুর ছিলেন এবং ভুল ইজতিহাদের জন্য সাওয়াব পাবেন।...’’[5]

এভাবে আমরা দেখছি যে, ইমাম আবূ হানীফা হাদীস বিরোধী কিয়াসের প্রবর্তক ছিলেন না। সহীহ হাদীসের উপর নির্ভরতার পাশাপাশি তিনি ফকীহের মত যাচাই করে গ্রহণের তাকীদ দিয়েছেন। প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহগণ এবং অন্যান্য মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহগণও একই নির্দেশনা দিয়েছেন। তাকলীদ ও দলীল নির্ভরতার এ সমন্বয়ই সাহাবীগণের সুন্নাত। একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

মদীনার কিছু মানুষ ইবন আব্বাস (রা)-কে প্রশ্ন করেন: ফরয তাওয়াফের পরে যদি কোনো মহিলার হায়েয (ঋতুস্রাব) শুরু হয় তবে কী হবে? তিনি বলেন: উক্ত মহিলা (বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়াই) দেশে ফিরে যাবে। তখন তাঁরা বলেন: যাইদ ইবন সাবিত (রা)-এর মতে উক্ত মহিলা হায়েয শেষ হওয়ার পর বিদায়ী তাওয়াফ করে দেশে যাবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: মক্কা ত্যাগের আগে হাজীকে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। আমরা যাইদ (রা)-এর মত বাদ দিয়ে আপনার মত গ্রহণ করব না। তখন ইবন আব্বাস (রা) বলেন: আপনার যখন মদীনায় পৌঁছাবেন তখন আমার মতের হাদীসটির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেন। তাঁরা মদীনায় পৌঁছে উম্মু সুলাইম (রা) ও অন্যান্য সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা হাদীসটি বলেন। ঘটনাটি হলো, বিদায় হজ্জে ফরয তাওয়াফের পর সাফিয়্যাহ (রা)-এর হায়েয শুরু হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়াই মক্কা ত্যাগের অনুমতি দেন। তখন মদীনাবাসীগণ ইবন আব্বাস (রা)-এর মত গ্রহণ করেন এবং তাঁকে জানান যে, হাদীসটি তাঁর বর্ণনা মতই তাঁরা পেয়েছেন।[6]

সাহাবীগণের যুগের এ ঘটনা থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় জানছি:

(১) মুসিলমদের দায়িত্ব প্রাজ্ঞ আলিমদের থেকে দীন জেনে নেওয়া। এক্ষেত্রে একজন আলিমের প্রতি অধিক আস্থা থাকা খুবই স্বাভাবিক। যাইদ (রা)-এর প্রতি অবিচল আস্থার কারণে ইবন আব্বাস (রা)-এর মুখে হাদীসটি শুনে তাঁরা মেনে নেন নি।

(২) মদীনাবাসীদের কথার প্রতিবাদে ইবন আব্বাস (রা) তাদেরকে হাদীস বিরোধী বলে অভিযুক্ত করেন নি। তাঁর বর্ণনা মেনে নিতেও তাদেরকে চাপাচাপি করেন নি। তিনি তাঁদেরকে হাদীসটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে উৎসাহ দিয়েছেন।

(৩) মদীনাবাসীগণ যাইদ (রা)-এর উপর আস্থার কারণে ইবন আব্বাস (রা)-এর হাদীসটি বিভিন্ন অজুহাতে বাতিল বলে থেমে থাকেন নি। তাঁরা হাদীসটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে ইবন আববাসের (রা) বর্ণনার নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন।

এটিই তাকলীদ ও দলীল অনুসন্ধানের মাসনূন আদর্শ। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ অনুসারে সাধারণ মুমিন ফকীহগণ থেকে দীন জানবেন। এক্ষেত্রে কোনো একজন ফকীহের উপর অধিক আস্থাশীল হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, সকল ফকীহ বা মুহাদ্দিসের মত সমানভাবে গ্রহণ করলে বা ইচ্ছামত গ্রহণ করলে সাধারণ মুমিনকে বিভ্রান্ত হতে হবে। তবে এরূপ আস্থা বা তাকলীদ অর্থ নির্বিচার বা অন্ধ অনুসরণ নয়। মুমিনের দায়িত্ব বিপরীত কোনো হাদীস জানা গেলে তার নির্ভুলতার বিষয়ে অনুসন্ধান করা। অনুসন্ধানের মাধ্যমে যদি প্রমাণ হয় যে, তিনি যে ফকীহের অনুসরণ করেন তার মতের বিপরীত হাদীসটি বিশুদ্ধ, নির্ভুল ও ব্যাখ্যাতীত তখন তিনি তা গ্রহণ করবেন।

‘‘যখন কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণ হয়’’ বলতে ইমাম আবূ হানীফা ও অন্যান্য ইমাম বাহ্যত এ অবস্থা-ই বুঝিয়েছেন। কোনো একটি হাদীসকে কোনো নির্দিষ্ট আলিম সহীহ বলেছেন বলে জানা এবং নিজে অনুসন্ধানের মাধ্যমে হাদীসটি সহীহ, ব্যাখ্যাতীত ও নিজের পালনীয় মতের দলীলের চেয়ে শক্তিশালী বলে নিশ্চিত হওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। কোনো আলিমের উপর নির্ভর করে কোনো হাদীসকে সহীহ বলে গ্রহণ করা ফিকহী তাকলীদের মতই তাকলীদ। এটি নিন্দনীয় নয়। তবে এরূপ তাকলীদের উপর নির্ভর করে অন্য তাকলীদ খণ্ডন বা বর্জন করা যায় না। বুখারী, মুসলিম, ইবন হাজার, সুয়ূতী, আলবানী বা অন্য কোনো মুহাদ্দিস (রাহিমাহুমুল্লাহ) একটি হাদীসকে সহীহ বলেছেন বলে উক্ত হাদীসের বিপরীত কর্মকে বাতিল বলে মনে করা বিভ্রান্তিকর। আবার আবূ হানীফা, শাফিয়ী, আহমদ, মালিক, আওযায়ী, তাহাবী বা অন্য কোনো ফকীহ (রাহিমাহুল্লাহ) একটি কর্মকে সঠিক বলেছেন বলে উক্ত মতের বিপরীত হাদীসকে রহিত, বাতিল, দুর্বল ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দেওয়াও একইরূপ বিভ্রান্তিকর।

বিশেষত মুফতী ও আলিমের দায়িত্ব তাঁর ফাতওয়ার দলীলটি ভালভাবে জানা। একজন ফকীহ বা মুহাদ্দিসের উপর আস্থার কারণে ফিকহ বা হাদীস বিষয়ে তাঁর মতের উপর নির্ভর করা সাধারণ মুসলিমদের জন্য স্বাভাবিক। তবে অন্য কাউকে এ বিষয়ে ফাতওয়া বা সিদ্ধান্ত দিতে হলে বিষয়টি অধ্যয়ন করতে হবে। এরূপ সিদ্ধান্ত দেওয়ার পূর্বে এ বিষয়ে কুরআন, হাদীস, সাহাবী-তাবিয়ীগণের মত, একাধিক হাদীস থাকলে একটিকে গ্রহণ করার কারণ ভালভাবে জানতে হবে। ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রগণ এ বিষয়টির প্রতি সর্বোচ্চ তাকিদ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ ইমাম আবূ হানীফা এবং উম্মাতের সকল ফকীহকে রহমত করুন এবং সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রদান করুন।

১৬. ইবন তাইমিয়ার মন্তব্য

ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর আলোচনা শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়ার বক্তব্য দিয়ে শেষ করব। আমরা আগেই বলেছি, ইমাম আবূ হানীফাকে কলঙ্কিত করতে জালিয়াতগণ অনেক জালিয়াতি করেছে। এমনকি তাঁর নামে ‘কিতাবুল হিয়াল’ নামে একটি জাল পুস্তক রচনা করে প্রচার করেছে। এ পুস্তকে জঘন্য দীন বিরোধী কথা ইমামের নামে লেখা হয়েছে। ৪র্থ-৫ম হিজরী শতক পর্যন্ত কেউ উল্লেখ করেন নি যে, ইমাম আবূ হানীফা কিতাবুল হিয়াল নামে কোনো বই লিখেছেন। সম্ভবত ৪র্থ-৫ম শতকের কোনো জালিয়াত তা রচনা করে। এরপর তারা এ পুস্তকের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের অনেক প্রসিদ্ধ আলিমের বক্তব্য জাল করেছে। এ পুস্তক প্রসঙ্গে ইবন তাইমিয়া বলেন:

إنَّ هَذِهِ الْحِيلَةَ الَّتِي هِيَ مُحَرَّمَةٌ فِي نَفْسِهَا لا يَجُوزُ أَنْ يُنْسَبَ إلَى إمَامٍ أَنَّهُ أَمَرَ بِهَا فَإِنَّ ذَلِكَ قَدْحٌ فِي إمَامَتِهِ وَذَلِكَ قَدْحٌ فِي الأُمَّةِ حَيْثُ ائْتَمُّوا بِمَنْ لا يَصْلُحُ لِلإِمَامَةِ

‘‘এ সকল হারাম হীলা উম্মাতের একজন ইমামের বক্তব্য হতে পারে না। তিনি কখনোই এরূপ হীলা-বাহানার নির্দেশ দিতে পারেন না। তাহলে তো তিনি ইমাম হওয়ার অযোগ্য বলে প্রমাণিত হবেন। আর সেক্ষেত্রে উম্মাতে মুহাম্মাদী অযোগ্য উম্মাত বলে প্রমাণিত হবে; কারণ তারা অযোগ্য একজনকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করেছে।’’

বস্ত্তত ইবন তাইমিয়ার অধ্যয়ন ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। এ কারণে হানাফী ফিকহ তিনি যেভাবে বুঝেছেন, অন্য মাযহাবের অন্য কোনো আলিম সেভাবে বুঝেন নি। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থে ইমাম আযমের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ খন্ডন করেন। উপরন্তু অনেক ফিকহী ও উসূলী বিষয়ে তিনি হাম্বালী মাযহাব পরিত্যাগ করে হানাফী মত গ্রহণ করেন। তাঁর বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যারা ইমাম আবূ হানীফাকে কলঙ্কিত করতে চেষ্টা করেছেন বা করছেন তাঁরা জেনে অথবা না জেনে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে কলঙ্কিত করছেন।

৭/৮ জন সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত প্রায় মুতাওয়াতির হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পরের তিন প্রজন্মের প্রামাণ্যতা ও বরকতের সাক্ষ্য দিয়েছেন। সে বরকতময় দ্বিতীয় হিজরী শতকে যাকে আলিমগণ, সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্র প্রশাসন মুসলিমদের অন্যতম একজন ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন পরবর্তী যুগে এসে তাঁকে অযোগ্য প্রমাণ করার অর্থ উম্মাতে মুহাম্মাদীকে অযোগ্য প্রমাণ করা। আর দ্বিতীয় শতকের উম্মাতকে অযোগ্য প্রমাণ করার অর্থ কী হতে পারে তা আমরা বুঝতে পারছি।

বস্ত্তত সামান্য কিছু মতভেদ নিয়ে যে দুঃখজনক বাড়াবাড়ি পূর্ববর্তী কয়েক শতকে ঘটেছে দীনের স্বার্থে ও উম্মাতের স্বার্থেই আমাদেরকে তাঁর ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। মহান আল্লাহ ইমাম আবূ হানীফাকে এবং তাঁর বিরুদ্ধে উম্মাতের যে সকল প্রাজ্ঞ আলিম ও বুজুর্গ কথা বলেছেন তাঁদের সকলকেই ক্ষমা করুন, রহমত করুন এবং দীনের জন্য তাঁদের অবদান কবুল করে তাঁদেরকে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করুন। আমীন



সূত্রঃ ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এর লেখা ‘আল-ফিকহুল আকবার বাংলা অনুবাদ ও বাখ্যা বই থেকে।

বিষয়: বিবিধ

৩৮৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File