আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য এক ও একক সর্বাধিপতি প্রতিপালক

লিখেছেন লিখেছেন দূর্যোধন ২৩ আগস্ট, ২০১৪, ১০:১৪:১৬ রাত

তাওহীদ : আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য এক ও একক সর্বাধিপতি প্রতিপালক। তিনি রাজত্ব, সৃষ্টি, ধন-সম্পদ ও কর্তৃত্বের অধিপতি। এতে কোন অংশীদার নেই। এককভাবে তিনিই প্রভু। এবাদত, আনুগত্য, আশা-ভরসা, সাহায্য ও ফরিয়াদের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে তার সাথে অংশীদার করা জায়েজ নেই। তিনি সুন্দর নামসমূহ ও মহান গুণাবলির অধিকারী, তার সদৃশ কোন জিনিস নেই। তিনি সর্ব-শ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।

তাওহীদের মর্যাদা ও আলামত

১. তাওহীদ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ ও তার আনুগত্যের সর্বোত্তম ও সর্ব শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। এ তাওহীদের বার্তা দিয়েই তিনি রাসূলদের প্রেরণ করেছেন এবং এর ব্যাখ্যার জন্য কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে-

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ. (سورة إبراهيم )1:

‘এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাজিল করেছি-যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন।'

অর্থাৎ শিরকের অন্ধকার হতে তাওহীদের আলোতে।

ভাগ্য নির্ধারণ

বুদ্ধিবৃত্তি ও আইন ‘ওহী’ নামে অভিহিত

আমরা যদি খুব সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব যে, মানুষের আজন্ম কাংখিত আইন, যার প্রয়োজনীয়তা মানুষ বিশ্বাসগত বা সমষ্টিগতভাবে তার খোদাপ্রদত্ত স্বভাব দ্বারা উপলব্ধি করে, যে আইন মানব জাতির সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধান করে। সেটা একমাত্র সেই আইন, যা এই মনুষ্য জগতকে মনুষ্য হওয়ার কারণে কোন বৈষম্য বা ব্যতিক্রম ছাড়াই সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায়। এ ছাড়া তা মানব জাতির সার্বজনীন পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আর এটাও সর্বজন বিধিত ব্যাপার যে, মানব জাতির ইতিহাসে মানুষের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা প্রসূত এমন কোন আর্দশ আইন আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি। মানুষ যদি প্রাকৃতিক ভাবে তার বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এমন কোন আদর্শ আইন রচনা করতে সক্ষম হত, তাহলে এই সুদীর্ঘ মানব ইতিহাসে তা অবশ্যই আমাদের সবার গোচরীভূত হত। বরঞ্চ, উচ্চ মেধা ও বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যে কোন বিশ্বাস ঐ আর্দশ আইন সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধির জ্ঞানের অধিকারী হতেন, যেমনটি বুদ্ধিমান সমাজ তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উপলব্ধি করে। আরও স্পষ্ট করে এভাবে বলা যায় যে, মানব সমাজের সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধায়ক পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন আইন,

যার মাধ্যমে এ সৃষ্টিজগত প্রাকৃতিক ভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, তা প্রণয়নের দায়িত্ব ও ক্ষমতা যদি মানুষের বুদ্ধিমত্তার উপর অর্পিত হত তাহলে বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হত। ঠিক যেমন করে মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে তার লাভ ক্ষতি এবং জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয় গুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হয়, তেমনি ঐ জাতীয় আইনের উপলব্ধি তার জন্য অতি সহজ ব্যাপারই হত। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, মানব রচিত এমন কোন আদর্শের আইনের সন্ধানই খুঁজে পাওয়া যায় না। মানব ইতিহাসে একক কোন ব্যক্তির, গোষ্ঠী বা জাতি সমূহের দ্বারা যেসব আইন এযাবত প্রণীত হয়েছে, তা কোন একটি জনসমষ্টির কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত হলেও অন্যদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য বা স্বীকৃত নয়। অনেকেই ঐ নির্দিষ্ট আইন সম্পর্কে জ্ঞাত হলেও অনেকেই আবার সে সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। খোদা প্রদত্ত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং সৃষ্টিগতভাবে সমান মানুষ ঐ ধরণের মানব রচিত আইন সম্পর্কে সমপর্যায়ের সৃষ্টি মানব জাতিও উপলব্ধি পোষণ করে না।

‘ওহী’ নামে অভিহিত রহস্যাবৃত উপলব্ধি

পূর্বের আলোচনায় এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, বুদ্ধিমত্তা, মানব জীবনের সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধায়ক নীতিমালা উপলব্ধি করতে অক্ষম। অথচ মানব জাতিকে সত্য পথে পরিচালনার লক্ষ্যে এ আর্দশ বিধান উপলব্ধির ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির উপস্থিতি মানব সমাজের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ঐ ধরণের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিশ্বাসই মানুষকে জীবনের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবেন এবং আপামর জনসাধরণের কাছে সে ধারণা পৌঁছে দেবেন। আর্দশ বিধান অনুধাবনের ঐ বিশেষ ক্ষমতা, যা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও সাধারণ অনুভুতির বাইরে, তা ওহী বা ঐশীবাণী উপলব্ধির ক্ষমতা হিসেবে পরিচিত। মানব জাতির মধ্যে বিশেষ কোন ব্যক্তির এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার অর্থ এই নয় যে, একইভাবে অন্য লোকেরাও ঐ বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই জন্মগতভাবে যৌন ক্ষমতা নিহিত রয়েছে। কিন্তু যৌন তৃপ্তির উপলব্ধি ও তা উপভোগ করার মত যোগ্যতা শুধুমাত্র সেসব ব্যক্তির মধ্যেই পাওয়া যাবে, যারা সাবালকত্বের বয়সে উপনীত হয়েছে। নাবালক শিশুর কাছে যৌন তৃপ্তির প্রকৃতি যেমন দূর্বোধ্য এবং রহস্যাবৃত, ওহী বা ঐশীবাণী অনুধাবনে অক্ষম মানুষের কাছে তার মর্ম উপলব্ধির বিষয়টিও তেমনি রহস্যাবৃত। মহান আল্লাহ্‌‌ তাঁর পবিত্র ঐশীবাণী অনুধাবনে সাধারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তার অক্ষমতা সম্পর্কে কুরআনে বলেন ঃ ‘‘আমি তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করেছি, যেমনটি নুহ ও তার পরবর্তী নবীগণের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম। ..... আমরা সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী রাসুল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসুল আসার পর আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে।’’ (সুরা আন্‌ নিসা, ১৬২ নং আয়াত।)

নবীগণ ও ‘ইস্‌মাত্‌’ বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণ

মানবজাতির মাঝে নবীগণের আবির্ভাব পূর্বের আলোচনার সত্যতাই প্রমাণ করে। আল্লাহ্‌র নবীগণ এমনসব ব্যক্তি ছিলেন, যারা ওহী বা ঐশীবাণী বহন ও নবুয়তের দাবী করেছেন। তাঁরা তাঁদের ঐ দাবীর স্বপক্ষে অকাট্য দলিল-প্রমাণও উপস্থাপন করেছেন। মানবজাতির সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধায়ক ঐশী বিধানই মানুষের মাঝে প্রচার ও আপামর জনসাধারণের কাছে তার অমিয়বাণী তাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহ্‌র নবীগণ ওহী বা ঐশীবাণী এবং নবুয়তের বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত ছিলেন। তাই যে যুগেই নবীর আর্বিভাব ঘটেছে, সেখানে একই যুগে একজন অথবা অল্পসংখ্যক নবীর বেশী একই সাথে আর্বিভূত হননি। মহান আল্লাহ্‌‌ নবীদেরকে তাঁর ঐশী বিধান প্রচারের দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে আপামর জনসাধারণকে সত্য পথে (হেদায়েত) পরিচালনার দায়িত্বের কাজ পূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে, আল্লাহ্‌‌ নবীকে অবশ্যই ‘ইসমাত্‌’ বা ‘নিষ্পাপের গুণে গুনাম্বিত হতে হবে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ্‌‌র ওহী বা ঐশীবাণী গ্রহণ, ধারণ এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে তাঁকে অবশ্যই যে কোন ধরণের ভুল বা ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে নিরাপদ থাকতে হবে। তেমনি যেকোন ধরণের পাপ বা অবাধ্যতা (ঐশী বিধানের লঘংন) থেকে তাকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে হবে। যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে, মহান ঐশীবাণী গ্রহণ, সংরক্ষণ ও জনগণের কাছে তা প্রচারের বিষয়টি খোদাপ্রদত্ত সৃষ্টিগত হেদায়েতের প্রক্রিয়ার তিনটি মৌলিক ভিত্তি বিশেষ। আর সৃষ্টিগত (প্রাকৃতিক) প্রক্রিয়ায় ভুলের কোন স্থান নেই। আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে পাপ বা অবাধ্যতা (ঐশীবিধান লংঘনমূলক) প্রচারকার্য্যের বাস্তব বিরোধিতা বটে। শুধু তাই নয়, এর ফলে প্রচারকারী পাপজনিত কারণে প্রচারের ব্যাপারে তার প্রতি জনগণের আস্থা ও স্বীয় বিশ্বস্ততা হারায়। এর মাধ্যমে ঐশী আর্দশ প্রচারের মহতী উদ্দেশ্য ধ্বংস হয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ্‌‌‌ নবীদের নিষ্পাপ হওয়ার (ইস্‌মাত’) ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি বলেছেন ঃ ‘‘তাদেরকে মনোনীত করেছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করেছিলাম।” (সুরা আল্‌ আনআম, ৮৭ নং আয়াত।)তিনি আরও বলেছেনঃ “তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারও নিকট প্রকাশ করেন না, শুধুমাত্র তার মনোনীত রাসুল ছাড়া। সেক্ষেত্রে আল্লাহ্‌‌‌ রাসুলের আগে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। রাসুলগণ তাঁদের প্রতিপালকের বাণী পৌঁছে দিয়েছে কিনা, তা জানার জন্যে।” (সুরা জ্বিন, ২৬ থেকে ২৭ নং আয়াত।)

নবীগণ ও ঐশীধর্ম

মহান আল্লাহ্‌র নবীগণ ওহীর মাধ্যমে যা পেয়েছেন এবং জনগণের মাঝে আল্লাহ্‌র পবিত্র ঐশীবাণী হিসেবে প্রচার করেছেন, তাই দ্বীন হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ মানুষের জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি ও জীবনের পালনীয় ঐশীদায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ, যা মানব জীবনের প্রকৃত সাফল্য ও সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধান করে, তারই নাম “দ্বীন”।এই ঐশী ‘দ্বীন’ বা ধর্ম বিশ্বাসগত ও ব্যবহারিক এই দু’টো অংশ নিয়ে গঠিত। বিশ্বাসগত অংশটি এক ধরণের মৌলিক বিশ্বাস ও কিছু বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর সমন্বয়ে গঠিত, যার উপর ভিত্তি করে মানুষ তার জীবনযাপন পদ্ধতি নির্ধারণ করে। এই মৌলিক বিশ্বাসের তিনটি মূল অংশ রয়েছেঃ

৩. একত্ববাদ৪. নবুয়ত৫. পুনরূত্থান বা কেয়ামত

এই তিনটি মৌলিক বিষয়ের একটিতেও যদি বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়, তাহলে ‘দ্বীন’ বা ধর্ম সেখানে অস্তিত্ব লাভ করতে পারবে না। ‘দ্বীনের’ ব্যবহারিক অংশঃ এ অংশটিও বেশ কিছু ব্যবহারিক ও আচরণগত দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমন্বয়ে রচিত। মূলত সর্বস্রষ্টা আল্লাহ্‌‌‌ ও সমাজের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যের উপর ভিত্তি করেই এসব দায়িত্ব ও কর্তব্য রচিত। এ কারণেই ঐশীবিধান নির্দেশিত মানুষের দায়িত্ব সাধারণতঃ দু’ভাগে বিভক্তঃ

১। ব্যবহারিক কিছু কাজের দায়িত্ব

২। শিষ্টাচারগত কর্তব্য

এদু’টো অংশ আবার দু’ভাগে বিভক্ত যেমনঃ বেশ কিছু ব্যবহারিক কাজ ও শিষ্টাচার শুধুমাত্র মহান আল্লাহ্‌‌র সাথেই সংশ্লিষ্ট যথাঃ সচ্চরিত্র, ঈমান, সততা, নিষ্কলুষতা, আল্লাহ্‌‌র প্রতি আত্মসর্ম্পন, তাঁর প্রতি সন্তুষ্টি পোষণ, নামায, রোযা, কুরবানী এবং এ জাতীয় অন্যান্য ইবাদত, আল্লাহ্‌‌র প্রতি ভক্তি পোষণ ইত্যাদি মানুষকে আল্লাহ্‌‌র প্রকৃত ও অনুগত দাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। আবার বেশ কিছু শিষ্টাচার ও কাজ আছে যা সমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন মানুষের সদাচারণ, মানুষের কল্যাণ কামনা, ন্যায়বিচার, দানশীলতা, মানুষের পারস্পরিক মেলামেশা সংক্রান্ত দায়িত্ব, পারস্পরিক লেনদেন ইত্যাদি। এ অংশটি সাধারণতঃ পারস্পরিক আচরণ ও লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় হিসেবে পরিচিত। ওদিকে মানব জাতি সর্বদাই ক্রম উন্নয়নমুখী। সর্বদাই মানুষ পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বকামী। তাই মানব সমাজ সময়ের আবর্তনে ক্রমশই উন্নততর হয়। তাই ঐশীবিধানের ক্রমোন্নতি বা বিকাশও অপরিহার্য। আর পবিত্র কুরআনও এই ক্রমোন্নতি ও বিকাশকে (যেমনটি বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছে) সর্মথন করে। যেমন ঃ কুরআনে বলা হয়েছে, এযাবৎ অবতীর্ণ প্রতিটি ঐশী বিধানই তার পূর্বের ঐশীবিধানের তুলনায় পূর্ণাঙ্গ এবং উন্নততর। তাই মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ “আমি আপনার প্রতি সত্যসহ ঐশীগ্রন্থ (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি যা এর পূর্বে অবতীর্ণ ঐশীগ্রন্থের (যেমন ইঞ্জিল, তৌরাত) সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণকারী স্বরূপ।” (সুরা আল্‌ মায়েদা, ৪৮ নং আয়াত।) বিজ্ঞান এবং কুরআনের দৃষ্টিতে মানব জীবন অমর ও চিরন্তন নয়। তাই তার উন্নয়ন ও বিকাশও অন্তহীন নয়। এ কারণে বিশ্বাস ও কাজের দিক থেকে মানুষের দায়িত্বও একটি বিশেষ স্তরে এসে থেমে যেতে বাধ্য। একইভাবে মৌলিক বিশ্বাসের পূর্ণতা ও ব্যবহারিক ঐশীবিধানের বিস্তৃতি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার কারণে নবুয়ত ও শরীয়তের (ঐশীবিধান) বিকাশ ধারার সমাপ্তি ঘটাতে বাধ্য। এ কারণেই পবিত্র কুরআন এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করার লক্ষ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বশেষ নবী এবং ইসলামকে পূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতম ঐশীধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর একথাও বলেছে যে, এই ঐশীগ্রন্থ (পবিত্র কুরআন) চির অপরিবর্তনীয় ও মহানবী (সা.) নবুয়তের ধারা সমাপণকারী। আর ইসলাম ধর্মকে মানুষের সকল প্রয়োজনীয় দায়িত্বের আধার হিসেবে পরিচিত করিয়েছেন। তাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ঃ ‘‘এটা অবশ্যই এক মহিমাময়গ্রন্থ এর সামনে বা পিছনে কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবে না।’’ (সুরা ফুস্‌সিলাত, ৪১-৪২ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌‌ আরও বলেন ঃ ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন, বরং সে আল্লাহ্‌‌র রাসুল এবং শেষ নবী।’ পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে ঃ “আমি তোমাদের জন্যে প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ এই ঐশীগ্রন্থ (কুরআন) অবর্তীণ করেছি”। (সুরা আন্‌ নাহ্‌ল, ৮৯ নং আয়াত।)

নবীগণ ও ‘ওহী’ জনিত প্রমাণ এবং নবুয়ত

বর্তমান পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানী, গবেষক ও পন্ডিতগণই ওহী (ঐশীবাণী) ও নবুয়ত এবং তদসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলিয়েছেন এবং তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলকে সামাজিক মনস্তত্বের ভিত্তিতে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে পৃথিবীর ইতিহাসে আগত আল্লাহ্‌র নবীগণ ছিলেন পবিত্র অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত মহতী উদ্দেশ্যের অধিকারী, মানব হিতাকাংখী। তাঁরা মানব জাতির পার্থিব ও আত্মিক উন্নয়ন ও র্দূর্নীতিপূর্ণ সমাজ সংস্কারের জন্য আদর্শ আইন প্রণয়ন করেন এবং মানুষকে তা গ্রহণের আহ্‌বান জানান। যেহেতু সে যুগের মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তির কাছে আত্মসমর্পন করতো না, তাই বাধ্য হয়ে তাদের আনুগত্য ও দৃষ্টি আর্কষনের জন্যেই তারা নিজেদেরকে এবং স্বীয় চিন্তাধারাকে উচ্চতর ও ঐশীজগতের সাথে সর্ম্পকিত বলে ঘোষণা করেন। তারা নিজেদের পবিত্র আত্মকে ‘রূহুল কুদ্‌স্‌’ (পবিত্র আত্মা) এবং তা থেকে নিঃসৃত চিন্তাধারাকে ‘ওহী’ ও ‘নবুয়ত’ হিসেবে ঘোষণা করেন। আর তদসংশ্লিষ্ট দায়িত্ব সমূহকে ‘শরীয়ত’ বা ঐশীবিধান এবং যে গ্রন্থে তা লিপিবদ্ধ আছে তাকে ‘ঐশীবাণী’ হিসেবে অভিহিত করেন।কিন্তু ন্যায়বিচারপূর্ণ সুগভীর দৃষ্টিতে ঐ ঐশী গ্রন্থসমূহ, বিশেষ করে পবিত্র কুরআন এবং নবীগণের শরীয়ত (ঐশী বিধানসমূহ) পর্যক্ষেণ করলে অবশ্যই এ ব্যাপারে সবাই একমত হতে বাধ্য যে নিঃসন্দেহে উপরোক্ত মতামতটি সঠিক নয়।আল্লাহ্‌র নবীগণ কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। বরং তাঁরা ছিলেন সত্যবাদী ও সত্যের প্রতিভু। কোন ধরণের অতিরঞ্জন ছাড়াই তাঁরা তাদের অনুভুতি ও উপলব্ধির কথা প্রকাশ করতেন। যা তাঁরা বলতেন, তাই তাঁরা করতেন। ‘ওহী’ প্রাপ্তির যে দাবীটি তাঁরা করতেন, তা ছিল এক রহস্যাবৃত বিশেষ উপলব্ধি, যা অদৃশ্য সহযোগীতায় তাঁদের সাথে যুক্ত হত। এভাবে তাঁরা বিশ্বাসগত ব্যবাহারিক কাজের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতেন। উপরের আলোচনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, নবুয়তের দাবী মেনে নেয়ার জন্য যথেষ্ট যুক্তি ও দলিল প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে। নবীদের আনীত ঐশীবিধান (শরীয়ত) বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রজ্ঞার অনুকুলে হওয়াই নবুয়তের সত্যতা প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট নয়। কারণ নবুয়তের দাবীদার নবী রাসুলগণ নিজেদের আনীত ঐশীবিধানের (শরীয়ত) সত্যতা ও পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি উচ্চতর ও ঐশীজগতের সাথে নিজেদের সংযুক্ত (ওহী ও নবুয়ত) দাবী করেন। তাঁরা দাবী করেন যে, মানুষকে সৎপথের দিকে আহ্‌বান করার জন্যে তাঁরা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত। আর এই দাবী অবশ্যই তার সত্যতা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে। আর একারণে প্রতি যুগেই (যেমনটি পবিত্র কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে) মানুষ তাদের সাধারণ বুদ্ধির উপর ভিত্তি করেই নবুয়তের দাবীর সত্যতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে এর দাবীকারীদের কাছে নবুয়তের প্রমাণ স্বরূপ বিশেষ অলৌকিক ঘটনা (মু’জিযা) প্রদর্শনের দাবী জানিয়েছে। আর মানুষের এই সহজ সাধারণ বুদ্ধিপ্রসূত যুক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, নবুয়তের দাবীদার ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য অবশ্যই অন্য সকল সাধারণ মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই বিশেষ পদের জন্যে এমন বিশেষ এক অদৃশ্য ক্ষমতা থাকা অপরিহার্য, যা মহান আল্লাহ্‌‌ অলৌকিক ভাবে একমাত্র তাঁর নবীগণকেই দান করেন। আল্লাহ্‌‌ প্রদত্ত ঐ বিশেষ ক্ষমতা বলে নবীগণ আল্লাহ্‌র বাণী প্রাপ্ত হন এবং দায়িত্ব স্বরূপ জনগণের কাছে তা পৌঁছে দেন। তাই তাদের দাবী যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে, তাদের ঐ দাবীর সত্যতা প্রমাণ স্বরূপ আল্লাহ্‌র কাছে অলৌকিক কোন কান্ড প্রদর্শনের আবেদন জানানো উচিত, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তাঁদের দাবীর সত্যতা বিশ্বাস করতে পারে। এ বিষয়টি পরিস্কার যে যুক্তি ও বুদ্ধির দৃষ্টিতে নবীদের কাছে তাঁদের নবুয়তের দাবীর সত্যতা প্রমাণ স্বরূপ অলৌকিক কোন কান্ড (মু’যিজা) প্রদর্শনের দাবী নিঃসন্দেহে অত্যন্ত যৌক্তিকতাপূর্ণ একটি ব্যাপার। তাই নবীদেরকে তাঁদের সত্যতার প্রমাণের উদ্দেশ্যে প্রথমেই জনগণের দাবী অনুযায়ী অলৌকিক ঘটনা (মু’যিজা) প্রদর্শন করা উচিত। এমনকি পবিত্র কুরআনও এই যুক্তিকে জোরালো ভাবে সর্মথন করেছে। তাই পবিত্র কুরআনেও নবীদের ইতিহাস বর্ণনা ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তাঁরা তাঁদের নবুয়ত প্রমাণের স্বার্থে প্রথমেই অথবা জনগণের দাবী অনুযায়ী অলৌকিক কান্ড (মু’যিজা) প্রদর্শন করেছেন। অবশ্য অনেক খুঁতখুঁতে লোকই নবীদের ঐসব অলৌকিক কান্ডের (মু’যিজা) অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে। কিন্তু তাদের ঐ অস্বীকৃতির পেছনে শক্তিশালী কোন যুক্তি তারা দাঁড় করাতে সক্ষম হয়নি। কোন ঘটনার জন্যে আজ পর্যন্ত যেসব কারণ সাধারণতঃ অনুভবযোগ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, সেগুলোর চিরন্তন ও স্থায়ী হবার পেছনে কোন দলিল বা যুক্তিই নেই। আর কোন ঘটনাই তার নিজস্ব ও স্বাভাবিক শর্ত ও কারণ সমূহ পূর্ণ হওয়া ব্যতীত বাস্তবায়িত হয় না। যেসব অলৌকিক কান্ড আল্লাহ্‌র নবীদের সাথে সম্পর্কিত, তা প্রকৃত অর্থে “মৌলিকভাবে অসম্ভব” এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রজ্ঞা বিরোধী (যেমন, জোড় সংখ্যা বিজোড় সংখ্যায় রূপান্তরিত হওয়া যা অসম্ভব) ব্যাপার নয় বরং তা ছিল অস্বাভাবিক ব্যাপার, যেমনটি বহু সাধু পুরুষের ক্ষেত্রেই অতীতে দেখা ও শোনা গিয়েছে।

আল্লাহ্‌র নবীদের সংখ্যা

ইতিহাসের সাক্ষ্যানুসারে আল্লাহ্‌র অসংখ্য নবীই এ পৃথিবীতে এসেছেন। পবিত্র কুরআনও এ বিষয়েরই সাক্ষী দেয়। যাদের মধ্যে অনেকের নাম ও ইতিহাসই পবিত্র কুরআন উল্লেখ করেছে। আবার তাঁদের অনেকের নামই পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়নি।কিন্তু নবীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সঠিক তথ্য কারো কাছেই নেই। এ ব্যাপারে হযরত আবুজার গাফ্‌ফারী (রা.) বর্ণিত রাসুল (সা.)-এর এ সংক্রান্ত হাদীসই আমাদের একমাত্র সম্বল। ঐ হাদীসের তথ্য অনুসারে নবীদের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার।

শরীয়ত প্রবর্তক ‘উলুল আযম’ নবীগণ

পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুসারে প্রত্যেক নবীই শরীয়তের (ইসলামী আইন শাস্ত্র) অধিকরী ছিলেন না। নবীদের মধ্যে শুধুমাত্র পাঁচজনই ছিলেন ‘শরীয়ত’ প্রবর্তক। যারা হচ্ছেন ঃ হযরত নুহ্‌ (আ.), হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)। অন্যান্য নবীগণ এসব ‘উলুল আয্‌ম’ নবীদের আনীত শরীয়তের অনুসারী ছিলেন।মহান আল্লাহ্‌‌ পবিত্র কুরআনে বলেন ঃ “তিনি তোমাদের জন্যে দীনকে বিধিবদ্ধ করেছেন, যার নির্দেশ দিয়ে ছিলেন তিনি নুহ্‌কে-আর যা আমি ‘ওহী’ (প্রত্যাদেশ) করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়ে ছিলাম ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসাকে।” (সুরা আশ্‌ শুরা, ১২ নং আয়াত।) মহান আল্লাহ্‌‌ আরো বলেন যে, “স্মরণ কর, যখন আমি অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম নবীদের নিকট হতে, তোমার নিকট হতে, এবং ইব্রাহীম, মুসা ও মার্‌য়াম তনয় ঈসার নিকট হতে, আর তাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিলাম সুদৃঢ় অঙ্গীকার।” (সুরা আল্‌ আহযাব, ৭ নং আয়াত।)

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই সর্বশেষ নবী। পবিত্র কুরআন তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং তিনিই ‘শরীয়ত’ প্রবর্তক। বিশ্বের সকল মুসলমানই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরী চন্দ্র বর্ষ শুরু হওয়ার প্রায় তিপ্পান্ন বছর পূর্বে পবিত্র মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশের বনি হাশেম গোত্রে (সম্মানিত বংশ হিসেবে খ্যাত) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল আব্দুলাহ্‌ এবং মা’য়ের নাম ছিল আমিনা। শৈশবের প্রাক্কালেই তিনি তাঁর বাবা ও মাকে হারান। এরপর তাঁর দাদা জনাব আব্দুল মুত্তালিব তাঁর অভিভাবক হন। কিন্তু এর অল্প ক’দিন পর তাঁর স্নেহময় দাদাও পরলোক গমন করেন। তারপর তাঁর চাচা জনাব আবু তালিব দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন এবং নিজের ঘরে তাঁকে নিয়ে যান। তারপর থেকে মহানবী চাচার বাড়ীতেই মানুষ হতে লাগলেন। মহানবী (সা.) সাবালকত্ব প্রাপ্তির পূর্বেই চাচার সাথে ব্যবসায়িক সফরে দামেষ্ক গিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) কারো কাছেই লেখাপড়া শেখেননি। কিন্তু সাবালক হওয়ার পর থেকেই তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞ, ভদ্র এবং বিশ্বস্ত হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর এই বিজ্ঞতা ও বিশ্বস্ততার কারণেই মক্কার জনৈকা বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী মহিলা তাঁকে তার ব্যবসা পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব অর্পন করেন। ঐ ব্যবসার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) আবারও দামেস্ক ভ্রমণ করেন। ঐ ব্যবসায়িক ভ্রমণে নিজের অতুলনীয় যোগ্যতার কারণে মহানবী (সা.) সেবার প্রচুর পরিমাণে লাভবান হন। মহানবী (সা.)-এর ঐ অতুলনীয় যোগ্যতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এর অল্প ক’দিন পরই মক্কার ঐ বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী মহিলা তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মহানবী (সা.)-ও ঐ প্রস্তাব মেনে নেন। অতঃপর মহানবী (সা.)-এর সাথে ঐ ভদ্র মহিলার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় মহানবী (সা.)-এর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। বিয়ের পর চলিশ বছর বয়সে পৌঁছা পর্যন্ত এভাবেই মহানবী (সা.) তাঁর দাম্পত্য জীবন কাটান। এসময় অসাধরণ বিজ্ঞতা ও বিশ্বস্ততার জন্যে জনগণের মধ্যে তিনি ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু কখনোই তিনি মূর্তি পুজা করেননি। অথচ মূর্তিপুজোই ছিল সে যুগের আরবদের ধর্ম। তিনি প্রায়ই নির্জনে গিয়ে সর্বস্রষ্টা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা ও ধ্যান করতেন। এভাবে একবার যখন তিনি মক্কার নিকটবর্তী ‘তাহামা’ পাহাড়ের ‘হেরা’ গুহায় বসে নির্জনে মহান আল্লাহ্‌র ধ্যানে গভীরভাবে নিমগ্ন ছিলেন। তখনই আল্লাহ্‌‌ তাঁকে নবী হিসেবে র্নিবাচন করেন এবং ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেন। পবিত্র কুরআনের সর্ব প্রথম সুরাটি (সুরা আলাক) তখনই তাঁর প্রতি অবর্তীণ হয়। এ ঘটনার পর তিনি নিজ বাড়ীতে ফিরে যান। বাড়ী ফেরার পথে স্বীয় চাচতো ভাই হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। তিনি সব কিছু তাঁকে খুলে বলেন। হযরত আলী (আ.) সাথে সাথেই তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর বাড়ীতে ফিরে স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.)-কেও সব কিছু খুলে বলেন এবং হযরত খাদিজা (রা.)-ও সাথে সাথেই নবী হিসেবে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন। মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম যখন জনগণকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে আহ্‌বান জানান, তখন তিনি অত্যন্ত কষ্টকর ও বেদনাদায়ক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। যারফলে বাধ্য হয়ে বেশ কিছু দিন যাবৎ তিনি গোপনে ইসলাম প্রচারের কাজ চালিয়ে যান। পুনরায় তিনি নিজ আত্মীয়স্বজনের কাছে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। কিন্তু তাঁর ঐ প্রচেষ্টা সফল হয়নি। আত্মীয়দের মধ্যে হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ছাড়া আর কেউই ইসলাম গ্রহণ করেনি। (অবশ্য নির্ভরযোগ্য শীয়া সুত্র অনুযায়ী যেমনটি পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, তিনি পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি মহানবী (সা.) এর একমাত্র সহযোগী ছিলেন, তাই ইসলাম জনসমক্ষে শক্তিশালী রূপধারণ করা পর্যন্ত কুরাইশদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে জনগণের কাছে নিজের ঈমানের বিষয়টি গোপন রেখে ছিলেন।) গোপনে ইসলাম প্রচারের কিছুদিন পরই আল্লাহ্‌র নির্দেশে মহানবী (সা.) প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং তার বাস্তবায়ন শুরু করেন। আর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের সাথেসাথেই এর কঠিন ও বেদনাদায়ক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। মহানবী (সা.) ও নবমুসলিমদের প্রতি মক্কাবাসীদের সমস্ত ধরণের অত্যাচার শুরু হয়। এমনকি মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু মুসলমান তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগ করে ‘আবিসিনিয়ায়’ (ইথিওপিয়া) গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর মহানবী (সা.) তাঁর প্রিয় চাচা হযরত আবু তালিব এবং বনি হাশিম গোত্রের আত্মীয়বর্গসহ মক্কার উপকন্ঠে ‘শি’বে আবি তালিব’ নামক এক পাহাড়ী উপত্যকায় দীর্ঘ তিনটি বছর বন্দী জীবনের কষ্ট ও র্দূভোগ সহ্য করেন। মক্কাবাসীরা সব ধরণের লেনদেন ও মেলামেশা ত্যাগ করে এবং একই সাথে মহানবী (সা.) ও তার সমর্থকদেরকে সম্পূর্ণ রূপে এক ঘরে করে রাখে। ঐ অবস্থা থেকে মহানবী (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের বেরিয়ে আসার সুযোগও ছিল না। মক্কার মূর্তিপুজারীরা অত্যাচার অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা সহ মহানবী (সা.)-এর উপর যে কোন ধরণের চাপ প্রয়োগেই কুন্ঠিত হয়নি। তথাপি মহানবী (সা.) কে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে কুরাইশরা নম্রতার পথও বেছে নেয়। তারা মহানবী (সা.)-কে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও মক্কার নেতৃত্ব পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কাফেরদের এধরণের হুমকি ও অর্থ লোভ প্রদর্শন, দু’টোই ছিল বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে সমান। তাই হুমকি ও লোভ দেখিয়ে তারা বিশ্বনবী (সা.)-এর মহতী লক্ষ্য ও পবিত্র প্রতিজ্ঞাকে অধিকতর দৃঢ় করা ছাড়া আর কিছুই করতে সক্ষম হয়নি। একবার কুরাইশরা বিশ্বনবী (সা.)-কে যখন বিপুল অংকের অর্থ এবং মক্কার নেতৃত্ব পদগ্রহণের প্রস্তাব দেয়। মহানবী (সা.) তার প্রত্যুত্তরে বলেনঃ তোমরা যদি সূর্যকে আমার ডান হাতে আর চাঁদকে আমার বাম হাতে এনে দাও, তবুও এক আল্লাহ্‌র আনুগত্য ও তাঁর প্রদত্ত দায়িত্ব পালন থেকে কখনোই বিরত হব না। নবুয়ত প্রাপ্তির পর দশম বছরে ‘শি’বে আলী ইবনে আবি তালিবে’র বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরই তাঁকে সাহায্যকারী একমাত্র চাচাও (হযরত আলী ইবনে আবি তালিব) পরকাল গমন করেন। এ ঘটনার কিছুদিন পরই তাঁর একমাত্র জীবনসংঙ্গিনী হযরত খাদিজা (রা.)ও পরলোক গমন করেন। অতঃপর বাহ্যত: মহানবী (সা.)-এর আশ্রয়ের আর কোন স্থান অবশিষ্ট রইল না। সুযোগ বুঝে মক্কার মূর্তি উপাসক কাফেররা গোপনে মহানবী (সা.)-কে হত্যার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র আঁটে। তাদের পূর্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কোন একরাতে মহানবীর বাড়ী ঘেরাও করে এবং শেষরাতে তারা মহানবী (সা.)-এর বাড়ী আক্রমণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (সা.)-কে শায়িত অবস্থাতেই তাঁর বিছানায় টুকরা টুকরা করে ফেলা। কিন্তু ঐ ঘটনা ঘটার পূর্বেই মহান আল্লাহ্‌‌ তাঁর প্রিয় নবী (সা.)-কে ঐ চক্রান্ত সম্পর্কে সম্পূর্ণ রূপে অবহিত করেন এবং মদীনা গমনের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী মহানবী (সা.)-ও তাঁর বিছানায় হযরত আলী (আ.)-কে শুইয়ে রেখে রাতের আঁধারে আল্লাহ্‌‌ প্রদত্ত বিশেষ নিরাপত্তার মাধ্যমে শত্রুদলের মাঝ দিয়ে ‘ইয়াস্‌রেবের’ (মদীনা) পথে পাড়ি দেন। মহানবী (সা.) বাড়ী থেকে বেরিয়ে বেশ ক’মাইল পার হবার পর মক্কার বাইরে এক পাহাড়ী গুহায় আশ্রয় নেন। এদিকে মক্কার কাফের শত্রুরা একটানা তিনদিন যাবৎ ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পরও মহানবী (সা.)-কে না পেয়ে নিরাশ হয়ে বাড়ী ফিরে যায়। শত্রুরা ফিরে যাওয়ার পরই মহানবী (সা.) ঐ গুহা থেকে বের হয়ে পুনরায় মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। মদীনাবাসীরা ইতিপূর্বেই মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর হাতে ‘বায়াত’ (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেছিল। তারা অতিশয় আন্তরিক সংবর্ধনার মাধ্যমে মহানবী (সা.)-কে স্বাগত জানায়। তারা তাদের প্রাণ ও অর্থ সম্পদ সহ সম্পূর্ণ রূপে মহানবী (সা.)-এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বনবী (সা.) তাঁর জীবনে এই প্রথমবারের মত মদীনায় ছোট্ট একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামী সমাজ গঠনের পাশাপাশি ইয়াসরেব (মদীনা) ও তার আশেপাশে বসবাসরত ইহুদী ও অন্যান্য শক্তিশালী আরব গোত্রদের সাথে চুক্তি সাক্ষর করেন। অতঃপর তিনি ইসলাম প্রচারের কর্মসুচী বাস্তবায়নে প্রবৃত্ত হন। রাসুল (সা.)-এর ইয়াসরেবে আগমনের পর থেকে ইয়াসরেব নগরী ‘মদীনাতুর্‌ রাসুল (সা.)’ (রাসুলের শহর) তথা মদীনা হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। যার ফলে ইসলাম ক্রমেই বিস্তৃতি ও উন্নতি লাভ করতে থাকে। ওদিকে কাফেদের অত্যাচারে জর্জরিত মক্কার মুসলমানরাও একের পর এক বাপদাদার ভিটেমাটি ত্যাগ করে মদীনায় পাড়ি দিতে লাগল। এভাবে অগ্নিমুখ পতঙ্গের মত মুসলমানরা ক্রমেই বিশ্বনবী (সা.)-এর চারপাশে ভীড় জমাতে থাকল। দেশ ত্যাগকারী মক্কার এসব মুসলনরাই ইতিহাসে মুহাজির হিসাবে পরিচিত। আর মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদেরকে সাহায্য করার কারণে মদীনাবাসী মুসলমানরাও ইতিহাসে ‘আনসার’ (সাহায্যকারী) নামে খ্যাতি লাভ করে। এভাবে ইসলাম তার সর্বোচ্চ গতিতে উন্নতি লাভ করতে থাকে। কিন্তু এতদসত্তেও মক্কার মূর্তি পুজারী কুরাইশ এবং আরবের ইহুদী গোত্রগুলো মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন ধরণের বিশ্বাস ঘাতকতামূলক কার্য-কলাপ চালিয়ে যেতে কোন প্রকারের দ্বিধাবোধ করেনি। এর পাশাপাশি ওদিকে মুসলমানদের মধ্যে গাঢাকা দিয়ে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় মুসলমান নামধারী মুনাফিকরা ঐসব ইহুদী ও কাফেরদের সহযোগীতায় প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরণের জটিল সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকল। অবশেষে ঐসব সমস্যা একসময় যুদ্ধ-বিগ্রহে পর্যবসিত হয়। যার ফলে মূর্তি পুজারী কাফের ও ইহুদীদের সাথে ইসলামের অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলামী বাহিনী বিজয়ী ভূমিকা লাভ করে। মহানবী (সা.)-এর জীবনে ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ টিরও বেশী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার মধ্যে বদর, ওহুদ, খন্দক ও খাইবারের মত বড় বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর সবগুলোতেই বিশ্বনবী (সা.) স্বয়ং নিজেই অংশ গ্রহণ করেন। ইসলামের সকল বড় বড় এবং বেশ কিছু ছোট যুদ্ধে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সেনাপতিত্বেই বিজয় অর্জিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি কখনোই যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করেননি। হিজরতের পরে অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর মদীনা গমনের পরের দশ বছরে সংঘটিত ঐসব যুদ্ধে সর্বমোট প্রায় দু’শত মুসলমান এবং প্রায় এক হাজার কাফের নিহত হয়। বিশ্বনবী (সা.)-এর অক্লান্ত কর্ম প্রচেষ্টা এবং মুহাজির ও আনসার মুসলমানদের আত্মত্যাগের ফলে হিজরত পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে ইসলাম সমগ্র আরবের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পারস্য, রোম, মিশর ও ইথিওপিয়ার সম্রাটদের কাছেও ইসলাম গ্রহণের আহ্‌বান জানিয়ে বিশ্ব নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র পাঠানো হয়। বিশ্বনবী (সা.) আজীবন দরিদ্রদের মধ্যে তাদের মতই জীবনযাপন করেন। তিনি আপন দারিদ্রের জন্যে গর্ববোধ করতেন। তিনি জীবনে কখনোই সময় নষ্ট করেননি। বরং তিনি তাঁর সময়কে মোট তিন অংশে ভাগ করতেন। একাংশ শুধুমাত্র মহান আল্লাহ্‌র জন্যে। অর্থাৎ, আল্লাহ্‌র ইবাদত ও তাঁর স্মরণের জন্যে নির্ধারিত রাখতেন।আর একাংশ তিনি নিজের ও পরিবারবর্গের প্রয়োজন মেটানো জন্যে ব্যয় করতেন। আর বাকী অংশ জনগণের জন্যে ব্যয় করতেন। সময়ের এই তৃতীয় অংশকে বিশ্বনবী (সা.) ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা ও তার প্রচার, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজ সংস্কার, মুসলমানদের প্রয়োজন মেটানো, রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বৈদেশিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ সহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় করতেন। বিশ্ব নবী (সা.) পবিত্র মদীনা নগরীতে দশ বছর অবস্থানের পর জনৈকা ইহুদী মহিলার বিষ মিশানো খাদ্য গ্রহণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর বেশ ক’দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে তিনি পরলোক গমন করেন।যেমনটি হাদীসে পাওয়া গেছে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্বে বিশ্ব নবী (সা.) ক্রীতদাস ও নারী জাতির সাথে সর্বোত্তম আচরণ করার জন্যে সমগ্র মুসলিম উম্মার প্রতি বিশেষভাবে ‘ওসিয়ত’ করে গেছেন।

মহানবী (সা.) ও পবিত্র কুরআন

অন্যান্য নবীদের মত বিশ্ব নবী (সা.)-এর কাছেও নবুয়তের প্রমাণ স্বরূপ মু’জিযা বা অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শনের দাবী জানানো হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা.) নিজেও তার পূর্বতন নবীদের মু’জিযা আালৌকিক নিদর্শনের অস্তিত্বের বিষয়টি সর্মথন করেন। যে বিষয়টি পবিত্র কুরআনেও অত্যন্ত সুস্প ষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বনবী (সা.)-এর দ্বারা প্রদর্শিত এধরণের মু’জিযা বা অলৌকিক নির্দশনের ঘটনার অসংখ্য তথ্যই আমাদের কাছে রয়েছে। ঐ সকল লিপিবদ্ধ ঘটনার অনেকগুলোই নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত। বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রদর্শিত অলৌকিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে নিদর্শনটি আজও জীবন্ত হয়ে আছে, তা হচ্ছে ঐশীগ্রন্থ ‘পবিত্র কুরআন’। এই পবিত্র ঐশী গ্রন্থে ছোট বড় মোট ১১৪ টি সুরা রয়েছে। যা মোট ৩০টি অংশে বিভক্ত। বিশ্বনবী (সা.) এর ২৩ বছর যাবৎ নবুয়তী জীবনে ইসলাম প্রচারকালীন সময়ে ধীরে ধীরে সমগ্র কুরআন অবর্তীণ হয়। একটি আয়াতের অংশবিশেষ থেকে শুরু করে কখনও বা পূর্ণ একটি সুরাও একেকবারেই অবর্তীণ হত। অবস্থানরত অবস্থায় বা ভ্রমণ কালে, যুদ্ধ অবস্থায় বা সন্ধিকালে, র্দূযোগপূর্ণ কঠিন দিনগুলোতে বা শান্তিপূর্ণ সময়ে এবং দিন ও রাতে যে কোন সময়েই ঐ পবিত্র ঐশীবাণী বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে অবর্তীণ হত। পবিত্র কুরআন তার আয়াতের মাধ্যমে অত্যন্ত স্পষ্ট ও সুদৃঢ় ভাষায় নিজেকে এক মু’জিযা বা অলৌকিক নির্দশন হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুসারে, পবিত্র কুরআন অবর্তীণের যুগে আরবরা ভাষাগত উৎকর্ষতার দিক থেকে উন্নতির চরম শীর্ষে আরোহণ করেছিল। শুদ্ধ, সুমিষ্ট, আর্কষণীয় ও সাবলীল ভাষা ও বক্তব্যের অধিকারী হিসেবে তারা খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছিল। পবিত্র কুরআন ঐক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দিতায় নামার জন্যে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করে। পবিত্র কুরআন তাদেরকে আহ্‌বান করে বলেছে, তোমরা কি মনে কর যে, কুরআনের বাণী মানুষের বক্তব্য এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই তা রচনা করেছেন? অথবা কারও কাছে তিনি তা শিখেছেন? তাহলে তোমরাও পবিত্র কুরআনের মতই একটি কুরআন [মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ “তারা যদি সত্যবাদী হয়, তাহলে তার (কুরআনের) সদৃশ কোন রচনা উপস্থাপন করুক না!” (-সুরা আত্‌ তুর, ৩৪ নং আয়াত।)]বা এর যেকোন দশটি সুরা [মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেনঃ “আর মানুষ কি বলে যে, এটি বানিয়ে এনেছ? বলে দাও! তোমরা নিয়ে এসো (-কুরআনের সুরার মতই) একটিই সুরা। (-সুরা আল্‌ ইউনুস, ৩৮ নং আয়াত।) “তারা কি এটা বলে, ‘সে এটা (কুরআন) নিজে রচনা করেছে? বল, ‘তোমরা যদি সত্যবাদীই হও তোমরা এর অনুরূপ দশটি স্বরচিত সুরা আনায়ন কর।’ (-সুরা আল হুদ, ১৩ নং আয়াত।)] বা অন্তত:পক্ষে একটি সুরাও যদি তোমাদের পক্ষে সম্ভব হয় রচনা করে নিয়ে এসো। আর এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যেকোন ধরণের পন্থা তোমরা অবলম্বন করতে পার। [মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেনঃ “আর মানুষ কি বলে যে, এটি বানিয়ে এনেছ? বলে দাও! তোমরা নিয়ে এসো (-কুরআনের সুরার মতই) একটিই সুরা। (-সুরা আল্‌ ইউনুস, ৩৮ নং আয়াত।) “তারা কি এটা বলে, ‘সে এটা (কুরআন) নিজে রচনা করেছে? বল, ‘তোমরা যদি সত্যবাদীই হও তোমরা এর অনুরূপ দশটি স্বরচিত সুরা আনায়ন কর।’ (-সুরা আল হুদ, ১৩ নং আয়াত।)] কিন্তু সে যুগের খ্যাতিসম্পন্ন শীর্ষ স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকরা পবিত্র কুরআনের ঐ চ্যালেঞ্জের প্রত্যুত্তর দিতে ব্যর্থ হন। বরঞ্চ ঐ চ্যালেঞ্জের জবাব হিসেবে যা তারা বলেছিল, তা হলঃ “কুরআন একটি যাদুর নামান্তর সুতরাং এর সদৃশ রচনা আমাদের সাধ্যের বাইরে।” [জনৈক আরব বক্তা বর্ণনা করেছেন, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ (ওয়ালিদ অনেক চিন্তাভাবনার পর সত্যকে অবজ্ঞা করে) বলেঃ “এর পর বলেছেঃ এতো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু বৈ নয়, এতো মানুষের উক্তি নয়। (-সুরা আল্‌ মুদ্দাস্‌সির, ২৪ ও ২৫ নং আয়াত।)]এটাও লক্ষ্যণীয় যে, পবিত্র কুরআন শুধুমাত্র ভাষাগত উৎকর্ষতার ব্যাপারেই চ্যালেঞ্জ বা প্রতিদ্বন্দ্বী তার আহ্‌বান ঘোষণা করেনি, বরং এর অর্ন্তনিহিত গুঢ় অর্থের ব্যাপারেও মানুষ ও জ্বীন জাতির সামগ্রিক মেধাশক্তি খাটিয়ে প্রতিদ্বন্দীতায় অংশ গ্রহণের জন্যে চ্যালেঞ্জ করেছে।কেননা, এই পবিত্র ঐশী গ্রন্থে সমগ্র মানব জীবনের কর্মসূচী ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বর্ণিত হয়েছে। যদি অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই জীবন বিধান অত্যন্ত ব্যাপক, যা মৌলিক বিশ্বাস, আচরণ বিধি ও কাজকর্ম সহ মানব জীবনের সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে পরিবৃত করে। আর অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে এবং দক্ষতার সাথে কুরআন মানব জীবনের বিভিন্ন দিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। মহান আল্লাহ্‌‌ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই জীবন পদ্ধতিকেই একমাত্র সঠিকও সত্য ধর্ম হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। (ইসলাম এমন এক ধর্ম, যার আইন-কানুন সত্য ও প্রকৃত কল্যাণ থেকে উৎসরিত। যার আইন মানুষের খুশীমত রচিত হয়নি। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মতামতের উপর ভিত্তি করেও রচিত হয়নি। আর কোন এক শক্তিশালী শাসকের যাচ্ছেতাই সিদ্ধান্ত অনুসারে রচিত হয়নি।) শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়টিকেই বিস্তৃত ঐশী কর্মসূচীর ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আর এ বিষয়টিই হল এ কর্মসূচীর সর্বোচ্চ সম্মানিত ঐশীবাণী। ইসলামের সকল মৌলিক বিশ্বাস এবং জ্ঞানের উৎসই হচ্ছে আল্লাহ্‌র এই একত্ববাদ বা তৌহিদ। আর মানুষের সুন্দর সদাচরণও ঐ মৌলিক বিশ্বাস ও জ্ঞানের ভিত্তিতেই রচিত এবং ঐ ঐশী কর্মসূচীর অর্ন্তভূক্ত হয়েছে। এরপর মানুষের বিশ্বাসগত বা সামাজিক জীবনের কর্মসূচীর অসংখ্য সাধারণ ও বিশেষ বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় সমুহের বিশ্লেষণ এবং তদসংশ্লিষ্ট দায়িত্ব সমুহও আল্লাহ্‌র সেই একত্ববাদ বা তৌহিদের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে। ইসলামের মৌলিক ও ব্যবহারিক অংশদ্বয়ের পরস্পর সম্পর্ক এতই নিবিড় যে, যদি ব্যবহারিক অংশের অর্থাৎ আইনগত অংশের সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, তাও আল্লাহ্‌র একত্ববাদ থেকেই উৎসরিত। আর আল্লাহ্‌র একত্ববাদও ঐসব বিধান সমুহেরই সামষ্টিকরূপ। মহাবিস্তৃত ইসলামী বিধানের এই সুসজ্জিত ও সুশৃংখলিতরূপ ছাড়াও এতে নিহিত পারস্পরিক ঐক্য ও নিবিড় সম্পর্ক সত্যিই এক অলৌকিক বিষয়। এমনকি এর প্রাথমিক সূচীপত্রের বিন্যাসও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আইনবিদের স্বাভাবিক ক্ষমতার বাইরে।সুতরাং, বিশ্বাসগত ও সামাজিক জান-মালের নিরাপত্তাহীনতা জনিত সমস্যা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিশ্বাস ঘাতকতাসহ হাজারও সমস্যা সংকুল ও অশান্ত পরিবেশে জীবন যাপন করে এত স্বল্প সময়ে কারো পক্ষে এমন এক ঐশী বিধান রচনা নিঃসন্দেহে এক অসম্ভব ব্যাপার। আর বিশেষ করে সমগ্র বিশ্ববাসীর মোকাবিলায় আজীবন যাকে একই সংগ্রামে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে, এমন বিশ্বাসর পক্ষে এ ধরণের কিছু করা সত্যিই অসম্ভব। এ ছাড়া বিশ্বনবী (সা.) শুধু যে পৃথিবীর কোন শিক্ষকের কাছে শিক্ষা লাভ করেননি তাই নয়। বরং লিখতে বা পড়তেও তিনি শিখেননি। এমনকি নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ বিশ্বনবী (সা.) এর জীবনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সময়ই এমন এক জাতির মধ্যে বসবাস করেছেন, যারা সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছিল নীচু মানের। [মহান আল্লাহ্‌ তাঁর নবী (সা.)-এর ভাষায় বলনেঃ “নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে একটা বয়স অতিবাহিত করেছি, তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না? ” (-সুরা আল্‌ ইউনুস, ১৬ নং আয়াত।) মহান আল্লাহ্‌ আরও বলেছেনঃ “আপনি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করেননি এবং স্বীয় দক্ষিণহস্তে কোন কিতাব লিখেননি।” (-সুরা আনকাবুত, ৪৮ নং আয়াত।) মহান আল্লাহ্‌ বলেছেন ঃ “এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবর্তীণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সুরা রচনা করে নিয়ে এস।” (-সুরা আল বাকারা, ২৩ নং আয়াত।)

বিষয়: বিবিধ

১১২৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

257535
২৩ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৫৯
আবু সাইফ লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ- অনেক লিখেছেন

কিন্তু পোস্টের সাইজ দেখেই তো পাঠক দৌড়ে পালাবে-

এটাতো মুদ্রিত পত্রিকা নয় যে হাতে রেখে পড়বো

কাজেই কয়েক পর্বে পোস্ট দিলে সাথে সাথেই পড়া হয়ে যেতো

২৪ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:৫৭
201343
দূর্যোধন লিখেছেন : ও আচ্ছা
257550
২৪ আগস্ট ২০১৪ রাত ১২:০০
২৪ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:৫৭
201344
দূর্যোধন লিখেছেন : হুম

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File