"ইমামাতের ইতিহাস ও বিস্তারিত বর্ণনা:সত্য চিনার দায়িত্ব আপনার"
লিখেছেন লিখেছেন শিআনে আলী আলাইহিস সালাম ২৩ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:১৪:২৮ সন্ধ্যা
আমাদের দৃশ্যমান এ সৃষ্টি জগত অন্তহীন আয়ূর অধিকারী নয়। একদিন অবশ্যই এ সৃষ্টি জগতের আয়ু নিঃশেষ হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনেরও এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ্ বলেছেন: “নভোমন্ডল, ভূ-মন্ডল ও উভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু আমি যথাযথ ভাবেই এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্যেই সৃষ্টি করেছি। আর কাফেররা যে বিষয়ে তাদেরকে সর্তক করা হয়েছে, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ” (সুরা আহ্ক্বাফ্ আয়াত নং ৩)
উপরোক্ত সুনির্দিষ্ট ও সীমিত সময় সীমার কথা উলে-খ করা হয়েছে। কিন্তু এ পৃথিবী ও মানব জাতির বর্তমান প্রজন্ম সৃষ্টির পুর্বে অন্য কোন পৃথিবী বা প্রজন্ম সৃষ্টি করা হয়ে ছিল কি? এ বিশ্ব এবং মানব জাতির ধবংস প্রাপ্তির পর (যেমনটি কুরআনে উলে-খ করা হয়েছে) পুণরায় অন্য কোন মানব বিশ্ব সৃষ্টি হবে কি? সামান্য কিছু ইঙ্গিত ছাড়া এ সব প্রশ্নের সরাসরি ও সুস্পষ্ট কোন উত্তর পবিত্র কুরআনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে আমাদের ইমামগণের (আ.) বর্ণীত হাদীসসমুহে এ সব প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও ইতিবাচক উত্তর দেয়া হয়েছে। (বিহারূল আনোয়ার, খন্ড-১৪, পৃ.-৭৯)
১- ইমাম শব্দের অর্থ :
‘ইমাম’ বা নেতা তাকেই বলা হয়, যে এক দল লোককে নির্দিষ্ট কোন সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, অথবা ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশ্য নেতা তার নেতৃত্বের পরিধির বিস্তৃতি ও সংকীর্ণতার ক্ষেত্রে সময় ও পরিবেশগত পরিস্থিতির অনুসারী পবিত্র ইসলাম ধর্ম (যেমনটি পুর্বে আলোচিত হয়েছে) মানব জীবনের সকল দিক পর্যবেক্ষণ পুর্বক তার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন করবেন।
ইসলাম মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন বিশ্লেষণ পুর্বক তার জন্যে প্রয়োজনীয় পথর্নিদেশ দান করেছে। পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে ও মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন ও তার পরিচালনার ব্যাপারেও ইসলামের হস্তক্ষেপ রয়েছে ঠিক একইভাবে মানুষের সামাজিক (পার্থিব) জীবন ও তার পরিচালনার (রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা) ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশ রয়েছে।
উপরে মানব জীবনের যে সব দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে ইসলামী নেতৃত্ব তিনভাবে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। সেই দিকগুলো হচ্ছে : ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, ইসলামী জ্ঞান ও আইন-কানুন বর্ণনা এবং আধ্যাত্মিক জীবনে নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনার দিক।
শিয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামী সমাজের জন্যে উক্ত গুরুত্বপুর্ণ তিনটি দিকের নেতৃত্ব দানের জন্যে নেতার প্রয়োজন অপরিহার্য। যিনি ইসলামী সমাজের এ তিনটি দিকের উপযুক্ত নেতৃত্ব দেবেন অবশ্যই তাকে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর দ্বারা মনোনিত হতে হবে। অবশ্য মহান আল্লাহ্র নির্দেশে বিশ্ব নবী (সা.) এই মনোনয়ন কার্য সম্পন্নও করে গেছেন।
২- ইমামত এবং ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ও মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকার :
মানুষ তার খোদা প্রদত্ত স্বভাব দিয়ে অতি সহজেই এ বিষয়টি উপলব্ধি করে যে, কোন দেশ, শহর, গ্রাম বা গোত্র এবং এমনকি গুটি কয়েক লোক সম্বলিত কোন একটি সংসারও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের চাকা সচল রাখা সম্ভব নয়। একজন নেতার ইচ্ছাই সমাজের অসংখ্য ব্যক্তির ইচ্ছার উপর প্রভুত্ব করে। এভাবে সে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নেতাহীন ঐ সমাজ ছত্র ভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য। এর এক ব্যাপক অরাজকতা ঐ সমাজকে ছেয়ে ফেলবে। সুতরাং, উক্ত যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে, সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত (সে সমাজ বৃহত্তরই হোক অথবা ক্ষুদ্রত্তরই হোক) নেতা, সমাজের অস্তিত্ব টিকে রাখার ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি যদি কখনও অস্থায়ীভাবে অথবা স্থায়ীভাবে তার পথ থেকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার ঐ অনুপস্থিত কালীন সময়ের জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োজিত করে যান। এ ধরণের দায়িত্বশীল কোন নেতা কোন মতেই এমন কাজ করতে প্রস্তুত হবেন না, যার ফলে নিজের দায়িত্বের পথ থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে নেতার অভাবে ঐ সমাজের অস্তিত্ব ধবংসোন্মুখ হয়ে পড়বে। কোন পরিবারের কর্তা ব্যক্তিও যদি কিছু দিনের জন্যে অথবা কয়েক মাসের জন্যে পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ করে দুরে কোথাও ভ্রমণে যান, তখন অবশ্যই তিনি তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে সংসার পরিচালনার জন্যে পরিবারের কাউকে (অথবা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে) দায়িত্বশীল হিসাবে নিয়োগ করে যান। কোন প্রতিষ্ঠানের পরিাচালক বা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অথবা দোকানের মালিক, যাদের অধীনে বেশ ক’জন কর্মচারী কর্মরত, তারা যদি অল্প ক’ঘন্টার জন্যেও কোন কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করেন, তাহলে অধীনস্থ কাউকে তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নিযুক্ত করে যান। আর অন্যদেরকে ঐ নব নিযুক্ত দায়িত্বশীলের আনুগত্য করার নির্দেশ দেন।
ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা খোদা প্রদত্ত মানব প্রকৃতি অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম একটি সামাজিক আদর্শ যার প্রকৃতির সাথে পরিচিত ও অপরিচিত সবার কাছেই সুস্পষ্ট। মহান আল্লাহ্ ও বিশ্ব নবী (সা.) এই আদর্শের সামাজিকতার ক্ষেত্রে যে মহান অবদান রেখেছেন, তা সবার কাছেই অনস্বীকার্য। এই ঐশী আদর্শ পৃথিবীর অন্য কোন কিছুর সাথেই তুলনা যোগ্য নয়।
মহানবী (সা.) ও ইসলামের সাথে সংশিষ্ট কোন সামাজিক বিষয়ই পরিত্যাগ করতেন না। যখনই কোন শহর বা গ্রাম মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হত, সম্ভব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বিশ্ব নবী (সা.) তাঁর পক্ষ থেকে কাউকে ঐ অঞ্চলের শাসন কর্তা ও স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠাতেন। এমনকি জিহাদ পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত সেনা বাহিনীর জন্যে প্রয়োজন বোধে (অত্যাধিক গুরুত্বের কারণে) একাধিক সেনাপতিও তিনি নিযুক্ত করতেন। এমনকি ঐতিহাসিক ‘ময়াত্তার’ যুদ্ধে বিশ্ব নবী (সা.) চারজন সেনাপতি নির্বাচন করে ছিলেন। যাতে প্রথম সেনাপতি শাহাদত বরণ করলে দিত্বীয় সেনাপতি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয় জন শাহাদত বরণ করলে তৃতীয় জন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আর এই ভাবে এ ধারা বাস্তবায়িত হবে। এর মাধ্যমেই নেতা নিয়োগের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়।
একই ভাবে বিশ্ব নবী (সা.) তাঁর স্বীয় উত্তরাধিকারের বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। প্রয়োজন বোধে স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে কখনই তিনি পিছপা হননি। যখনই তিনি প্রয়োজন বোধে মদীনার বাইরে যেতেন, তখনই তিনি কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। এমনকি যখন তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরী ত্যাগ করে ছিলেন, যখন কেউই সে সংবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিল না। তখনও মাত্র অল্প ক’দিনের জন্য স্বীয় ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ও জনগণের গচ্ছিত আমানত দ্রব্যাদি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে মক্কায় হযরত ইমাম আলীকে (আ.) নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। এ ভাবেই বিশ্ব নবী (সা.) মৃত্যুর পুর্বে স্বীয় ঋণ পরিশোধ ও ব্যক্তিগত অসমাপ্ত কার্যবলী সম্পাদনের জন্যে ইমাম আলীকে (আ.) নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেব নির্বাচিত করে ছিলেন।
তাই শিয়ারা বলে : উপরোক্ত দলিলের ভিত্তিতে এটা আদৌও কল্পনাযুক্ত নয় যে বিশ্ব নবী (সা.)-এর মৃত্যুর পুর্বে কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করে যাননি। মুসলমানদের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা এবং ইসলামী সমাজের চালিকা শক্তি নিয়ন্ত্রনের জন্যে কাউকেই মহা নবী (সা.) মনোনীত করে যাননি, এটা এক কল্পনাতীত ব্যাপার বটে। এক শ্রেণীর আইন-কানুন ও কিছু সাধারণ আচার অনুষ্ঠান, যা সমাজের অধিকাংশ জনগণের দ্বারা বাস্-বে স্বীকৃত ও সমর্থিত, তার উপর ভিত্তি করেই একটি সমাজের সৃষ্টি হয়। আর ঐ সমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল একটি প্রশসানের অস্তিত্বের উপরই নির্ভরশীল। এটা এমন কোন বিষয় নয় যে, মানব প্রকৃতির গুরুত্ব ও মুল্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে। কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেও এটা কোন অজ্ঞাত বিষয় নয় এবং এটা ভোলার বিষয়ও নয়। কারণ, ইসলামী শরীয়তের (বিধান) সুক্ষ্মাতি সুক্ষ্মতা ও বিস্তৃত একটি সন্দেহাতীত ব্যাপার। আর এ ব্যাপারটিও অনস্বীকার্য যে, বিশ্ব নবী (সা.) এ ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করতেন এবং এ পথে তিনি নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন। তাঁর ঐ আত্ম ত্যাগ, অসাধারণ চিন্তা শক্তি, প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব, সুক্ষ্ম ও সঠিক দৃষ্টি ভঙ্গী এবং সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতার (ওহী ও নবুওতের সাক্ষ্য ছাড়াও) বিষয়টি নিঃসন্দেহে বির্তকের উধের্ব। শিয়া ও সুন্নী উভয় দলেরই মত নির্বিশেষে বর্ণীত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস অনুযায়ী (‘ফিৎনা’ অধ্যায়ের হাদীস) বিশ্ব নবী (সা.) তাঁর অর্ন্তধানের পর ইসলামী সমাজ যেসব দুনীতি মুলক সমস্যায় আক্রান্ত হবে, তার ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন। ঐ সব সমস্যার মধ্যে যেসব ইসলামকে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, উমাইয়া বংশসহ আরও অন্যান্যদের খেলাফত লাভের বিষয়টি তার মধ্যে অন্যতম। কারণ, তারা ইসলামের পবিত্র আর্দশকে তাদের বিভিন্ন ধরণের অপবিত্রতা ও অরাজকতা মুলক জঘন্য কাজে ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে বিশ্ব নবী (সা.) তাঁর হাদীসে বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন। বিশ্ব নবী (সা.) তাঁর মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরের ইসলামী সমাজের খুঁটি নাটি বিষয়াদি ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভবিষ্যৎ বাণীও করে গেছেন। তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে, যিনি তাঁর পরবর্তী সুদুর ভবিষ্যতের ব্যাপারে এত সচেতন, অথচ স্বীয় মৃত্যু পরবর্তী মুহূর্তগুলোতে সংঘটিত ঘটনাবলীর ব্যাপারে আদৌ সচেতন নন?! বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরবর্তী উত্তরাধিকারের মত এত গুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি কি তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করেছেন, অথবা এটাকে গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন? এটা কেমন করে সম্ভব যে, খাওয়া-পরা, ঘুমানো এবং যৌন বিষয়াদির মত মানব জীবনের শত শত খুটি নাটি বিষয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি জারী করেছেন, অথচ ঐ ধরণের একটি অতি মুল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ রূপে নীরবতা পালন করেছেন? নিজের উত্তরাধিকারীকে তিনি মনোনীত করে যাননি? ধরে নেয়া যাক (যদিও এটা অসম্ভব এটি ধারণা) যে, মহা নবী (সা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের দায়িত্বভার মুসলমানদের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন, তাহলে এ ব্যাপারে অবশ্যই বিশ্ব নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার কথা। এ ব্যাপারে অবশ্যই জনগণের প্রতি তাঁর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা উচিত। কারণ, ইসলামী সমাজ অস্তিত্ব ও বিকাশ এবং ইসলামী নির্দশনাবলীর অস্তিত্ব এ বিষয়টির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। তাই এ ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মতকে সদা সচেতন থাকতে হবে।
অথচ এ ব্যাপারে বিশ্ব নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, যদি এমন সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্ব নবী (সা.) - এর পরে তাঁর স্থলাভিষিক্তের পদাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে এত মতভেদের সৃষ্টি হত না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, প্রথম খলিফা উসিয়তের (উইল) মাধ্যমে দ্বিতীয় খলিফার কাছে খেলাফত হন্তান্তর করে ছিলেন। দ্বিতীয় খলিফা তার মৃত্যু পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ‘খলিফা নির্বাচন কমিটি’ গঠন করে ছিলেন। ছয় সদশ্য বিশিষ্ট ঐ কমিটির প্রতিটি সদস্যই দ্বিতীয খলিফার দ্বারা মনোনীত হয়ে ছিলেন। ঐ কমিটির খলিফা নির্বাচন সংক্রান্ত মুলনীতিও তিনি নিজেই নির্ধারণ করে ছিলেন। এর ভিত্তিতেই তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর চতুর্থ খলিফা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। পঞ্চম খলিফা চতুর্থ খলিফার উসিয়তের (উইল) মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এর পর মুয়াবিয়া হযরত ইমাম হাসানকে (আ.) (পঞ্চম খলিফা) বল পুর্বক সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য করার মাধ্যমে খেলাফতের পদটি ছিনিয়ে নেয়। তারপর থেকেই খেলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। আর তখন থেকেই জিহাদ, সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ, ইসলামী দন্ড বিধি প্রয়োগ, ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনাবলী একের পর এক পর্যায় মে ইসলামী সমাজ থেকে উধাও হতে থাকে। এ ভাবে বিশ্ব নবী (সা.)-এর সারা জীবনের লালিত সাধনা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। শিয়ারা আল্লাহ্ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি এবং জ্ঞানী ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান চালায়। তারা ফিতরাত বা মানব প্রকৃতি সঞ্জীবনী ইসলামী আর্দশের মুল দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত, মহা নবী (সা.)-এর অনুসৃত সামাজিক পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং মহা নবী (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী দুঃখ জনক ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে। মহা নবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ও মুসলমানরা যেসব দুর্দশা ও জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে ছিল তারও আদ্যোপান্ত আলোচনা করে। এ ছাড়াও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইসলামী প্রশাসকদের ইসলামের ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার বিষয়টিও সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে। উক্ত গবেষণার মাধ্যমে শিয়ারা একটি সুনিশ্চিত ফলাফলে পৌঁছুতে সক্ষম হয়। আর তা হচ্ছে এই যে, বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বর্ণনার অস্তিত্ব ইসলামে বিদ্যমান। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং বিশ্ব নবী (সা.)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে, যার সত্যতা ও নির্ভর যোগ্যতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত ও সর্বজন স্বীকৃত। এ ব্যাপারে ‘বিলায়ত’ সংক্রান্ত আয়াত এবং গাদীরে খুমের হাদীস, ‘সাফিনাতুন্ নুহ’-এর হাদীস, ‘হাদীসে সাকালাইন’ ‘হাদীসে হাক্ক’ ‘হাদীসে মান্যিলাত’ নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত সংক্রান্ত হাদীসসহ আরও অসংখ্য হাদীসের কথা উলে-খযোগ্য। উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসসমুহের বক্তব্যে শিয়াদের বক্তব্যেরই সর্মথন পাওয়া যায়। অবশ্য ঐ সব হাদীসের যথেষ্ট অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এর মাধ্যমে ঐ গুলোর মুল অর্থকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
সুন্নী ও শিয়া উভয় তফসিরকারকগণই এ ব্যাপারে এক মত যে, কুরআনের উপরোক্তি আয়াতটি একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মর্যাদায়ই অবর্তীন হয়েছে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ শিয়া ও সুন্নী উভয় সম্প্রদায়ের বর্ণীত অসংখ্য হাদীসও এ কথারই প্রমাণ বহন করে। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) -এর সাহাবী হযরত আবুযার গিফারী (রা.) বলেন : “একদিন মহা নবীর পিছনে যোহরের নামায পড়ছিলাম। এ সময়ে জনৈক ভিক্ষুক সেখানে উপস্থিত হয়ে সবার কাছে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কেউই ঐ ভিক্ষুককে সাহায্য করল না। তখন ঐ ভিক্ষুক তার হাত দু’টি আকাশের দিকে উঠিয়ে বলল: ‘হে আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থেকো, রাসুল (সা.)-এর এই মসজিদে কেউই আমাকে সাহার্য্য করলো না। ঐ সময় হযরত ইমাম আলী (আ.) নামাযরত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তখন রুকুতে ব্যস্ত ছিলেন। হযরত আলী (আ.) তখন রুকু অবস্থাতেই হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঐ ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করলেন। ঐ ভিক্ষুকও ইমাম আলী (আ.)-এর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাঁর হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নিল। এ দৃশ্য দেখে মহা নবী (সা.) আকাশের দিকে মাথা উচিঁয়ে এই প্রার্থনাটি করে ছিলেন : ‘হে আল্লাহ্ আমার ভাই হযরত মুসা (আ.) তোমাকে বলেছিল আমার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কাজগুলোকে সহজ করে দাও। আমার জিহববার জড়তা দুর করে দাও যাতে সবাই আমার বক্তব্য অনুধাবন
করতে পারে। আর আমার ভাই হারূনকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগীতে পরিণত কর।’ তখন তোমার ঐশী বাণী অবর্তীন হল : ‘তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমরা শক্তিশালী করব এবং তোমাকে প্রভাব বিস্তারের শক্তি দান করব’।
সুতরাং, হে আল্লাহ্! আমিও তো তোমারই নবী। তাই আমাকেও হৃদয়ের প্রশস্ততা দান কর। আমার কাজ গুলোকেও সহজ করে দাও। আর আলীকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত কর।”
হযরত আবুযার (রা.) বললেন : “রাসুল (সা.)-এর কথা শেষ না হতেই কুরআনের আলোচ্য আয়াতটি অবর্তীন হল”।
-যাখাইরূল উকবা (তাবারী) ১৬নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ।
একই হাদীস সামান্য কিছু শব্দিক পার্থক্যসহ নিম্নোক্ত গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে। -দুররূল মানসুর, ২য় খন্ড, ২৯৩নং পৃষ্ঠা।
-গায়াতুল মারাম- বাহ্রানী, এ বইয়ের ১০৩নং পৃষ্ঠায় আলোচ্য আয়াতের অবতরণের ইতিহাস বর্ণনায় সুন্নী সুত্রে বর্ণিত ২৪টি হাদীস এবং শিয়া সুত্রে বর্ণীত ১৯টি হাদীস বর্ণীত হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন: আজ কাফেররা তোমাদের ‘দ্বীন’ থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন’কে পুর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নিয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলমকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সুরা মায়েদা ৬৩ নং আয়াত)
বাহ্যত উক্ত আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এই আয়াত অবর্তীন হওয়ার পুর্বে কাফেররা এই ভেবে আশ্বান্বিত ছিল যে, শীঘ্রই এমন একদিন আসবে, যে দিন ইসলাম ধবংস হয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ্ উক্ত আয়াত অবর্তীনের মাধ্যমে চিরদিনের জন্যে কাফেরদেরকে নিরাশ করলেন। আর এটই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব লাভ ও তার ভিত্তিকে শক্তিশালী হওয়ার কারণ ঘটিয়ে ছিল। এটা সাধারণ কোন ইসলামী নির্দেশ জারীর মত স্বাভাবিক কোন ঘটনা ছিল না। বরং এটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা ছিল, যার ইসলামের অস্তিত্ব টিকে থাকা নির্ভরশীল ছিল। এই সূরার শেষের অবর্তীন আয়াতও আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন নয়।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন : “হে রাসুল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবর্তীন হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন তবে আপনি তাঁর (প্রতিপালকের) রিসালাতের কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ্ আপনাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন।” (সুরা মায়েদা, ৬৭ নং আয়াত)
উক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, মহান আল্লাহ্ এমন একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ের বাস্-বায়ন করতে চাচ্ছেন, যা সাধিত না হলে ইসলামের মুল ভিত্তি ও বিশ্ব নবী (সা.)-এর এই মহান মিশন বা রিসালত চরম বিপদের সম্মুখীন হবে। তাই আল্লাহ্ এ ব্যাপারে বিশ্ব নবীকে (সা.) নির্দেশ দেন। কিন্তু বিশ্ব নবী (সা.) ঐ গুরুত্বপুর্ণ কাজটি সাধিত হওয়ার ব্যাপারে জনগণের বিরোধীতা ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হওয়ার আশংকা করলেন। এমতাবস্থায় ঐ গুরুত্বপুর্ণ কাজটি অতি দ্রুত সমাধান করার জন্যে জোর তাগিদ সম্বলিত নির্দেশ মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বিশ্ব নবী (সা.)-এর প্রতি জারী করা হয়।
মহান আল্লাহ্ বিশ্ব নবী (সা.)-এর প্রতি উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, ঐ গুরুত্বপুর্ণ কাজটি সমাধানের ব্যাপারে অবশ্যই অবহেলা কর না এবং ঐ ব্যাপারে কাউকে ভয়ও কর না। এ বিষয়টি অবশ্যই ইসলামী শরীয়তের কোন বিধান ছিল না। কেননা এক বা একাধিক ইসলামী বিধান প্রচারের গুরুত্ব এত বেশী হতে পারে না যে, তার অভাবে ইসলামের মুল ভিত্তি ধবংস হয়ে যাবে। আর বিশ্ব নবীও (সা.) কোন ঐশী বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে আদৌ ভীতু ছিলেন না।
উপরোক্ত দলিল-প্রমাণাদি এটাই নির্দেশ করে যে, আলোচ্য আয়াতটি ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর বিলায়াত সংক্রান্ত ব্যাপারে অবর্তীন হয়েছে। অসংখ্য সুন্নী ও শীয়া তাফসীরকারক গণই এ ব্যাপারে ঐ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন : “বিশ্ব নবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি সবার দৃষ্টি আর্কষণ করেন। এরপর বিশ্ব নবী (সা.) ইমাম আলীর হাত দু’টি উপর দিকে উত্তোলন করেন। এমন কি বিশ্ব নবী (সা.) হযরত আলীর (আ.) হাত এমন ভাবে উত্তোলন করেছেন যে, মহা নবী (সা.)-এর বগলের শুভ্র অংশ প্রকাশিত হয়ে পড়ে ছিল। এমতাবস্থায় পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি অবর্তীন হয় : “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন’কে পুর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নিয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলমকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সুরা মায়েদা, ৬৩ নং আয়াত)
উক্ত আয়াতটি অবর্তীন হওয়ার পর মহা নবী (সা.) বললেন : ‘আল্লাহ্ আকবর’ কারণ, বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ‘বিলায়াত’ (কর্তৃত্ব) প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে আজ আল্লাহ্র নিয়ামত ও সন্তুষ্টি এবং ইসলামের পুর্ণত্ব প্রাপ্তি ঘটলো। অতঃপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) বললেন : “আমি যাদের মাওলা ও অভিভাবক, আজ থেকে আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক।
হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুর প্রতি বন্ধু বৎসল হও ও আলীর শত্রুর সাথে শত্রুতা পোষণ কর। যে তাকে (আলীকে) সাহায্য করবে, তুমিও তাকে সাহায্য কর। আর যে আলীকে ত্যাগ করবে, তুমিও তাকে ত্যাগ কর। ”
জনাব আলামা বাহ্রানী তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থের ৩৩৬ নং পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের অবতরণের কারণ প্রসঙ্গে সুন্নী সুত্রে বর্ণিত ৬টি হাদীস এবং শীয়া সুত্রে বর্ণিত ১৫টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।
সারাংশ : ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে ধবংস করার স্বার্থে কোন প্রকার অনিষ্ট সাধনে কখনই কুন্ঠা করেনি। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা ইসলামের এটুকু পরিমাণ ক্ষতি করতেও সমর্থ হয়নি। ফলে ব্যর্থ হয়ে তারা সব দিক থেকেই নিরাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু এর পরও শুধু মাত্র একটি বিষয়ে তাদের মনে আশার ক্ষীণ প্রদীপ জ্বল ছিল। আর তা সেই আশার সর্বশেষ সেই বস্তুটি ছিল এই যে, তারা ভেবে ছিল, যেহেতু মহা নবী (সা.)-ই ইসলামের রক্ষক ও প্রহারী, তাই তার মৃত্যুর পর ইসলাম অবিভাবকহীন হয়ে পড়বে। তখন ইসলাম অতি সহজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনা তাদের হৃদয়ে লুকানো আশার শেষ প্রদীপটাও নিভিয়ে দিল। কারণ, ‘গাদীরে খুমে’ মহা নবী (সা.), হযরত ইমাম আলীকে (আ.) তাঁর পরবর্তী দায়িত্বশীল ও ইসলামের অবিভাবক হিসেবে জন সমক্ষে ঘোষণা প্রদান করে। এমন কি বিশ্ব নবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পর ইসলামের এই দায়িত্বভার মহা নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশ তথা হযরত আলী (আ.)-এর ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে নির্ধারণ করেন।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত তর্থ্যের জন্যে হযরত আলামা তাবাতাঈ রচিত ‘তাফসীর আল্ মিজান’ নামক কুরআনের তাফসীরের ৫ম খন্ডের ১৭৭ থেকে ২১৪নং পৃষ্ঠা এবং ৬ষ্ঠ খন্ড ৫০ থেকে ৫৪নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
হাদীসে গাদীরে খুম :
বিশ্ব নবী (সা.) বিদায় হজ্জ শেষে মদীনা দিকে ফিরে যাচ্ছি লেন, পথি মধ্যে ‘গাদীরেখুম’ নামক একটি স্থানে পৌঁছনোর পর পবিত্র কুরআনের সুরা মায়েদার ৬৭ নং আয়াতটি অবর্তীন হয়। মহা নবী (সা.) তাঁর যাত্রা থামিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁর আগে চলে যাওয়া এবং পেছনে আগত সকল মুসলমানদেরকে তাঁর কাছে জড়ো হবার আহ্বান করেন। সবাই মহা নবী (সা.) এর কাছে সমাবেত হবার পর তাদের উদ্দশ্যে তিনি এক মহা মুল্য বান ও ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। এটাই সেই ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। এই ভাষণের মাধ্যমেই তিনি হযরত ইমাম আলীকে (আ.) তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন।
হযরত বুরআ’ (রা.) বলেন : বিদায় হজ্জের সময় আমি মহানবীর পবিত্র সান্নিধে উপস্থিত ছিলাম। যখন আমারা ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছেলাম, তখন মহা নবী (সা.) আমাদেরকে ঐ স্থানটি পরিস্কার করার নির্দেশ দিলেন। এর পর তিনি হযরত ইমাম আলীকে (আ.) তাঁর ডান দিকে এনে তাঁর হাত দু’টি জন সমক্ষে উপর দিকে উঁচিয়ে ধরলেন। তারপর তিনি বললেন : আমি কি মু’মিনদের মধ্যে তাদের থেকে অধিক উত্তম নই? সবাই উত্তর দিল অবশ্যই। অতঃপর তিনি বললেন : আমি যার মাওলা বা অভিভাবক, এই আলীও তার মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব কর এবং আলীর শত্রুর সাথে শত্রুতা কর। এর পর হযরত ওমর বিন আল খাত্তার হযরত আলীকে (আ.) সম্মোধন করে বলেন : ‘তোমার এই অমুল্য পদ মর্যাদা আরও উন্নত হোক! কেননা তুমি আমার এবং সকল মু’মিনদের অবিভাবক হয়েছো”।
-আল্ বিয়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্, ৫ম খন্ড, ২০৮ নং-পৃষ্ঠা, এবং ৭ম খন্ড, ৩৪৬ নং পৃষ্ঠা।
-যাখাইরুল উকবা, (তাবারী), ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ, ৬৭ নং পৃষ্ঠা।
-ফুসুলুল্ মুহিম্মাহ্, (ইবনে সাববাগ), ২য় খন্ড, ২৩ নং-পৃষ্ঠা।
-খাসাইসুস্ (নাসাঈ), ১৩৫৯ হিজরীর নাজাফীয় সংস্করণ, ৩১ নং-পৃষ্ঠা।
জনাব আলামা বাহ্রানী (রহঃ) তার ‘গায়তুল মারাম’ নামক গ্রন্থে সুন্নী সুত্রে বর্ণিত ৮৯ টি হাদীস এবং শিয়া সুত্রে বর্ণিব ৪৩টি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
সাফিনাতুন্ নুহ্-এর হাদীস :
হযরত ইবনে আববাস (রা.) বলেন : মহা নবী (সা.) বলেছেন যে, ‘আমার আইলে বাইতের উদাহরণ হযরত নুহ (আ.)-এর নৌকার মত। যারা নৌকায় আরহণ করল, তারাই রক্ষা পেল। আর যারা তা করল না তারা সবাই ডুবে মরল’।
-‘যাখাইরুল উকবা’ ২০ নং পৃষ্ঠা।
-‘আস সাওয়াইকুল মুহরিকাহ (ইবনে হাজার)’ মিশরীয় সস্করণ, ৮৪ ও ১৫০ নং পৃষ্ঠা।
-‘তারীখুল খুলাফাহ (জালালুদ্দিন আস্ সুয়ুতী)’ ৩০৭ নং পৃষ্ঠা।
-‘নরুল আব্সার (শাবালঞ্জি)’ মিশরীয় সংস্করণ, ১১৪ নং পৃষ্ঠা ।
জনাব আলামা বাহরানী, তার ‘গায়তুল মারাম’ নামক গ্রন্থের ২৩৭ নং-পৃষ্ঠায় সুন্নীদের ১১টি সুত্র থেকে এবং শিয়াদের ৭টি সুত্র থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হাদীসে সাকালাইন :
হযরত যাইদ বিন আরকাম (রা.) বলেন : মহা নবী (সা.) বলেছেন : মনে হচ্ছে আল্লাহ্ যেন আমাকে তার দিকেই আহবান যানাচ্ছেন, অবশ্যই আমাকে তার প্রত্যুত্তর দিতে হবে। তবে আমি তোমাদের মাঝে অত্যন্- ভারী (গুরুত্বপুর্ণ) দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি : তা হচ্ছে আল্লাহ্ এই ঐশী গ্রন্থ (কুরআন) এবং আমার আহলে বাইত। তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে, সে ব্যাপারে সর্তক থেকো। এ দু’টি (কুরআন ও আহলে বাইত) বিষয় ‘হাইজে কাউসারে’ (কিয়ামতের দিন) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। ”
- আল্ বিদাহয়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্ ৫ম খন্ড, ২০৯ নং-পৃষ্ঠা।
-যাখাইরূল উকবা, (তাবারী) ১৬ নং-পৃষ্ঠা ।
-ফুসুলুল্ মুহিম্মাহ্, ২২নং পৃষ্ঠা।
-খাসাইস্ (নাসাঈ), ৩০ নং-পৃষ্ঠা।
-আস্ সাওয়াইকুল মুহরিকাহ্, ১৪৭ নং-পৃষ্ঠা।
গয়াতুল মারাম’ গ্রন্থে আলামা বাহরানী ৩৯টি সুন্নী সুত্রে এবং ৮২টি শিয়া সুত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
‘হাদীসে সাকালাইন্’ একটি বিখ্যাত ও সর্বজন স্বীকৃত এবং অকাট্য ভাবে প্রমাণিত সুত্রে বর্ণিত।
উক্ত হাদীসটি অসংখ্য সুত্রে এবং বিভিন্ন ধরণের বর্ণনায় (একই অর্থে) বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসের সত্যতার ব্যাপাওে সুন্নী ও শিয়া, উভয় সম্প্রদায়ই স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এ ব্যাপারে তারা উভয়ই সম্পূর্ণ রূপে একমত।
আলোচ্য হাদীসটি এবং এ ধরণের হাদীস থেকে বেশ কিছু বিষয় আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়। তা হল :
১- পবিত্র কুরআন যে ভাবে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে টিকে থাকবে, মহা নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইত ও তার পাশা পাশি মানব জাতির মাঝে কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবেন। অর্থাৎ, এ বিশ্বের কোন যুগই ইমাম বা প্রকৃত নেতা বিহীন অবস্থায় থাকবে না।
২- বিশ্ব নবী (সা.) মানব জাতির কাছে এই দু’টি অমুল্য আমানত গচ্ছি ত রাখার মাধ্যমে তাদের সর্ব প্রকার ধর্মীয় ও জ্ঞান মুলক প্রয়োজন মেটানোর সমস্যার সমাধান করে গেছেন। মহা নবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণকে (আ.) সর্ব প্রকার জ্ঞানের অমুল্য রত্ন ভান্ডার হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। মহা নবী (সঃ) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) - এর যে কোন কথা ও কাজকেই নির্ভর যোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
৩- পবিত্র কুরআন ও মহা নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে অবশ্যই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না। মহা নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্র জ্ঞানধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাদের উপদেশ ও হিদায়েতের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবার অধিকার কোন মুসলমানেরই নেই।
৪- মানুষ যদি আহলে বাইতগণ (আ.)-এর আনুগত্য করে এবং তাঁদের কথা মেনে চলে, তাহলে কখনই তারা পথ ভ্রষ্ট হবে না। কেননা, তারা সর্বদাই সত্যের সাথে অবস্থান করছে।
৫- মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সর্ব প্রকার ধর্মীয় ও অন্য সকল জ্ঞানই আহলে বাইতগণ (আ.)- এর কাছে রয়েছে। তাই যারা তাঁদের অনুসরণ করবে, তারা কখনই পথ ভ্রষ্ট হবে না, এবং তারা অবশ্যই জীবনের প্রকৃত সাফল্য লভি করবে। অর্থাৎ আহলে বাইতগণ (আ.) সর্ব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
এ থেকেই বোঝা যায় যে, আহলে বাইত বলতে মহানবী (সা.)-এর পরিবারের সকল আত্মীয়বর্গ ও বংশধরকেই বোঝায় না, বরং আহলে বাইত বলতে নবী বংশের বিশেষ ব্যক্তিবর্গকেই বোঝানো হচ্ছে। ইসলাম সম্পকে পুর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া এবং সর্ব প্রকার পাপ ও ভুল থেকে তাঁদের অস্তিত্ব মুক্ত ও পবিত্র হওয়াই ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য। যাতে করে তাঁরা প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী হতে পারেন। ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন : হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এবং তাঁর বংশের অন্য এগারো জন সন্তান। তাঁরা প্রত্যেকেই একের পর এক ইমাম হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। একই ব্যাখ্যা মহা নবী (সা.)-এর অন্য একটি হাদীসে পাওয়া যায়।
হযরত ইবনে আববাস (রা.) বলেন : আমি মহা নবীকে (সা.) জিজ্ঞাস করলাম যে, আপনার যে সব আত্মীয়কে ভাল বাসা আমাদের জন্যে ওয়াজিব, তাঁরা কারা? মহা নবী (সা.) বললেন : ‘তাঁরা হচ্ছে আলী, ফাতিমা, হাসান এবং হুসাইন -ইয়া নাবীউল মুয়াদ্দাহ্, ৩১১ নং পৃষ্ঠা।
হযরত যাবির (রা.) বলেন : বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন : মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক নবীর বংশকেই সবীয় পবিত্র সত্ত্বার মাঝে নিহিত রেখেছেন। কিন্তু আমার বংশকে আলীর মাঝেই সুপ্ত রেখেছেন।”-ইয়া নাবীউল মুয়াদ্দাহ্, ৩১৮ নং পৃষ্ঠা।
হাদীসে হাক্ক :
হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন: আমি আল্লাহ্র রাসূলকে (সা.) বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন : আলী সত্যের সাথে রয়েছে। কুরআনও আলীর সাথে থাকবে এবং তাঁরা ‘হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। উক্ত হাদীসটি ‘গায়তুল মারাম’ গ্রন্থের ৫৩৯ নং পৃষ্ঠায় একই অর্থে সুন্নী সুত্রে ১৪টি এবং শীয়া সুত্রে ১০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হাদীসে মান্যিলাত্ :
হযরত সা’দ বিন ওয়াক্কাস (রা.) বলেন : “আল্লাহ্র রাসুল (সা.) হযরত আলীকে (আ.) বলেছেন : ‘তুমি এতেই সন্তুষ্ট নও যে, তুমি (আলী) আমার কাছে মুসার (নবী) হারুনের মত? পার্থক্য শুধু এত টুকুই যে, আমার পর আর কোন নবী আসবে না।”
-বিটায়াহ্ ওয়ন্ নিহায়াহ্, ৭ম খন্ড, ৩৩৯ নং পৃষ্ঠা।
-যাখাইরূল উকবা, ( তাবারী ), ৫৩ নং পৃষ্ঠা।
-ফুসুসুল মুহিম্মাত, ২১ নং পৃষ্ঠা।
-কিফায়াতুত তালিব ( গাঞ্জী শাফেঈ), ১১৪৮ - ১৫৪ পৃষ্ঠা।
-খাসাইস্ (নাসাঈ), ১৯- ২৫ নং পৃষ্ঠা।
-আস্ সাওয়ঈকুল মুহ্রিকাহ্, ১৭৭ নং পৃষ্ঠা।
‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থের ১০৯ নং পৃষ্ঠায় জনাব আলামা বাহরানী উক্ত হাদীসটি ১০০টি সুন্নী সুত্রে
এবং ৭০টি শিয়া সুত্রে বর্ণনা করেছেন।
আত্মীয় দাওয়াতের হাদীস :
মহানবী (সা.) তাঁর নিকট আত্মীয়দেরকে নিমন্ত্রন করে ছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন : এমন কোন ব্যক্তির কথা আমার জানা নেই, যে আমার চেয়ে উত্তম কিছু তার জাতিকে উপহার দিতে পেরেছে। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর প্রতি আহ্বান জানানোর জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আমাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে? আর সে হবে আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা বা প্রতিনিধি। উপস্থিত সবাই নিরুত্তর রইল। অথচ আলী (আ.) যদিও উপস্থিত সবার মাঝে কনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বললেন : ‘আমিই হব আপনার প্রতিনিধি এবং সহযোগী’। অত :পর মহা নবী (সা.) নিজের হাত তাঁর ঘাড়ের উপর রেখে বললেন : ‘আমার এ ভাইটি আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা। তোমরা সবাই অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করবে’। এর পর উপস্থিত সবাই সেখান থেকে উঠে গেল এবং এ বিষয় নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগল। তারা জনাব আবু তালিকে বলল : “মুহাম্মাদ তোমাকে তোমার ছেলের আনুগত্য করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে”। -তারিখু আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১১৬ নং পৃষ্ঠা।
এ জাতিয় হাদীসের সংখ্যা অনেক, যেমন : হযরত হুযাইফা (রা.) বলেন মহা নবী (সা.) বলেছেন : “তোমরা যদি আমার পরে আলীকে খলিফা ও আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত কর, তাহলে তোমরা এক জন দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন পথ প্রর্দশক হিসেবেই পাবে, যে তোমাদেরকে সৎ পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করবে। অবশ্য অবশ্য আমার মনে হয় না যে, এমন কাজ তোমরা করবে”। -খলিফাতুল আউলিয়া (আবু নাঈম), ১ম খন্ড, ৬৪ নং পৃষ্ঠা, কিফায়াতুত তালিব, ৬৭ নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরীর নাজাফিয় মুদ্রণ।
হযরত ইবনু মারদুইয়াহ্ (রা.) বলেন : মহা নবী (সা.) বলেছেন যে, “যে ব্যক্তি আমার মতই জীবন যাপন ও মৃত্যু বরণ করতে চায় এবং বেহেশত বাসী হতে চায়, সে যেন আমার পরে আলীর প্রেমিকও আমার আহলে বাইতের অনুসারী হয়। কারণ, তারা আমারই রক্ত সম্পকের ঘনিষ্ঠ আত্মিয়বর্গ এবং আমারই কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আমার জ্ঞান ও বোধ শক্তি তারাই লাভ করেছে। সুতরাং হতভাগ্য সেই, যে তাঁদের পদ মর্যাদাকে অস্বীকতার করেছে। অবশ্যই আমার সুপারিশ (শাফায়াত) থেকে বঞ্চিত হবে”।
- মুন্তাখাবু কানযুল উম্মাল।
-মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খন্ড, ৯৪ নং পৃষ্ঠা। টিকা টিপ্পনী দ্রষ্টব্য।
৩- পুর্বোক্ত আলেচনার পক্ষে কিছু কথা :
বিশ্বনবী (সা.) জীবনের অসুস্থতাময় শেষ দিন গুলো কাটাচ্ছি লেন। এক দল সাহাবী রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলেন। হযরত রাসুল (সা.) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন: “আমার জন্যে কাগজ ও কলম নিয়ে এসো। কারণ, আমি এমন কিছু তোমাদের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই, যা মেনে চললে তোমারা কখনই পথ ভ্রষ্ট হবে না”। উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক বলল : ‘এ লোক তো অসুস্থতার ফলে প্রলাপ (?) বকছে। কারণ, আল্লাহ্র কুরআনই তো আমাদের জন্যে যথেষ্ট’। এ নিয়ে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। রাসুল এ অবস্থা দেখে বললেন: তোমারা এখান থেকে উঠে পড়। আমার কাছ থেকে দুর হয়ে যাও। আল্লাহ্র রাসুলের কাছে হৈ চৈ করা উচিত নয়’। পুর্বেক্ত অধ্যায়ের বিষয় বস্তু এবং এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ যদি আমরা আলেচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, যারা রাসুল (সা.)-এর ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সে দিন বাঁধা প্রদান করে ছিল, তারাই রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর খেলাফত নির্বাচনের ঘটনা থেকে লাভবান হয়ে ছিল। বিশেষ করে তারা হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের অজ্ঞাতসারেই ‘খিলাফত নির্বাচনের’ পর্বটি সম্পন্ন করে। তারা হযরত হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের বিপরীতে ঐ কাজটি সম্পন্ন করে ছিল। এর পর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে, উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনায় মহা নবী (সা.) তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী বা স্থলভিষিক্ত হিসেবে হযরত আলী (আ.)-এর নাম ঘোষণা করতে চেয়ে ছিলেন।
মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ বাস্-বায়নে বাধা প্রদান পুর্বক ঐ ধরণের কথা বলার মাধ্যমে কথা কাটা -কাটি বা বির্তক সৃষ্টিই ছিল মুল উদ্দেশ্য, যাতে করে এর ফলে মহা নবী (সা.) তাঁর সিদ্ধান্- বাস্-বায়ন থেকে বিরত হতে বাধ্য হন। সুতরাং অসুস্থতা জনিত প্রলাপ বকার কারণে তাঁর নির্দেশ বাস্-বায়নে বাধা দেয়াই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ,
প্রথমতঃ আল্লাহর রাসুল (সা.) এর পবিত্র মুখ থেকে অসুস্থ কালীন সময়ে অসংলগ্ন একটি কথাও শোনা যায়নি। আর এ যাবৎ এ ধরণের কোন ঘটনাও (অসংলগ্ন কথা বার্তা) কেই বর্ণনা করেনি। ইসলাম নির্ধারিত নীতি মালা অনুযায়ী কোন মুসলমানই মহা নবী (সা.) এর প্রতি প্রলাপ বকার (?) মত অপবাদ আরোপ করতে পারে না। কারণ, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) ছিলেন ঐশী ‘ইসমাত’ বা নিষপাপ হওয়ার গুণে গুণাম্বিত।
দ্বিতীয়তঃ যদি তাদের কথা (প্রলাপ বকার মিথ্যা অভিযোগ সত্যই হত, তাহলে এর পরে কথাটি কুরআনই আমাদের জন্যে যথেষ্ট) বলার কোন প্রয়েজন হত না। কারণঃ তাদের পরবর্তী কথার অর্থ হচ্ছে , কুরআনই তাদের জন্যে যথেষ্ট, এর পর রাসুল (সা.)-এর বক্তব্যে কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর সাহাবীরা ভাল করেই জানতেন যে, পবিত্র কুরআনই মহা নবী (সা.)-এর অনুসারণকে সবার জন্যে ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। রাসুল (সা.)-এর বাণীকে আল্লাহ্র বাণীরই মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল অনুসারে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশের মোকাবিলায় মানুষের ‘ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা বা অধিকার নেই।
তৃতীয়তঃ প্রথম খলিফার মৃত্যুর সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ছিল। তখন প্রথম খলিফা তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে দ্বিতীয় খলিফার নামে। খেলাফতের ওসিয়ত (উইল) লিখে যান। তৃতীয় খলিফা ওসমান যখন প্রথম খলিফার নির্দেশে উক্ত ‘উসিয়ত’ উইল লিখ ছিলেন, তখন প্রথম কলিফা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু, এবার দ্বিতীয় খলিফা প্রথম খলিফার ব্যাপারে মোটেই প্রতিবাদ করেননি, যে প্রতিবাদটি তিনি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর ব্যাপারে করে ছিলেন।
এ ছাড়া হযরত ইবনে আববাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে দ্বিতীয় খলিফার যে স্বীকারোক্তি উলিখিত হয়েছে, তাতে তিনি বলেছেন: “আমি বুঝতে পেরে ছিলাম যে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) আলীর খেলাফতের বিষয়টি লিখে দিতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা আমি হতে দেইনি”। তিনি আরও বলেন যে ‘আলীই ছিল খেলাফতের অধিকারী। কিন্তু সে যদি খেলাফতের আসনে বসত্, তাহলে জনগণকে সত্য পথে চলার জন্যে উদ্বুদ্ধ করত। কিন্তু কুরাইশরা তার আনুগত্য করত্ না। তাই আমি তাকে খেলাফতের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি’।
ইসলামের নীতি অনুযায়ী সত্য প্রত্যাখনকারীদের জন্যে সত্য বাদীদেকে পরিত্যাগ না করে বরং সত্য প্রত্যাখান কারীদেরকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করা উচিত। যখন প্রথম খলিফার কাছে সংবাদ পৌঁছলো যে মুসলমানদের একটি গোত্র যাকাৎ প্রদানে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তৎক্ষণাত তিনি তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন : ুআল্লাহ্ রাসুলকে (সা.) মাথার রূমাল বাধার যে দড়ি দেয়া হত, তা যদি আমাকে না দেয়া হয়, তাহলেও তাদের সাথে আমি যুদ্ধে অবর্তীন হব”। অবশ্য এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে , যে কোন মুল্যে বিনিময়েই হোক না কেন, সত্যকে পুর্ণজীবিত করতে হবে। অথচ, সত্য ভিত্তিক খেলাফতের বিষয়টি মাথার রূমাল বাঁধার দড়ির চেয়ে অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বপুর্ণ ও মুল্যবান ছিল।
৪-ইসলামে ইমামত :
গণভাবে পথ নির্দেশনার (হিদায়াত) অপরিহর্যি ও ধ্রুব আইন অনুসারে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৃষ্টিই প্রাকৃতিক ভাবে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব, পুর্ণত্ব মহত্ব প্রাপ্তির পথে পরিচালিত ও সদা ধাবমান। মানুষ ও জগতের অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি। তাই মানুষও উক্ত আইনের ব্যতি ম নয়। সুতরাং মানুষও তার বাস্তব দৃষ্টি ভঙ্গী ও সামাজিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে তার নিজ জীবনে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে, যার মাধ্যমে সে ইহ ও পরকালে দু’ জীবনেই সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। এক কথায় মানুষ এমন এক শ্রেণীর বিশ্বাস ও বাস্তব দায়িত্বের ভিত্তিতে মানব জীবন পরিচালিত হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে মানুষ জীবনে সাফল্য ও মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানব জীবন পরিচালনার ঐ কর্মসুচী ও জীবন দর্শনের নামই দ্বীন। এই দ্বীন মানুষের বুদ্ধি বৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত নয়। বরং তা ঐশী বাণী (ওহী) ও নবুওতের মাধ্যমে প্রাপ্ত, যা মানব জাতির কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও পবিত্র আ্ত সম্পন্ন ব্যক্তিদের (নবীগণ) মাধ্যমে অর্জিত হয়।
আল্লাহ্র নবীরাই ‘ওহী’ বা ঐশী বাণীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মানব জাতির কাছে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সমুহ পৌঁছে দেন। যাতে করে ঐ সব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানব জীবন সাফল্য মন্ডিত হয়। এটা খুবই স্পষ্ট যে, উক্ত যুক্তির ভিত্তিতে এ ধরণের একটি জীবন বিধানের প্রয়োজনীয়তা মানব জাতির জন্যে প্রমাণিত হয়। একই ভাবে এর পাশা পাশি মানব জাতির ঐ মুল্যবান জীবন বিধান সম্পূর্ণ অবিকৃত রূপে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও প্রমাণিত হয়। মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহের মাধ্যমে সেই ঐশী জীবন বিধান মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে যেমন বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন, ঐ জীবন বিধান সংরক্ষণের জন্যেও তেমনি বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন। যাতে করে ঐ জীবন বিধান চির দিন অবিকৃত রূপে সংরক্ষিত থাকে এবং প্রয়োজনে তা মানুষের কাছে উপস্থাপন ও শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ, সর্বদাই একের পর এক এমন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকা প্রয়োজন, যারা আল্লাহ্র প্রদত্ত ঐ দ্বীনকে সর্বদাই অবিকৃত রূপে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তা ব্যবহার করবেন। যে বিশিষ্ট ব্যক্তি ঐ ঐশী দ্বীনকে অবিকৃত ভাবে সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নিয়োজিত, তাঁকেই ‘ইমাম’ নামে অভিহিত করা হয়। একই ভাবে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশী বাণী ও বিধান গ্রহণের যোগ্যতা সম্পন্ন আ্তার অধিকারী ব্যক্তিকে ‘নবী’ হিসেবে অবিহিত করা হয়। নবুওতও ইমামতের সমাহার একই ব্যক্তির মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে, আবার পৃথক পৃথক ভাবেও পাওয়া যেতে পারে ।
পুর্বোক্ত দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে নবী- রাসুল গণের জন্যে ‘ইমামত’ বা নিষপাপ হওয়ার গুণে গুণান্ব্বিত হওয়ার অপরিহার্যতা যেমন প্রমাণিত হয়, তেমনি ইমামের জন্যে ‘ইসমাত’ বা নিষপাপ হওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার অপরিহায়তাও প্রমাণিত হয়। কেননা, দ্বীনকে কিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃত ও প্রচারের যোগ্যতা সম্পন্ন অবস্থায় সংরক্ষণ করা আল্লাহ্র দায়িত্ব। আর এ উদ্দেশ্য ঐশী ‘ইসমাত’ (নিষপাপ হওয়ার গুণ) ও ঐশী নিরাপত্তা বিধান ছাড়া বাস্-বায়ন সম্ভব নয়।
৫- নবী ও ইমামের পার্থক্য :
পুর্বোক্ত আলোচনায় আনিত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশী বাণী প্রাপ্তির মাধ্যমে নবী- রাসুলগণের ঐশী বিধান আরোহণের বিষয়টিই শুধু মাত্র প্রমাণিত হয়। কিন্তু ঐ ঐশী বিধানের অব্যাহত ভাবে টিকে থাকা ও অবিকৃত ভাবে চির দিন তা সংরক্ষিত থাকার বিষয়টি সর্ব সম্মত একটি বিষয় হলেও উপরোক্ত যুক্তির মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয় না। আর ঐশী বিধানের ঐ অমরত্বের কারণেই পুণঃ পুণঃ নবী আগমনের প্রয়োজন হীনতা প্রমাণিত হয়। আবার এর পাশাপাশি ঐশী বিধারকে মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃত রূপে চির দিন সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত উপস্থিতির অপরিহার্যতাও এখানে প্রমাণিত হয়। এমন কি সমাজের লোকেরা ঐ ঐশী ইমামতকে চিনতে পারুক অথবা নাই পারুক, মানব সমাজ কখনই ঐশী ইমামের অস্তিত্ব থেকে মুক্ত থাকবে না।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন : “এরা যদি আমাদের হেদায়েতকে অস্বীকার করে তবে এর জন্যে এমন সম্প্রদায় নির্দিষ্ট করেছি, (তারা) তার অবিশ্বাসী হবে না।”-সুরা আনআম, ৮৯ নং আয়াত।
পুর্বে যেমনটি বলা হয়েছে যে, নবুওত ও ইমামতের দু’টি পদের সমাহার অনেক সময় একই ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। আবার এ দু’টি পদের অস্তিত্ব পৃথক পৃথকভাবেও বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে পরিলক্ষিত হতে পারে। তাই নবী হীন যুগে কোন কালই ইমামের অস্তিত্ব বিহীন অবস্থায় কাটবে না। আর স্বাভাবিক ভাবেই নবীদের সংখ্যা সীমিত এবং সব সময় তাদের অস্তিত্ব ছিল না।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে তাঁর কিছু সংখ্যক নবীকে ইমাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন : মহান আল-াহ্ পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে বলেছেন: যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালন কর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পুর্ণ করে দিলেন, তখন পআলন কর্তা বললেন, নিশ্চয় আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও ? তিনি বললেন, আমার প্রতিশ্রুতিতে অত্যাচারীরা সামীল হবে না।”-সুরা বাকারা, ১২৪ নং আয়াত।
তিনি আরও বলেছেন : “আমি তাদেরকে নেতা মনোনীত করলাম। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রর্দশন করত...”।-সুরা আম্বিয়া, ৭৩ নং আয়াত।
৬- কাজের অন্তরালে ইমামত :
‘ইমাম’ যেমন মানুষের বাহ্যিক কাজ কর্মের ব্যাপারে নেতা ও পথ প্রর্দশক স্বরূপ, তেমনি তিনি মানুষের অন্-রেরও ইমাম বা পথ প্রর্দশক তিনিই প্রকৃত পক্ষে মানব জাতির কর্ণধার স্বরূপ, যিনি আধ্যাত্মিক পথে মহান আল্লাহ্র প্রতি ধাবমান। উক্ত বিষয়টি আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝার জন্যে নিম্নো লিখিত ভুমিকাটির প্রতি লক্ষ্য করুন।
প্রথমতঃ এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলাম সহ পৃথিবীর একত্ববাদী সকল ঐ ধর্মের দৃষ্টিতে মানব জীবনের চিরন্তন ও প্রকৃত সাফল্য ও দূর্ভাগ্য তার কৃত সৎ ও অসৎ কর্মের উপর নির্ভরশীল। এটাই সকল ঐশী ধর্মের শিক্ষা। মানুষ তার আপন সত্ত্বায় নিহিত খোদা প্রদত্ত স্বভাব দিয়ে ঐ সব সৎ ও অসৎ কর্মে পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে।
মহান আল্লাহ্ ওহী ও নবুওতের মাধ্যমে ঐ সব কাজ কর্মকে মানব জাতির চিন্তা শক্তি ও বোধ শক্তির উপযোগী সামাজিক ভাষায় আদেশ ও নিষেধ এবং প্রশংসা ও তিরস্কারের আকারে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ্ নির্দেশিত ঐ সব আদেশ নিষেধ আনুগত্যকারীদের জন্যে পরকালে এক সুমধুর ও অনন্ত জীবনের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, যেখানে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব ও পুর্ণত্বের সকল কামনা -বাসনা বাস্-বায়িত হবে। আর তার অবাধ্যকারী অসৎ লোকদের জন্যে সর্ব প্রকার ব্যর্থতা ও দুর্ভাগ্যপুর্ণ এক তিক্ত ও অনন্ত জীবনের সংবাদ দেয়া হয়েছে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সর্ব স্রষ্টা আল্লাহ্ সকল দিক থেকেই আমাদের কল্পনা শক্তির উধের্ব। তিনি আমাদের মত সামাজিক চিন্তাধারার অধিকারী নন। কারণ, প্রভুত্ব ,দাসত্ব, নেতৃত্ব, আনুগত্য, আদেশ, নিষেধ,পারিশ্রমিক এবং পুরস্কার প্রথা আমাদের সমাজের মধ্যেই সীমাদ্ধ। এর বাইরে এ সবের কোন অস্তিত্ব নেই। এ সৃষ্টি জগতের সাথে সর্ব স্রষ্টা আল্লাহ্র সম্পর্ক বাস্তব ও সত্য নির্ভর। যেমনটি পবিত্র কুরআন ও মহা নবীর হাদীসসমুহে যে ভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী দ্বীন এমন কিছু নিগুঢ় সত্য ও উচ্চতর জ্ঞান মালার সমষ্টি, যা সাধারণ বোধ শক্তির ঊর্ধেব। মহান আল্লাহ্ ঐ সব জটিল ও উচ্চতর বিষয়সমুহকে সাধারণ মানুষের চিন্তা ও বোধ শক্তির মাত্রার উপযোগী করে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মানব জাতির জন্যে অবর্তীণ করেছেন।
উক্ত বর্ণনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, সৎ ও অসৎ কাজ এবং পরকালের অনন্ত জীবন ও তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এক বাস্তব সম্পর্ক বিদ্যমান। ভবিষ্যৎ জীবনের (পরকাল) সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য আল্লাহ্র ‘ইচ্ছায় মানুষের ঐ সব সৎ ও অসৎ কাজের সৃষ্ট ফল স্বরূপ।
আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে, সৎ ও অসৎ কাজ গুলো মানুষের আ্তায় এমন এক প্রতিচ্ছ বির সৃষ্টি করে, যার উপর তার পরকালীন জীবনের সুখ দুঃখ নির্ভরশীল।
মানুষ প্রকৃত পক্ষে শিশুর মতই। লালন-পালন কালীন সময়ে একটি শিশু তার অভিভাবকের কাছ থেকে ‘এটা কর’ ‘ওটা কর না’ এমনই সব আদেশ নিষেধই প্রতিনিয়ত শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু ঐ অবস্থায় ঐ শিশু ঐ সব কাজ করা বা না করার মুল মর্ম আদৌ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না। ঐ শিশু যদি শৈশবে লালিত হওয়ার কালীন সময়ে তার প্রশিক্ষক বা অভিভাবকের আদেশ নিষেধের ঠিক মত আনুগত্য করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে ভবিষ্যতে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং ভবিষ্যত সামাজিক জীবনে সে সুখী হবে। কিন্তু কোন শিশু যদি শৈশবে তার অভিভাবক বা প্রশিক্ষকের অবাধ্যতা করে, তাহলে সে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে না এবং এর ফলে ভবিষ্যত জীবনে সে হতভাগ্য হবে। ঐ সব আদেশ নিষেধের নিগুঢ় তত্ব ঐ শিশু বুঝুক অথবা নাই বুঝুক, ঐ সবের আনুগত্যেই তার মঙ্গল নিহিত। একই ভাবে মানব জাতিও সর্ব স্রষ্টা আল্লাহর কাছে শিশুর মত। আল্লাহর আদেশ- নিষেধের মর্ম সে উপলব্ধি করুক অথবা নাই করুক, তা মানা বা না মানার উপরই তার পরকালীন জীবনের সুখ দুঃখ নির্ভরশীল।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ঔষধ-পথ্য গ্রহণ ও ব্যয়াম করার দায়িত্ব পালনই রোগীর এক মাত্র দায়িত্ব। এ ভাবে ডাক্তারের নিদেশ মেনে চলার মাধমেই রোগীর দেহে শৃংখলা নেমে আসে এবং রোগী মেই রোগ মুক্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং এটাই তখন তার সুখের কারণ হয়ে উঠে।
মোট কথা, মানুষ তার এই বাহ্যিক জীবনের পাশা পাশি একটি আধ্যা্তিক জীবনেরও অধিকারী। মানুষের ঐ আধ্যা্তিক জীবনের প্রকৃতি তার কৃত কর্মের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে। আর তার পরকালীন জীবনের সকল সুখ ও দুঃখ সম্পূর্ণ রূপে তার জীবনের ঐ সব কৃত কর্মের উপরই নির্ভরশীল। পবিত্র কুরআনও উক্ত বুদ্ধি বৃত্তিগত যুক্তিকে সমর্থন করে। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। কুরআনের ঐ সব আয়াতে সৎ লোক ও আল্লাহ্তে বিশ্বাসীদের জন্যে এ পৃথিবীর জীবন ও বর্তমান আত্মার চেয়েও অনেক উন্নত ও উচ্চতর জীবন এবং উন্নত ও জ্যোর্তিময় আত্মার অধিকারী হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
পবিত্র কুরআন মানব জীবনের কৃত কর্মসমুহের অদৃশ্য ফলা ফলকে মানুষের নিত্য সঙ্গী হিসেবে বিশ্বাস করে। মহা নবী (সা.)-এর হাদীস গুলোতেও এই অর্থই অসংখ্য বার উচ্চারিত হয়েছে।
দ্বিতীয়: প্রায়ই এমনটি ঘটতে দেখা যায় যে, অনেকেই হয়ত অন্যদেরকে কোন সৎ বা অসৎ কাজের নির্দেশ দেয়, অথচ সে নিজে ঐ সব কাজ করে না, কিন্তু আল্লাহ্র নবী, রাসুল বা ইমাম গণের ক্ষেত্রে এমনটি কখনই পরিলক্ষিত হবে না। কারণ, তাঁরা সরাসরি আল্লাহ্র দ্বারা নির্দেশিত ও পরিচালিত। তাঁরা মানুষকে যে দ্বীনের পথে পরিচালিত করেন এবং তার পথ নির্দেশনা দেন, তাঁরা নিজেরাও তা মেনে চলেন। তাঁরা মানুষকে যে আধ্যাত্মিক জীবনের পথে পরিচালিত করেন, তাঁরা নিজেরাও ঐ আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী। কারণ, মহান আল্লাহ্ যতক্ষণ পর্যন্ত স্বয়ং কাউকে হিদায়েত না করেন বা সৎ পথে পরিচালিত না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যদের সৎ পথে পরিচালিত করার দায়িত্বভার তার উপর অর্পণ করেন না। আল্লাহর ‘বিশেষ হিদায়াত’ কখনই ব্যর্থ কতে পারে না। উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারি।
১- বিশ্বের প্রতিটি জাতির মধ্যেই তাদের জন্যে প্রেরিত নবী রাসুল বা ইমাম পুর্ণাঙ্গ দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী, যে জীবনাদর্শ অনুসারে প্রতি তারা জনগণকে আহ্বান জানায়। আর এ ক্ষেত্রে (আমলের ব্যাপারে) তাঁরা আর অন্য সবার চেয়ে অগ্রগামী। কারণ, নিজেদের প্রচারিত আর্দশকে অবশ্যই ব্যক্তি জীবনেও বাস্তবায়িত করতে হবে এবং আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী হতে হবে।
২- যেহেতু তাঁরা অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী এবং তাদের পথ প্রদর্শক ও নেতা, তাই তাঁরা অন্য সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মহত্বের অধিকারী।
৩- যিনি মহান আল্লাহ্র নির্দেশে ‘উম্মত’ বা জাতির নেতত্বের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি মানুষের বাহ্যিক কাজ কর্মের বিষয় যেমন নেতা ও পথ প্রদর্শক, তেমনি মানুষের আধ্যা্তিক জীবন ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদিরও নেতা ও পথ প্রদর্শক ।
৭- ইমাম ও ইসলামের নেতৃবৃন্দ :
পুর্বোক্ত আলোচনা সমুহের ভিত্তিতে এটাই প্রতিয়মাণ হয়যে, বিশ্ব নবী (সা.)-এর তিরোধণের পর ইসলামী উম্মতের মাঝে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামের (নেতা) অস্তিত্ব ছিল এবং থাকবে।
এ ব্যাপারে বিশ্ব নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ঐ সব হাদীসে ইমামদের বৈশিষ্ট, পরিচিতি, সংখ্যা, ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। এমন কি ইমামরা যে, সবাই কুরাইশ বংশীয় এবং মহা নবী (আ.)-এর আহলে বাইতের সদশ্য হবেন তাও বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, প্রতীক্ষিত ইমাম হযরত মাহ্দীই (আ.) হবেন ইমামদের মধ্যে সর্বশেষ ইমাম। একই ভাবে হযরত আলী (আ.)-এর প্রথম ইমাম হওয়ার ব্যাপারেও মহা নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় ইমামের ইমামতের সমর্থনেও মহা নবী (সা.) ও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে অকাট্য ভাবে প্রমাণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে।
একই ভাবে প্রত্যেক ইমাম তাঁর পরবর্তী ইমামের ইমামতের সর্মথনে অকাট্য প্রামাণ্য দলিল রেখে গেছেন।উপরোক্ত হাদীস সমুহের দলিলের ভিত্তিতে ইমামদের মোট সংখ্যা বার। তাঁদের পবিত্র নামগুলো নিম্নরূপ :
১- হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)।
২- হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (আ.)।
৩- হযরত ইমাম হোসেন বিন আলী (আ.)।
৪- হযরত ইমাম আলী বিন (আ.) [যয়নুল আবেদীন]।
৫- হযরত ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী (আ.) [বাকের]।
৬- হযরত ইমাম জাফর বিন মুহাম্মাদ (আ.) [জাফর সাদিক]।
৭- হযরত ইমাম মুসা ইবনি জাফর (আ.) [মুসা কাযিম]।
৮- হযরত ইমাম আলী ইবনি মুসা (আ.) [রেজা]।
৯- মুহাম্মাদ ইবনি আলী (আ.) [ত্বাকী]।
১০- হযরত ইমাম আলী ইবনি মুহাম্মাদ (আ.) [নাক্বী]।
১১- হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (আ.) [আসকারী]।
১২- হযরত ইমাম মাহদী (আ.)।
উদাহরণ স্বরূপ কিছু হাদীস :
হযরত যাবের বিন সুমাইরা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি ‘বার জন প্রতিনিধির আবির্ভাবের পূর্বে এই প্রিয় ধর্ম পরিসপ্তি ঘটবে না । আরো বলেন : তখন সবাই তাকবির হস্য ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে পরিবেশ। অতঃপর আস্তে কিছু কথা বলেন। আমি আমার বাবাকে বললাম : কি বলে-ন? তিনি উত্তরে বলেন : তাদের সবাই কুরাইশ গোত্রের লোক হবেন ।
-সহীহ্ আবু দাউদ, ২য় খন্ড ২০৭নং পৃষ্ঠ।
-মুসনাদে আহ্মাদ, ৫ম খন্ড, ৯২নং পৃষ্ঠা।
-একই অর্থে বর্ণিত আরও অসংখ্য হাদীস রয়েছে। স্থানাভাবে এখানে সে গুলো উলে-খ করা হচ্ছে না।
অন্য একটি হাদীস :
হযরত সালমান ফারসি (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : একদিন আমি মহানবী (সা.) এর নিকট উপন্থিত হলাম, হুসাইন তখন তিনি তাঁর চোখে ও ঠোটে চুমু নিচ্ছেলেন আর বলছিলেন : তুমি সাইদের সন্তান সাইয়েদ এবং ইমামের সন্তান ইমাম, তুমি [ঐশী] প্রতিনিধির সন্তান [ঐশী] প্রতিনিধি, তুমি নয়জন [ঐশী] প্রতিনিধির সন্তান , যাদের নবম ব্যক্তি হলেন তাদের কায়েম [মাহদী] । ইয়ানাবী উল্ মাওয়াদ্দাহ্, (সুলাইমান বিন ইব্রাহীম কান্দুযি) ৭ম মুদ্রণ, ৩০৮ নং পৃষ্ঠা।
গ্রন্থপঞ্জী :
১-‘আল্গাদীর’- আলামা আমিনী।
২-‘গায়াতুল মারাম’- সাইয়েদ হাশেম বাহ্রানী।
৩-‘ইসবাতুল হুদাহ্’ -মুহাম্মদ বিন হাসান আল্ হুর আল্ আমিলী।
৪-‘যাখাইরুল উকবা’ মুহিবুদ্দিন আহমাদ বিন আবদিলাহ্ আত্তাবারী।
৫-‘মানাকিব’- খারযমি।
৬-‘তাযকিরাতুস্ খাওয়াস্’- সিবতু ইবনি জাইযি।
৭-‘ইয়া নাবী উল্ মুয়াদ্দাহ্, সুলাইমান বিন ইব্রাহীম কান্দুযি হানাফী।
৮-‘ফুসুলুল মুহিম্মাহ্’- ইবনু সাববাগ।
৯-‘দালাইলুল ইমামাহ্’ -মুহাম্মাদ বিন জারির তাবারী।
১০-‘আন্ নাস্ ওয়াল ইজতিহাদ’ আলামা শারাফুদ্দীন আল্ মুসাভী।
১১-উসুলুল ক্বাফী, ১ম খন্ড -মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব আল্ কুলাইনী।
১২-‘কিতাবুল ইরশাদ্’ -শেইখ মুফিদ।
বিষয়: বিবিধ
১৬২৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনি কি ইরান কালচারাল সেন্টারের কোন প্রতিনিধি?
মন্তব্য করতে লগইন করুন