ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ও তাঁর আন্দোলনের কারণ
লিখেছেন লিখেছেন শিআনে আলী আলাইহিস সালাম ০৮ আগস্ট, ২০১৪, ১১:৩৫:৪০ রাত
বেহেশ্তের যুবকদের নেতা ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম আশুরার দিনে কারবালার মরুপ্রান্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইসলামের এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রতি বছরই স্মরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের এ মুসলিম সমাজে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাকেই বড় করে দেখা হয়, অথচ যে আদর্শের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই আদর্শের কথা তেমন একটা আলোচিত হয় না। কোথাও আলোচনা করা হলেও সেখানে শুধু এতটুকু বলা হয় যে, ইমাম হুসাইন একজন ফাসেক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন এবং তাঁকে তাঁর পরিবার-পরিজনসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ও পটভূমি এবং তাঁর আন্দোলনের কারণ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা হয় না বললেই চলে।
কিন্তু আমরা যদি কারবালার ঘটনার সাথে জড়িত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা না করি তা হলে আমাদের কাছে ইমাম হুসাইনের মহান আত্মত্যাগ কেবল একটি মর্মান্তিক ঘটনা হিসাবেই রয়ে যাবে, আমরা এ থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে পারব না। তাই আমাদের অবশ্যই ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পেক্ষাপট এবং তাঁর আন্দোলনের কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত। তবে সবচেয়ে আগে প্রাসঙ্গিকভাবে যে আলোচনা একান্ত প্রয়োজন তা হলো ইসলামের দৃষ্টিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা। যদি আমরা ইমাম হুসাইনের মর্যাদা বুঝতে না পারি তা হলে তাঁর আন্দোলনকেও ঝুঝতে পারব না। কেননা তাঁর মর্যাদা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারার জন্যই তাঁর আন্দোলন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা
মহানবী (সা.)-এর আহ্লে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম হুসাইন (আ.) মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ঘোষিত নিষ্পাপ ব্যক্তি। পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ যাঁর নিষ্পাপ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন১ :
إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرَا
“হে নবীর আহ্লে বাইত! আল্লাহ্ চান তোমাদের থেকে পাপ-পঙ্কিলতা দূর করে তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”
মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সব হাদীসের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ দু’টি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হলো। মহানবী (সা.) বলেছেন :
اَلْحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلَ الْجَنَّةِ
“হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা।”২
মহানবী (সা.) আরো বলেছেন :
إِنَّ الْحُسَيْنَ مِصْبَاحُ الْهُدَى وَ سَفِيْنَةُ النَّجَاةِ
“নিশ্চয়ই হুসাইন হেদায়েতের প্রদীপ ও মুক্তির তরণী।”৩
অনেক সময় আমরা ইমাম হুসাইনের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর এসব হাদীসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হই। অনেকে মনে করেন, যেহেতু ইমাম হুসাইন মহানবীর দৌহিত্র ছিলেন সেজন্য তিনি ভালোবেসে তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন, এমনকি ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে প্রশংসাসূচক উক্তি বা তাঁকে ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’ উপাধিতে ভূষিত করার পেছনে আত্মীয়তার সম্পর্কের কোনো ভূমিকা ছিল, নাকি ইমাম হুসাইন এর যোগ্য ছিলেন বলেই রাসূল তাঁকে এ উপাধিতে ভূষিত করেছেন এর জবাবের জন্য ইমাম হুসাইনের জীবন ও কর্মের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।
আমরা যদি তাঁর জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত জীবন পর্যালোচনা করি তা হলে আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হবে যে, তিনি কীভাবে নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আর ইসলামের জন্যই বা তিনি কতটুকু অবদান রেখেছেন!
ইমাম হুসাইন মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্যে তাঁর শৈশবের সাতটি বছর অতিবাহিত করেছেন। ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন। রাসূলের ওফাতের পর তিনি তাঁর পিতা রাসূলের ‘জ্ঞান নগরীর দ্বার’ হযরত আলী (আ.) ও ‘বেহেশতের নারীদের নেত্রী’ হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গড়ে তুলেছেন। পিতা-মাতার সংগ্রামী জীবন থেকেও তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাফের-মুশরিকদের সাথে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ তিনি পান নি; কিন্তু আলী (আ.)-এর খেলাফতকালে ইসলামের প্রকৃত রূপ বজায় রাখার জন্য তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়। রাসূলের ওফাতের পর যখন আলী (আ.)-এর কোষবদ্ধ তরবারি আবার কোষমুক্ত হলো তখন তিনি পিতার পাশে তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। পিতার শাহাদাতের পর বড় ভাই ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফতকালেও তিনি একই ভূমিকা পালন করলেন।
ইসলামের জন্য একে একে মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের আত্মত্যাগ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। অবশেষে সময় হলো নিজেকে উৎসর্গ করার। কিন্তু তিনি কীভাবে এ উৎসর্গ করলেন? তিনি কি শুধু নিজেকেই উৎসর্গ করলেন? না; বরং নিজের কলিজার টুকরো সন্তানদের, ভাইয়ের সন্তানদের ও নিকটাত্মীয়দেরকেও নিজের সাথে উৎসর্গ করে পৃথিবীর বুকে আত্মোৎসর্গের অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
মহান আল্লাহ্র ধর্ম ইসলামকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবার-পরিজনসহ নিজেকে চূড়ান্তভাবে উৎসর্গ করার মাধ্যমে যে ধারাবাহিক ভূমিকা তিনি রেখে গেছেন সেজন্যই তিনি ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’Ñ রাসূলের দৌহিত্র হিসাবে তাঁর এ মর্যাদা নয়।
আবার আমরা এ বিষয়টিও লক্ষ্য করি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সকল আত্মীয়ের মর্যাদাও সমান নয়। রাসূলের কোনো কোনো আত্মীয় অন্য সকল আত্মীয়ের চেয়ে অধিক সম্মানের অধিকারী। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁদের মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত হামযা (রা.)-কে ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা’ (শহীদদের নেতা), হযরত ফাতিমা (আ.)-কে ‘সাইয়্যেদাতু নিসায়িল আলামীন’ (জগতসমূহের নারীদের নেত্রী), হযরত হাসানকে ‘সাইয়্যেদু শাবাবি আহ্লিল জান্নাহ্’ (বেহেশতের যুবকদের নেতা), হযরত জাফর বিন আবি তালিব (রা.)-কে ‘তাইয়্যার’ (পাখি) উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আর এসকল মহান ব্যক্তিত্বের খোদাভীরুতা এবং ইসলামের জন্য তাঁদের অতুলনীয় ভূমিকার কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে। তাই বলা যায়, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) রক্ত-সম্পর্ক থাকার কারণে কাউকে কোনো মর্যাদায় ভূষিত করেন নি; বরং মহান আল্লাহ্র প্রতি তাঁদের ভালোবাসা এবং ইসলাম ধর্মের জন্য তাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগের কারণেই তাঁদের মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন। আর এ বিষয়টিই ইসলামে মর্যাদার ভিত্তি যা পবিত্র কোরআনেই বর্ণিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন :
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَى كُم
“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু ব্যক্তিই আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে সম্মানিত।”৪
এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলাম মানুষের মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে খোদাভীরুতা ও পরহেজগারীকে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদা দানের বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে।
খোদাভীরু (মুত্তাকী) ব্যক্তি নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে মহান আল্লাহ্র নির্দেশের কাছে সমর্পণ করেন। তিনি তাঁর করণীয় কাজ নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করেন এবং মহান আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহ্র নির্দেশ পালনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, দীন ইসলামের কল্যাণে কোনো বিষয়ই তাঁর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
ইমাম হুসাইন (আ.) তেমনি এক ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের জীবনে যেমন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি ইসলাম ধর্মের খেদমতে নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিয়োগ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যেরূপ ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ইমাম হুসাইনও সেরূপ এ ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং এ ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত শাহাদাতের অমিয় সুধা পানের মাধ্যমে এ ধর্মের খেদমতের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদা দানকে অস্বীকার করার বিষয়টি পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের জীবনী থেকেও প্রমাণিত হয়। যেমন হযরত নূহ (আ.)-এর স্ত্রী ও পুত্র এবং হযরত লূত (আ.)-এর স্ত্রী কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। নবীর স্ত্রী বা সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইসলামে তাদের কোনো মর্যাদা দেয়া হয় নি; বরং তাদেরকে জাহান্নামের অধিবাসী বলা হয়েছে।
তাই পবিত্র কোরআনের আলোকেই আমরা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারি। আবার রাসূলের মর্যাদার সাথেও এটি মোটেও খাপ খায় না যে, তিনি কেবল তাঁর সাথে রক্ত-সম্পর্ক থাকার কারণে কারো প্রশংসা করবেন। কারণ, পবিত্র কোরআন তাঁরই ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তিনি যা বলেন তা ‘ওহী ব্যতীত আর কিছুই নয়’।* প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর তাকওয়া-পরহেজগারী এবং ইসলাম ধর্মের জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন সে কারণেই রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলমানদের মধ্যে এমন কী হয়েছিল যার পরিণতিতে তাঁর ওফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পর প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁরই বংশধর বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইনকে?
ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের ঘটনা এমন নয় যে, হঠাৎ করেই ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া মুসলিম বিশ্বের খলিফা হয়ে ইমাম হুসাইনকে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করার নির্দেশ দেয় এবং ইমাম হুসাইনও বাইয়াত করতে অস্বীকার করে তাঁর আন্দোলন শুরু করেন; আন্দোলনের এক পর্যায়ে কুফা যাবার পথে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় নীত হন এবং সেখানে তিনি নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন।
প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনার একটি দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। আমরা জানি, নবিগণের ওফাতের পর তাঁদের উম্মতদের মধ্য থেকে কিছু লোক তাঁদের প্রচারিত ধর্মের মধ্যে বিকৃতি সাধন করত এবং একটা সময়ে সেই বিকৃতি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ধর্মের অস্তিত্বকেই বিলীন করে দিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের সময়ও মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকদের অস্তিত্ব ছিল যারা মনে-প্রাণে ইসলামকে গ্রহণ করে নি; বরং পরিস্থিতির কারণে মুখে ইসলাম প্রকাশ করেছিল। তারা সবসময় ইসলামের ক্ষতি সাধন করতে চাইত, ইসলামের মধ্যে বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে একে ধ্বংস করতে চাইত। তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এমন মুনাফিক গোষ্ঠীর কারণেই ধীরে ধীরে কারবালার এ হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়।
মুনাফিক গোষ্ঠীর কারণেই তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের সময় মুসলিম বিশ্বে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, এমনকি এদের কারণেই হযরত উসমান নিহত হন। এরপর হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতকালেও এ বিশৃঙ্খল অবস্থা অব্যাহত থাকে; বরং এটি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফ্ফিনের মতো দু’টি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর মুনাফিকরা ষড়যন্ত্র করে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। এরপর মুসলমান সমাজে প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে আমীরে মুয়াবিয়া ইয়াযীদকে মুসলমানদের খেলাফতে অধিষ্ঠিত করেন।
ইসলামবিরোধী যে সব কাজ অতীতে গোপনে সংঘটিত হতো, সেগুলো প্রকাশ্যে সংঘটিত হতে থাকে। এমনকি, মুসলিম বিশ্বের খলিফা ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কাজ শুরু করে। সে পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ইমাম হুসাইন (আ.) তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
তাই আমরা যদি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতকে পূর্ববর্তী পেক্ষাপট ছাড়া ৬১ হিজরীতে আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা মনে করি তা হলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পূর্ববর্তী দু’তিন বছরের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা বুঝতে পারব যে, রাসূলের ওফাতের পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনের ওপর বিপদ নেমে আসাটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। কাফের-মুশরিক নয়; বরং মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত মুনাফিকদের দ্বারা স্বয়ং রাসূলের জীবনই সবসময় হুমকির মুখে ছিল। রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে যেমন হযরত সালমান (রা.), হযরত আবু যার (রা.), হযরত আম্মার (রা.), হযরত মিকদাদ (রা.), হযরত আবু আইউব আনসারী (রা.)-এর মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন, এর বিপরীতে অনেক মুনাফিকও ছিল। এর প্রমাণ মেলে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসূলকে পাহাড় থেকে ফেলে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের ঘটনায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত হুযাইফাকে এসব মুনাফিকের নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। এসব মুনাফিকের ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণও রাসূল বলেছেন : “আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করলে বিধর্মীরা বলবে, মুহাম্মদ শক্তি ও ক্ষমতার তুঙ্গে পৌঁছার পর নিজ সঙ্গী-সাথীদের গর্দানের ওপর তরবারির আঘাত হেনেছে।”৫
রাসূলকে হত্যা চেষ্টার পাশাপাশি তাঁর সাথে মতবিরোধে লিপ্ত হওয়ার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটতে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিরোধিতার বিষয়টি ধীরে ধীরে প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। হযরত উসামাকে সেনাপতি নিয়োগের বিরোধিতা করা, রাসূলের আদেশ অমান্য করে সিরিয়া অভিযানে যেতে বিলম্ব করা অথবা রাসূলের শেষ অসিয়তনামা লেখতে বাধা দানের ঘটনায় রাসূলের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। তাই বলা যায়, রাসূলের ওফাতের পূর্বেই মুসলমানদের বিচ্যুতি শুরু হয় এবং রাসূলের ওফাতের পর তা চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ইসলামের মুখোশ পরে ইসলামের নামেই ইসলামবিরোধী কাজ চলতে থাকে। পরে প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কাজ শুরু হয়। ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাসনামলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হয় যে, ইসলামের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর কালজয়ী আন্দোলন শুরু করেন এবং বুকের রক্ত দিয়ে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের কারণ
ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের পেছনে বাহ্যিকভাবে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়ে থাকে :
১. ইয়াযীদের বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ নেয়ার চাপ;
২. কুফাবাসীর পক্ষ থেকে পত্র প্রেরণ এবং
৩. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।
আমরা সংক্ষেপে এ তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব এবং এরপর এর মধ্য থেকে কোন্টি ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল তা পর্যালোচনা করব।
১. ইয়াযীদের বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ নেয়ার চাপ : ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া ক্ষমতায় আরোহণের পরই ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে বাইয়াত আদায়ের জন্য মদীনার গভর্নর ওয়ালীদ ইবনে ওতবাকে নির্দেশ দেয়। সে বুঝতে পারে যে, যদি মদীনার জনগণ তার আনুগত্য মেনে নেয়, তা হলে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণও তার আনুগত্য সহজে মেনে নেবে। আর মদীনার জনগণের আনুগত্য আদায়ে মদীনার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য স্বীকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ইমাম হুসাইনকে গভর্নর প্রাসাদে ডেকে আনা হয়। ইমাম হুসাইন সেখানে গেলে গভর্নর তাঁকে ইয়াযীদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার জন্য আহ্বান জানায়। ইমাম হুসাইন তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন : “তোমরা কেনো আমার কাছে বাইয়াত চাচ্ছ? আল্লাহ্র জন্য নয়, আবার আমার বাইয়াতের মাধ্যমে তোমাদের শরীয়তবিরোধী খেলাফতকে শরীয়তসিদ্ধ করার জন্যও নয়; বরং তোমাদের উদ্দেশ্য জনগণের জন্যই তো? আমার বাইয়াত করা দেখে অন্যরা বাইয়াত করুক এটাই তোমরা চাও।” ওয়ালীদ তা স্বীকার করে নিলে তিনি বলেন : “তা হলে এ ফাঁকা দরবারে মাত্র তিন ব্যক্তির উপস্থিতিতে আমার বাইয়াত করায় তোমাদের কী লাভ হবে? বরং এ বিষয়টি পরে হবে।” এভাবে তিনি ইয়াযীদের আনুগত্য স্বীকার হতে বিরত থাকেন। এরপর তিনি মাত্র তিন দিন মদীনায় অবস্থান করেন। তারপর তিনি মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন।
২. কুফাবাসীর পক্ষ থেকে পত্র প্রেরণ : কুফাবাসী যখন জানতে পারে যে, ইমাম হুসাইন ইয়াযীদের বাইয়াত করতে অস্বীকার করেছেন, তখন তারা তাকে কুফায় যাওয়ার আহ্বান জানায়। তারা হাজার হাজার চিঠি লিখে তাঁকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। ইমাম তাদের আহ্বানে কুফার দিকে রওয়ানা হন।
৩. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ : ‘সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে নিষেধ করার ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য ইমাম হুসাইন (আ.) আন্দোলন করেছিলেন। যেহেতু তিনি দেখছিলেন মুসলমানরা অন্যসব বিধান পালন করছে কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান অনুযায়ী কাজ করছে না, তখন তিনি এ বিধান অনুযায়ী কাজ করলেন এবং আন্দোলন গড়ে তুললেন।
ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝতে না পারার জন্য মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করার ক্ষেত্রে যে উদাসীনতা ইমাম হুসাইন (আ.) লক্ষ্য করেছিলেন তা দূর করে ইসলামের প্রকৃত রূপ তাদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য তিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ইসলামের প্রতিটি হুকুমকে যে একইভাবে মানতে হবে সে বিষয়টিই তিনি প্রচার করলেন। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ক্ষেত্রেও যে মুসলমানদের ভূমিকা পালন করতে হবে তা তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন।
পর্যালোচনা
এবার আমরা তিনটি কারণ পর্যালোচনা করে সঠিক কারণটি নির্ণয়ের জন্য চেষ্টা করব।
ইয়াযীদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার চাপের বিষয়ে বলা যায় যে, যদি ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনকে বাইয়াতের জন্য চাপ না দিত তা হলে অন্যদের মতো ইমাম হুসাইনও নিশ্চুপ থাকতেন, এমন ভাববার কোনো কারণই নেই। অন্যরা যেমন ব্যক্তিগত ধর্মচর্চায় মগ্ন ছিল, ইমাম হুসাইন কখনোই তেমনি ব্যক্তিগত ধর্ম চর্চায় মগ্ন থাকতেন না। তিনি অবশ্যই ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। ইয়াযীদ কেবল ধর্মের বিধান লঙ্ঘন করত, তা নয়; বরং সে এ কাজ করে আনন্দ প্রকাশ করত। সে ধর্মের বিধান নিয়ে ঠাট্টা করত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি প্রকাশ্যে অসম্মানজনক উক্তি করত। তাই স্বয়ং ইয়াযীদের অস্তিত্বই ইসলামের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল।
ইমাম হুসাইন (আ.) বলেছেন :
وَ عَلَى الْإِسْلَامِ السَّلَامُ إِذْ قَدْ بُلِيَتِ الْأُمَّة بِرَعٍ مِثْلِ يَزِيْدِ
“ইয়াযীদের মতো লোক যদি উম্মতের রক্ষক হয় তা হলে এখানেই ইসলামের পরিসমাপ্তি।”৬
শাসক হিসাবে এমন লোকের অস্তিত্বই ইসলামকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সে ইসলামের মধ্যে ইসলামবিরোধী বিষয় অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করছিল, সে ইসলামকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছিল। তাই বাইয়াতের জন্য চাপ দেয়া হোক বা না হোক ইমাম হুসাইন আন্দোলন করতেন। তবে, বাইয়াতের চাপ তাঁর আন্দোলনকে গতিশীল করে।
এবার কুফাবাসীর আহ্বান প্রসঙ্গ। অনেকে মনে করে থাকেন, ইমাম হুসাইন (আ.) কুফাবাসীর আহ্বানে মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন এবং তিনি সরকারের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাবার জন্য মদীনা ত্যাগ করেছিলেন।
ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম হুসাইন যখন মদীনা ত্যাগ করে মক্কার দিকে রওয়ানা হন তখন কুফাবাসী জানতই না যে, তিনি ইয়াযীদের আনুগত্য করতে অস্বীকার করেছেন এবং মক্কার দিকে রওয়ানা হয়েছেন; বরং তাঁর মক্কায় পৌঁছারও দু’মাস পরে এ বিষয়টি কুফাবাসী জানতে পারে। এরপর তারা তাঁকে কুফায় গিয়ে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়ে পত্র প্রেরণ শুরু করে। তাই এটি স্পষ্ট হলো যে, তিনি কুফাবাসীর আহ্বান পেয়ে মদীনা ত্যাগ করেন নি। আবার তাঁর উদ্দেশ্যও রাজনৈতিক সশস্ত্র বিপ্লব ছিল না যা তাঁর আন্দোলনের প্রকৃতি থেকেই বোঝা যায়।
তিনি যদি রাজনৈতিক সশস্ত্র বিপ্লব ঘটানোর জন্য মদীনা থেকে বের হতেন তা হলে অবশ্যই চিরচেনা পথ ধরে যাত্রা না করে অন্য কোনো পথ বেছে নিতেন; তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কী করতে চাচ্ছেন তা গোপন রাখার চেষ্টা করতেন। অথচ তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে এবং ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর সামনে দিয়ে মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করে মদীনা থেকে মক্কায় পৌঁছেছিলেন। একইভাবে প্রকাশ্যে মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন।
যদি তিনি গোপন পথ অনুসরণ করতেন এবং জনগণ হঠাৎ করেই জানতে পারত যে, তিনি কুফায় গিয়ে বিদ্রোহীদের মাঝে অবস্থান করছেন তা হলে বলা যেত তিনি পরিকল্পিতভাবে একটি রাজনৈতিক বিপ্লব করার জন্য চেষ্টা করছিলেন। আবার তিনি যদি সশস্ত্র বিপ্লব করতে চাইতেন তা হলে তাঁর পরিবারের শিশু ও নারীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করতেন না।
আমরা যদি ইমাম হুসাইনের বক্তব্যের দিকে দৃষ্টি দেই তা হলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাবার জন্য আন্দোলন করছিলেন না। কারণ, যখন তিনি মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হন তখন বলেছিলেন : “আমি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছি।” তিনি মৃত্যুকে তুলনা করেছেন তরুণীর গলার হারের সাথে।
সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনাকারী সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার এবং দুশমনদের ধ্বংস করার ঘোষণা দেন। তিনি কখনো এভাবে কথা বলেন না। তিনি মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেন। মানুষ যেন তাঁকে একাকী ফেলে চলে না যায় সেজন্য তিনি অনেক কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে এর বিপরীত বিষয়ই পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাঁর গন্তব্য ‘মৃত্যু’ বলে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন এবং তাঁর সাথীদের মৃত্যুর সংবাদও অবহিত করছেন। মুসলিম বিন আকীলের শাহাদাতের সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছলে তিনি এ খবর গোপন না রেখে প্রকাশ করে দেন। কুফাবাসীর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয়টিও তিনি মানুষকে জানিয়ে দেন। আসলে তিনি চাচ্ছিলেন যারা তাঁর সঙ্গী হবে তারা যেন বুঝে-শুনেই সঙ্গী হয় যে, তিনি ক্ষমতা দখলের জন্য আন্দোলন করছেন না। এমনকি আশুরার রাতেও তিনি তাঁর সঙ্গীদের চলে যেতে বলেছেন। তিনি বলেছেন : “ওরা শুধু আমাকেই চায়, আমি তোমাদের থেকে বাইয়াত উঠিয়ে নিচ্ছি।”
ইমাম হুসাইনের গতিবিধি এবং তাঁর আন্দোলনের প্রকৃতিই প্রমাণ করে যে, তিনি ভিন্ন উদ্দেশ্যে অগ্রসর হচ্ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলন ছিল আল্লাহ্র ধর্মের পথে নিজেকে চূড়ান্তভাবে উৎসর্গ করার আন্দোলন, এ আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণরূপে একটি আধ্যাত্মিক আন্দোলনÑ পার্থিব কোনো চাওয়া-পাওয়ার বিষয় এর মধ্যে ছিল নাÑ সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল তো নয়ই।
ইসলামের আদর্শকে বিসর্জন দেয়া হচ্ছে, ইসলাম তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলছে, এ অবস্থায় ইমাম হুসাইন নিশ্চুপ থাকতে পারেন না। তাই তিনি আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত তাঁর মিশন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেছেন, বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামের বিধান সম্পর্কে মুসলমানদের সচেতন করার চেষ্টা করেছেন, শাসকদের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনগণকে অবগত করেছেন। তিনি জনগণকে অত্যাচারী ও ইসলামবিরোধী শাসকদের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
অনেকে ইমাম হুসাইনের কুফা যাবার সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে অদূরদর্শী বলে সাব্যস্ত করতে চান। তাঁরা বলেন : ইমাম হুসাইন কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাঁর পিতা ও ভাইয়ের সাথে তাদের আচরণ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি সর্বজনবিদিত ছিল। আর এজন্যই তাঁর শুভাকাক্সক্ষীরা তাঁকে মদীনা থেকে বের হওয়ার সময় এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন এবং কুফায় না যাবার সঠিক পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে কুফায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
এটি ঠিক যে, কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি ইমাম হুসাইন খুব ভালোভাবেই জানতেন। কিন্তু কুফাবাসীর আহ্বানে তিনি মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন এটি ঠিক নয়। কুফাবাসীর পক্ষ থেকে পত্র প্রেরণ ইমাম হুসাইনের মদীনায় অবস্থানকালে হয় নি। তিনি মদীনা থেকে বের হন রজব মাসে। আর মক্কায় পৌঁছার পরও দুই মাস পর কুফাবাসী তাঁর কাছে পত্র প্রেরণ করে। তাই মদীনা থেকে বের হবার সময় কুফা না যাবার ব্যাপারে তাঁকে সতর্ক করার বিষয়টি ইতিহাস-সমর্থিত নয়।
তবে কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও কেনো তিনি কুফা যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এ বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে।
কুফার অধিবাসী অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ইমামের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। ইমামের জন্য তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়াই তো বাস্তবসম্মত ছিল। যদি কুফার পরিবর্তে মুসলিম বিশ্বের অন্য কোনো জায়গা থেকে আহ্বান পেতেন তা হলে তিনি সেখানেই যেতেন। কিন্তু কুফা ব্যতীত অন্য কোন জায়গা থেকে তাঁর প্রতি আহ্বান জানানো হয় নি। একমাত্র কুফাই তাঁর অন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁকে নেতা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিল। ইমাম হুসাইন কাপুরুষ ছিলেন না যে, যারা তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল তাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে মক্কায় অবস্থান করবেন। অন্যদিকে তাঁর মক্কায় আগমনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছিল। ইমাম হুসাইন (আ.) যে উদ্দেশ্য নিয়ে মক্কায় এসেছিলেন তার একটি হলো মক্কায় মহান আল্লাহ্র ঘর কাবা অবস্থিত। শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সবাই মক্কার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিল। তাই তিনি অধিকতর নিরাপত্তার জন্য মক্কাকে বেছে নিয়েছিলেন। আরেকটি কারণ হলো রজব ও শাবান মাসে ওমরা এবং কিছুদিন পর জিলহজ্ব মাসে হজ্বের জন্য প্রচুর সংখ্যক মুসলমানের মক্কায় আগমনের বিষয়কে তিনি তাঁর মিশন প্রচারের জন্য কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াযীদের গুপ্তঘাতক কর্তৃক মক্কায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হবে এটি জানতে পেরে তিনি মক্কা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার চিন্তা করছিলেন। এ অবস্থায় কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেখানে যাওয়াই তাঁর জন্য যুক্তিযুক্ত ছিল এবং কুফাবাসীর আহ্বান তাঁর আন্দোলনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে ইতিহাস পর্যালোচনায়ও এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, রাজনৈতিক-সামরিক শক্তি বিবেচনায় কুফার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে নি; বরং পরবর্তীতে ক্ষমতায় আরোহণ ও পতনের পেছনে কুফার ভূমিকাই মূখ্য হয়ে ওঠে।
যদি কুফার এ ভূমিকা না-ও থাকত, তবু এতটুক অবশ্যই রাজনৈতিক-সামরিক বিশ্লেষকরা বলতে পারতেন যে, কুফার বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি সর্বজনবিদিত হলেও ইমাম হুসাইন অন্তত তাদের অবস্থা যাচাই করার চেষ্টা করে দেখতে পারতেন! দীর্ঘদিনের অত্যাচার-নিপীড়নের কারণে কুফাবাসীর মধ্যে শাসকদের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সেদিন দানা বেধে উঠেছিল তাতে তারা যে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে সংশোধন করেছিল তা বোঝা যাচ্ছিল। আর এজন্যই তারা শত-সহস্র চিঠিতে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছিল। যদি ইমাম হুসাইন সেখানে যেতেন তা হলে অত্যাচারী উমাইয়্যা শাসকদের পতন অবধারিত ছিল। ইমাম হুসাইন কুফায় গিয়ে অবস্থার ভিন্নতা দেখতে পেলে অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। কিন্তু আজ এ প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই যে, তিনি কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছেন!
অনেকের মতে ইমাম হুসাইনের অপর অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও তিনি ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর মতো একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসমযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।
যদি তাঁর সামরিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় তবে বলতে হবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কেনো মক্কার কাফের-মুশরিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন? কিংবা হযরত ইবরাহীম (আ.) কেনো একাকী হয়েও নমরুদের বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন? আর কেনোই বা হযরত মূসা (আ.) তাঁর একমাত্র সহযোগী ভাই হযরত হারুন (আ.)-কে সাথে নিয়ে ফিরআউনের রাজপ্রাসাদে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন?
আসলে খোদাদ্রোহিতাকে উৎখাত করাই এসব মহাপুরুষের উদ্দেশ্য। ঐশী পুরুষগণ এভাবেই খালি হাতে বৃহৎ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন। ইমাম হুসাইনও এর ব্যক্তিক্রম ছিলেন না।
ইয়াযীদ প্রকাশ্যে ইসলামের বিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে খোদাদ্রোহিতায় নেমেছিল। রাসূলের উত্তরাধিকারী হিসাবে এমন এক ব্যক্তি রাসূলের আসনে উপবিষ্ট হয়েছিল যে প্রকাশ্যে মদপান করত, ব্যাভিচার করত, বানর নিয়ে খেলা করত। এ অবস্থায় ইসলামের সম্মানের কতটুকুই বা অবশিষ্ট ছিল?
আর তাই ইসলামের জিহাদের বিধান কার্যকর করার জন্য এটিই ছিল উৎকৃষ্ট সময়। যদি তা করা না হতো তবে পরবর্তীতে কি নিয়ে জিহাদের দাবি উত্থাপিত হতে পারত?
সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের প্রসঙ্গ। ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের কারণ হিসাবে অপর দু’টি কারণ উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর আন্দোলনের একমাত্র কারণই ছিল সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ।
পবিত্র কোরআন ও রাসূলের হাদীসে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ব্যাপারে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেই নির্দেশের অনুবর্তী হয়েই ইমাম হুসাইন (আ.) বিদ্রোহ করেছেন।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
ولْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَ يَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ يَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ أُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ
“তোমাদের মধ্যে এমন একদল হোক যারা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে বাধা দেবে, তারাই সফলকাম।”৭
কোরআন মজীদ আরো বলছে :
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ للنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرْ
“তোমরা মানব জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, (কারণ) তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর ও অসৎ কাজে নিষেধ কর।”৮
ইমাম হুসাইন মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে।
তিনি ইসলামের ক্রান্তিলগ্নে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে বলেছেন :
ألَا تَرَوْنَ أَنَّ الْحَقَّ لَا يَعْمَلْ بِهِ، وَ أَنَّ الْبَاطِلَ لَا يَتَنَهى عَنْهُ؟ ليَرْغَبُ الْمُؤْمِن فِيْ لِقَاءِ اللهِ مُحَقًّا
“তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে, হকের ওপর আমল করা হচ্ছে না, বাতিলকে নিষেধ করা হচ্ছে না, এ অবস্থায় একজন মুমিনের উচিত নিজের জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করা।”৯
অত্যাচারী এবং আল্লাহ্র আদেশ অমান্যকারী শাসকদের সম্পর্কে রাসূলের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন :
أَيُّهَا النَّاسَ مَنْ رَأَى سُلطَانًا جَائِراً مُسْتَحِلًّا لِحَرَامِ اللهِ، نَاكِثًا لِعَهْدِ اللهِ مُسْتَأْثِراً لَفي اللهِ مُعْتَدِيًا لِحُدُوْدِ اللهِ فَلَمْ يُغَيِّر عَلَيْهِ بِقَوْلٍ وَ لَا فِعْلٍ كَانَ حَقًّا عَلى اللهِ أَنْ يَدْخُلَهُ مَدْخَلَهُ إِلَّا وَ أَنَّ هَؤُلَاءِ الْقَوْم قَدْ أَحَلُّوا حَرَامَ اللهِ وَ حَرَّمُوا حَلَالَهُ وَ اسْتَأْثَرُوا فِي اللهِ
“যদি কেউ কোনো অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী সরকারকে দেখে যে হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করছে, বায়তুল মালকে নিজের ব্যক্তিগত খাতে খরচ করে, আল্লাহ্র বিধান পদদলিত করে, মুসলমানের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করে না, এরপরও যদি সে নিশ্চুপ থাকে তা হলে আল্লাহ্ তাকে ঐ জালেমের সাথে একই শাস্তি প্রদান করবেন।”
ইমাম হুসাইন সবসময় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং আল্লাহ্র বিধান বর্ণনা করে সতর্কও করেছেন। সবশেষে ইমাম হুসাইন (আ.) স্বয়ং তাঁর আন্দোলনের কারণ হিসাবে কী বলেছেন সেটাই আমরা দেখব। তিনি বলেছেন :
إِنِّيْ مَا خَرَجْتُ أَشِراً وَ لَا بَطِراً وَ لَا مُفْسِداً وَ لَا ظَالِماً وَ إِنَّمَا خَرَجْتُ لِطَلَبِ الْإِصْلَاحِ فِيْ أُمَّةِ جَدِّيْ، أُرِيْدُ أَنْ آمُرَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ أَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ و أَسِيْرَ سِيْرَةِ جَدِّيْ وَ أَبِيْ عَلِيّ بْنِ أَبِيْ طَالِبْ
“আমি যশের বা ক্ষমতার লোভে কিংবা বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য অথবা অত্যাচারী হিসাবে বের হই নি। আমি বের হয়েছি আমি আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করার জন্য। আমি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে চাই এবং আমার নানা এবং বাবা আলী ইবনে আবি তালিব যে পথে চলেছেন সে পথেই চলতে চাই।”১০
একদিকে ইসলামের বিধান না মানা ও এর বিপরীতে ইসলামবিরোধী কাজকে বৈধ করার চেষ্টা চলছিল এমনভাবে শুরু হয়েছিল যে, যদি তা বিনা বাধায় অনুমোদন পেয়ে যেত তা হলে আজ ইসলামেরই কোনো অস্তিত্ব থাকত না। যেমন নামায ঠিকমতো আদায় না করা, মদপান, ব্যাভিচার, বাইতুল মালের অপব্যবহার ও আত্মসাৎ, শাসক নিয়োগে যোগ্যতার নীতি পরিহার, রাজতন্ত্র কায়েম, সম্মানিত ব্যক্তিদের মর্যাদা হানি ও তাদের বিকলাঙ্গ করা, গুপ্তহত্যা, বানর নিয়ে খেলা প্রভৃতি বিষয় ইসলামের ভিত্তি নাড়িয়ে দিচ্ছিল।
অন্যদিকে শাসকশ্রেণীর অত্যাচার-নিপীড়নের মুখে মুসলমানদের এসব কাজের প্রতি নির্লিপ্ততা ও তাদের অজ্ঞতা শাসকদেরকে আরো বেপরোয়া করে তুলছিল। মুসলমান হিসাবে যে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তা থেকে মুসলমানরা দূরে সরে গিয়েছিল।
এরকম পরিস্থিতিতেই ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্যই ইমাম হুসাইন (আ.) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ভিত্তিতে তাঁর আন্দোলন শুরু করেন।
অনেক সময় মানুষের অনভূতি এতটা ভোঁতা হয়ে যায় যে, যদি তাকে শক্ত আঘাত করা না যায়, তা হলে তার অনুভূতি জাগ্রত হয় না। ইমাম হুসাইন যখন দেখলেন তাঁর বক্তব্য কাউকে উজ্জীবিত করতে পারছে না, তাঁর জীবিত অস্তিত্ব কাউকে প্রভাবিত করতে পারছে না, তখন তিনি মানুষের অনুভূতি জাগ্রত করার জন্য অন্য পথ বেছে নিলেন। আর তা হলো শাহাদাতে পথ। রক্ত দিয়ে তিনি মানুষের বিবেক জাগ্রত করলেন। শহীদ ইমাম হয়ে উঠলেন জীবিত ইমামের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তির অধিকারী। যখন তিনি শাহাদাত বরণ করলেন তখনই মানুষ তাঁর শাহাদাতের কারণ উদ্ঘাটনে তৎপর হলো, শাসকবর্গের চরিত্র অনুসন্ধানের ফলে তাদের চরিত্র প্রকাশিত হতে লাগল। শুরু হলো একের পর বিদ্রোহ। মদীনা, কুফা, মক্কাসহ ইসলামী বিশ্বের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দিল। এভাবে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের এক পর্যায়ে কুখ্যাত বনু উমাইয়্যার শাসনব্যবস্থার পতন হলো।
এ আন্দোলনের চলমানতা
ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর সাথীদের শাহাদাতবরণের পর আহ্বান করেছিলেন :
هَلْ مِنْ نَاصِرِيْنَ يَنْصُرْنِيْ؟
“আমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আছ কি?”
এ আহ্বান কেবল সে সময়ের মানুষের প্রতি ছিল না। এ আহ্বান কিয়ামত পর্যন্ত যারা পৃথিবীতে আগমন করবে তাদের সবার প্রতি। ইমাম হুসাইনের আহ্বানের প্রতি সাড়া দিয়ে কেউ যখন সত্যের পতাকা হাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির সাহায্যে দাঁড়িয়ে যায় সে দিনটিই আশুরা আর যখন একজন শহীদের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে তার রক্ত কোনো ভূমিতে পতিত হয় সেই ভূমিই কারবালা।
তাই কারবালার কাফেলা এখনো চলছে। শাহাদাতের মর্যাদা ৬১ হিজরীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এ রহমতের দরজা এখনো উন্মুক্ত। তাই যতদিন এ নশ্বর পৃথিবীতে অত্যাচার-উৎপীড়ন থাকবে ততদিন মহান আল্লাহ্র অনুগত বান্দাদের নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা উচিত নয়। বাতিল ও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পূর্ববর্তী নবী-রাসূল হযরত আদম (আ.), হযরত নূহ (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), মূসা (আ.), ঈসা (আ.) এবং রাসূল্লুাহ্ (সা.)-এর উত্তরাধিকার ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছেছিল। অপরদিকে নমরুদ, ফিরআউন, আবু জাহ্ল, ইয়াযীদ, ইবনে সা’দ, উবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদ এবং শিমারের উত্তরাধিকার পৌঁছেছে বর্তমান কালের অত্যাচারী শাসকদের কাছে যারা সব সময়ই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য আমাদেরকেও চেষ্টা করতে হবে। ইসলামকে রক্ষার জন্য ইমাম হুসাইনের মতো আমাদেরকেও চূড়ান্তভাবে আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আর তা হলেই আমরা তাঁকে ভালোবাসার দাবি করতে পারব, তাঁর অতুলনীয় শাহাদাতের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব, অন্যথায় নয়।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র বংশরগণের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
বিষয়: বিবিধ
১২৮৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যেমন আপনি লিখেছেন- হযরত নূহ (আ.)-এর স্ত্রী ও পুত্র এবং হযরত লূত (আ.)-এর স্ত্রী কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। নবীর স্ত্রী বা সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইসলামে তাদের কোনো মর্যাদা দেয়া হয় নি; বরং তাদেরকে জাহান্নামের অধিবাসী বলা হয়েছে।
তেমনিভাবেই হযরত আমিয়ে মুয়াবিয়া (রা) ছেলে অভিশপ্ত ইয়াজিদ (লা. আ.)কেও কোন মুসলমান হকের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে মনে করেন না। হযরত আমিরে মোয়াবিয়া (রা) একজন কাতেবে ওয়াহীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। অপর দিকে তার পিতা মক্কার কাফির শক্তি কোরাইশদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব পর্যায়ের একজন হয়ে জীবনের বেশীর ভাগ সময় ইসলামের বিরোধীতা করলেও জীবন সায়াহ্নে এসে ঈমান কবুল করে ইসলামের অনেক বড় খেদমত করেছিলেন।
হযরত ওসমান (রা) এর শাহাদতকে এতো তুচ্চ তাচ্ছিল্যের ভাষায় বর্ণনা করলে হয়তো নিজস্ব আক্বিদাগত বোধ বিশ্বাসের আলোকে মনের ঝাল মিটানো যেতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে তার পক্ষে।
আহলে বাইত তথা রাসুল (সা) এর বংশধরদের ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তর থেকে দরদ, ভক্তি ও শ্রদ্ধা আছে এবং থাকা উচিতও বটে।
হযরত ফাতিমা (রা)-কে ‘সাইয়্যেদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ বলা হয়েছে’ হযরত হাসান (রা)কে সাইয়েদাতু শাবাবে আহলিল জান্নাহ যেমন বলা হয়েছে তেমনি রাসুল (সা) দশ জন সাহাবীর ব্যাপারে আগাম জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন তাদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করা উচিত একজন মুসলমান সবার।
মন্তব্য করতে লগইন করুন