ইমামত বিষয়ে ইমাম আলী (আঃ) এর নিরবতাবলম্বনের অন্তর্নিহিত কারণ
লিখেছেন লিখেছেন শিআনে আলী আলাইহিস সালাম ২২ আগস্ট, ২০১৪, ১১:৫৮:২৮ রাত
আলোচনার সূচনাতেই বলে নেয়া সমীচীন মনে করছি যে, এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য বহু গবেষণার দরকার। আর বিষয়টি খুবই জটিল ও দীর্ঘ পরিসরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তাই সামান্য কলেবরে উল্লেখিত
শিরোনামের সামান্য কিছু ব্যাখ্যার প্রয়াস পাব। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আহ্লে বাইয়াতকে মুহাব্বত করে না এমন মুসলমান খুবই কম। তবে যুগ যুগ ধরে আহলে বাইয়াতকে মাজলুম বানিয়ে কোনঠাসা করে রাখার অপতৎপরতা চালিয়েছে
মুসলমান নামধারী বকধার্মিক কিছু মোনাফেকের দল। তাই আজও কিছু মানব জগৎসংসারে বসবাস করে যারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা করে থাকেন। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা, সত্য ইতিহাস না জেনে নির্বোধের মত কথা
বলা এ যেন তাদের নিত্তনৈমিত্তিক পেশা। কতক লোক আজও ইমাম আলী (আঃ) এর মারেফাত লাভ না করার কারণে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামুলক কথাবার্তা বলেন যা বিবেকবহির্ভূত এবং অন্তঃসারশূন্য কাজ। অনেকেই
নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে যদি খেলাফত আলী (আঃ) এর হক ছিল তবে কেন তিনি তার হক আদায় করতে আন্দোলন করেননি, কেন তিনি নিরবতাকে বেঁছে নিলেন, কেন প্রতিবাদ করেননি। যাই হোক এ জাতীয় প্রশ্ন করে
এক প্রকার বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। তাই আসুন ইনসাফের সুরে কথা বলি এবং সত্যকে জানার, বুঝায় ব্রতী হয় তাহলে আর বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হবে না। এবার মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পয়গাম্বর (সাঃ) এর বেদনাময় ওফাতে গোটা মুসলিম সমাজ এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের উপর নেমে আসে যন্ত্রণার মহাপ্লাবন ও মহাসংকট। রাষ্ট্রে সর্বদা একটা টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি
বিরাজ করছিল বিশেষ করে খেলাফতের শাসন কর্তৃত্বের রদবদলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং সার্বক্ষণিক একটা ভীতি কাজ করছিল যে, হয়তো আরবের নব দীক্ষিত মুসলমানরা
জাহিলিয়াতের পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন একটি নব প্রষ্ফুটিত ফুলের পাঁপড়ির ন্যায় সবেমাত্র উঁকি মেরে আত্মপ্রকাশ করেছিল যার ফলে জনগণ ইসলামের সাথে তখনও সখ্যতা গড়তে পারেনি বা
ইসলামী আন্দোলনকে তারা গুরুত্বহীন ভেবে পাশ কেটে চলেছে। ইমাম আলী (আঃ) এবং মহানবী (সাঃ) এর কিছু বিশ্বস্ত সাহাবা কেরাম সবেমাত্র রাসুলুল্লাহর (সাঃ) দাফন কাফন সুসম্পন্ন করতে না করতেই সাহাবাকেরামের
মাঝে দুটি দল খেলাফতের দাবিদার সেজে হৈ হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেয়। দল দুটি হচ্ছে,
১) আনসারগণ যারা খাজরাজ জনগোষ্ঠীর লোক ছিল। তারা আগে থেকেই সাকিফায়ে বানী সাআদা নামক স্থানে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় মুসলিম রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদ বিন উবাদার হাতে ন্যস্ত
করতে হবে এবং সেই হবে পয়গাম্বর (সাঃ) এর জানেশিন বা উত্তরসূরি। কিন্তু আনসারদের মধ্যে ঐকমত্য না থাকায় বিশেষতঃ আউস ও খাজরাজ গোত্রের পারস্পরিক পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। আউস গোত্রের
লোকেরা খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদের সাথে শুধু বিরোধীতাই করেনি বরং তারা ক্ষমতা তার হাত থেকে নিয়ে মুহাজিরদের কারো হাতে দেয়ার পক্ষপাতি ছিল।
২) মুহাজিরগণ যদিও বানী সাকিফায় মুহাজিরদের উপস্থিত লোকের সংখ্যা সামান্য ছিল তথাপি এক ধরনের কৌশল অবলম্বনের ফলে সকলেই হযরত আবু বকরের প্রতি সমর্থন জানায়। আশে পাশের অনেকেই তাকে রাসুলুল্লাহর (সাঃ)
খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর এ সুযোগে তিনি জনগণকে নিজের বাইয়াত করার আহ্বান জানান।
উক্ত দুটি দল ছাড়াও আরেকটি দল বিদ্যমান ছিল যারা ইমাম আলী (আঃ) এর জন্য ছিল নিবেদিত। এদের মধ্যে বানী হাশিম ও কিছুসংখ্যক বুযুর্গ সাহাবা কেরাম মনে করতেন খেলাফতের একমাত্র হকদার ইমাম আলী (আঃ)
এবং অন্য সবার চেয়ে ইমাম আলী নেতা ও রাহবার হিসেবে যোগ্য। এই দলটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল যে, রাসূলুল্লাহর পবিত্র দেহ মোবারক সবেমাত্র দাফন হতে না হতেই মুহাজির ও আনসারদের মাঝে খলিফা মনোনয়ন নিয়ে
বাকবিতন্ডা, সংঘর্ষ বেঁধে গেছে। তারা নিজেদের বিরোধী মনোভাবকে মুহাজির ও আনসারদের বরং সমস্ত মুসলমানদের কর্ণকুহরে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে হযরত আবু বকরের খলিফা মনোনয়ন পন্থাকে বাতিল ঘোষণা করে সরাসরি
হযরত ফাতেমার গৃহাভিমুখে গমন করেন। অবশেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফাতেমার গৃহকে ত্যাগ করে মসজিদে গিয়ে অবস্থান নেন। নাজুক পরিস্থিতিতে তৃতীয় দলটি বিশেষ করে ইমাম আলী ও তার সঙ্গী সাথীরা দেখলেন যে
ইসলামী শাসন কর্তৃত্ব তার সঠিক হকদার ও প্রাপকের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এবং তার সাথে শরীয়তের মাঝেও কাঁটছাট করা হচ্ছে পাশাপাশি পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে মোড় নিল যে খেলাফতের সত্যিকারের আল্লাহর
মনোনীত ব্যক্তির স্থলে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে জনসাধারণ রাসূলুল্লাহর প্রকৃত উত্তরসুরি ভাবতে শুরু করল। আর এমতাবস্থায় হযরত আলী (আঃ) এর ন্যায় মহোত্তম ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চুপ থাকাটা মোটেও ভাল ঠেকেনি
তাই তিনি নিরবতাকে পিছনে ঠেলে জবানের তীক্ষ্ণতাকে কাজে লাগান। মসজিদে নব্বীতে আসার পর তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্য পিড়াপীড়ি করা হলে সমবেত মুহাজিরদের সম্বোধন করে বলেন, হে মুহাজিরগণ!
পয়গাম্বর (সাঃ) স্বয়ং যে হুকুমাতের ভিত্তি স্থাপন করেছেন সেটাকে তোমরা তাঁর পবিত্র অভিজাত বংশের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেদের কুটিরে আবদ্ধ রাখার বৃথা চেষ্টা করোনা। আল্লাহর শপথ! মহানবীর পরিবার একাজের
জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম। কেননা তাদের মধ্যে (আহলে বাইত) এমন সমস্ত যোগ্য ও মেধাবান ব্যক্তিরা রয়েছে যারা কোরআনের সঠিক গুঢ়রহস্য জানে এবং দ্বীন ইসলামের জ্ঞানভান্ডার তাদের অধীনে সুরক্ষিত, পয়গাম্বর (সাঃ)
এর সুন্নাত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত, তারাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনার ক্ষমতা রাখে, সমস্ত ফেতনা ফ্যাসাদের শিকড়কে তারাই উপড়ে ফেলতে পারে এবং বাইতুল মাল গাণিমতের সম্পদকে সুষমভাবে
একমাত্র তারাই বন্টন করার মনমানসিকতা রাখে। আর বাস্তবতা হচ্ছে এমন সকল যোগ্য পন্ডিত ব্যক্তিরা থাকতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অন্যদের হাতে মানায় না। এমন যেন না হয় যে, তোমরা নফসের খায়েশ মোতাবেক চলতে গিয়ে
আল্লাহর পথ থেকে ছিটকে পড় এবং হাকীকাত থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্রান্তিতে হামাগুড়ি খেতে থাক। (সূত্রঃ আল ইমামত ওয়াসসিয়াসাত খ.১, প.১১)
উক্ত বক্তৃতায় ইমাম নিজের শ্র্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে কত সুন্দর ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া এখানে অবৈধ খেলাফতের দাবিদারদের সাথে নিজের বিরোধী মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে
ইমাম আলী (আঃ) বানী হাশিমের একটি দল নিয়ে আবু বকরের নিকট যান এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, যোগ্যতা, বীরত্বগাঁথা ইতিহাস, রণাঙ্গনের সাহসিকতা এ সমস্ত বিষয়কে তার সামনে তুলে ধরে বলেন, আমি পয়গাম্বরের
জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উপযুক্ত। আমি তাঁর (সাঃ) উযির, উত্তরসূরি, জ্ঞানভান্ডার এবং গুপ্তরহস্য ভান্ডার। আমি হলাম সিদ্দিকে আকবার এবং সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী ন্যায়বান ব্যক্তি।
আমি সেই পুরুষ যে প্রথম মহানবীর উপর ঈমান আনার পর তাঁকে সত্যবাদী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। আমি মুশরিকদের সাথে রণক্ষেত্রে দৃঢ় ও অটলভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি, সুন্নাত ও কিতাবের সর্বজান্তা, উসূলে দ্বীন ও ফুরুয়ে
দ্বীনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, ভাষার মাধুর্যতা আর বাক্যালংকারে আমার রয়েছে পুরোপুরি দখল। তবু কেন তোমরা আমার অধিকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছো?
ইমাম আলী (আঃ) অন্য আরেকটি খুতবায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সক্ষম ক্ষমতাবান ও সর্বাপেক্ষা আল্লাহর বিধি বিধান সম্পর্কে সুঅভিজ্ঞ পন্ডিত একজন কোয়ালিটি সম্পন্ন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, হে জনতা! হুকুমত
পরিচালনার জন্য তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত যিনি জনতার মাঝে রাষ্ট্র চালানোর কলাকৌশলে অভিজ্ঞ এবং আল্লাহর বিধানকে ভাল করে জানেন। যার মধ্যে এই সামষ্টিক গুণাবলী অবর্তমান সে যদি খেলাফত লাভের চিন্তায় মগ্ন হয় এবং
নিজের ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডকে চালাতে থাকে তবে সে কতল তো হবেই। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-১৬৮)
এটা ছিল ইমাম আলীর দূরদর্শিতা, যুক্তিবিদ্যার পরিচায়ক রহস্য। আর নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শুধুমাত্র তাঁরই জবানীতে প্রকাশিত হয়নি বরং তাঁর ঘোরবিরোধীরাও একথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইমাম আলী যুগশ্রেষ্ঠ
মানব ও খেলাফতের যথাযোগ্য প্রাপক। প্রাধান্য রাখা সত্ত্বেও তাঁকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত রেখে তাঁর অধিকারকে ভূ-লন্ঠিত করা হয়েছে। আবু উবাইদা জাররা যখন শুনতে পায় যে ইমাম আবু বকরের বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি
জানিয়েছে তখন ইমামের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, শাসন কর্তৃত্বকে আবু বকরের হাতে ছেড়ে দিন। আমি জানি আপনি এর জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কারণ শ্রেষ্ঠত্বে, মর্যাদায়, ঈমানদার হিসেবে, জ্ঞানগরিমায়, দূরদর্শিতায়,
বংশমর্যাদায় এবং রাসুলুল্লাহর জামাতা হিসেবে আপনার সমতুল্য কেউই নেই। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১ পৃ. ১২)
ইমাম নিজের অধিকার পুনরুদ্ধারে শুধু বক্তৃতা ভাষণ বা স্মরণ করানোর উপরই ডিফেন্স করেননি ইতিহাসবেত্তাদের লেখনীতে জানা যায় পাশাপাশি তিনি কখনো কখনো ফাতেমা, হাসান-হোসাইনকে নিয়ে আনসারদের শীর্ষ নেতৃবর্গের
নিকট গমন করতেন যাতে করে খেলাফতকে তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাড়া পাননি। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বলাবলি করত যে আলী নিজেই যদি সবার
আগে খেলাফতের চিন্তা করে এবং আমাদের কাছ থেকে বাইয়াত চায় তাহলে আমরা তো তার সমর্থন ব্যক্ত করতে পারিনা কখনো; কেননা তার পূর্বেও তো আমরা প্রথম খলিফার বাইয়াতকে নাকচ করে দিয়েছি? ইমাম তাদের
প্রশ্নোত্তরে বলতেন, আচ্ছা আপনাদের দৃষ্টিতে এটাই কি উত্তম হত যে আমি পয়গাম্বরের মৃতদেহকে ফেলে রেখে খেলাফতের মোহে ছুটে যেতাম এবং সবার কাছ থেকে বাইয়াতের আহ্বান জানাতাম? ইমামের কথার সমর্থনে হযরত
ফাতেমা যাহরা বলেন, আলী নিজের দায়িত্ব কর্তব্যকে সবার চেয়ে ভালই জানেন। যারা আলীর হককে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাধাদান করেছে তাদের হিসাব মহান আল্লাহর হাতে। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১, পৃ. ১২)
অবাধ্য সীমালংঘনকারী দলের সামনে ইমামের এটা ছিল প্রথম পদক্ষেপ যার মাধ্যমে তিনি আশাবাদী ছিলেন হয়তো আনসারদের বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গকে বলে কয়ে অবহিত করে নিজের অধিকারকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে; কিন্তু
ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে এতে তিনি কোন ফলাফল লাভ করতে পারেননি বরং তাঁর হককে পঁয়মাল করা হয়। এখন যদি কোন বিবেকবান ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয় পরিবেশের এমন অস্থিতিশীল, সংবেদনশীল, অরাজকতাপূর্ণ
ও টানটান উত্তেজনায় ইমাম আলীর পক্ষে কোন পন্থাবলম্বন করলে ভাল হত, শুধুমাত্র সমাজকে পর্যবেক্ষণ করা ও নিশ্চুপ থাকা নাকি যুদ্ধ ও আন্দোলনের ডাক দেয়া?
ইমাম আলী (আঃ) এর সামনে একটি মাত্র রাস্তা খোলা ছিলঃ
পরিস্থিতির এমন নাজুক অবস্থায় ইমামের সামনে একটি পথ ব্যতীত ভিন্ন কোন উপায় না থাকায় তিনি শুধু আনসার ও মুহাজিরদের বিভিন্ন উপদেশমুলক, পরামর্শমুলক, সাবধানমুলক এবং সমাধানমুলক বাণীর মাধ্যমে
পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন এবং জনগণের নিকট সত্যকে পরিষ্কার ও নিজের হুজ্জাতকে সমাপ্ত করেন। অন্য দিকে খলিফা ও তার সমমনা ব্যক্তিরা খেলাফতের রশিকে কবজা করার জন্য জোরাজুরি করতে লাগে এবং তারা নিজেদের
ক্ষমতাকে সমপ্রসারণের অভিসন্ধি নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায়। আর যুগের আবর্তে খেলাফতের মসনদে আরোহণকারীরা খেলাফতের বিষয়টিকে এমনভাবে জনতার মন-মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করাতে থাকে যে এক সময় এটাকেই তারা
সঠিক প্রচলিত হুকুমাত হিসেবে মনে করতে লাগে এবং তাদের থেকে জীবনাদর্শ গ্রহণ করতে শুরু করে। সমাজের এমন সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মুহূর্তে মুহূর্তে মহানবীর পরিবারের উপর নেমে আসে দুর্ভোগ। বিপরীত দিকে
শাসকদের ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। এমতাবস্থায় ইমাম আলী (আঃ) এর দুটি পন্থা বেছে নেয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
ক) নবী বংশের সহায়তা করা এবং অনুরক্তদের নিয়ে লড়াই করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনা।
খ) আর নয়তো নিরব থাকা ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া এবং ব্যক্তিগত, চারিত্রিক দায়দায়িত্বকেই শুধু আঞ্জাম দেয়া।
অতএব, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে জানা যায় ইমাম যদি এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিগ্রহের পন্থা অবলম্বন করতেন তাহলে এতে তৎকালীন নব জন্ম নেয়া ইসলামের ক্ষতি ও অমঙ্গল বৈ কোনই কল্যাণ হত না। যার ফলে দ্বিতীয়
পথ নির্বাচন ছাড়া ইমামের সামনে ভিন্ন কোন উপায়ন্তর ছিল না।
পয়গাম্বর (সাঃ) উম্মাতের মুর্তাদ হওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেনঃ
১। মহানবী (সাঃ) জীবদ্দশায় ইসলামী সমাজের ভবিষ্যত ও ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন এবং তিনি সমাজের অবাধ্যতা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে মুসলমানদের মধ্যে কিছু দল তার মৃত্যুর পর সেই জাহিলিয়াতের
দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। সাথে সাথে ইলাহী বিধি আহকামকেও ভুলে যাবে। তাঁর এই ভাবনা আরো দৃঢ়তা লাভ করে উহুদের যুদ্ধের সময়। উহুদের যুদ্ধে যখন পয়গাম্বর (সাঃ) এর কতল হওয়ার অপপ্রচার শুরু হয় তিনি প্রত্যক্ষদর্শী
হিসেবে দেখতে পান যে অধিকাংশ সাধুবেশী পাশে অবস্থানকারী বুযুর্গ ব্যক্তিরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করতে আরম্ভ করেছে। তারা পাহাড়, পর্বত ও ময়দানের আশেপাশে জান বাঁচাতে ছুটাছুটি করছে। আবার অনেকেই
আবু সুফিয়ান ও মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর পাশে থাকাকে নিরাপদ মনে করে ছুটে যায়। এসকল লোকদের আকিদা বিশ্বাস এতই নড়বড়ে ও দুর্বল ছিল যে আল্লাহর সম্পর্কে হীন ধারণা করতেও তাদের বুক ততটুকু কাঁপেনি।
এ সমস্ত ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করে পবিত্র কোরআন ইরশাদ করে, “স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলেনা আর রাসুল তোমাদের পিছন দিক হতে আহ্বান করছিল।
ফলে তিনি তোমাদের বিপদের উপর বিপদ দিলেন যাতে তোমরা যা হারিয়েছো অথবা যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছিল তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।
(সূত্রঃ আলে ইমরানঃ ১৫৩)
পয়গাম্বরের কিছু সঙ্গীরা আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে শুরু করল যেভাবে জাহিলিয়াতের লোকেরা করত তারা এটাও বলতে লাগে যে এছাড়া কি আমাদের জন্য আর কোন পথ খোলা ছিল?
পবিত্র কোরআন অন্য একটি আয়াতে পয়গাম্বরের ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর কিছু লোকের ছত্রভঙ্গ ও দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। যেমন বলা হচ্ছে, মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র; তার পূর্বে
বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।
(সূত্রঃ আলে ইমরান আয়াত ১৪৪)
উক্ত আয়াত আসহাবে পয়গাম্বরকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এক. জাহিলিয়াতের যুগে প্রত্যাবর্তনকারী দল, দুই. মজবুত ঈমানের উপর অবিচল অবস্থানকারী কৃতজ্ঞ দল।
২) বানী সাকিফার ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নীল নকশা তৈরি, গোত্র ও বংশীয় বিদ্বেষ, জাহিলিয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, ঐ সমস্ত মুসলমানদের মনে
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তখনও পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেনি। ইসলাম ও ঈমান কেবলমাত্র তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ চেহারায় ঢাকনার ন্যায় ঝুলছিল। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় ঐ সমস্ত জামাত, তাদের বক্তৃতা ভাষণ কোন কিছুই
মঙ্গলার্থে ছিল না। প্রত্যেকেই খেলাফতের রাজমুকুট তার যোগ্য ব্যক্তির হাতে না দিয়ে নিজের গায়ে জড়াতে চেয়েছে। উক্ত সংগঠনটি ইসলাম ও মুসলমানদের কোন ধরণের কল্যাণমুলক চিন্তা তো করেনই নি বরং ইসলামের ভঙ্গুর
কিশতিকে যিনি সমুদ্রের পারে নিয়ে মুক্তি দিতে পারেন তার কাছ থেকে খেলাফত লুন্ঠন করেছে। মোটকথা হলো ঐ সমস্ত লোকদের অন্তরে ইসলামী আকিদা তখনও পর্যন্ত স্থান পায়নি, জাহিলিয়াতের আদিখ্যেতা চালচলন
অভ্যাস তাদের মন মস্তিষ্ককে ঘিরে রেখেছিল এবং মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বিগ্রহ, ফেরকাবাজী, দলে দলে বিভক্তির ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ হুমকির মুখে পড়ে আর কিছু লোক শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়।
৩) বানী সাকিফার ঘটনার পর ইমাম আলী (আঃ) এর প্রদত্ত ভাষণ এ বিষয়গুলোকে আরো পরিষ্কার করে। তিনি নিজের বক্তৃতায় ইসলামী উম্মাহর ঐক্য সংহতির গুরুত্ব এবং ছত্রভঙ্গতা, দলাদলির পরিণাম সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, আবু সুফিয়ান যখন ইমাম আলীকে বাইয়াতের চাপ দিতে থাকে ইমাম জনসমাবেশের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, হে জনমন্ডলী! ফিতনার তরঙ্গের মাঝে শক্ত হাতে হাল ধরে মুক্তির নৌকা চালিয়ে যাও; বিভেদের পথ থেকে
ফিরে এসো; এবং অহংকারের মুকুট নামিয়ে ফেলো ........ যদি আমি বলেই ফেলি খেলাফতের কথা তবে তারা আমাকে বলবে ক্ষমতালোভী, আর যদি আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি তবে তারা বলবে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত।
দুঃখের বিষয় এই যে, সকল উত্থান-পতনের মধ্যেও আমি টিকে আছি। আল্লাহর কসম, আবু তালিবের পুত্র মৃত্যুর সাথে এমনভাবে পরিচিত যেমন একটি শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে। আমি নিরব রয়েছি আমার গুপ্ত জ্ঞানের
কারনে যা আমাকে দান করা হয়েছে। যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে গভীর কূপ থেকে পানি উত্তোলনরত রশির মতো তোমরা কাঁপতে থাকবে। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-৫)
৪) নবমুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে পয়গাম্বরের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই তাদের মাঝে কতক দল ধর্মত্যাগ করে জাহিলিয়াতের তাদের পূর্বপুরুষদের পথকে স্বাগত জানায়। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইসলামী হুকুমতের বিরোধীতায় নেমে
পড়ে এবং ইসলামী কর দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ হলো, মুসলমানদের মধ্যে যারা ঈমানে বলিষ্ঠ তাদেরকে সাথে নিয়ে মুর্তাদদের সাথে সংগ্রাম করা যাতে তারা পুনরায় শাসকদের আনুগত্য
প্রকাশ করে এবং ইসলামী আইন কানুনের কাছে মস্তকাবনত করে। এছাড়া অন্য একটি গ্রুপ ইয়ামানে (মুসাইলামা, সাজ্জাহ ও তালাইহা) মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদার সেজে আরেকটি ফিতনার সৃষ্টি করে। তাই মুহাজির ও আনসারদের
মধ্যে যেখানে ঐক্য ফিরিয়ে আনা অসম্ভব, পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের ইসলামকে বিদায় জানানো এবং বিভিন্ন স্থানে মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদারদের উত্থান এ সমস্ত পরিস্থিতি সমূহে ইমাম আলী (আঃ) এর ন্যায় মহামানবের পক্ষে
নিজের অধিকার আদায়কল্পে কিয়াম করা মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। ইমাম মিশরবাসীদের প্রতি একটি পত্রে উক্ত বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আরবরা খেলাফতকে পয়গাম্বরের খান্দান
থেকে ছিনিয়ে নিবে বা এ থেকে আমাকে বিরত রাখবে। তারা যখন আমার বাইয়াত নিতে চাপ সৃষ্টি করছিল এ দেখে আমি আরো চমকে গেলাম। কিন্তু আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। দেখলাম জনতার একটি দল ইসলামকে ত্যাগ করেছে
এবং তারা মুহাম্মদের দ্বীনকে ধ্বংসের পাঁয়তারায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপলব্ধি করলাম যে যদি ইসলাম ও মুসলমানদের সাহায্যার্থে এগিয়ে না যাই তাহলে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আর দ্বীন ধ্বংস হওয়ার যন্ত্রণা আমার নিকট খানিক
দিনের হুকুমত না পাবার যন্ত্রণা অপেক্ষা অধিক বেশি যা বন্যার বানের মত অতিদ্রুত শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর আমি ঐ সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম এবং মুসলমানদের সহযোগিতা করতে প্রস্তত হলাম যাতে বাতিল অপসারিত
হয় আর জনতা ইসলামের নিরাপদ দূর্গে প্রবেশ করতে পারে। (নাহাজুল বালাগা)
উসমানের খেলাফতের সূচনালগ্নে যখন শূরা কমিটির সদস্যরা তার প্রতি রায় প্রকাশ করে ইমাম তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা সকলেই জানেন আমি খেলাফতের জন্য একমাত্র উপযুক্ত। এ মুহূর্তে যদিও আমার উপর জুলুম
করা হয় তবুও খেলাফতকে ছালাম জানালাম এবং শুধুমাত্র সওয়াবের আশায় আমি হুকুমতের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছি।
ইবনে আবিল হাদীদের মন্তব্যঃ
ইমাম আলী (আঃ) নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন রাখলেন কিছু দিন। হযরত নবী দুলালী ফাতেমা যাহরা (সাঃ আঃ) তাঁকে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য লড়াই করতে পরামর্শ দেন। মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের
আযানের ধ্বনি আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ ভেসে আসছিল ইমাম ফাতেমার দিকে মুখ করে বলেন, তুমি কি চাও এই ধ্বনি বিলুপ্ত হয়ে যাক? ফাতেমা বলেন, কখনো না। তারপর ইমাম বলেন, তাহলে আমি যে পথ
নির্বাচন করেছি এটা আঁকড়ে থাকাটাই হবে উত্তম। (সূত্রঃ শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১১, পৃ.১১৩)
এতক্ষণ আলোচনার পর এখন আমরা ইমাম ঠান্ডা মাথায় সার্বজনীন কল্যাণ চিন্তা করে যে পদক্ষেপ নিলেন তার ফলাফল সম্পর্কে পরখ করে দেখব,
মহৎ উদ্দেশ্যের মূল্যায়নঃ
এ রকম খুব কম সমাজই চোখে পড়ে যেখানে যোগ্য পরিচালক বা রাহবারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। একজন দক্ষ রাহবারের যে শর্তাবলী থাকা বাঞ্ছনীয় এ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তাহলে বলা যায় যে গোটা সমাজের মাঝে
এ কাজের জন্য হাতেগোনা কয়েকজনকে পাওয়া যাবে যারা এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত। সেই যোগ্য সমাজের রাহবারদের মধ্যে যিনি ঐশ্বী প্রদত্ত রাহবার হিসাবে মনোনীত তার দায় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
আল্লাহ মনোনীত রাহবারগণ নিজের মাকাম বা পদমর্যাদাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। আর খোদায়ী রাহবারগণ তো সেই মহৎ লক্ষ্যকে সমাজে বাস্তবায়ন করতেই প্রেরিত। তাদের
সামনে যখন দুটি রাস্তা উন্মোচন হয় তখন বাধ্য হয়ে একটি ত্যাগ করে অন্যটিকে বেছে নেন এবং নিজের মিশন বা অভিসন্ধিকে বাঁচানোর তাগিদে রাহবারত্বকে বিসর্জন দিয়ে দেন; কেননা এ ক্ষেত্রে মাকামের চেয়ে পবিত্র লক্ষ্যই
অগ্রাধিকার রাখে।
মুত্তাকিনদের মাওলা ইমাম আলী (আঃ) পয়গাম্বর (সাঃ) এর ওফাতের পর পরই ঠিক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোন। মানুষ যেভাবে কচি চারা গাছকে অতিযত্নে লালন করে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে তার শাখা প্রশাখা,
ফল ফলাদি, শীতল ছায়া দ্বারা উপকার ভোগ করতে পারে তদ্রুপ মহানবী (সাঃ) ইমাম আলী (আঃ)কে লালন পালন করেন যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তার পবিত্র অস্তিত্ব থেকে লাভবান হতে পারে। ইমাম মহানবীর (সাঃ) মৃত্যুর
পর পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলেন যে যদি খেলাফতকে হস্তগত করা হয় তাহলে এমন জটিলতার উদয় হবে যে পয়গাম্বরের পবিত্র মিশন যা তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তা বিফলে যাবে।
পূর্ব শত্রুতা ও বিদ্বেষঃ
তৎকালীন ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার দুরাবস্থা এবং মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ বিসম্বাদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে চরম আক্রোশ ও রক্তারক্তি শুরু হয়। মদিনার ও বাহিরের অধিকাংশ সমপ্রদায় ইমাম আলী (আঃ)
এর প্রতি ছিল নির্দয়। তারা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আলী (আঃ) এর উপর আক্রোশে ফেটে পড়ে। কারণ এসকল গোত্রের লোকদের পূর্বপুরুষদের তিনি কুফরের পক্ষে অবস্থান করার জন্য শায়েস্তা করেন এবং বিভিন্ন
যুদ্ধক্ষেত্রে ইমামের হাতেই তারা নিহত হোন। যদিও সে সকল মুশরিকদের পরবর্তী প্রজন্ম ইসলামের সাথে বাহ্যিক বন্ধন তৈরি করে কিন্তু মনে মনে চরম বিদ্বেষ লালন করে আসছিল। আর এমতাবস্থায় যদি ইমাম নিজের শক্তিমত্তা
দিয়ে লড়াই করে স্বীয় অধিকারকে ছিনিয়ে আনতেন তাহলে এ লড়াই থেকে নিম্নের ফলাফল বের হয়ে আসতঃ
১। এ লড়াইয়ে নিজের অধিকাংশ প্রিয় সাথীদের হারাতে হত। তারা মাওলার জন্য মৃত্যুকে বরণ করলেও বিনিময়ে ইমামের হক ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না।
২। শুধু বিশ্বস্থ সাথীদের শাহাদতই নয় বরং বানী হাশিম ও প্রিয় ব্যক্তিদের আন্দোলনের কারণে পয়গাম্বরের সাহাবাদের মধ্যে যারা আলীর খেলাফতকে মানতে পারেনি তারা কখনো তাঁর কাছে মাথা নত করত না। ফলে মুসলমান সমাজ
নড়বড়ে হয়ে যেত। সাহাবীদের মধ্যে যদিও আলীর রাহবারিত্বকে অনেকে মানতে নারাজ ছিল; কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তারা ইমামের সাথে ঐক্যমত ছিল।
৩। মুসলমানদের ঈমানী দূর্বলতার কারণে অন্যান্য প্রদেশে যাদের মধ্যে সবেমাত্র ইসলামের ছোঁয়া লেগেছিল তারাও ইসলাম বিদ্বেষী ও মুর্তাদদের সাথে যোগদান করে। তারা এক কাতারে শামিল হয় এবং সমাজের সঠিক দিকনির্দেশক না
থাকার ফলে তাদের মাঝ থেকে তাওহীদের চেরাগ চিরদিনের জন্য খামোশ হয়ে যেত। ইমাম আলী (আঃ) এমন একটা তিক্ত ভয়ানক পরিস্থিতিকে অতি কাছে থেকে অবলোকন করে নিরব থাকাটাই মঙ্গলজনক মনে করেন।
বিষয়টি আরো ভাল হবে যদি তা ইমামের জবান থেকে শ্রবণ করি।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুনাদা বলেন, আমি আলী (আঃ) এর ক্ষমতায় আরোহণকালে একদিন মক্কা থেকে মদিনায় আসলাম। দেখলাম যে, জনতা মসজিদে পয়গাম্বরে একত্রিত হয়েছে এবং ইমামের প্রতীক্ষায় বসে আছে। ইমাম একটি
তরবারী সাথে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। সকলেই তার প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর তিনি মিম্বারে উঠে আল্লাহর স'তি গাওয়ার পর সবাইকে সম্বোধন করে বলেন, সাবধান হও হে জনমন্ডলী! পয়গাম্বরের
ওফাতের পর তোমাদের উচিত ছিল তিনি হুকুমাতের জন্য যাকে নির্বাচিত করে ছিলেন তার ব্যাপারে বিরোধীতা না করা। কেননা, আমরাই মহানবীর উত্তরসূরি, আহলে বাইয়াত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কুরাইশদের মধ্যে
একটি দল আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, খেলাফতকে আমাদের কাছ থেকে ছিনতাই করেছে এবং তা নিজেরদের কাছে রাখতে চেয়েছে। আল্লাহর কসম! যদি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকত বা ইসলাম
থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় না থাকত অথবা ইসলাম নিঃশ্বেষ হওয়ার উপত্রুম না হত তবে তোমরা আলীর ভিন্ন রুপ দেখতে। (শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১, পৃ. ৩০৭)
মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করা ও ঐক্য বজায় রাখা ছিল ইমামের একটি মহান লক্ষ্য। তিনি ভাল করে জানতেন যে এই ঐক্যের কারণেই মহানবীর (সাঃ)আমলে স্বৈরবাদীদের ভীত নড়বড়ে হয়েছিল এবং ইসলামের বিকাশ ও
অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং যদি এই বন্ধন ক্ষমতার জটিলতার কারণে বিনষ্ট হয় তাহলে মুসলমানরা এখতেলাফের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তাছাড়া কুরাইশদের মধ্যে যে দলটি ইসলামের অমঙ্গল চেয়েছিল তারা একটি অজুহাতে
ইসলামের মূলে আঘাত হানার অপচেষ্টা করবে।
সমস্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ইমাম আলী (আঃ) কেন নিরবতাকেই যুদ্ধের উপর প্রাধান্য দিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। একজন কবি বিষয়টি তার কবিতার চরণে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। যার অনুবাদ হলোঃ
আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি উম্মতের নেতৃত্ব খান্দানে হাশিম ও আবুল হাসানের কাছ থেকে ছিনতাই করা হবে।
আলী কি প্রথম পুরুষ নন যিনি কেবলার দিকে নামাজ আদায় করেছেন? তিনি কি কোরআন ও সুন্নাতে তোমাদের চেয়ে জ্ঞানী নন? তিনি কি মহানবীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন না? তিনি কি প্রত্যেকটি সমরে পয়গাম্বরকে সাহায্য করেননি?
সিফফিনের যুদ্ধে বানী আসাদের এক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞাসা করেন, কুরাইশগণ কিভাবে আপনার মত ব্যক্তিকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করলো? ইমাম তার এই অসময়ে প্রশ্ন করার জন্য অসন্তষ্ট হলেন কারণ অনেক ইমামের
পক্ষাবলম্বনকারী সিপাহীরা অন্য খলিফাদের উপর বিশ্বাস করত। তার এহেন প্রশ্নের কারণে তাদের সারিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ইমাম ব্যথিত হৃদয়ে বলেন, পয়গাম্বরের প্রতি অনুরাগের কারণে এবং যেহেতু প্রত্যেক মুসলমান প্রশ্ন করার
হক রাখে তাই তোমাকে এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলব উম্মতের পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই ছিল এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মহানবীর সাথে। কিন্তু একদল কৃপণতা প্রকাশ করল এবং একদল চোখ বন্ধ করে রাখল।
তাদের ও আমাদের মাঝে ফয়সালা দান করবে আল্লাহপাক এবং আমরা সকলেই তার কাছে ফিরে যাব।
পরিশেষে বলব, এ ধরনের আরো বহু কারণ বিদ্যমান ছিল যার কারণে ইমাম ইসলাম রক্ষার্থে নিজের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেন এবং প্রায় পঁচিশ বছর নিরব থেকে বুক ভরা বেদনা নিয়ে দিনাতিপাত করেন। আলোচনার সূচনাতেই বলে নেয়া সমীচীন মনে করছি যে, এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য বহু গবেষণার দরকার। আর বিষয়টি খুবই জটিল ও দীর্ঘ পরিসরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তাই সামান্য কলেবরে উল্লেখিত
শিরোনামের সামান্য কিছু ব্যাখ্যার প্রয়াস পাব। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আহ্লে বাইয়াতকে মুহাব্বত করে না এমন মুসলমান খুবই কম। তবে যুগ যুগ ধরে আহলে বাইয়াতকে মাজলুম বানিয়ে কোনঠাসা করে রাখার অপতৎপরতা চালিয়েছে
মুসলমান নামধারী বকধার্মিক কিছু মোনাফেকের দল। তাই আজও কিছু মানব জগৎসংসারে বসবাস করে যারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা করে থাকেন। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা, সত্য ইতিহাস না জেনে নির্বোধের মত কথা
বলা এ যেন তাদের নিত্তনৈমিত্তিক পেশা। কতক লোক আজও ইমাম আলী (আঃ) এর মারেফাত লাভ না করার কারণে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামুলক কথাবার্তা বলেন যা বিবেকবহির্ভূত এবং অন্তঃসারশূন্য কাজ। অনেকেই
নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে যদি খেলাফত আলী (আঃ) এর হক ছিল তবে কেন তিনি তার হক আদায় করতে আন্দোলন করেননি, কেন তিনি নিরবতাকে বেঁছে নিলেন, কেন প্রতিবাদ করেননি। যাই হোক এ জাতীয় প্রশ্ন করে
এক প্রকার বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। তাই আসুন ইনসাফের সুরে কথা বলি এবং সত্যকে জানার, বুঝায় ব্রতী হয় তাহলে আর বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হবে না। এবার মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পয়গাম্বর (সাঃ) এর বেদনাময় ওফাতে গোটা মুসলিম সমাজ এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের উপর নেমে আসে যন্ত্রণার মহাপ্লাবন ও মহাসংকট। রাষ্ট্রে সর্বদা একটা টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি
বিরাজ করছিল বিশেষ করে খেলাফতের শাসন কর্তৃত্বের রদবদলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং সার্বক্ষণিক একটা ভীতি কাজ করছিল যে, হয়তো আরবের নব দীক্ষিত মুসলমানরা
জাহিলিয়াতের পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন একটি নব প্রষ্ফুটিত ফুলের পাঁপড়ির ন্যায় সবেমাত্র উঁকি মেরে আত্মপ্রকাশ করেছিল যার ফলে জনগণ ইসলামের সাথে তখনও সখ্যতা গড়তে পারেনি বা
ইসলামী আন্দোলনকে তারা গুরুত্বহীন ভেবে পাশ কেটে চলেছে। ইমাম আলী (আঃ) এবং মহানবী (সাঃ) এর কিছু বিশ্বস্ত সাহাবা কেরাম সবেমাত্র রাসুলুল্লাহর (সাঃ) দাফন কাফন সুসম্পন্ন করতে না করতেই সাহাবাকেরামের
মাঝে দুটি দল খেলাফতের দাবিদার সেজে হৈ হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেয়। দল দুটি হচ্ছে,
১) আনসারগণ যারা খাজরাজ জনগোষ্ঠীর লোক ছিল। তারা আগে থেকেই সাকিফায়ে বানী সাআদা নামক স্থানে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় মুসলিম রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদ বিন উবাদার হাতে ন্যস্ত
করতে হবে এবং সেই হবে পয়গাম্বর (সাঃ) এর জানেশিন বা উত্তরসূরি। কিন্তু আনসারদের মধ্যে ঐকমত্য না থাকায় বিশেষতঃ আউস ও খাজরাজ গোত্রের পারস্পরিক পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। আউস গোত্রের
লোকেরা খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদের সাথে শুধু বিরোধীতাই করেনি বরং তারা ক্ষমতা তার হাত থেকে নিয়ে মুহাজিরদের কারো হাতে দেয়ার পক্ষপাতি ছিল।
২) মুহাজিরগণ যদিও বানী সাকিফায় মুহাজিরদের উপস্থিত লোকের সংখ্যা সামান্য ছিল তথাপি এক ধরনের কৌশল অবলম্বনের ফলে সকলেই হযরত আবু বকরের প্রতি সমর্থন জানায়। আশে পাশের অনেকেই তাকে রাসুলুল্লাহর (সাঃ)
খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর এ সুযোগে তিনি জনগণকে নিজের বাইয়াত করার আহ্বান জানান।
উক্ত দুটি দল ছাড়াও আরেকটি দল বিদ্যমান ছিল যারা ইমাম আলী (আঃ) এর জন্য ছিল নিবেদিত। এদের মধ্যে বানী হাশিম ও কিছুসংখ্যক বুযুর্গ সাহাবা কেরাম মনে করতেন খেলাফতের একমাত্র হকদার ইমাম আলী (আঃ)
এবং অন্য সবার চেয়ে ইমাম আলী নেতা ও রাহবার হিসেবে যোগ্য। এই দলটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল যে, রাসূলুল্লাহর পবিত্র দেহ মোবারক সবেমাত্র দাফন হতে না হতেই মুহাজির ও আনসারদের মাঝে খলিফা মনোনয়ন নিয়ে
বাকবিতন্ডা, সংঘর্ষ বেঁধে গেছে। তারা নিজেদের বিরোধী মনোভাবকে মুহাজির ও আনসারদের বরং সমস্ত মুসলমানদের কর্ণকুহরে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে হযরত আবু বকরের খলিফা মনোনয়ন পন্থাকে বাতিল ঘোষণা করে সরাসরি
হযরত ফাতেমার গৃহাভিমুখে গমন করেন। অবশেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফাতেমার গৃহকে ত্যাগ করে মসজিদে গিয়ে অবস্থান নেন। নাজুক পরিস্থিতিতে তৃতীয় দলটি বিশেষ করে ইমাম আলী ও তার সঙ্গী সাথীরা দেখলেন যে
ইসলামী শাসন কর্তৃত্ব তার সঠিক হকদার ও প্রাপকের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এবং তার সাথে শরীয়তের মাঝেও কাঁটছাট করা হচ্ছে পাশাপাশি পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে মোড় নিল যে খেলাফতের সত্যিকারের আল্লাহর
মনোনীত ব্যক্তির স্থলে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে জনসাধারণ রাসূলুল্লাহর প্রকৃত উত্তরসুরি ভাবতে শুরু করল। আর এমতাবস্থায় হযরত আলী (আঃ) এর ন্যায় মহোত্তম ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চুপ থাকাটা মোটেও ভাল ঠেকেনি
তাই তিনি নিরবতাকে পিছনে ঠেলে জবানের তীক্ষ্ণতাকে কাজে লাগান। মসজিদে নব্বীতে আসার পর তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্য পিড়াপীড়ি করা হলে সমবেত মুহাজিরদের সম্বোধন করে বলেন, হে মুহাজিরগণ!
পয়গাম্বর (সাঃ) স্বয়ং যে হুকুমাতের ভিত্তি স্থাপন করেছেন সেটাকে তোমরা তাঁর পবিত্র অভিজাত বংশের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেদের কুটিরে আবদ্ধ রাখার বৃথা চেষ্টা করোনা। আল্লাহর শপথ! মহানবীর পরিবার একাজের
জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম। কেননা তাদের মধ্যে (আহলে বাইত) এমন সমস্ত যোগ্য ও মেধাবান ব্যক্তিরা রয়েছে যারা কোরআনের সঠিক গুঢ়রহস্য জানে এবং দ্বীন ইসলামের জ্ঞানভান্ডার তাদের অধীনে সুরক্ষিত, পয়গাম্বর (সাঃ)
এর সুন্নাত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত, তারাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনার ক্ষমতা রাখে, সমস্ত ফেতনা ফ্যাসাদের শিকড়কে তারাই উপড়ে ফেলতে পারে এবং বাইতুল মাল গাণিমতের সম্পদকে সুষমভাবে
একমাত্র তারাই বন্টন করার মনমানসিকতা রাখে। আর বাস্তবতা হচ্ছে এমন সকল যোগ্য পন্ডিত ব্যক্তিরা থাকতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অন্যদের হাতে মানায় না। এমন যেন না হয় যে, তোমরা নফসের খায়েশ মোতাবেক চলতে গিয়ে
আল্লাহর পথ থেকে ছিটকে পড় এবং হাকীকাত থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্রান্তিতে হামাগুড়ি খেতে থাক। (সূত্রঃ আল ইমামত ওয়াসসিয়াসাত খ.১, প.১১)
উক্ত বক্তৃতায় ইমাম নিজের শ্র্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে কত সুন্দর ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া এখানে অবৈধ খেলাফতের দাবিদারদের সাথে নিজের বিরোধী মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে
ইমাম আলী (আঃ) বানী হাশিমের একটি দল নিয়ে আবু বকরের নিকট যান এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, যোগ্যতা, বীরত্বগাঁথা ইতিহাস, রণাঙ্গনের সাহসিকতা এ সমস্ত বিষয়কে তার সামনে তুলে ধরে বলেন, আমি পয়গাম্বরের
জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উপযুক্ত। আমি তাঁর (সাঃ) উযির, উত্তরসূরি, জ্ঞানভান্ডার এবং গুপ্তরহস্য ভান্ডার। আমি হলাম সিদ্দিকে আকবার এবং সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী ন্যায়বান ব্যক্তি।
আমি সেই পুরুষ যে প্রথম মহানবীর উপর ঈমান আনার পর তাঁকে সত্যবাদী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। আমি মুশরিকদের সাথে রণক্ষেত্রে দৃঢ় ও অটলভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি, সুন্নাত ও কিতাবের সর্বজান্তা, উসূলে দ্বীন ও ফুরুয়ে
দ্বীনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, ভাষার মাধুর্যতা আর বাক্যালংকারে আমার রয়েছে পুরোপুরি দখল। তবু কেন তোমরা আমার অধিকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছো?
ইমাম আলী (আঃ) অন্য আরেকটি খুতবায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সক্ষম ক্ষমতাবান ও সর্বাপেক্ষা আল্লাহর বিধি বিধান সম্পর্কে সুঅভিজ্ঞ পন্ডিত একজন কোয়ালিটি সম্পন্ন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, হে জনতা! হুকুমত
পরিচালনার জন্য তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত যিনি জনতার মাঝে রাষ্ট্র চালানোর কলাকৌশলে অভিজ্ঞ এবং আল্লাহর বিধানকে ভাল করে জানেন। যার মধ্যে এই সামষ্টিক গুণাবলী অবর্তমান সে যদি খেলাফত লাভের চিন্তায় মগ্ন হয় এবং
নিজের ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডকে চালাতে থাকে তবে সে কতল তো হবেই। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-১৬৮)
এটা ছিল ইমাম আলীর দূরদর্শিতা, যুক্তিবিদ্যার পরিচায়ক রহস্য। আর নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শুধুমাত্র তাঁরই জবানীতে প্রকাশিত হয়নি বরং তাঁর ঘোরবিরোধীরাও একথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইমাম আলী যুগশ্রেষ্ঠ
মানব ও খেলাফতের যথাযোগ্য প্রাপক। প্রাধান্য রাখা সত্ত্বেও তাঁকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত রেখে তাঁর অধিকারকে ভূ-লন্ঠিত করা হয়েছে। আবু উবাইদা জাররা যখন শুনতে পায় যে ইমাম আবু বকরের বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি
জানিয়েছে তখন ইমামের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, শাসন কর্তৃত্বকে আবু বকরের হাতে ছেড়ে দিন। আমি জানি আপনি এর জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কারণ শ্রেষ্ঠত্বে, মর্যাদায়, ঈমানদার হিসেবে, জ্ঞানগরিমায়, দূরদর্শিতায়,
বংশমর্যাদায় এবং রাসুলুল্লাহর জামাতা হিসেবে আপনার সমতুল্য কেউই নেই। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১ পৃ. ১২)
ইমাম নিজের অধিকার পুনরুদ্ধারে শুধু বক্তৃতা ভাষণ বা স্মরণ করানোর উপরই ডিফেন্স করেননি ইতিহাসবেত্তাদের লেখনীতে জানা যায় পাশাপাশি তিনি কখনো কখনো ফাতেমা, হাসান-হোসাইনকে নিয়ে আনসারদের শীর্ষ নেতৃবর্গের
নিকট গমন করতেন যাতে করে খেলাফতকে তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাড়া পাননি। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বলাবলি করত যে আলী নিজেই যদি সবার
আগে খেলাফতের চিন্তা করে এবং আমাদের কাছ থেকে বাইয়াত চায় তাহলে আমরা তো তার সমর্থন ব্যক্ত করতে পারিনা কখনো; কেননা তার পূর্বেও তো আমরা প্রথম খলিফার বাইয়াতকে নাকচ করে দিয়েছি? ইমাম তাদের
প্রশ্নোত্তরে বলতেন, আচ্ছা আপনাদের দৃষ্টিতে এটাই কি উত্তম হত যে আমি পয়গাম্বরের মৃতদেহকে ফেলে রেখে খেলাফতের মোহে ছুটে যেতাম এবং সবার কাছ থেকে বাইয়াতের আহ্বান জানাতাম? ইমামের কথার সমর্থনে হযরত
ফাতেমা যাহরা বলেন, আলী নিজের দায়িত্ব কর্তব্যকে সবার চেয়ে ভালই জানেন। যারা আলীর হককে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাধাদান করেছে তাদের হিসাব মহান আল্লাহর হাতে। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১, পৃ. ১২)
অবাধ্য সীমালংঘনকারী দলের সামনে ইমামের এটা ছিল প্রথম পদক্ষেপ যার মাধ্যমে তিনি আশাবাদী ছিলেন হয়তো আনসারদের বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গকে বলে কয়ে অবহিত করে নিজের অধিকারকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে; কিন্তু
ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে এতে তিনি কোন ফলাফল লাভ করতে পারেননি বরং তাঁর হককে পঁয়মাল করা হয়। এখন যদি কোন বিবেকবান ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয় পরিবেশের এমন অস্থিতিশীল, সংবেদনশীল, অরাজকতাপূর্ণ
ও টানটান উত্তেজনায় ইমাম আলীর পক্ষে কোন পন্থাবলম্বন করলে ভাল হত, শুধুমাত্র সমাজকে পর্যবেক্ষণ করা ও নিশ্চুপ থাকা নাকি যুদ্ধ ও আন্দোলনের ডাক দেয়া?
ইমাম আলী (আঃ) এর সামনে একটি মাত্র রাস্তা খোলা ছিলঃ
পরিস্থিতির এমন নাজুক অবস্থায় ইমামের সামনে একটি পথ ব্যতীত ভিন্ন কোন উপায় না থাকায় তিনি শুধু আনসার ও মুহাজিরদের বিভিন্ন উপদেশমুলক, পরামর্শমুলক, সাবধানমুলক এবং সমাধানমুলক বাণীর মাধ্যমে
পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন এবং জনগণের নিকট সত্যকে পরিষ্কার ও নিজের হুজ্জাতকে সমাপ্ত করেন। অন্য দিকে খলিফা ও তার সমমনা ব্যক্তিরা খেলাফতের রশিকে কবজা করার জন্য জোরাজুরি করতে লাগে এবং তারা নিজেদের
ক্ষমতাকে সমপ্রসারণের অভিসন্ধি নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায়। আর যুগের আবর্তে খেলাফতের মসনদে আরোহণকারীরা খেলাফতের বিষয়টিকে এমনভাবে জনতার মন-মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করাতে থাকে যে এক সময় এটাকেই তারা
সঠিক প্রচলিত হুকুমাত হিসেবে মনে করতে লাগে এবং তাদের থেকে জীবনাদর্শ গ্রহণ করতে শুরু করে। সমাজের এমন সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মুহূর্তে মুহূর্তে মহানবীর পরিবারের উপর নেমে আসে দুর্ভোগ। বিপরীত দিকে
শাসকদের ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। এমতাবস্থায় ইমাম আলী (আঃ) এর দুটি পন্থা বেছে নেয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
ক) নবী বংশের সহায়তা করা এবং অনুরক্তদের নিয়ে লড়াই করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনা।
খ) আর নয়তো নিরব থাকা ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া এবং ব্যক্তিগত, চারিত্রিক দায়দায়িত্বকেই শুধু আঞ্জাম দেয়া।
অতএব, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে জানা যায় ইমাম যদি এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিগ্রহের পন্থা অবলম্বন করতেন তাহলে এতে তৎকালীন নব জন্ম নেয়া ইসলামের ক্ষতি ও অমঙ্গল বৈ কোনই কল্যাণ হত না। যার ফলে দ্বিতীয়
পথ নির্বাচন ছাড়া ইমামের সামনে ভিন্ন কোন উপায়ন্তর ছিল না।
পয়গাম্বর (সাঃ) উম্মাতের মুর্তাদ হওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেনঃ
১। মহানবী (সাঃ) জীবদ্দশায় ইসলামী সমাজের ভবিষ্যত ও ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন এবং তিনি সমাজের অবাধ্যতা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে মুসলমানদের মধ্যে কিছু দল তার মৃত্যুর পর সেই জাহিলিয়াতের
দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। সাথে সাথে ইলাহী বিধি আহকামকেও ভুলে যাবে। তাঁর এই ভাবনা আরো দৃঢ়তা লাভ করে উহুদের যুদ্ধের সময়। উহুদের যুদ্ধে যখন পয়গাম্বর (সাঃ) এর কতল হওয়ার অপপ্রচার শুরু হয় তিনি প্রত্যক্ষদর্শী
হিসেবে দেখতে পান যে অধিকাংশ সাধুবেশী পাশে অবস্থানকারী বুযুর্গ ব্যক্তিরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করতে আরম্ভ করেছে। তারা পাহাড়, পর্বত ও ময়দানের আশেপাশে জান বাঁচাতে ছুটাছুটি করছে। আবার অনেকেই
আবু সুফিয়ান ও মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর পাশে থাকাকে নিরাপদ মনে করে ছুটে যায়। এসকল লোকদের আকিদা বিশ্বাস এতই নড়বড়ে ও দুর্বল ছিল যে আল্লাহর সম্পর্কে হীন ধারণা করতেও তাদের বুক ততটুকু কাঁপেনি।
এ সমস্ত ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করে পবিত্র কোরআন ইরশাদ করে, “স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলেনা আর রাসুল তোমাদের পিছন দিক হতে আহ্বান করছিল।
ফলে তিনি তোমাদের বিপদের উপর বিপদ দিলেন যাতে তোমরা যা হারিয়েছো অথবা যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছিল তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।
(সূত্রঃ আলে ইমরানঃ ১৫৩)
পয়গাম্বরের কিছু সঙ্গীরা আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে শুরু করল যেভাবে জাহিলিয়াতের লোকেরা করত তারা এটাও বলতে লাগে যে এছাড়া কি আমাদের জন্য আর কোন পথ খোলা ছিল?
পবিত্র কোরআন অন্য একটি আয়াতে পয়গাম্বরের ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর কিছু লোকের ছত্রভঙ্গ ও দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। যেমন বলা হচ্ছে, মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র; তার পূর্বে
বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।
(সূত্রঃ আলে ইমরান আয়াত ১৪৪)
উক্ত আয়াত আসহাবে পয়গাম্বরকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এক. জাহিলিয়াতের যুগে প্রত্যাবর্তনকারী দল, দুই. মজবুত ঈমানের উপর অবিচল অবস্থানকারী কৃতজ্ঞ দল।
২) বানী সাকিফার ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নীল নকশা তৈরি, গোত্র ও বংশীয় বিদ্বেষ, জাহিলিয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, ঐ সমস্ত মুসলমানদের মনে
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তখনও পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেনি। ইসলাম ও ঈমান কেবলমাত্র তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ চেহারায় ঢাকনার ন্যায় ঝুলছিল। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় ঐ সমস্ত জামাত, তাদের বক্তৃতা ভাষণ কোন কিছুই
মঙ্গলার্থে ছিল না। প্রত্যেকেই খেলাফতের রাজমুকুট তার যোগ্য ব্যক্তির হাতে না দিয়ে নিজের গায়ে জড়াতে চেয়েছে। উক্ত সংগঠনটি ইসলাম ও মুসলমানদের কোন ধরণের কল্যাণমুলক চিন্তা তো করেনই নি বরং ইসলামের ভঙ্গুর
কিশতিকে যিনি সমুদ্রের পারে নিয়ে মুক্তি দিতে পারেন তার কাছ থেকে খেলাফত লুন্ঠন করেছে। মোটকথা হলো ঐ সমস্ত লোকদের অন্তরে ইসলামী আকিদা তখনও পর্যন্ত স্থান পায়নি, জাহিলিয়াতের আদিখ্যেতা চালচলন
অভ্যাস তাদের মন মস্তিষ্ককে ঘিরে রেখেছিল এবং মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বিগ্রহ, ফেরকাবাজী, দলে দলে বিভক্তির ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ হুমকির মুখে পড়ে আর কিছু লোক শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়।
৩) বানী সাকিফার ঘটনার পর ইমাম আলী (আঃ) এর প্রদত্ত ভাষণ এ বিষয়গুলোকে আরো পরিষ্কার করে। তিনি নিজের বক্তৃতায় ইসলামী উম্মাহর ঐক্য সংহতির গুরুত্ব এবং ছত্রভঙ্গতা, দলাদলির পরিণাম সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, আবু সুফিয়ান যখন ইমাম আলীকে বাইয়াতের চাপ দিতে থাকে ইমাম জনসমাবেশের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, হে জনমন্ডলী! ফিতনার তরঙ্গের মাঝে শক্ত হাতে হাল ধরে মুক্তির নৌকা চালিয়ে যাও; বিভেদের পথ থেকে
ফিরে এসো; এবং অহংকারের মুকুট নামিয়ে ফেলো ........ যদি আমি বলেই ফেলি খেলাফতের কথা তবে তারা আমাকে বলবে ক্ষমতালোভী, আর যদি আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি তবে তারা বলবে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত।
দুঃখের বিষয় এই যে, সকল উত্থান-পতনের মধ্যেও আমি টিকে আছি। আল্লাহর কসম, আবু তালিবের পুত্র মৃত্যুর সাথে এমনভাবে পরিচিত যেমন একটি শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে। আমি নিরব রয়েছি আমার গুপ্ত জ্ঞানের
কারনে যা আমাকে দান করা হয়েছে। যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে গভীর কূপ থেকে পানি উত্তোলনরত রশির মতো তোমরা কাঁপতে থাকবে। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-৫)
৪) নবমুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে পয়গাম্বরের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই তাদের মাঝে কতক দল ধর্মত্যাগ করে জাহিলিয়াতের তাদের পূর্বপুরুষদের পথকে স্বাগত জানায়। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইসলামী হুকুমতের বিরোধীতায় নেমে
পড়ে এবং ইসলামী কর দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ হলো, মুসলমানদের মধ্যে যারা ঈমানে বলিষ্ঠ তাদেরকে সাথে নিয়ে মুর্তাদদের সাথে সংগ্রাম করা যাতে তারা পুনরায় শাসকদের আনুগত্য
প্রকাশ করে এবং ইসলামী আইন কানুনের কাছে মস্তকাবনত করে। এছাড়া অন্য একটি গ্রুপ ইয়ামানে (মুসাইলামা, সাজ্জাহ ও তালাইহা) মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদার সেজে আরেকটি ফিতনার সৃষ্টি করে। তাই মুহাজির ও আনসারদের
মধ্যে যেখানে ঐক্য ফিরিয়ে আনা অসম্ভব, পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের ইসলামকে বিদায় জানানো এবং বিভিন্ন স্থানে মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদারদের উত্থান এ সমস্ত পরিস্থিতি সমূহে ইমাম আলী (আঃ) এর ন্যায় মহামানবের পক্ষে
নিজের অধিকার আদায়কল্পে কিয়াম করা মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। ইমাম মিশরবাসীদের প্রতি একটি পত্রে উক্ত বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আরবরা খেলাফতকে পয়গাম্বরের খান্দান
থেকে ছিনিয়ে নিবে বা এ থেকে আমাকে বিরত রাখবে। তারা যখন আমার বাইয়াত নিতে চাপ সৃষ্টি করছিল এ দেখে আমি আরো চমকে গেলাম। কিন্তু আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। দেখলাম জনতার একটি দল ইসলামকে ত্যাগ করেছে
এবং তারা মুহাম্মদের দ্বীনকে ধ্বংসের পাঁয়তারায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপলব্ধি করলাম যে যদি ইসলাম ও মুসলমানদের সাহায্যার্থে এগিয়ে না যাই তাহলে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আর দ্বীন ধ্বংস হওয়ার যন্ত্রণা আমার নিকট খানিক
দিনের হুকুমত না পাবার যন্ত্রণা অপেক্ষা অধিক বেশি যা বন্যার বানের মত অতিদ্রুত শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর আমি ঐ সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম এবং মুসলমানদের সহযোগিতা করতে প্রস্তত হলাম যাতে বাতিল অপসারিত
হয় আর জনতা ইসলামের নিরাপদ দূর্গে প্রবেশ করতে পারে। (নাহাজুল বালাগা)
উসমানের খেলাফতের সূচনালগ্নে যখন শূরা কমিটির সদস্যরা তার প্রতি রায় প্রকাশ করে ইমাম তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা সকলেই জানেন আমি খেলাফতের জন্য একমাত্র উপযুক্ত। এ মুহূর্তে যদিও আমার উপর জুলুম
করা হয় তবুও খেলাফতকে ছালাম জানালাম এবং শুধুমাত্র সওয়াবের আশায় আমি হুকুমতের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছি।
ইবনে আবিল হাদীদের মন্তব্যঃ
ইমাম আলী (আঃ) নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন রাখলেন কিছু দিন। হযরত নবী দুলালী ফাতেমা যাহরা (সাঃ আঃ) তাঁকে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য লড়াই করতে পরামর্শ দেন। মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের
আযানের ধ্বনি আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ ভেসে আসছিল ইমাম ফাতেমার দিকে মুখ করে বলেন, তুমি কি চাও এই ধ্বনি বিলুপ্ত হয়ে যাক? ফাতেমা বলেন, কখনো না। তারপর ইমাম বলেন, তাহলে আমি যে পথ
নির্বাচন করেছি এটা আঁকড়ে থাকাটাই হবে উত্তম। (সূত্রঃ শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১১, পৃ.১১৩)
এতক্ষণ আলোচনার পর এখন আমরা ইমাম ঠান্ডা মাথায় সার্বজনীন কল্যাণ চিন্তা করে যে পদক্ষেপ নিলেন তার ফলাফল সম্পর্কে পরখ করে দেখব,
মহৎ উদ্দেশ্যের মূল্যায়নঃ
এ রকম খুব কম সমাজই চোখে পড়ে যেখানে যোগ্য পরিচালক বা রাহবারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। একজন দক্ষ রাহবারের যে শর্তাবলী থাকা বাঞ্ছনীয় এ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তাহলে বলা যায় যে গোটা সমাজের মাঝে
এ কাজের জন্য হাতেগোনা কয়েকজনকে পাওয়া যাবে যারা এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত। সেই যোগ্য সমাজের রাহবারদের মধ্যে যিনি ঐশ্বী প্রদত্ত রাহবার হিসাবে মনোনীত তার দায় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
আল্লাহ মনোনীত রাহবারগণ নিজের মাকাম বা পদমর্যাদাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। আর খোদায়ী রাহবারগণ তো সেই মহৎ লক্ষ্যকে সমাজে বাস্তবায়ন করতেই প্রেরিত। তাদের
সামনে যখন দুটি রাস্তা উন্মোচন হয় তখন বাধ্য হয়ে একটি ত্যাগ করে অন্যটিকে বেছে নেন এবং নিজের মিশন বা অভিসন্ধিকে বাঁচানোর তাগিদে রাহবারত্বকে বিসর্জন দিয়ে দেন; কেননা এ ক্ষেত্রে মাকামের চেয়ে পবিত্র লক্ষ্যই
অগ্রাধিকার রাখে।
মুত্তাকিনদের মাওলা ইমাম আলী (আঃ) পয়গাম্বর (সাঃ) এর ওফাতের পর পরই ঠিক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোন। মানুষ যেভাবে কচি চারা গাছকে অতিযত্নে লালন করে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে তার শাখা প্রশাখা,
ফল ফলাদি, শীতল ছায়া দ্বারা উপকার ভোগ করতে পারে তদ্রুপ মহানবী (সাঃ) ইমাম আলী (আঃ)কে লালন পালন করেন যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তার পবিত্র অস্তিত্ব থেকে লাভবান হতে পারে। ইমাম মহানবীর (সাঃ) মৃত্যুর
পর পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলেন যে যদি খেলাফতকে হস্তগত করা হয় তাহলে এমন জটিলতার উদয় হবে যে পয়গাম্বরের পবিত্র মিশন যা তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তা বিফলে যাবে।
পূর্ব শত্রুতা ও বিদ্বেষঃ
তৎকালীন ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার দুরাবস্থা এবং মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ বিসম্বাদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে চরম আক্রোশ ও রক্তারক্তি শুরু হয়। মদিনার ও বাহিরের অধিকাংশ সমপ্রদায় ইমাম আলী (আঃ)
এর প্রতি ছিল নির্দয়। তারা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আলী (আঃ) এর উপর আক্রোশে ফেটে পড়ে। কারণ এসকল গোত্রের লোকদের পূর্বপুরুষদের তিনি কুফরের পক্ষে অবস্থান করার জন্য শায়েস্তা করেন এবং বিভিন্ন
যুদ্ধক্ষেত্রে ইমামের হাতেই তারা নিহত হোন। যদিও সে সকল মুশরিকদের পরবর্তী প্রজন্ম ইসলামের সাথে বাহ্যিক বন্ধন তৈরি করে কিন্তু মনে মনে চরম বিদ্বেষ লালন করে আসছিল। আর এমতাবস্থায় যদি ইমাম নিজের শক্তিমত্তা
দিয়ে লড়াই করে স্বীয় অধিকারকে ছিনিয়ে আনতেন তাহলে এ লড়াই থেকে নিম্নের ফলাফল বের হয়ে আসতঃ
১। এ লড়াইয়ে নিজের অধিকাংশ প্রিয় সাথীদের হারাতে হত। তারা মাওলার জন্য মৃত্যুকে বরণ করলেও বিনিময়ে ইমামের হক ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না।
২। শুধু বিশ্বস্থ সাথীদের শাহাদতই নয় বরং বানী হাশিম ও প্রিয় ব্যক্তিদের আন্দোলনের কারণে পয়গাম্বরের সাহাবাদের মধ্যে যারা আলীর খেলাফতকে মানতে পারেনি তারা কখনো তাঁর কাছে মাথা নত করত না। ফলে মুসলমান সমাজ
নড়বড়ে হয়ে যেত। সাহাবীদের মধ্যে যদিও আলীর রাহবারিত্বকে অনেকে মানতে নারাজ ছিল; কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তারা ইমামের সাথে ঐক্যমত ছিল।
৩। মুসলমানদের ঈমানী দূর্বলতার কারণে অন্যান্য প্রদেশে যাদের মধ্যে সবেমাত্র ইসলামের ছোঁয়া লেগেছিল তারাও ইসলাম বিদ্বেষী ও মুর্তাদদের সাথে যোগদান করে। তারা এক কাতারে শামিল হয় এবং সমাজের সঠিক দিকনির্দেশক না
থাকার ফলে তাদের মাঝ থেকে তাওহীদের চেরাগ চিরদিনের জন্য খামোশ হয়ে যেত। ইমাম আলী (আঃ) এমন একটা তিক্ত ভয়ানক পরিস্থিতিকে অতি কাছে থেকে অবলোকন করে নিরব থাকাটাই মঙ্গলজনক মনে করেন।
বিষয়টি আরো ভাল হবে যদি তা ইমামের জবান থেকে শ্রবণ করি।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুনাদা বলেন, আমি আলী (আঃ) এর ক্ষমতায় আরোহণকালে একদিন মক্কা থেকে মদিনায় আসলাম। দেখলাম যে, জনতা মসজিদে পয়গাম্বরে একত্রিত হয়েছে এবং ইমামের প্রতীক্ষায় বসে আছে। ইমাম একটি
তরবারী সাথে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। সকলেই তার প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর তিনি মিম্বারে উঠে আল্লাহর স'তি গাওয়ার পর সবাইকে সম্বোধন করে বলেন, সাবধান হও হে জনমন্ডলী! পয়গাম্বরের
ওফাতের পর তোমাদের উচিত ছিল তিনি হুকুমাতের জন্য যাকে নির্বাচিত করে ছিলেন তার ব্যাপারে বিরোধীতা না করা। কেননা, আমরাই মহানবীর উত্তরসূরি, আহলে বাইয়াত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কুরাইশদের মধ্যে
একটি দল আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, খেলাফতকে আমাদের কাছ থেকে ছিনতাই করেছে এবং তা নিজেরদের কাছে রাখতে চেয়েছে। আল্লাহর কসম! যদি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকত বা ইসলাম
থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় না থাকত অথবা ইসলাম নিঃশ্বেষ হওয়ার উপত্রুম না হত তবে তোমরা আলীর ভিন্ন রুপ দেখতে। (শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১, পৃ. ৩০৭)
মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করা ও ঐক্য বজায় রাখা ছিল ইমামের একটি মহান লক্ষ্য। তিনি ভাল করে জানতেন যে এই ঐক্যের কারণেই মহানবীর (সাঃ)আমলে স্বৈরবাদীদের ভীত নড়বড়ে হয়েছিল এবং ইসলামের বিকাশ ও
অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং যদি এই বন্ধন ক্ষমতার জটিলতার কারণে বিনষ্ট হয় তাহলে মুসলমানরা এখতেলাফের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তাছাড়া কুরাইশদের মধ্যে যে দলটি ইসলামের অমঙ্গল চেয়েছিল তারা একটি অজুহাতে
ইসলামের মূলে আঘাত হানার অপচেষ্টা করবে।
সমস্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ইমাম আলী (আঃ) কেন নিরবতাকেই যুদ্ধের উপর প্রাধান্য দিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। একজন কবি বিষয়টি তার কবিতার চরণে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। যার অনুবাদ হলোঃ
আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি উম্মতের নেতৃত্ব খান্দানে হাশিম ও আবুল হাসানের কাছ থেকে ছিনতাই করা হবে।
আলী কি প্রথম পুরুষ নন যিনি কেবলার দিকে নামাজ আদায় করেছেন? তিনি কি কোরআন ও সুন্নাতে তোমাদের চেয়ে জ্ঞানী নন? তিনি কি মহানবীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন না? তিনি কি প্রত্যেকটি সমরে পয়গাম্বরকে সাহায্য করেননি?
সিফফিনের যুদ্ধে বানী আসাদের এক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞাসা করেন, কুরাইশগণ কিভাবে আপনার মত ব্যক্তিকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করলো? ইমাম তার এই অসময়ে প্রশ্ন করার জন্য অসন্তষ্ট হলেন কারণ অনেক ইমামের
পক্ষাবলম্বনকারী সিপাহীরা অন্য খলিফাদের উপর বিশ্বাস করত। তার এহেন প্রশ্নের কারণে তাদের সারিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ইমাম ব্যথিত হৃদয়ে বলেন, পয়গাম্বরের প্রতি অনুরাগের কারণে এবং যেহেতু প্রত্যেক মুসলমান প্রশ্ন করার
হক রাখে তাই তোমাকে এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলব উম্মতের পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই ছিল এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মহানবীর সাথে। কিন্তু একদল কৃপণতা প্রকাশ করল এবং একদল চোখ বন্ধ করে রাখল।
তাদের ও আমাদের মাঝে ফয়সালা দান করবে আল্লাহপাক এবং আমরা সকলেই তার কাছে ফিরে যাব।
পরিশেষে বলব, এ ধরনের আরো বহু কারণ বিদ্যমান ছিল যার কারণে ইমাম ইসলাম রক্ষার্থে নিজের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেন এবং প্রায় পঁচিশ বছর নিরব থেকে বুক ভরা বেদনা নিয়ে দিনাতিপাত করেন। আলোচনার সূচনাতেই বলে নেয়া সমীচীন মনে করছি যে, এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য বহু গবেষণার দরকার। আর বিষয়টি খুবই জটিল ও দীর্ঘ পরিসরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তাই সামান্য কলেবরে উল্লেখিত
শিরোনামের সামান্য কিছু ব্যাখ্যার প্রয়াস পাব। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আহ্লে বাইয়াতকে মুহাব্বত করে না এমন মুসলমান খুবই কম। তবে যুগ যুগ ধরে আহলে বাইয়াতকে মাজলুম বানিয়ে কোনঠাসা করে রাখার অপতৎপরতা চালিয়েছে
মুসলমান নামধারী বকধার্মিক কিছু মোনাফেকের দল। তাই আজও কিছু মানব জগৎসংসারে বসবাস করে যারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা করে থাকেন। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা, সত্য ইতিহাস না জেনে নির্বোধের মত কথা
বলা এ যেন তাদের নিত্তনৈমিত্তিক পেশা। কতক লোক আজও ইমাম আলী (আঃ) এর মারেফাত লাভ না করার কারণে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামুলক কথাবার্তা বলেন যা বিবেকবহির্ভূত এবং অন্তঃসারশূন্য কাজ। অনেকেই
নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে যদি খেলাফত আলী (আঃ) এর হক ছিল তবে কেন তিনি তার হক আদায় করতে আন্দোলন করেননি, কেন তিনি নিরবতাকে বেঁছে নিলেন, কেন প্রতিবাদ করেননি। যাই হোক এ জাতীয় প্রশ্ন করে
এক প্রকার বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। তাই আসুন ইনসাফের সুরে কথা বলি এবং সত্যকে জানার, বুঝায় ব্রতী হয় তাহলে আর বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হবে না। এবার মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পয়গাম্বর (সাঃ) এর বেদনাময় ওফাতে গোটা মুসলিম সমাজ এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের উপর নেমে আসে যন্ত্রণার মহাপ্লাবন ও মহাসংকট। রাষ্ট্রে সর্বদা একটা টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি
বিরাজ করছিল বিশেষ করে খেলাফতের শাসন কর্তৃত্বের রদবদলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং সার্বক্ষণিক একটা ভীতি কাজ করছিল যে, হয়তো আরবের নব দীক্ষিত মুসলমানরা
জাহিলিয়াতের পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন একটি নব প্রষ্ফুটিত ফুলের পাঁপড়ির ন্যায় সবেমাত্র উঁকি মেরে আত্মপ্রকাশ করেছিল যার ফলে জনগণ ইসলামের সাথে তখনও সখ্যতা গড়তে পারেনি বা
ইসলামী আন্দোলনকে তারা গুরুত্বহীন ভেবে পাশ কেটে চলেছে। ইমাম আলী (আঃ) এবং মহানবী (সাঃ) এর কিছু বিশ্বস্ত সাহাবা কেরাম সবেমাত্র রাসুলুল্লাহর (সাঃ) দাফন কাফন সুসম্পন্ন করতে না করতেই সাহাবাকেরামের
মাঝে দুটি দল খেলাফতের দাবিদার সেজে হৈ হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেয়। দল দুটি হচ্ছে,
১) আনসারগণ যারা খাজরাজ জনগোষ্ঠীর লোক ছিল। তারা আগে থেকেই সাকিফায়ে বানী সাআদা নামক স্থানে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় মুসলিম রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদ বিন উবাদার হাতে ন্যস্ত
করতে হবে এবং সেই হবে পয়গাম্বর (সাঃ) এর জানেশিন বা উত্তরসূরি। কিন্তু আনসারদের মধ্যে ঐকমত্য না থাকায় বিশেষতঃ আউস ও খাজরাজ গোত্রের পারস্পরিক পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। আউস গোত্রের
লোকেরা খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদের সাথে শুধু বিরোধীতাই করেনি বরং তারা ক্ষমতা তার হাত থেকে নিয়ে মুহাজিরদের কারো হাতে দেয়ার পক্ষপাতি ছিল।
২) মুহাজিরগণ যদিও বানী সাকিফায় মুহাজিরদের উপস্থিত লোকের সংখ্যা সামান্য ছিল তথাপি এক ধরনের কৌশল অবলম্বনের ফলে সকলেই হযরত আবু বকরের প্রতি সমর্থন জানায়। আশে পাশের অনেকেই তাকে রাসুলুল্লাহর (সাঃ)
খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর এ সুযোগে তিনি জনগণকে নিজের বাইয়াত করার আহ্বান জানান।
উক্ত দুটি দল ছাড়াও আরেকটি দল বিদ্যমান ছিল যারা ইমাম আলী (আঃ) এর জন্য ছিল নিবেদিত। এদের মধ্যে বানী হাশিম ও কিছুসংখ্যক বুযুর্গ সাহাবা কেরাম মনে করতেন খেলাফতের একমাত্র হকদার ইমাম আলী (আঃ)
এবং অন্য সবার চেয়ে ইমাম আলী নেতা ও রাহবার হিসেবে যোগ্য। এই দলটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল যে, রাসূলুল্লাহর পবিত্র দেহ মোবারক সবেমাত্র দাফন হতে না হতেই মুহাজির ও আনসারদের মাঝে খলিফা মনোনয়ন নিয়ে
বাকবিতন্ডা, সংঘর্ষ বেঁধে গেছে। তারা নিজেদের বিরোধী মনোভাবকে মুহাজির ও আনসারদের বরং সমস্ত মুসলমানদের কর্ণকুহরে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে হযরত আবু বকরের খলিফা মনোনয়ন পন্থাকে বাতিল ঘোষণা করে সরাসরি
হযরত ফাতেমার গৃহাভিমুখে গমন করেন। অবশেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফাতেমার গৃহকে ত্যাগ করে মসজিদে গিয়ে অবস্থান নেন। নাজুক পরিস্থিতিতে তৃতীয় দলটি বিশেষ করে ইমাম আলী ও তার সঙ্গী সাথীরা দেখলেন যে
ইসলামী শাসন কর্তৃত্ব তার সঠিক হকদার ও প্রাপকের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এবং তার সাথে শরীয়তের মাঝেও কাঁটছাট করা হচ্ছে পাশাপাশি পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে মোড় নিল যে খেলাফতের সত্যিকারের আল্লাহর
মনোনীত ব্যক্তির স্থলে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে জনসাধারণ রাসূলুল্লাহর প্রকৃত উত্তরসুরি ভাবতে শুরু করল। আর এমতাবস্থায় হযরত আলী (আঃ) এর ন্যায় মহোত্তম ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চুপ থাকাটা মোটেও ভাল ঠেকেনি
তাই তিনি নিরবতাকে পিছনে ঠেলে জবানের তীক্ষ্ণতাকে কাজে লাগান। মসজিদে নব্বীতে আসার পর তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্য পিড়াপীড়ি করা হলে সমবেত মুহাজিরদের সম্বোধন করে বলেন, হে মুহাজিরগণ!
পয়গাম্বর (সাঃ) স্বয়ং যে হুকুমাতের ভিত্তি স্থাপন করেছেন সেটাকে তোমরা তাঁর পবিত্র অভিজাত বংশের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেদের কুটিরে আবদ্ধ রাখার বৃথা চেষ্টা করোনা। আল্লাহর শপথ! মহানবীর পরিবার একাজের
জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম। কেননা তাদের মধ্যে (আহলে বাইত) এমন সমস্ত যোগ্য ও মেধাবান ব্যক্তিরা রয়েছে যারা কোরআনের সঠিক গুঢ়রহস্য জানে এবং দ্বীন ইসলামের জ্ঞানভান্ডার তাদের অধীনে সুরক্ষিত, পয়গাম্বর (সাঃ)
এর সুন্নাত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত, তারাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনার ক্ষমতা রাখে, সমস্ত ফেতনা ফ্যাসাদের শিকড়কে তারাই উপড়ে ফেলতে পারে এবং বাইতুল মাল গাণিমতের সম্পদকে সুষমভাবে
একমাত্র তারাই বন্টন করার মনমানসিকতা রাখে। আর বাস্তবতা হচ্ছে এমন সকল যোগ্য পন্ডিত ব্যক্তিরা থাকতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অন্যদের হাতে মানায় না। এমন যেন না হয় যে, তোমরা নফসের খায়েশ মোতাবেক চলতে গিয়ে
আল্লাহর পথ থেকে ছিটকে পড় এবং হাকীকাত থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্রান্তিতে হামাগুড়ি খেতে থাক। (সূত্রঃ আল ইমামত ওয়াসসিয়াসাত খ.১, প.১১)
উক্ত বক্তৃতায় ইমাম নিজের শ্র্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে কত সুন্দর ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া এখানে অবৈধ খেলাফতের দাবিদারদের সাথে নিজের বিরোধী মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে
ইমাম আলী (আঃ) বানী হাশিমের একটি দল নিয়ে আবু বকরের নিকট যান এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, যোগ্যতা, বীরত্বগাঁথা ইতিহাস, রণাঙ্গনের সাহসিকতা এ সমস্ত বিষয়কে তার সামনে তুলে ধরে বলেন, আমি পয়গাম্বরের
জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উপযুক্ত। আমি তাঁর (সাঃ) উযির, উত্তরসূরি, জ্ঞানভান্ডার এবং গুপ্তরহস্য ভান্ডার। আমি হলাম সিদ্দিকে আকবার এবং সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী ন্যায়বান ব্যক্তি।
আমি সেই পুরুষ যে প্রথম মহানবীর উপর ঈমান আনার পর তাঁকে সত্যবাদী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। আমি মুশরিকদের সাথে রণক্ষেত্রে দৃঢ় ও অটলভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি, সুন্নাত ও কিতাবের সর্বজান্তা, উসূলে দ্বীন ও ফুরুয়ে
দ্বীনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, ভাষার মাধুর্যতা আর বাক্যালংকারে আমার রয়েছে পুরোপুরি দখল। তবু কেন তোমরা আমার অধিকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছো?
ইমাম আলী (আঃ) অন্য আরেকটি খুতবায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সক্ষম ক্ষমতাবান ও সর্বাপেক্ষা আল্লাহর বিধি বিধান সম্পর্কে সুঅভিজ্ঞ পন্ডিত একজন কোয়ালিটি সম্পন্ন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, হে জনতা! হুকুমত
পরিচালনার জন্য তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত যিনি জনতার মাঝে রাষ্ট্র চালানোর কলাকৌশলে অভিজ্ঞ এবং আল্লাহর বিধানকে ভাল করে জানেন। যার মধ্যে এই সামষ্টিক গুণাবলী অবর্তমান সে যদি খেলাফত লাভের চিন্তায় মগ্ন হয় এবং
নিজের ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডকে চালাতে থাকে তবে সে কতল তো হবেই। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-১৬৮)
এটা ছিল ইমাম আলীর দূরদর্শিতা, যুক্তিবিদ্যার পরিচায়ক রহস্য। আর নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শুধুমাত্র তাঁরই জবানীতে প্রকাশিত হয়নি বরং তাঁর ঘোরবিরোধীরাও একথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইমাম আলী যুগশ্রেষ্ঠ
মানব ও খেলাফতের যথাযোগ্য প্রাপক। প্রাধান্য রাখা সত্ত্বেও তাঁকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত রেখে তাঁর অধিকারকে ভূ-লন্ঠিত করা হয়েছে। আবু উবাইদা জাররা যখন শুনতে পায় যে ইমাম আবু বকরের বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি
জানিয়েছে তখন ইমামের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, শাসন কর্তৃত্বকে আবু বকরের হাতে ছেড়ে দিন। আমি জানি আপনি এর জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কারণ শ্রেষ্ঠত্বে, মর্যাদায়, ঈমানদার হিসেবে, জ্ঞানগরিমায়, দূরদর্শিতায়,
বংশমর্যাদায় এবং রাসুলুল্লাহর জামাতা হিসেবে আপনার সমতুল্য কেউই নেই। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১ পৃ. ১২)
ইমাম নিজের অধিকার পুনরুদ্ধারে শুধু বক্তৃতা ভাষণ বা স্মরণ করানোর উপরই ডিফেন্স করেননি ইতিহাসবেত্তাদের লেখনীতে জানা যায় পাশাপাশি তিনি কখনো কখনো ফাতেমা, হাসান-হোসাইনকে নিয়ে আনসারদের শীর্ষ নেতৃবর্গের
নিকট গমন করতেন যাতে করে খেলাফতকে তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাড়া পাননি। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বলাবলি করত যে আলী নিজেই যদি সবার
আগে খেলাফতের চিন্তা করে এবং আমাদের কাছ থেকে বাইয়াত চায় তাহলে আমরা তো তার সমর্থন ব্যক্ত করতে পারিনা কখনো; কেননা তার পূর্বেও তো আমরা প্রথম খলিফার বাইয়াতকে নাকচ করে দিয়েছি? ইমাম তাদের
প্রশ্নোত্তরে বলতেন, আচ্ছা আপনাদের দৃষ্টিতে এটাই কি উত্তম হত যে আমি পয়গাম্বরের মৃতদেহকে ফেলে রেখে খেলাফতের মোহে ছুটে যেতাম এবং সবার কাছ থেকে বাইয়াতের আহ্বান জানাতাম? ইমামের কথার সমর্থনে হযরত
ফাতেমা যাহরা বলেন, আলী নিজের দায়িত্ব কর্তব্যকে সবার চেয়ে ভালই জানেন। যারা আলীর হককে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাধাদান করেছে তাদের হিসাব মহান আল্লাহর হাতে। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১, পৃ. ১২)
অবাধ্য সীমালংঘনকারী দলের সামনে ইমামের এটা ছিল প্রথম পদক্ষেপ যার মাধ্যমে তিনি আশাবাদী ছিলেন হয়তো আনসারদের বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গকে বলে কয়ে অবহিত করে নিজের অধিকারকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে; কিন্তু
ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে এতে তিনি কোন ফলাফল লাভ করতে পারেননি বরং তাঁর হককে পঁয়মাল করা হয়। এখন যদি কোন বিবেকবান ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয় পরিবেশের এমন অস্থিতিশীল, সংবেদনশীল, অরাজকতাপূর্ণ
ও টানটান উত্তেজনায় ইমাম আলীর পক্ষে কোন পন্থাবলম্বন করলে ভাল হত, শুধুমাত্র সমাজকে পর্যবেক্ষণ করা ও নিশ্চুপ থাকা নাকি যুদ্ধ ও আন্দোলনের ডাক দেয়া?
ইমাম আলী (আঃ) এর সামনে একটি মাত্র রাস্তা খোলা ছিলঃ
পরিস্থিতির এমন নাজুক অবস্থায় ইমামের সামনে একটি পথ ব্যতীত ভিন্ন কোন উপায় না থাকায় তিনি শুধু আনসার ও মুহাজিরদের বিভিন্ন উপদেশমুলক, পরামর্শমুলক, সাবধানমুলক এবং সমাধানমুলক বাণীর মাধ্যমে
পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন এবং জনগণের নিকট সত্যকে পরিষ্কার ও নিজের হুজ্জাতকে সমাপ্ত করেন। অন্য দিকে খলিফা ও তার সমমনা ব্যক্তিরা খেলাফতের রশিকে কবজা করার জন্য জোরাজুরি করতে লাগে এবং তারা নিজেদের
ক্ষমতাকে সমপ্রসারণের অভিসন্ধি নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায়। আর যুগের আবর্তে খেলাফতের মসনদে আরোহণকারীরা খেলাফতের বিষয়টিকে এমনভাবে জনতার মন-মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করাতে থাকে যে এক সময় এটাকেই তারা
সঠিক প্রচলিত হুকুমাত হিসেবে মনে করতে লাগে এবং তাদের থেকে জীবনাদর্শ গ্রহণ করতে শুরু করে। সমাজের এমন সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মুহূর্তে মুহূর্তে মহানবীর পরিবারের উপর নেমে আসে দুর্ভোগ। বিপরীত দিকে
শাসকদের ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। এমতাবস্থায় ইমাম আলী (আঃ) এর দুটি পন্থা বেছে নেয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
ক) নবী বংশের সহায়তা করা এবং অনুরক্তদের নিয়ে লড়াই করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনা।
খ) আর নয়তো নিরব থাকা ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া এবং ব্যক্তিগত, চারিত্রিক দায়দায়িত্বকেই শুধু আঞ্জাম দেয়া।
অতএব, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে জানা যায় ইমাম যদি এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিগ্রহের পন্থা অবলম্বন করতেন তাহলে এতে তৎকালীন নব জন্ম নেয়া ইসলামের ক্ষতি ও অমঙ্গল বৈ কোনই কল্যাণ হত না। যার ফলে দ্বিতীয়
পথ নির্বাচন ছাড়া ইমামের সামনে ভিন্ন কোন উপায়ন্তর ছিল না।
পয়গাম্বর (সাঃ) উম্মাতের মুর্তাদ হওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেনঃ
১। মহানবী (সাঃ) জীবদ্দশায় ইসলামী সমাজের ভবিষ্যত ও ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন এবং তিনি সমাজের অবাধ্যতা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে মুসলমানদের মধ্যে কিছু দল তার মৃত্যুর পর সেই জাহিলিয়াতের
দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। সাথে সাথে ইলাহী বিধি আহকামকেও ভুলে যাবে। তাঁর এই ভাবনা আরো দৃঢ়তা লাভ করে উহুদের যুদ্ধের সময়। উহুদের যুদ্ধে যখন পয়গাম্বর (সাঃ) এর কতল হওয়ার অপপ্রচার শুরু হয় তিনি প্রত্যক্ষদর্শী
হিসেবে দেখতে পান যে অধিকাংশ সাধুবেশী পাশে অবস্থানকারী বুযুর্গ ব্যক্তিরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করতে আরম্ভ করেছে। তারা পাহাড়, পর্বত ও ময়দানের আশেপাশে জান বাঁচাতে ছুটাছুটি করছে। আবার অনেকেই
আবু সুফিয়ান ও মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর পাশে থাকাকে নিরাপদ মনে করে ছুটে যায়। এসকল লোকদের আকিদা বিশ্বাস এতই নড়বড়ে ও দুর্বল ছিল যে আল্লাহর সম্পর্কে হীন ধারণা করতেও তাদের বুক ততটুকু কাঁপেনি।
এ সমস্ত ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করে পবিত্র কোরআন ইরশাদ করে, “স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলেনা আর রাসুল তোমাদের পিছন দিক হতে আহ্বান করছিল।
ফলে তিনি তোমাদের বিপদের উপর বিপদ দিলেন যাতে তোমরা যা হারিয়েছো অথবা যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছিল তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।
(সূত্রঃ আলে ইমরানঃ ১৫৩)
পয়গাম্বরের কিছু সঙ্গীরা আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে শুরু করল যেভাবে জাহিলিয়াতের লোকেরা করত তারা এটাও বলতে লাগে যে এছাড়া কি আমাদের জন্য আর কোন পথ খোলা ছিল?
পবিত্র কোরআন অন্য একটি আয়াতে পয়গাম্বরের ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর কিছু লোকের ছত্রভঙ্গ ও দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। যেমন বলা হচ্ছে, মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র; তার পূর্বে
বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।
(সূত্রঃ আলে ইমরান আয়াত ১৪৪)
উক্ত আয়াত আসহাবে পয়গাম্বরকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এক. জাহিলিয়াতের যুগে প্রত্যাবর্তনকারী দল, দুই. মজবুত ঈমানের উপর অবিচল অবস্থানকারী কৃতজ্ঞ দল।
২) বানী সাকিফার ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নীল নকশা তৈরি, গোত্র ও বংশীয় বিদ্বেষ, জাহিলিয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, ঐ সমস্ত মুসলমানদের মনে
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তখনও পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেনি। ইসলাম ও ঈমান কেবলমাত্র তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ চেহারায় ঢাকনার ন্যায় ঝুলছিল। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় ঐ সমস্ত জামাত, তাদের বক্তৃতা ভাষণ কোন কিছুই
মঙ্গলার্থে ছিল না। প্রত্যেকেই খেলাফতের রাজমুকুট তার যোগ্য ব্যক্তির হাতে না দিয়ে নিজের গায়ে জড়াতে চেয়েছে। উক্ত সংগঠনটি ইসলাম ও মুসলমানদের কোন ধরণের কল্যাণমুলক চিন্তা তো করেনই নি বরং ইসলামের ভঙ্গুর
কিশতিকে যিনি সমুদ্রের পারে নিয়ে মুক্তি দিতে পারেন তার কাছ থেকে খেলাফত লুন্ঠন করেছে। মোটকথা হলো ঐ সমস্ত লোকদের অন্তরে ইসলামী আকিদা তখনও পর্যন্ত স্থান পায়নি, জাহিলিয়াতের আদিখ্যেতা চালচলন
অভ্যাস তাদের মন মস্তিষ্ককে ঘিরে রেখেছিল এবং মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বিগ্রহ, ফেরকাবাজী, দলে দলে বিভক্তির ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ হুমকির মুখে পড়ে আর কিছু লোক শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়।
৩) বানী সাকিফার ঘটনার পর ইমাম আলী (আঃ) এর প্রদত্ত ভাষণ এ বিষয়গুলোকে আরো পরিষ্কার করে। তিনি নিজের বক্তৃতায় ইসলামী উম্মাহর ঐক্য সংহতির গুরুত্ব এবং ছত্রভঙ্গতা, দলাদলির পরিণাম সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, আবু সুফিয়ান যখন ইমাম আলীকে বাইয়াতের চাপ দিতে থাকে ইমাম জনসমাবেশের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, হে জনমন্ডলী! ফিতনার তরঙ্গের মাঝে শক্ত হাতে হাল ধরে মুক্তির নৌকা চালিয়ে যাও; বিভেদের পথ থেকে
ফিরে এসো; এবং অহংকারের মুকুট নামিয়ে ফেলো ........ যদি আমি বলেই ফেলি খেলাফতের কথা তবে তারা আমাকে বলবে ক্ষমতালোভী, আর যদি আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি তবে তারা বলবে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত।
দুঃখের বিষয় এই যে, সকল উত্থান-পতনের মধ্যেও আমি টিকে আছি। আল্লাহর কসম, আবু তালিবের পুত্র মৃত্যুর সাথে এমনভাবে পরিচিত যেমন একটি শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে। আমি নিরব রয়েছি আমার গুপ্ত জ্ঞানের
কারনে যা আমাকে দান করা হয়েছে। যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে গভীর কূপ থেকে পানি উত্তোলনরত রশির মতো তোমরা কাঁপতে থাকবে। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-৫)
৪) নবমুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে পয়গাম্বরের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই তাদের মাঝে কতক দল ধর্মত্যাগ করে জাহিলিয়াতের তাদের পূর্বপুরুষদের পথকে স্বাগত জানায়। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইসলামী হুকুমতের বিরোধীতায় নেমে
পড়ে এবং ইসলামী কর দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ হলো, মুসলমানদের মধ্যে যারা ঈমানে বলিষ্ঠ তাদেরকে সাথে নিয়ে মুর্তাদদের সাথে সংগ্রাম করা যাতে তারা পুনরায় শাসকদের আনুগত্য
প্রকাশ করে এবং ইসলামী আইন কানুনের কাছে মস্তকাবনত করে। এছাড়া অন্য একটি গ্রুপ ইয়ামানে (মুসাইলামা, সাজ্জাহ ও তালাইহা) মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদার সেজে আরেকটি ফিতনার সৃষ্টি করে। তাই মুহাজির ও আনসারদের
মধ্যে যেখানে ঐক্য ফিরিয়ে আনা অসম্ভব, পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের ইসলামকে বিদায় জানানো এবং বিভিন্ন স্থানে মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদারদের উত্থান এ সমস্ত পরিস্থিতি সমূহে ইমাম আলী (আঃ) এর ন্যায় মহামানবের পক্ষে
নিজের অধিকার আদায়কল্পে কিয়াম করা মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। ইমাম মিশরবাসীদের প্রতি একটি পত্রে উক্ত বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আরবরা খেলাফতকে পয়গাম্বরের খান্দান
থেকে ছিনিয়ে নিবে বা এ থেকে আমাকে বিরত রাখবে। তারা যখন আমার বাইয়াত নিতে চাপ সৃষ্টি করছিল এ দেখে আমি আরো চমকে গেলাম। কিন্তু আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। দেখলাম জনতার একটি দল ইসলামকে ত্যাগ করেছে
এবং তারা মুহাম্মদের দ্বীনকে ধ্বংসের পাঁয়তারায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপলব্ধি করলাম যে যদি ইসলাম ও মুসলমানদের সাহায্যার্থে এগিয়ে না যাই তাহলে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আর দ্বীন ধ্বংস হওয়ার যন্ত্রণা আমার নিকট খানিক
দিনের হুকুমত না পাবার যন্ত্রণা অপেক্ষা অধিক বেশি যা বন্যার বানের মত অতিদ্রুত শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর আমি ঐ সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম এবং মুসলমানদের সহযোগিতা করতে প্রস্তত হলাম যাতে বাতিল অপসারিত
হয় আর জনতা ইসলামের নিরাপদ দূর্গে প্রবেশ করতে পারে। (নাহাজুল বালাগা)
উসমানের খেলাফতের সূচনালগ্নে যখন শূরা কমিটির সদস্যরা তার প্রতি রায় প্রকাশ করে ইমাম তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা সকলেই জানেন আমি খেলাফতের জন্য একমাত্র উপযুক্ত। এ মুহূর্তে যদিও আমার উপর জুলুম
করা হয় তবুও খেলাফতকে ছালাম জানালাম এবং শুধুমাত্র সওয়াবের আশায় আমি হুকুমতের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছি।
ইবনে আবিল হাদীদের মন্তব্যঃ
ইমাম আলী (আঃ) নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন রাখলেন কিছু দিন। হযরত নবী দুলালী ফাতেমা যাহরা (সাঃ আঃ) তাঁকে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য লড়াই করতে পরামর্শ দেন। মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের
আযানের ধ্বনি আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ ভেসে আসছিল ইমাম ফাতেমার দিকে মুখ করে বলেন, তুমি কি চাও এই ধ্বনি বিলুপ্ত হয়ে যাক? ফাতেমা বলেন, কখনো না। তারপর ইমাম বলেন, তাহলে আমি যে পথ
নির্বাচন করেছি এটা আঁকড়ে থাকাটাই হবে উত্তম। (সূত্রঃ শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১১, পৃ.১১৩)
এতক্ষণ আলোচনার পর এখন আমরা ইমাম ঠান্ডা মাথায় সার্বজনীন কল্যাণ চিন্তা করে যে পদক্ষেপ নিলেন তার ফলাফল সম্পর্কে পরখ করে দেখব,
মহৎ উদ্দেশ্যের মূল্যায়নঃ
এ রকম খুব কম সমাজই চোখে পড়ে যেখানে যোগ্য পরিচালক বা রাহবারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। একজন দক্ষ রাহবারের যে শর্তাবলী থাকা বাঞ্ছনীয় এ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তাহলে বলা যায় যে গোটা সমাজের মাঝে
এ কাজের জন্য হাতেগোনা কয়েকজনকে পাওয়া যাবে যারা এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত। সেই যোগ্য সমাজের রাহবারদের মধ্যে যিনি ঐশ্বী প্রদত্ত রাহবার হিসাবে মনোনীত তার দায় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
আল্লাহ মনোনীত রাহবারগণ নিজের মাকাম বা পদমর্যাদাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। আর খোদায়ী রাহবারগণ তো সেই মহৎ লক্ষ্যকে সমাজে বাস্তবায়ন করতেই প্রেরিত। তাদের
সামনে যখন দুটি রাস্তা উন্মোচন হয় তখন বাধ্য হয়ে একটি ত্যাগ করে অন্যটিকে বেছে নেন এবং নিজের মিশন বা অভিসন্ধিকে বাঁচানোর তাগিদে রাহবারত্বকে বিসর্জন দিয়ে দেন; কেননা এ ক্ষেত্রে মাকামের চেয়ে পবিত্র লক্ষ্যই
অগ্রাধিকার রাখে।
মুত্তাকিনদের মাওলা ইমাম আলী (আঃ) পয়গাম্বর (সাঃ) এর ওফাতের পর পরই ঠিক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোন। মানুষ যেভাবে কচি চারা গাছকে অতিযত্নে লালন করে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে তার শাখা প্রশাখা,
ফল ফলাদি, শীতল ছায়া দ্বারা উপকার ভোগ করতে পারে তদ্রুপ মহানবী (সাঃ) ইমাম আলী (আঃ)কে লালন পালন করেন যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তার পবিত্র অস্তিত্ব থেকে লাভবান হতে পারে। ইমাম মহানবীর (সাঃ) মৃত্যুর
পর পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলেন যে যদি খেলাফতকে হস্তগত করা হয় তাহলে এমন জটিলতার উদয় হবে যে পয়গাম্বরের পবিত্র মিশন যা তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তা বিফলে যাবে।
পূর্ব শত্রুতা ও বিদ্বেষঃ
তৎকালীন ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার দুরাবস্থা এবং মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ বিসম্বাদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে চরম আক্রোশ ও রক্তারক্তি শুরু হয়। মদিনার ও বাহিরের অধিকাংশ সমপ্রদায় ইমাম আলী (আঃ)
এর প্রতি ছিল নির্দয়। তারা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আলী (আঃ) এর উপর আক্রোশে ফেটে পড়ে। কারণ এসকল গোত্রের লোকদের পূর্বপুরুষদের তিনি কুফরের পক্ষে অবস্থান করার জন্য শায়েস্তা করেন এবং বিভিন্ন
যুদ্ধক্ষেত্রে ইমামের হাতেই তারা নিহত হোন। যদিও সে সকল মুশরিকদের পরবর্তী প্রজন্ম ইসলামের সাথে বাহ্যিক বন্ধন তৈরি করে কিন্তু মনে মনে চরম বিদ্বেষ লালন করে আসছিল। আর এমতাবস্থায় যদি ইমাম নিজের শক্তিমত্তা
দিয়ে লড়াই করে স্বীয় অধিকারকে ছিনিয়ে আনতেন তাহলে এ লড়াই থেকে নিম্নের ফলাফল বের হয়ে আসতঃ
১। এ লড়াইয়ে নিজের অধিকাংশ প্রিয় সাথীদের হারাতে হত। তারা মাওলার জন্য মৃত্যুকে বরণ করলেও বিনিময়ে ইমামের হক ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না।
২। শুধু বিশ্বস্থ সাথীদের শাহাদতই নয় বরং বানী হাশিম ও প্রিয় ব্যক্তিদের আন্দোলনের কারণে পয়গাম্বরের সাহাবাদের মধ্যে যারা আলীর খেলাফতকে মানতে পারেনি তারা কখনো তাঁর কাছে মাথা নত করত না। ফলে মুসলমান সমাজ
নড়বড়ে হয়ে যেত। সাহাবীদের মধ্যে যদিও আলীর রাহবারিত্বকে অনেকে মানতে নারাজ ছিল; কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তারা ইমামের সাথে ঐক্যমত ছিল।
৩। মুসলমানদের ঈমানী দূর্বলতার কারণে অন্যান্য প্রদেশে যাদের মধ্যে সবেমাত্র ইসলামের ছোঁয়া লেগেছিল তারাও ইসলাম বিদ্বেষী ও মুর্তাদদের সাথে যোগদান করে। তারা এক কাতারে শামিল হয় এবং সমাজের সঠিক দিকনির্দেশক না
থাকার ফলে তাদের মাঝ থেকে তাওহীদের চেরাগ চিরদিনের জন্য খামোশ হয়ে যেত। ইমাম আলী (আঃ) এমন একটা তিক্ত ভয়ানক পরিস্থিতিকে অতি কাছে থেকে অবলোকন করে নিরব থাকাটাই মঙ্গলজনক মনে করেন।
বিষয়টি আরো ভাল হবে যদি তা ইমামের জবান থেকে শ্রবণ করি।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুনাদা বলেন, আমি আলী (আঃ) এর ক্ষমতায় আরোহণকালে একদিন মক্কা থেকে মদিনায় আসলাম। দেখলাম যে, জনতা মসজিদে পয়গাম্বরে একত্রিত হয়েছে এবং ইমামের প্রতীক্ষায় বসে আছে। ইমাম একটি
তরবারী সাথে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। সকলেই তার প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর তিনি মিম্বারে উঠে আল্লাহর স'তি গাওয়ার পর সবাইকে সম্বোধন করে বলেন, সাবধান হও হে জনমন্ডলী! পয়গাম্বরের
ওফাতের পর তোমাদের উচিত ছিল তিনি হুকুমাতের জন্য যাকে নির্বাচিত করে ছিলেন তার ব্যাপারে বিরোধীতা না করা। কেননা, আমরাই মহানবীর উত্তরসূরি, আহলে বাইয়াত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কুরাইশদের মধ্যে
একটি দল আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, খেলাফতকে আমাদের কাছ থেকে ছিনতাই করেছে এবং তা নিজেরদের কাছে রাখতে চেয়েছে। আল্লাহর কসম! যদি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকত বা ইসলাম
থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় না থাকত অথবা ইসলাম নিঃশ্বেষ হওয়ার উপত্রুম না হত তবে তোমরা আলীর ভিন্ন রুপ দেখতে। (শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১, পৃ. ৩০৭)
মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করা ও ঐক্য বজায় রাখা ছিল ইমামের একটি মহান লক্ষ্য। তিনি ভাল করে জানতেন যে এই ঐক্যের কারণেই মহানবীর (সাঃ)আমলে স্বৈরবাদীদের ভীত নড়বড়ে হয়েছিল এবং ইসলামের বিকাশ ও
অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং যদি এই বন্ধন ক্ষমতার জটিলতার কারণে বিনষ্ট হয় তাহলে মুসলমানরা এখতেলাফের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তাছাড়া কুরাইশদের মধ্যে যে দলটি ইসলামের অমঙ্গল চেয়েছিল তারা একটি অজুহাতে
ইসলামের মূলে আঘাত হানার অপচেষ্টা করবে।
সমস্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ইমাম আলী (আঃ) কেন নিরবতাকেই যুদ্ধের উপর প্রাধান্য দিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। একজন কবি বিষয়টি তার কবিতার চরণে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। যার অনুবাদ হলোঃ
আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি উম্মতের নেতৃত্ব খান্দানে হাশিম ও আবুল হাসানের কাছ থেকে ছিনতাই করা হবে।
আলী কি প্রথম পুরুষ নন যিনি কেবলার দিকে নামাজ আদায় করেছেন? তিনি কি কোরআন ও সুন্নাতে তোমাদের চেয়ে জ্ঞানী নন? তিনি কি মহানবীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন না? তিনি কি প্রত্যেকটি সমরে পয়গাম্বরকে সাহায্য করেননি?
সিফফিনের যুদ্ধে বানী আসাদের এক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞাসা করেন, কুরাইশগণ কিভাবে আপনার মত ব্যক্তিকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করলো? ইমাম তার এই অসময়ে প্রশ্ন করার জন্য অসন্তষ্ট হলেন কারণ অনেক ইমামের
পক্ষাবলম্বনকারী সিপাহীরা অন্য খলিফাদের উপর বিশ্বাস করত। তার এহেন প্রশ্নের কারণে তাদের সারিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ইমাম ব্যথিত হৃদয়ে বলেন, পয়গাম্বরের প্রতি অনুরাগের কারণে এবং যেহেতু প্রত্যেক মুসলমান প্রশ্ন করার
হক রাখে তাই তোমাকে এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলব উম্মতের পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই ছিল এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মহানবীর সাথে। কিন্তু একদল কৃপণতা প্রকাশ করল এবং একদল চোখ বন্ধ করে রাখল।
তাদের ও আমাদের মাঝে ফয়সালা দান করবে আল্লাহপাক এবং আমরা সকলেই তার কাছে ফিরে যাব।
পরিশেষে বলব, এ ধরনের আরো বহু কারণ বিদ্যমান ছিল যার কারণে ইমাম ইসলাম রক্ষার্থে নিজের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেন এবং প্রায় পঁচিশ বছর নিরব থেকে বুক ভরা বেদনা নিয়ে দিনাতিপাত করেন। আলোচনার সূচনাতেই বলে নেয়া সমীচীন মনে করছি যে, এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য বহু গবেষণার দরকার। আর বিষয়টি খুবই জটিল ও দীর্ঘ পরিসরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তাই সামান্য কলেবরে উল্লেখিত
শিরোনামের সামান্য কিছু ব্যাখ্যার প্রয়াস পাব। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আহ্লে বাইয়াতকে মুহাব্বত করে না এমন মুসলমান খুবই কম। তবে যুগ যুগ ধরে আহলে বাইয়াতকে মাজলুম বানিয়ে কোনঠাসা করে রাখার অপতৎপরতা চালিয়েছে
মুসলমান নামধারী বকধার্মিক কিছু মোনাফেকের দল। তাই আজও কিছু মানব জগৎসংসারে বসবাস করে যারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা করে থাকেন। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা, সত্য ইতিহাস না জেনে নির্বোধের মত কথা
বলা এ যেন তাদের নিত্তনৈমিত্তিক পেশা। কতক লোক আজও ইমাম আলী (আঃ) এর মারেফাত লাভ না করার কারণে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামুলক কথাবার্তা বলেন যা বিবেকবহির্ভূত এবং অন্তঃসারশূন্য কাজ। অনেকেই
নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে যদি খেলাফত আলী (আঃ) এর হক ছিল তবে কেন তিনি তার হক আদায় করতে আন্দোলন করেননি, কেন তিনি নিরবতাকে বেঁছে নিলেন, কেন প্রতিবাদ করেননি। যাই হোক এ জাতীয় প্রশ্ন করে
এক প্রকার বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। তাই আসুন ইনসাফের সুরে কথা বলি এবং সত্যকে জানার, বুঝায় ব্রতী হয় তাহলে আর বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হবে না। এবার মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পয়গাম্বর (সাঃ) এর বেদনাময় ওফাতে গোটা মুসলিম সমাজ এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের উপর নেমে আসে যন্ত্রণার মহাপ্লাবন ও মহাসংকট। রাষ্ট্রে সর্বদা একটা টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি
বিরাজ করছিল বিশেষ করে খেলাফতের শাসন কর্তৃত্বের রদবদলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং সার্বক্ষণিক একটা ভীতি কাজ করছিল যে, হয়তো আরবের নব দীক্ষিত মুসলমানরা
জাহিলিয়াতের পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন একটি নব প্রষ্ফুটিত ফুলের পাঁপড়ির ন্যায় সবেমাত্র উঁকি মেরে আত্মপ্রকাশ করেছিল যার ফলে জনগণ ইসলামের সাথে তখনও সখ্যতা গড়তে পারেনি বা
ইসলামী আন্দোলনকে তারা গুরুত্বহীন ভেবে পাশ কেটে চলেছে। ইমাম আলী (আঃ) এবং মহানবী (সাঃ) এর কিছু বিশ্বস্ত সাহাবা কেরাম সবেমাত্র রাসুলুল্লাহর (সাঃ) দাফন কাফন সুসম্পন্ন করতে না করতেই সাহাবাকেরামের
মাঝে দুটি দল খেলাফতের দাবিদার সেজে হৈ হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেয়। দল দুটি হচ্ছে,
১) আনসারগণ যারা খাজরাজ জনগোষ্ঠীর লোক ছিল। তারা আগে থেকেই সাকিফায়ে বানী সাআদা নামক স্থানে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় মুসলিম রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদ বিন উবাদার হাতে ন্যস্ত
করতে হবে এবং সেই হবে পয়গাম্বর (সাঃ) এর জানেশিন বা উত্তরসূরি। কিন্তু আনসারদের মধ্যে ঐকমত্য না থাকায় বিশেষতঃ আউস ও খাজরাজ গোত্রের পারস্পরিক পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। আউস গোত্রের
লোকেরা খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদের সাথে শুধু বিরোধীতাই করেনি বরং তারা ক্ষমতা তার হাত থেকে নিয়ে মুহাজিরদের কারো হাতে দেয়ার পক্ষপাতি ছিল।
২) মুহাজিরগণ যদিও বানী সাকিফায় মুহাজিরদের উপস্থিত লোকের সংখ্যা সামান্য ছিল তথাপি এক ধরনের কৌশল অবলম্বনের ফলে সকলেই হযরত আবু বকরের প্রতি সমর্থন জানায়। আশে পাশের অনেকেই তাকে রাসুলুল্লাহর (সাঃ)
খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর এ সুযোগে তিনি জনগণকে নিজের বাইয়াত করার আহ্বান জানান।
উক্ত দুটি দল ছাড়াও আরেকটি দল বিদ্যমান ছিল যারা ইমাম আলী (আঃ) এর জন্য ছিল নিবেদিত। এদের মধ্যে বানী হাশিম ও কিছুসংখ্যক বুযুর্গ সাহাবা কেরাম মনে করতেন খেলাফতের একমাত্র হকদার ইমাম আলী (আঃ)
এবং অন্য সবার চেয়ে ইমাম আলী নেতা ও রাহবার হিসেবে যোগ্য। এই দলটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল যে, রাসূলুল্লাহর পবিত্র দেহ মোবারক সবেমাত্র দাফন হতে না হতেই মুহাজির ও আনসারদের মাঝে খলিফা মনোনয়ন নিয়ে
বাকবিতন্ডা, সংঘর্ষ বেঁধে গেছে। তারা নিজেদের বিরোধী মনোভাবকে মুহাজির ও আনসারদের বরং সমস্ত মুসলমানদের কর্ণকুহরে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে হযরত আবু বকরের খলিফা মনোনয়ন পন্থাকে বাতিল ঘোষণা করে সরাসরি
হযরত ফাতেমার গৃহাভিমুখে গমন করেন। অবশেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফাতেমার গৃহকে ত্যাগ করে মসজিদে গিয়ে অবস্থান নেন। নাজুক পরিস্থিতিতে তৃতীয় দলটি বিশেষ করে ইমাম আলী ও তার সঙ্গী সাথীরা দেখলেন যে
ইসলামী শাসন কর্তৃত্ব তার সঠিক হকদার ও প্রাপকের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এবং তার সাথে শরীয়তের মাঝেও কাঁটছাট করা হচ্ছে পাশাপাশি পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে মোড় নিল যে খেলাফতের সত্যিকারের আল্লাহর
মনোনীত ব্যক্তির স্থলে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে জনসাধারণ রাসূলুল্লাহর প্রকৃত উত্তরসুরি ভাবতে শুরু করল। আর এমতাবস্থায় হযরত আলী (আঃ) এর ন্যায় মহোত্তম ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চুপ থাকাটা মোটেও ভাল ঠেকেনি
তাই তিনি নিরবতাকে পিছনে ঠেলে জবানের তীক্ষ্ণতাকে কাজে লাগান। মসজিদে নব্বীতে আসার পর তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্য পিড়াপীড়ি করা হলে সমবেত মুহাজিরদের সম্বোধন করে বলেন, হে মুহাজিরগণ!
পয়গাম্বর (সাঃ) স্বয়ং যে হুকুমাতের ভিত্তি স্থাপন করেছেন সেটাকে তোমরা তাঁর পবিত্র অভিজাত বংশের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেদের কুটিরে আবদ্ধ রাখার বৃথা চেষ্টা করোনা। আল্লাহর শপথ! মহানবীর পরিবার একাজের
জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম। কেননা তাদের মধ্যে (আহলে বাইত) এমন সমস্ত যোগ্য ও মেধাবান ব্যক্তিরা রয়েছে যারা কোরআনের সঠিক গুঢ়রহস্য জানে এবং দ্বীন ইসলামের জ্ঞানভান্ডার তাদের অধীনে সুরক্ষিত, পয়গাম্বর (সাঃ)
এর সুন্নাত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত, তারাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনার ক্ষমতা রাখে, সমস্ত ফেতনা ফ্যাসাদের শিকড়কে তারাই উপড়ে ফেলতে পারে এবং বাইতুল মাল গাণিমতের সম্পদকে সুষমভাবে
একমাত্র তারাই বন্টন করার মনমানসিকতা রাখে। আর বাস্তবতা হচ্ছে এমন সকল যোগ্য পন্ডিত ব্যক্তিরা থাকতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অন্যদের হাতে মানায় না। এমন যেন না হয় যে, তোমরা নফসের খায়েশ মোতাবেক চলতে গিয়ে
আল্লাহর পথ থেকে ছিটকে পড় এবং হাকীকাত থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্রান্তিতে হামাগুড়ি খেতে থাক। (সূত্রঃ আল ইমামত ওয়াসসিয়াসাত খ.১, প.১১)
উক্ত বক্তৃতায় ইমাম নিজের শ্র্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে কত সুন্দর ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া এখানে অবৈধ খেলাফতের দাবিদারদের সাথে নিজের বিরোধী মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে
ইমাম আলী (আঃ) বানী হাশিমের একটি দল নিয়ে আবু বকরের নিকট যান এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, যোগ্যতা, বীরত্বগাঁথা ইতিহাস, রণাঙ্গনের সাহসিকতা এ সমস্ত বিষয়কে তার সামনে তুলে ধরে বলেন, আমি পয়গাম্বরের
জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উপযুক্ত। আমি তাঁর (সাঃ) উযির, উত্তরসূরি, জ্ঞানভান্ডার এবং গুপ্তরহস্য ভান্ডার। আমি হলাম সিদ্দিকে আকবার এবং সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী ন্যায়বান ব্যক্তি।
আমি সেই পুরুষ যে প্রথম মহানবীর উপর ঈমান আনার পর তাঁকে সত্যবাদী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। আমি মুশরিকদের সাথে রণক্ষেত্রে দৃঢ় ও অটলভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি, সুন্নাত ও কিতাবের সর্বজান্তা, উসূলে দ্বীন ও ফুরুয়ে
দ্বীনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, ভাষার মাধুর্যতা আর বাক্যালংকারে আমার রয়েছে পুরোপুরি দখল। তবু কেন তোমরা আমার অধিকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছো?
ইমাম আলী (আঃ) অন্য আরেকটি খুতবায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সক্ষম ক্ষমতাবান ও সর্বাপেক্ষা আল্লাহর বিধি বিধান সম্পর্কে সুঅভিজ্ঞ পন্ডিত একজন কোয়ালিটি সম্পন্ন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, হে জনতা! হুকুমত
পরিচালনার জন্য তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত যিনি জনতার মাঝে রাষ্ট্র চালানোর কলাকৌশলে অভিজ্ঞ এবং আল্লাহর বিধানকে ভাল করে জানেন। যার মধ্যে এই সামষ্টিক গুণাবলী অবর্তমান সে যদি খেলাফত লাভের চিন্তায় মগ্ন হয় এবং
নিজের ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডকে চালাতে থাকে তবে সে কতল তো হবেই। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-১৬৮)
এটা ছিল ইমাম আলীর দূরদর্শিতা, যুক্তিবিদ্যার পরিচায়ক রহস্য। আর নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শুধুমাত্র তাঁরই জবানীতে প্রকাশিত হয়নি বরং তাঁর ঘোরবিরোধীরাও একথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইমাম আলী যুগশ্রেষ্ঠ
মানব ও খেলাফতের যথাযোগ্য প্রাপক। প্রাধান্য রাখা সত্ত্বেও তাঁকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত রেখে তাঁর অধিকারকে ভূ-লন্ঠিত করা হয়েছে। আবু উবাইদা জাররা যখন শুনতে পায় যে ইমাম আবু বকরের বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি
জানিয়েছে তখন ইমামের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, শাসন কর্তৃত্বকে আবু বকরের হাতে ছেড়ে দিন। আমি জানি আপনি এর জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কারণ শ্রেষ্ঠত্বে, মর্যাদায়, ঈমানদার হিসেবে, জ্ঞানগরিমায়, দূরদর্শিতায়,
বংশমর্যাদায় এবং রাসুলুল্লাহর জামাতা হিসেবে আপনার সমতুল্য কেউই নেই। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১ পৃ. ১২)
ইমাম নিজের অধিকার পুনরুদ্ধারে শুধু বক্তৃতা ভাষণ বা স্মরণ করানোর উপরই ডিফেন্স করেননি ইতিহাসবেত্তাদের লেখনীতে জানা যায় পাশাপাশি তিনি কখনো কখনো ফাতেমা, হাসান-হোসাইনকে নিয়ে আনসারদের শীর্ষ নেতৃবর্গের
নিকট গমন করতেন যাতে করে খেলাফতকে তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাড়া পাননি। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বলাবলি করত যে আলী নিজেই যদি সবার
আগে খেলাফতের চিন্তা করে এবং আমাদের কাছ থেকে বাইয়াত চায় তাহলে আমরা তো তার সমর্থন ব্যক্ত করতে পারিনা কখনো; কেননা তার পূর্বেও তো আমরা প্রথম খলিফার বাইয়াতকে নাকচ করে দিয়েছি? ইমাম তাদের
প্রশ্নোত্তরে বলতেন, আচ্ছা আপনাদের দৃষ্টিতে এটাই কি উত্তম হত যে আমি পয়গাম্বরের মৃতদেহকে ফেলে রেখে খেলাফতের মোহে ছুটে যেতাম এবং সবার কাছ থেকে বাইয়াতের আহ্বান জানাতাম? ইমামের কথার সমর্থনে হযরত
ফাতেমা যাহরা বলেন, আলী নিজের দায়িত্ব কর্তব্যকে সবার চেয়ে ভালই জানেন। যারা আলীর হককে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাধাদান করেছে তাদের হিসাব মহান আল্লাহর হাতে। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১, পৃ. ১২)
অবাধ্য সীমালংঘনকারী দলের সামনে ইমামের এটা ছিল প্রথম পদক্ষেপ যার মাধ্যমে তিনি আশাবাদী ছিলেন হয়তো আনসারদের বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গকে বলে কয়ে অবহিত করে নিজের অধিকারকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে; কিন্তু
ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে এতে তিনি কোন ফলাফল লাভ করতে পারেননি বরং তাঁর হককে পঁয়মাল করা হয়। এখন যদি কোন বিবেকবান ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয় পরিবেশের এমন অস্থিতিশীল, সংবেদনশীল, অরাজকতাপূর্ণ
ও টানটান উত্তেজনায় ইমাম আলীর পক্ষে কোন পন্থাবলম্বন করলে ভাল হত, শুধুমাত্র সমাজকে পর্যবেক্ষণ করা ও নিশ্চুপ থাকা নাকি যুদ্ধ ও আন্দোলনের ডাক দেয়া?
ইমাম আলী (আঃ) এর সামনে একটি মাত্র রাস্তা খোলা ছিলঃ
পরিস্থিতির এমন নাজুক অবস্থায় ইমামের সামনে একটি পথ ব্যতীত ভিন্ন কোন উপায় না থাকায় তিনি শুধু আনসার ও মুহাজিরদের বিভিন্ন উপদেশমুলক, পরামর্শমুলক, সাবধানমুলক এবং সমাধানমুলক বাণীর মাধ্যমে
পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন এবং জনগণের নিকট সত্যকে পরিষ্কার ও নিজের হুজ্জাতকে সমাপ্ত করেন। অন্য দিকে খলিফা ও তার সমমনা ব্যক্তিরা খেলাফতের রশিকে কবজা করার জন্য জোরাজুরি করতে লাগে এবং তারা নিজেদের
ক্ষমতাকে সমপ্রসারণের অভিসন্ধি নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায়। আর যুগের আবর্তে খেলাফতের মসনদে আরোহণকারীরা খেলাফতের বিষয়টিকে এমনভাবে জনতার মন-মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করাতে থাকে যে এক সময় এটাকেই তারা
সঠিক প্রচলিত হুকুমাত হিসেবে মনে করতে লাগে এবং তাদের থেকে জীবনাদর্শ গ্রহণ করতে শুরু করে। সমাজের এমন সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মুহূর্তে মুহূর্তে মহানবীর পরিবারের উপর নেমে আসে দুর্ভোগ। বিপরীত দিকে
শাসকদের ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। এমতাবস্থায় ইমাম আলী (আঃ) এর দুটি পন্থা বেছে নেয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
ক) নবী বংশের সহায়তা করা এবং অনুরক্তদের নিয়ে লড়াই করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনা।
খ) আর নয়তো নিরব থাকা ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া এবং ব্যক্তিগত, চারিত্রিক দায়দায়িত্বকেই শুধু আঞ্জাম দেয়া।
অতএব, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে জানা যায় ইমাম যদি এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিগ্রহের পন্থা অবলম্বন করতেন তাহলে এতে তৎকালীন নব জন্ম নেয়া ইসলামের ক্ষতি ও অমঙ্গল বৈ কোনই কল্যাণ হত না। যার ফলে দ্বিতীয়
পথ নির্বাচন ছাড়া ইমামের সামনে ভিন্ন কোন উপায়ন্তর ছিল না।
পয়গাম্বর (সাঃ) উম্মাতের মুর্তাদ হওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেনঃ
১। মহানবী (সাঃ) জীবদ্দশায় ইসলামী সমাজের ভবিষ্যত ও ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন এবং তিনি সমাজের অবাধ্যতা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে মুসলমানদের মধ্যে কিছু দল তার মৃত্যুর পর সেই জাহিলিয়াতের
দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। সাথে সাথে ইলাহী বিধি আহকামকেও ভুলে যাবে। তাঁর এই ভাবনা আরো দৃঢ়তা লাভ করে উহুদের যুদ্ধের সময়। উহুদের যুদ্ধে যখন পয়গাম্বর (সাঃ) এর কতল হওয়ার অপপ্রচার শুরু হয় তিনি প্রত্যক্ষদর্শী
হিসেবে দেখতে পান যে অধিকাংশ সাধুবেশী পাশে অবস্থানকারী বুযুর্গ ব্যক্তিরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করতে আরম্ভ করেছে। তারা পাহাড়, পর্বত ও ময়দানের আশেপাশে জান বাঁচাতে ছুটাছুটি করছে। আবার অনেকেই
আবু সুফিয়ান ও মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর পাশে থাকাকে নিরাপদ মনে করে ছুটে যায়। এসকল লোকদের আকিদা বিশ্বাস এতই নড়বড়ে ও দুর্বল ছিল যে আল্লাহর সম্পর্কে হীন ধারণা করতেও তাদের বুক ততটুকু কাঁপেনি।
এ সমস্ত ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করে পবিত্র কোরআন ইরশাদ করে, “স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলেনা আর রাসুল তোমাদের পিছন দিক হতে আহ্বান করছিল।
ফলে তিনি তোমাদের বিপদের উপর বিপদ দিলেন যাতে তোমরা যা হারিয়েছো অথবা যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছিল তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।
(সূত্রঃ আলে ইমরানঃ ১৫৩)
পয়গাম্বরের কিছু সঙ্গীরা আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে শুরু করল যেভাবে জাহিলিয়াতের লোকেরা করত তারা এটাও বলতে লাগে যে এছাড়া কি আমাদের জন্য আর কোন পথ খোলা ছিল?
পবিত্র কোরআন অন্য একটি আয়াতে পয়গাম্বরের ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর কিছু লোকের ছত্রভঙ্গ ও দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। যেমন বলা হচ্ছে, মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র; তার পূর্বে
বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।
(সূত্রঃ আলে ইমরান আয়াত ১৪৪)
উক্ত আয়াত আসহাবে পয়গাম্বরকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এক. জাহিলিয়াতের যুগে প্রত্যাবর্তনকারী দল, দুই. মজবুত ঈমানের উপর অবিচল অবস্থানকারী কৃতজ্ঞ দল।
২) বানী সাকিফার ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নীল নকশা তৈরি, গোত্র ও বংশীয় বিদ্বেষ, জাহিলিয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, ঐ সমস্ত মুসলমানদের মনে
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তখনও পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেনি। ইসলাম ও ঈমান কেবলমাত্র তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ চেহারায় ঢাকনার ন্যায় ঝুলছিল। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় ঐ সমস্ত জামাত, তাদের বক্তৃতা ভাষণ কোন কিছুই
মঙ্গলার্থে ছিল না। প্রত্যেকেই খেলাফতের রাজমুকুট তার যোগ্য ব্যক্তির হাতে না দিয়ে নিজের গায়ে জড়াতে চেয়েছে। উক্ত সংগঠনটি ইসলাম ও মুসলমানদের কোন ধরণের কল্যাণমুলক চিন্তা তো করেনই নি বরং ইসলামের ভঙ্গুর
কিশতিকে যিনি সমুদ্রের পারে নিয়ে মুক্তি দিতে পারেন তার কাছ থেকে খেলাফত লুন্ঠন করেছে। মোটকথা হলো ঐ সমস্ত লোকদের অন্তরে ইসলামী আকিদা তখনও পর্যন্ত স্থান পায়নি, জাহিলিয়াতের আদিখ্যেতা চালচলন
অভ্যাস তাদের মন মস্তিষ্ককে ঘিরে রেখেছিল এবং মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বিগ্রহ, ফেরকাবাজী, দলে দলে বিভক্তির ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ হুমকির মুখে পড়ে আর কিছু লোক শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়।
৩) বানী সাকিফার ঘটনার পর ইমাম আলী (আঃ) এর প্রদত্ত ভাষণ এ বিষয়গুলোকে আরো পরিষ্কার করে। তিনি নিজের বক্তৃতায় ইসলামী উম্মাহর ঐক্য সংহতির গুরুত্ব এবং ছত্রভঙ্গতা, দলাদলির পরিণাম সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, আবু সুফিয়ান যখন ইমাম আলীকে বাইয়াতের চাপ দিতে থাকে ইমাম জনসমাবেশের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, হে জনমন্ডলী! ফিতনার তরঙ্গের মাঝে শক্ত হাতে হাল ধরে মুক্তির নৌকা চালিয়ে যাও; বিভেদের পথ থেকে
ফিরে এসো; এবং অহংকারের মুকুট নামিয়ে ফেলো ........ যদি আমি বলেই ফেলি খেলাফতের কথা তবে তারা আমাকে বলবে ক্ষমতালোভী, আর যদি আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি তবে তারা বলবে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত।
দুঃখের বিষয় এই যে, সকল উত্থান-পতনের মধ্যেও আমি টিকে আছি। আল্লাহর কসম, আবু তালিবের পুত্র মৃত্যুর সাথে এমনভাবে পরিচিত যেমন একটি শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে। আমি নিরব রয়েছি আমার গুপ্ত জ্ঞানের
কারনে যা আমাকে দান করা হয়েছে। যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে গভীর কূপ থেকে পানি উত্তোলনরত রশির মতো তোমরা কাঁপতে থাকবে। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-৫)
৪) নবমুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে পয়গাম্বরের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই তাদের মাঝে কতক দল ধর্মত্যাগ করে জাহিলিয়াতের তাদের পূর্বপুরুষদের পথকে স্বাগত জানায়। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইসলামী হুকুমতের বিরোধীতায় নেমে
পড়ে এবং ইসলামী কর দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ হলো, মুসলমানদের মধ্যে যারা ঈমানে বলিষ্ঠ তাদেরকে সাথে নিয়ে মুর্তাদদের সাথে সংগ্রাম করা যাতে তারা পুনরায় শাসকদের আনুগত্য
প্রকাশ করে এবং ইসলামী আইন কানুনের কাছে মস্তকাবনত করে। এছাড়া অন্য একটি গ্রুপ ইয়ামানে (মুসাইলামা, সাজ্জাহ ও তালাইহা) মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদার সেজে আরেকটি ফিতনার সৃষ্টি করে। তাই মুহাজির ও আনসারদের
মধ্যে যেখানে ঐক্য ফিরিয়ে আনা অসম্ভব, পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের ইসলামকে বিদায় জানানো এবং বিভিন্ন স্থানে মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদারদের উত্থান এ সমস্ত পরিস্থিতি সমূহে ইমাম আলী (আঃ) এর ন্যায় মহামানবের পক্ষে
নিজের অধিকার আদায়কল্পে কিয়াম করা মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। ইমাম মিশরবাসীদের প্রতি একটি পত্রে উক্ত বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আরবরা খেলাফতকে পয়গাম্বরের খান্দান
থেকে ছিনিয়ে নিবে বা এ থেকে আমাকে বিরত রাখবে। তারা যখন আমার বাইয়াত নিতে চাপ সৃষ্টি করছিল এ দেখে আমি আরো চমকে গেলাম। কিন্তু আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। দেখলাম জনতার একটি দল ইসলামকে ত্যাগ করেছে
এবং তারা মুহাম্মদের দ্বীনকে ধ্বংসের পাঁয়তারায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপলব্ধি করলাম যে যদি ইসলাম ও মুসলমানদের সাহায্যার্থে এগিয়ে না যাই তাহলে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আর দ্বীন ধ্বংস হওয়ার যন্ত্রণা আমার নিকট খানিক
দিনের হুকুমত না পাবার যন্ত্রণা অপেক্ষা অধিক বেশি যা বন্যার বানের মত অতিদ্রুত শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর আমি ঐ সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম এবং মুসলমানদের সহযোগিতা করতে প্রস্তত হলাম যাতে বাতিল অপসারিত
হয় আর জনতা ইসলামের নিরাপদ দূর্গে প্রবেশ করতে পারে। (নাহাজুল বালাগা)
উসমানের খেলাফতের সূচনালগ্নে যখন শূরা কমিটির সদস্যরা তার প্রতি রায় প্রকাশ করে ইমাম তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা সকলেই জানেন আমি খেলাফতের জন্য একমাত্র উপযুক্ত। এ মুহূর্তে যদিও আমার উপর জুলুম
করা হয় তবুও খেলাফতকে ছালাম জানালাম এবং শুধুমাত্র সওয়াবের আশায় আমি হুকুমতের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছি।
ইবনে আবিল হাদীদের মন্তব্যঃ
ইমাম আলী (আঃ) নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন রাখলেন কিছু দিন। হযরত নবী দুলালী ফাতেমা যাহরা (সাঃ আঃ) তাঁকে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য লড়াই করতে পরামর্শ দেন। মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের
আযানের ধ্বনি আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ ভেসে আসছিল ইমাম ফাতেমার দিকে মুখ করে বলেন, তুমি কি চাও এই ধ্বনি বিলুপ্ত হয়ে যাক? ফাতেমা বলেন, কখনো না। তারপর ইমাম বলেন, তাহলে আমি যে পথ
নির্বাচন করেছি এটা আঁকড়ে থাকাটাই হবে উত্তম। (সূত্রঃ শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১১, পৃ.১১৩)
এতক্ষণ আলোচনার পর এখন আমরা ইমাম ঠান্ডা মাথায় সার্বজনীন কল্যাণ চিন্তা করে যে পদক্ষেপ নিলেন তার ফলাফল সম্পর্কে পরখ করে দেখব,
মহৎ উদ্দেশ্যের মূল্যায়নঃ
এ রকম খুব কম সমাজই চোখে পড়ে যেখানে যোগ্য পরিচালক বা রাহবারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। একজন দক্ষ রাহবারের যে শর্তাবলী থাকা বাঞ্ছনীয় এ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তাহলে বলা যায় যে গোটা সমাজের মাঝে
এ কাজের জন্য হাতেগোনা কয়েকজনকে পাওয়া যাবে যারা এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত। সেই যোগ্য সমাজের রাহবারদের মধ্যে যিনি ঐশ্বী প্রদত্ত রাহবার হিসাবে মনোনীত তার দায় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
আল্লাহ মনোনীত রাহবারগণ নিজের মাকাম বা পদমর্যাদাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। আর খোদায়ী রাহবারগণ তো সেই মহৎ লক্ষ্যকে সমাজে বাস্তবায়ন করতেই প্রেরিত। তাদের
সামনে যখন দুটি রাস্তা উন্মোচন হয় তখন বাধ্য হয়ে একটি ত্যাগ করে অন্যটিকে বেছে নেন এবং নিজের মিশন বা অভিসন্ধিকে বাঁচানোর তাগিদে রাহবারত্বকে বিসর্জন দিয়ে দেন; কেননা এ ক্ষেত্রে মাকামের চেয়ে পবিত্র লক্ষ্যই
অগ্রাধিকার রাখে।
মুত্তাকিনদের মাওলা ইমাম আলী (আঃ) পয়গাম্বর (সাঃ) এর ওফাতের পর পরই ঠিক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোন। মানুষ যেভাবে কচি চারা গাছকে অতিযত্নে লালন করে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে তার শাখা প্রশাখা,
ফল ফলাদি, শীতল ছায়া দ্বারা উপকার ভোগ করতে পারে তদ্রুপ মহানবী (সাঃ) ইমাম আলী (আঃ)কে লালন পালন করেন যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তার পবিত্র অস্তিত্ব থেকে লাভবান হতে পারে। ইমাম মহানবীর (সাঃ) মৃত্যুর
পর পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলেন যে যদি খেলাফতকে হস্তগত করা হয় তাহলে এমন জটিলতার উদয় হবে যে পয়গাম্বরের পবিত্র মিশন যা তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তা বিফলে যাবে।
পূর্ব শত্রুতা ও বিদ্বেষঃ
তৎকালীন ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার দুরাবস্থা এবং মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ বিসম্বাদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে চরম আক্রোশ ও রক্তারক্তি শুরু হয়। মদিনার ও বাহিরের অধিকাংশ সমপ্রদায় ইমাম আলী (আঃ)
এর প্রতি ছিল নির্দয়। তারা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আলী (আঃ) এর উপর আক্রোশে ফেটে পড়ে। কারণ এসকল গোত্রের লোকদের পূর্বপুরুষদের তিনি কুফরের পক্ষে অবস্থান করার জন্য শায়েস্তা করেন এবং বিভিন্ন
যুদ্ধক্ষেত্রে ইমামের হাতেই তারা নিহত হোন। যদিও সে সকল মুশরিকদের পরবর্তী প্রজন্ম ইসলামের সাথে বাহ্যিক বন্ধন তৈরি করে কিন্তু মনে মনে চরম বিদ্বেষ লালন করে আসছিল। আর এমতাবস্থায় যদি ইমাম নিজের শক্তিমত্তা
দিয়ে লড়াই করে স্বীয় অধিকারকে ছিনিয়ে আনতেন তাহলে এ লড়াই থেকে নিম্নের ফলাফল বের হয়ে আসতঃ
১। এ লড়াইয়ে নিজের অধিকাংশ প্রিয় সাথীদের হারাতে হত। তারা মাওলার জন্য মৃত্যুকে বরণ করলেও বিনিময়ে ইমামের হক ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না।
২। শুধু বিশ্বস্থ সাথীদের শাহাদতই নয় বরং বানী হাশিম ও প্রিয় ব্যক্তিদের আন্দোলনের কারণে পয়গাম্বরের সাহাবাদের মধ্যে যারা আলীর খেলাফতকে মানতে পারেনি তারা কখনো তাঁর কাছে মাথা নত করত না। ফলে মুসলমান সমাজ
নড়বড়ে হয়ে যেত। সাহাবীদের মধ্যে যদিও আলীর রাহবারিত্বকে অনেকে মানতে নারাজ ছিল; কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তারা ইমামের সাথে ঐক্যমত ছিল।
৩। মুসলমানদের ঈমানী দূর্বলতার কারণে অন্যান্য প্রদেশে যাদের মধ্যে সবেমাত্র ইসলামের ছোঁয়া লেগেছিল তারাও ইসলাম বিদ্বেষী ও মুর্তাদদের সাথে যোগদান করে। তারা এক কাতারে শামিল হয় এবং সমাজের সঠিক দিকনির্দেশক না
থাকার ফলে তাদের মাঝ থেকে তাওহীদের চেরাগ চিরদিনের জন্য খামোশ হয়ে যেত। ইমাম আলী (আঃ) এমন একটা তিক্ত ভয়ানক পরিস্থিতিকে অতি কাছে থেকে অবলোকন করে নিরব থাকাটাই মঙ্গলজনক মনে করেন।
বিষয়টি আরো ভাল হবে যদি তা ইমামের জবান থেকে শ্রবণ করি।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুনাদা বলেন, আমি আলী (আঃ) এর ক্ষমতায় আরোহণকালে একদিন মক্কা থেকে মদিনায় আসলাম। দেখলাম যে, জনতা মসজিদে পয়গাম্বরে একত্রিত হয়েছে এবং ইমামের প্রতীক্ষায় বসে আছে। ইমাম একটি
তরবারী সাথে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। সকলেই তার প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর তিনি মিম্বারে উঠে আল্লাহর স'তি গাওয়ার পর সবাইকে সম্বোধন করে বলেন, সাবধান হও হে জনমন্ডলী! পয়গাম্বরের
ওফাতের পর তোমাদের উচিত ছিল তিনি হুকুমাতের জন্য যাকে নির্বাচিত করে ছিলেন তার ব্যাপারে বিরোধীতা না করা। কেননা, আমরাই মহানবীর উত্তরসূরি, আহলে বাইয়াত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কুরাইশদের মধ্যে
একটি দল আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, খেলাফতকে আমাদের কাছ থেকে ছিনতাই করেছে এবং তা নিজেরদের কাছে রাখতে চেয়েছে। আল্লাহর কসম! যদি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকত বা ইসলাম
থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় না থাকত অথবা ইসলাম নিঃশ্বেষ হওয়ার উপত্রুম না হত তবে তোমরা আলীর ভিন্ন রুপ দেখতে। (শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১, পৃ. ৩০৭)
মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করা ও ঐক্য বজায় রাখা ছিল ইমামের একটি মহান লক্ষ্য। তিনি ভাল করে জানতেন যে এই ঐক্যের কারণেই মহানবীর (সাঃ)আমলে স্বৈরবাদীদের ভীত নড়বড়ে হয়েছিল এবং ইসলামের বিকাশ ও
অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং যদি এই বন্ধন ক্ষমতার জটিলতার কারণে বিনষ্ট হয় তাহলে মুসলমানরা এখতেলাফের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তাছাড়া কুরাইশদের মধ্যে যে দলটি ইসলামের অমঙ্গল চেয়েছিল তারা একটি অজুহাতে
ইসলামের মূলে আঘাত হানার অপচেষ্টা করবে।
সমস্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ইমাম আলী (আঃ) কেন নিরবতাকেই যুদ্ধের উপর প্রাধান্য দিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। একজন কবি বিষয়টি তার কবিতার চরণে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। যার অনুবাদ হলোঃ
আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি উম্মতের নেতৃত্ব খান্দানে হাশিম ও আবুল হাসানের কাছ থেকে ছিনতাই করা হবে।
আলী কি প্রথম পুরুষ নন যিনি কেবলার দিকে নামাজ আদায় করেছেন? তিনি কি কোরআন ও সুন্নাতে তোমাদের চেয়ে জ্ঞানী নন? তিনি কি মহানবীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন না? তিনি কি প্রত্যেকটি সমরে পয়গাম্বরকে সাহায্য করেননি?
সিফফিনের যুদ্ধে বানী আসাদের এক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞাসা করেন, কুরাইশগণ কিভাবে আপনার মত ব্যক্তিকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করলো? ইমাম তার এই অসময়ে প্রশ্ন করার জন্য অসন্তষ্ট হলেন কারণ অনেক ইমামের
পক্ষাবলম্বনকারী সিপাহীরা অন্য খলিফাদের উপর বিশ্বাস করত। তার এহেন প্রশ্নের কারণে তাদের সারিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ইমাম ব্যথিত হৃদয়ে বলেন, পয়গাম্বরের প্রতি অনুরাগের কারণে এবং যেহেতু প্রত্যেক মুসলমান প্রশ্ন করার
হক রাখে তাই তোমাকে এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলব উম্মতের পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই ছিল এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মহানবীর সাথে। কিন্তু একদল কৃপণতা প্রকাশ করল এবং একদল চোখ বন্ধ করে রাখল।
তাদের ও আমাদের মাঝে ফয়সালা দান করবে আল্লাহপাক এবং আমরা সকলেই তার কাছে ফিরে যাব।
পরিশেষে বলব, এ ধরনের আরো বহু কারণ বিদ্যমান ছিল যার কারণে ইমাম ইসলাম রক্ষার্থে নিজের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেন এবং প্রায় পঁচিশ বছর নিরব থেকে বুক ভরা বেদনা নিয়ে দিনাতিপাত করেন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৪৭ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মালায়লাম বলতে হয়, ফায়দা ইল্লা্।
ঐ সমস্ত বানানো কিচ্ছা কাহিনী দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না। যদি আবু বকর রা. খলিফা না হয়ে আলী রা. খলিফা হতেন তাতে বর্তমান যুগের মুসলমানদের কি ফায়দা বা কি ক্ষতি ? কেন যে অর্থহীন কথাবার্তায় সময় নষ্ট করেন ? কেয়ামতের ময়দানে খোলাফায়ে রাসেদীনদের ব্যাপারে আপনাকে তো প্রশ্ন করা হবে না, কেন শেষ যামানায় মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের বাষ্প চড়াচ্ছেন ? আসলে আপনাদের আসল উদ্দেশ্যটা কি ?
এ মতগুলোতে যে বইগুলোর/বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছেন, সে ধরনের উদ্ধৃতি সুন্নীদের লেখা ইতিহাসে নাই? থেকে থাকলে কোন বইয়ে আছে?
আচ্ছা ভাই আঃ কি শুধু নবী রাসুল দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
তাহলে জীবরাইল, মীকাইল,ইস্রাফীল,আজরাইল উনাদের নামের শেষে কি লিখি?
হযরত হাওয়া র নামের শেষে কি লিখি?
হজরত মরিয়াম র নামের শেষে কি লিখি?
হজরত খিজির র নামের শেষে কি লিখি?
দয়া করে বিষয়টা পরিষ্কার করবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন