শিক্ষার গুনগত মান নিয়ে কিছু ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন দূর্যোধন ২০ জুলাই, ২০১৪, ০১:০৩:০৯ দুপুর
আমাদের জীবনের অনেক দুঃখ বা কষ্টের মাঝেও কিছু কিছু আনন্দ মনকে বড় নাড়া দেয়। ভাবনার মধ্যে পরিবর্তন আনে। স্বপ্ন দানা বাঁধে মনে। সেই স্বপ্নের পরিমণ্ডলে যদি সন্তানদের সাফল্য নিহিত থাকে তাহলে পিতামাতার মনটা যে কি আনন্দে নেচে উঠে তা কি বলার অপেক্ষা রাখে। আজ যে শিশু কাল সেই পরিণত ও আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। সেই শিশুদের বেড়ে উঠা, চলার পথকে মসৃণ করে দেয়া, চাপমুক্ত করা যেমন মাতাপিতার একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য তেমনি তা রাষ্ট্রেরও বটে।
শিশুরা তাঁদের পাঠ্য জানতে শুরু করে অ, আ, ক, খ... বা এ, বি, সি, ডি... বা ০, ১, ২, ৩...... দিয়ে। অগ্রসর হতে থাকে তাঁরা সামনের দিকে। পরিণত হয় তাঁরা কিশোরকিশোরীতে। স্বপ্নে বিভোর হয় তাঁদের মন। মনমানসের রঙ্গিন সেলগুলোতে তাই তাঁরা লালন করতে থাকে নিজেদেরকে আকাশের এক একটি জলন্ত নক্ষত্ররুপে অথবা ডানামেলা এক একটি উড়ন্ত পাখী হিসাবে। ধীরে ধীরে জানতে শেখে তাঁরা ভূগোলকে, বিশ্বকে, মহাবিজ্ঞানি আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটিকে বা নিউটনের মহাকর্ষীয় বা আর্কিমিডিস প্রিন্সিপলের মতো বিজ্ঞানের জটিল জটিল সুত্রকে অথবা গ্রেগর জোহান মেন্দেলের বেসিক প্রিন্সিপলস অফ জেনেটিক্সকে। এই জানাগুলোর মধ্যবর্তী সময়ে স্তরে স্তরে তাঁদেরকে শিক্ষার কিছু ফিটনেস টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতেই হয়। যে টেস্টগুলোকে আমরা বিভিন্ন নাম দিয়ে সনাক্ত করি যেমন জেএসসি বা এসএসসি বা এইচএসসি বা সমমানের স্তরগুলো। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধ তো রয়েছেই। এগুলোর প্রতিটি স্তর শিক্ষার্থীদের জন্য এক একটি স্ট্রেস- মাতাপিতার জন্য তো বটেই। তারপরেও এগুলোকে টপকাতেই হবে। জীবনকে এগিয়ে নিতে হবে। ভাল ফলাফল যে করতে হবে- সে আশায়। এরূপ একটি টেস্টের (এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা) রেজাল্ট প্রকাশিত হল এ বছরের মে মাসের ১৭ তারিখে। দশটি শিক্ষা বোর্ডে গড়ে পাশের হার ছিল ৯১.৩৪%। শুধু জিপিএ ৫-এর সংখ্যাই ছিল লক্ষণীয় অর্থাৎ ১,৪২,২৭৬ জন। জিপিএ ৪ থেকে ৫-এর মধ্যেও রয়েছে প্রায় ৫ লাখের উপরে। ফেল করেছে কম অর্থাৎ এক লাখের কিছু বেশী। সার্বিকভাবে এতো ভাল রেজাল্ট হওয়াতে বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে মেতে উঠেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন। তাঁদের প্রাণ-উচ্ছল ও হাসিমাখা আনন্দের অংশীদার তাঁদের পরমপ্রিয় শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ, অভিভাবক বা মাতা-পিতা, বন্ধু বা পড়ার সাথীরা ও পরিবারের আপনজনরা। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও যথোপযুক্ত শিক্ষা ও পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে দেশ গড়ার হাতিয়ার হিসাবে যেমন তৈরি করেছেন- স্বপ্ন দেখিয়েছেন -যাদের অবদান কখনোয় তুলনীয় হয়না, তেমনি অনেক মাতাপিতা কষ্টের শেষ আয়টুকু অন্তর থেকে উজার করে দিয়েছেন সন্তানের মঙ্গল কামনায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের আশায়। অনেক সময় ক্লাসমেট বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে বিজ্ঞান, গণিত বা তাঁদের পড়ালেখার অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধানও খুঁজে পান। আপনজনদের অক্রতিম ভালবাসা ও অনুপ্রেরণার কি কোনো তুলনা চলে? তাঁদের কারো কারো উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা আজকের এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনেকেরই সাফল্যের চাবিকাঠি। তাই এই আকাশচুম্বী সাফল্যে সমন্নিতভাবে সবার অবদান-ই অনস্বীকার্য। বাঁধভাঙ্গা উল্লাস ও উষ্ণ অভিনন্দনে সিক্ত যেমন উত্তীর্ণরা, তেমনি সেই আনন্দের সমান অংশীদার তাঁদের পরিমণ্ডলের এই মানুষগুলিরও- যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় আজকের এই অর্জিত সাফল্য। তাই প্রাণঢালা উষ্ণ অভিনন্দন জানাই তাঁদের সকলকে।
শিক্ষার্থীদের এই অভাবনীয় সাফল্যের পিছনের মূল রহস্য বা কারণগুলো কি কি হতে পারে? তা খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নেরও উদ্রেক হয়েছে অনেক সচেতন মানুষের মনে। যেমন ১. ছাত্ররা কি তাঁদের অধ্যবসায়ে আগের তুলনায় অনেক বেশী সচেতন ও মনযোগী ছিল এবার? ২. সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য আয়ত্ত করতে কি সহজতর হয়েছে? ৩. তুলনামূলক সহজ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে কি শিক্ষার্থীরা? ৪. উদারতার সঙ্গে কি মূল্যায়ন করা হয়েছে তাঁদের পরীক্ষার খাতাগুলো? ৫. জেএসসি ফ্যাক্টর কি এই অভাবনীয় পাশের হার বৃদ্ধির জন্য মূল সহায়ক ছিল? কারণ যারা এবার পাশ করেছে তাঁরা ইতিমধ্যেই অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। জেএসসিতে অনুত্তীর্ণরা নবম শ্রেণীতে পড়ার সুযোগ পায় না। তাই জেএসসি পরীক্ষাটিও ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরণের স্ক্রিনিং টেস্ট বা ছাঁকুনি যা মাধ্যমিক পর্যায়ের এই সাফল্যের কারণ হতে পারে। ৬. এছাড়া শিক্ষার্থীদেরকে উন্নতমানের পাঠদানের জন্য এবং গ্রেডিং ও সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি সম্পর্কে গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষকবৃন্দের প্রশিক্ষণের মান কি আরো উন্নততর হয়েছে? ৭. পিতামাতা বা অভিভাবকদের মধ্যে আগের তুলনায় কি আরো বেশী দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে? ৮. ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে অভিযোগটি রয়েছে তা কি এই ফলাফলকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে? ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। কিন্তু মূল যে প্রশ্নটি থেকেই যায়- তা হচ্ছে ফলাফলের এই আকাশচুম্বী সাফল্যের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মানের কতটুকু উন্নতি ঘটেছে? এবং শিক্ষার মানের উন্নতি নির্ণয়ের জন্য মাপকাঠিই বা কি কি হতে পারে? এসব প্রশ্ন হয়তো প্রশ্নই থেকে যাবে অথবা করতিপক্ষ ভেবে দেখবে এগুলো।
আমরা বরং আর একটু সামনে বা গভীরে গিয়ে সংকটকে ভেবে দেখি। যেমন যারা উত্তীর্ণ হল এবারের পরীক্ষায় এই ডানামেলা উড়ন্ত পাখীরা তাঁদের সাফল্যের এই ধারাকে কমপক্ষে আরো দুবছর পর্যন্ত ধরে রাখার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষা পর্যন্ত। কারণ তাঁরা জানে যে তাঁদের সামনে আসছে মূল কম্পিটিশন অর্থাৎ আসল প্রতিযোগিতা। আর তা হচ্ছে ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে ভর্তি পরীক্ষা। সেই কম্পিটিশনে তাঁদেরকে টিকতে হবে। বড় বড় স্বপ্ন নিয়ে দেশের স্বনামধন্য কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন বুয়েট, মেডিক্যাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব টপ রেঙ্কিং (যদিও রেটিং পদ্ধতি আমাদের দেশে নেই) বিশ্ববিদ্যালয় বা টেকনিক্যাল লাইনের হাতেগোনা যে কয়েকটি ভাল কলেজ আছে, সেগুলোতে ভর্তির জন্য উপচে পড়বে তাঁরা। তাঁদের অনেকের সেই স্বপ্ন সফল হবে। কম্পিটিশনে টিকে গিয়ে নিজেদের চাহিদামাফিক বিষয়ে পড়ার সুযোগ যারা পাবে, তাঁরা আরো সাফল্য অর্জন করে সামনে এগিয়ে যাবে, পরিবার ও দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে সেই আশাবাদ ও প্রাণঢালা আশীর্বাদ তো থাকবেই তাঁদের প্রতি আমাদের।
কিন্তু আসনসংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে যারা সেই ভর্তিযুদ্ধ থেকে ছিটকে পড়বে অর্থাৎ ভাল নামীদামী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিতেই চান্স পাবেনা, তাঁদের কি হবে? যদিও এই ছিটকে পরাদের মধ্যে অনেকেই থাকবে যারা জিপিএ ৩ ও ৫ এবং এর মধ্যবর্তী অবস্থানে। তাঁদের স্বপ্ন কি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে? তাঁরা তাহলে কোথায় গিয়ে পড়ালেখা করবে? দেখা যাবে অনন্যোপায় হয়ে তাঁদের অনেকেই ছুটবে ব্যাঙয়ের ছাতার মতো গজে উঠা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে- যেগুলোর অধিকাংশই মানসম্পন্ন নয় অথচ ব্যয়বহুল। অথবা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের কলেজগুলোর দিকে- যেগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। কলেজগুলো হচ্ছে যেমন রাজশাহী কলেজ, বিএম কলেজ, ইডেন কলেজ, সরকারী আজিজুল হক কলেজ, কারমাইকেল কলেজ ইত্যাদি আরো অনেক। এক্ষেত্রেও যে বড় প্রশ্নটি রয়ে যায় তা হল- কতিপয় কলেজ ব্যতীত সেই কলেজগুলোতেই বা অনার্স লেভেলে পড়ালেখার জন্য শিক্ষার মান কতটুকু উন্নতমানের? আন্তর্জাতিকমানের কি বলা যাবে? বিশেষ করে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে যেমন রসায়ন, পদার্থ, ম্যাথ বা বায়োলজিতে? অনার্স লেভেলে পড়ানোর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক কি সব কলেজগুলোতে আছে? শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান চর্চার জন্য সুযোগ সুবিধা, একটি আদর্শ লাইব্রেরী, ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি? রিসার্চ সেমিনার বা কনফারেন্সে অংশগ্রহণের সুযোগ? আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার আর্টিকেল বা অ্যাবসট্র্যাক্ট পড়ার সুযোগ-ই বা কতটুকু রয়েছে? ইত্যাদি সাধারণ সুবিধাগুলো কি একটি অনার্স লেভেলের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাটা অতি জরুরী নয়? নইলে ভর্তিকৃৎ শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রসার বা শিক্ষার মানের উন্নয়ন-ই বা ঘটবে কি করে?
এ তো গেল শুধু জিপিএ ৪ ও ৫ এর মধ্যকার উত্তীর্ণদের সঙ্কটকাহিনী। এছাড়া জিপিএ ৩ এর নিচে যে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীরা রয়ে যায় তাদেরকেও তো সহপাঠীদের সঙ্গে কম্পিটিশনের মাধ্যমে খুঁজে নিতে হবে তাঁদের অবস্থান ও কলেজে পড়ার সুযোগ। তাঁদের অনেকেই হয়তো কাংখিত বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না। শেষ পর্যন্ত পাসকোর্সে (ডিগ্রি) ভর্তি হতেই হবে। এটাই হয়তো বাস্তবতা।
পরিশেষে বলব যে, উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে না তাঁদেরকে কি আমরা সিমপ্লি খারাপ ছাত্রের উপাধি দিয়ে আমাদের দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারি? সেটা হবে বরং অমানবিকতার শামিল। ভাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে সীমিত আসনসংখ্যা বা আবাসিক অপ্রতুলতার কারণে এমনিতেই তাঁরা ছিটকে পড়ে এবং অল্পবয়সে তাঁদের মনমানসিকতার উপরে তা যথেষ্ট চাপ বা প্রভাব ফেলে বৈ কি! পরে দেখা যায় যা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অশান্তিও ডেকে আনে। তাই এই ছিটকে পড়া শিক্ষার্থীরা যে প্রতিষ্ঠানে যে বিষয়েই পড়ালেখা করুক না কেন- হউক সেটা অনার্স বা পাসকোর্স- সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুণগত বা মানসম্পন্ন শিক্ষাগ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। মানসম্পন্ন শিক্ষাগ্রহণের ফলে একজন শিক্ষার্থী তাঁর নিজের উপরে অসামান্য কনফিডেন্স লেভেল বাড়াতে পারে। যে আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে সে তাঁর প্রফেশনাল ক্যারিয়ার যেমন সুন্দরভাবে সাজাতে পারে, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও মর্যাদার সহিত প্রতিষ্ঠা পেতে পারে সে।
বিষয়: বিবিধ
১৩০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন