মাযহাব ও আহলে হাদীসঃ উভয় বাড়াবাড়ির বিপরীতে মধ্যমপন্থা কোনটি? - শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)
লিখেছেন লিখেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক সঞ্চারণ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৬:৩৩:৪৬ সন্ধ্যা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নেওয়া হয়েছে এই পেইজ থেকে - Islamic Scholars In Bangla
সঠিক পন্থা হলো মধ্যমপন্থা
মূল বইতে সামনের বিষয় দুটি বিস্তারিত আলোচনার পর শাইখ বলেন- উপরে যে দুটি পন্থার কথা আলোচনা করে এলাম, অর্থাৎ (১) হাদীসের শব্দের হুবহু অনুসরণ এবং (২) ফকীহদের বক্তব্য থেকে মাসয়ালা তাখরীজ (মাস’আলা বের করা) করা –এই উভয় পন্থারই দ্বীনি ভিত্তি রয়েছে। সকল যুগের মহাক্কিক আলিমগন দু’টি পন্থাই অনুসরন করে আসছেন। তবে (পার্থক্য ছিলো কেবল উভয় পন্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের)। অর্থাৎ তাদের কেউ তাখরীজের তরীকার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়েন আবার কেউ অধিক ঝুঁকে পড়েন হাদীসের শব্দ অনুসরণ নীতির প্রতি। (উভয় নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রতি তাঁরা কেউই মনোযোগ দেননি।) আসলে, এই দুটি পন্থার কোনো একটিকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করা যেতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উভয় পন্থার (অর্থাৎ আহলে হাদীস ও আহলে ফিকাহর) লোকেরাই এই কাজটী করেছেন। তাঁরা একটিকে পরিত্যাগ করে অপরটির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু সঠিক পন্থা ছিলো এর চাইতে ভিন্নতর। উচিত ছিলো, উভয় তরীকাকে একত্র করে একটিকে আরেকটির সাথে তুলনা করে দেখা এবং একটিতে কোন ভুল ক্রুটি থাকলে অপরটির দ্বারা তা নিরসন করা। এ কথাটিই বলেছেন হাসান বসরী তার নিম্নোক্ত বক্তব্যেঃ
“কসম সেই আল্লাহর, যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, তোমাদের পথ হচ্ছে গালী (সীমালংঘনকারী) এবং জাফী (অপরিহার্য সীমার নিচে অবস্থানকারী) এর মাঝখান দিয়ে।”
অতএব আহলে হাদীসের উচিত, তাদের অনুসৃত ও অবলম্বিত যাবতীয় মাসয়ালা এবং মাযহাবকে তাবেয়ী এবং পরবর্তীকালের মুজতাহিদ ইমামগণের রায়ের সাথে তুলনা করে দেখা এবং তাদের ইজতিহাদ থেকে ফায়দা হাসিল করা। আর আহলে ফিকাহর লোকদেরও উচিত সাধ্যানুযায়ী হাদীসের ভান্ডারে চিন্তা ও গবেষণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, যাতে করে সরীহ ও সহীহ হাদীসের বিপরীত মত প্রদান থেকে বাঁচতে পারেন এবং যেসব বিষয়ে হাদীস কিংবা আছার বর্তমার রয়েছে, সেসব বিষয়ে মত প্রদান থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
ইসলাম এসেছিল ঐক্যের পয়গাম নিয়ে। কিন্তু অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামীর কবলে পড়ে সে আজ মতবিরোধ ও ঝগড়া বিবাদের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কতিপয় ক্ষুদ্র আনুষঙ্গিক মাযহাবী মাসালাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া বিবাদের তুফান বইয়ে দেয়া হয়েছে। এসবের কারণ নিয়ে যখনই আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি, দেখতে পেয়েছি, প্রতিটি গ্রুপই সত্য ও ন্যায়ের কেন্দ্র থেকে কিছু না কিছু বিচ্যুত হয়েছে। গোঁড়ামী এবং বিদ্বেষ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। প্রত্যেকেই সত্যের অনুসারী বলে দাবী করেছে। কিন্তু সত্যের একনিষ্ঠ রাজপথে চলার পরিবর্তে তারা আবেগতাড়িত হয়েছে। আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে সঠিক সুষম ন্যায়-পন্থা জানার মানদন্ড প্রদান করেছেন। তা দিয়ে আমি সত্য ও ভ্রান্তের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছি। জানতে পারছি, সত্যের সরল সোজা রাজপথ কোনটি? আরো জানতে পারছি, লোকেরা এখন কোন ধরনের মতবিরোধসমূহের মধ্যে নিমজ্জিত? আর তাদের এস মতবিরোধ ও ঝগড়া বিবাদের ভিত্তি কি?
মুসলমানদের এই অবস্থা আমাকে দারুন পীড়া দেয়। তাই তাদের সমস্যার সঠিক ধরন তাদের সামনে তুলে ধরা দরকার। তাদের চিন্তা ও উপলব্ধির ভ্রান্তি সম্পর্কে তাদের সাবধান করা দরকার। তারা এই ভ্রান্ত পথে মুখে এবং কলিমের মাথায় যে বারাবাড়ি করছে, সে সম্পর্কে তাদের হুঁশিয়ার করা দরকার।
১. বিবাদের সবচাইতে বড় হাতিয়ারটি হলো তাকলীদ। চারজন ইমামের তাকলীদের ব্যাপারে প্রায় গোটা উম্মাত একমত। সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত লোকেরা প্রায় সর্বসম্মতভাবে তাঁদের তাকলীদ করে আসছে। আর এতে যে বিরাট কল্যাণ নিহিত আছে, তাও সকলের চোখের সামনেই রয়েছে। বিশেষ করে কাল পরিক্রমায় লোকেরা যখন দ্বীনি বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা গবেষণা পরিত্যাগ করে বসেছে, নিজ মতের পিছে ছুটে বেড়াচ্ছে এবং নফসের ঘোড়ার পিছে দৌড়াচ্ছে।
তাকলীদ সম্পর্কে ইবনে হাযমের বক্তব্যঃ
“কুরআন এবং প্রাচীন আলিমগণের সর্বসম্মত মতানুযায়ী তাকলীদ হারাম এবং মুজতাহিদ ইমামগণ স্বয়ং তাঁদের তাকলীদ করতে নিষেধ করে গেছেন” লোকদের দারুণ ভুল বুঝাবুঝিতে নিমজ্জিত করেছে। তারা মনে করে বসেছে, কথাটা বুঝি সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্যেই প্রযোজ্য! কথাটি স্বয়ং সত্য কথা। তবে তা প্রযোজ্য হবে ক্ষেত্রবিশেষে। অর্থাৎ তাকলীদ নিষিদ্ধ তাদের জন্যে, যারা ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখেন অন্তত একটি মাসয়ালার ক্ষেত্রে হলেও। তাদের জন্যেও তাকলীদ করা নিষেধ, যারা সুস্পষ্টভাবে জানেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) অমুক কাজের হুকুম দিয়েছেন, অমুক কাজ নিষেধ করেছেন এবং অমুক হুকুম রহিত।’ এ জ্ঞান তারা সরাসরি হাদীস অদ্যায় করে অর্জন করুক কিংবা অর্জন করুক দ্বীনের সেরা আলিমদের আমল দেখে, তাতে কিছু যায় আসে না।
এ সত্যের প্রতিই ইংগিত করেছেন শাইখ ইযযুদ্দীন আবদুস সালাম। তিনি বলেছেনঃ
“ঐসব ফকীহদের অবস্থা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি, যারা স্বীয় ইমামদের ইজতিহাদী ভ্রান্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্বেও সেই ভ্রান্তিকে আঁকড়ে ধরে থাকে এবং তা ত্যাগ করে কিতাব, সুন্নাহ ও কিয়াসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ মতকে গ্রহণ করে না। বরং এসব অজ্ঞ-অন্ধরা তাদের অন্ধ তাকলীদের ভ্রান্ত জজবায় অনেক সময় করে বাস্তবে কুরআন সুন্নাহর বিরুদ্ধে চলে যায় এবং স্বীয় ইমামকে ক্রটিহীন প্রমাণ করার জন্যে কুরআন সুন্নাহর এমন ভ্রান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে যা কালামের তাহরীফ (পরিবর্তন-পরিবর্ধন) ছাড়া আর কিছু নয়।”
তিনি অন্যত্র লিখেছেনঃ
“প্রথম যুগের লোকেরা যে আলিমকেই সামনে পেতেন, তাঁর কাছেই ফতোয়া জেনে নিতেন। তিনি কোন খেয়াল ও মসলকের লোক, তা জানার চেষ্টা করতেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। চার মাযহাবের আবির্ভাব ঘটে। সেগুলোর অন্ধ অনুকরণকারীদের আগমন ঘটে। লোকেরা হিদায়াতের আসল উৎস থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল ইমামদের বক্তব্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাদের কোনো বক্তব্য যতোই দুর্বল ও দলিলবিহীন হোক না কেন। ভাবটা যেন এমন যে, মুজতাহিদরা মুজতাহিদ নন বরং আল্লাহর রাসূল, মাসূম এবং তাদের কাছে ওহী নাযিল হয়! এটা সত্য ও হকের পথ নয়। বরঞ্চ নির্ঘাত অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির পথ।”
এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু শামাহ বলেনঃ
কেউ যদি ফিকাহর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, তিনি যেনো কোনো একটি মাযহাবেকে যথেষ্ট মনে না করেন। বরঞ্চ প্রত্যেক মুজতাহিদের মতামত যেনো মনোযোগ দিয়ে দেখেন। প্রত্যেকের মধ্যে ডুব দিয়ে সত্যের বাতি জ্বালিয়ে দেখা উচিত। অতঃপর যে মতটিকে কুরআন-সুন্নাহর অধিকতর মনে কাছাকাছি মনে করবেন সেটাই যেনো গ্রহণ করেন। প্রাচীন আলিমগণের জ্ঞান ভান্ডারের প্রয়োজনীয় অংশগুলোর প্রতি যদি তিনি নযর দেন, তবে ইনশাল্লাহ যাচাই-বাছাইর এ শক্তি অর্জন করা তার জন্যে সহজ হয়ে যাবে এবং সহজেই শরীয়তের সত্যিকার রাজপথের সন্ধান পেয়ে যাবেন। এরূপ লোকদের কর্তব্য হলো গোষ্ঠীগত গোঁড়ামী থেকে নিজেদের মন–মস্তিষ্ককে পবিত্র রাখা। বিবাদ-বিসম্বাদের ময়দানে একটি কদমও না ফেলা। কারণ সেখানে সময় নষ্ট করা এবং স্বভাব ও আচরণে বিকৃতি লাভ করা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ইমাম শাফেয়ী তাঁর এবং অন্যদের তাকলীদ করতে লোকদের নিষধ করে গেছেন। একথা বলেছেন শাফেয়ীর ছাত্র আল মুযনী তাঁর গ্রন্থ মুখতাসার এর সূচনায়।
ইবনে হাযমের মন্তব্য এমন সাধারণ ব্যক্তির ব্যাপারেও প্রযোজ্য যে দ্বীনি ইলম সম্পর্কে পূর্ণাংগ না থাকার তাকলীদ করে বটে, কিন্তু কোনো একজন ফকীহর তাকলীদ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে করে যে, তিনি ভুল করে না, তিনি যা বলেন সবই সঠিক। তাছাড়া দলিল-প্রমাণের দিক থেকে তাঁর মত যতোই ভুল এবং বিপরীত মত যতোই বিশুদ্ধ হোক না কেন, সর্বাবস্থায়ই সে তাঁর তাকলীদের উপর জমে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত এ নীতি সেই ইহুদীবাদেরই অনুরূপ যা তাওহীদী আদর্শকে শিরকে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল। এ প্রসংগে একটি হাদীস উল্লেখযোগ্য। হাদীসটি মুসলিম শরীফে আদী ইবনে হাতিম থেকে বর্ণিত হয়েছে।
তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা-মাশায়েখদের রব বানিয়ে নিয়েছে।
[সূরা তাওবা আয়াতঃ ৩১]
আয়াত পড়ে বলেছেনঃ ইহুদীরা তাদের উলামা-মাশায়েখদের ইবাদাত করতো না বটে, কিন্তু তারা যখন কোনো জিনিসকে বৈধ বলতো। তারা সেটাকেই (নির্বিচারে) বৈধ বলে গ্রহণ করতো আর তারা তাদের জন্যে যেটাকে নিষিদ্ধ করতো, সেটাকেই অবৈধ বলে মেনে নিতো।”
সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো একজন মাত্র ইমাম এর তাকলীদ করা যে, তিনি শরীয়তের নির্ভুল মুখপাত্র—তার পূজা করারই সমতুল্য।
ঐ ব্যক্তির ব্যাপারেও ইবনে হাযমের ফতোয়া প্রযোজ্য যে মনে করে, কোনো হানাফীর জন্যে শাফেয়ী ফকীহর কাছে এবং কোনো শাফেয়ীর জন্যে হানাফী ফিকাহর নিকট ফতোয়া চাওয়া বৈধ নয়, কিংবা হানাফীর জন্যে শাফেয়ী ইমামের পিছে এবং শাফেয়ীর জন্যে হানাফী ইমামের পিছে (নামাযে) ইক্তেদা করা বৈধ নয়। এটা সাহাবী, তাবেয়ী ও উলামায়ে সলফের কর্মনীতির সুস্পষ্ট বিরোধিতা। এরূপ চিন্তা ও কর্ম কোনো অবস্থাতেই বৈধ হতে পারে না।
কিন্তু এরূপ বিশুদ্ধ ঈমান-আকীদার অধিকারী হওয়া সত্বেও যেহেতু সে কুরআন-হাদীস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে না, বিরোধপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের যোগ্যতা রাখে না এবং কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতে মাসায়েল ইস্তিম্বাতের (উদ্ঘাটনের) যোগ্যতা রাখে না, সেহেতু সে যদি তার দৃষ্টিতে সুন্নাতের রাসূলের ভিত্তিতে ফতোয়া দেবার উপযুক্ত নির্ভরযোগ্য কোনো আলিমের ইক্তেদা-অনুসরণ করে এবং মনে এই চিন্তা রাখে যে, যখনই সে আলিমের কোনো ফতোয়া কুরআন সুন্নাহর প্রমাণিত দলিলের বিপরীত দেখতে পাবে, তখনই তা ত্যাগ করবে, কোনো প্রকার গোঁড়ামী করবে না, এরূপ ব্যাক্তির জন্যে তাকলীদকে কিছুতেই অবৈধ বলা যেতে পারে না।
কারণ, রাসূলুল্লাহর সে যুগ থেক এ নিয়ে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে ফতোয়া চাওয়া এবং ফতোয়া দেয়ার এ নিয়মই অবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। সুতরাং এই নীতিতে আমল করার পর এক ব্যাক্তির কাছে সবসময় ফতোয়া কিংবা বিভিন্ন ফকীহর নিকট বিভিন্ন সময় ফতোয়া চাওয়া উভয়টাই বৈধ। এটা কেমন করে অবৈধ হতে পারে? কারণ আমি তো কোনো ফকীহর ব্যাপারে এরূপ ঈমান পোষণ করি না যে, তাঁর নিকট আল্লাহ তায়ালা ফিকাহ সংক্রান্ত ওহী নাযিল করেন, তাঁর ইতায়াত করা আমার জন্যে ফরয এবং তিনি নিষ্পাপ। আমি যখন কোনো ফকীহর ইক্তেদা করি, তখন তার সম্পর্কে এ ধারণা নিয়েই তাঁর ইক্তেদা করি যে, তিনি কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের একজন আলিম। সুতরাং তাঁর বক্তব্য কুরআন সুন্নাহ মুতাবিকই হবে। হয় সরাসরি কুরআন হাদীস দিয়েই কথা বলবেন, কিংবা কুরাআন হাদীসের ভিত্তিতে ইস্তিম্বাত করে কথা বলবেন।
২. তাকলীদের পর মুসলমানদের মধ্যে সবচাইতে বড় সমস্যার কারণ হয়েছে কুরআন–হাদীসের শাব্দিক অনুসরণ এবং ইস্তেখরাজ।
এখানে দু’টি নিয়ম রয়েছে। একটি হলো, হাদীসের শাব্দিক অনুসরণ। আর দ্বিতীয়টি হলো, মুজতাহিদ ইমামদের প্রণীত উসূলের ভিত্তিতে মাসায়েল ইস্তিম্বাত করা। শরয়ী দিক থেকে এই দু’টি নিয়মই সর্বস্বীকৃত। সকল যুগের বিজ্ঞ ফকীহগণ দু’টি বিষয়ের প্রতিই গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তবে কেউ একটির প্রতি অধিক মনোনিবেশ করেন, আবা কেউ অপরটির প্রতি বেশী যত্মবান হন। কিন্তু কোনো একটিকে সম্পুর্ণ পরিত্যাগ কেউ করেননি।
সুতরাং হক পথের কোনো পথিকেরই কেবল একটি মাত্র পন্থার প্রতি সম্পূর্ণ ঝূঁকে পড়া উচিত নয়। অথচ দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এই প্রবণতাই তাদের গোমরাহীর জন্যে দায়ী। এই দু’টি পন্থার একটিকে বাদ দিয়ে কোনো একটি দ্বারা হিদায়াত এর রাজপথের সন্ধান পাওয়া খুবই দুষ্কর। সঠিক নীতি হচ্ছে, উভয় পন্থাকে পৃথক করে না দিয়ে উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা। একটি দ্বারা আরেকটির কাঠামোকে আঘাত না করে একটির সাহায্যে আরেকটিকে ক্রটিমুক্ত করা। কেবল এভাবেই অটল মজবুত ভিতের উপর দ্বীনী বিধানের এক দুর্ভেদ্য প্রাসাদ নির্মিত হতে পারে।
এভাবেই তাতে কোনো ভ্রান্তির প্রবেশ পথ বন্ধ হতে পারে। এ নীতির প্রতিই আমাদেরকে অংগুলি নির্দেশ করে দেখিয়েছেন হাসান বসরীঃ
“আল্লাহর কসম, তোমাদের পথ হচ্ছ, সীমা থেকে দূরে অবস্থান এবং সীমাতিক্রম—এ দূটির মাঝখানে।”
৩. তৃতীয় যে জিনিসটি মুসলমানদের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে, তা হলো শরয়ী বিধান জানার জন্যে কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ–অনুকরণগত তারতম্য।
শরয়ী বিধান অবগত হবার জন্যে কুরআন ও হাদীসের যে অনুসরণ করা হয়, তার মধ্যে মাত্রাগত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম মর্যাদা হলো, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে শরয়ী বিধানসমূহ সম্পর্কে এতোটা বিজ্ঞতা অর্জন করা, যাতে করে প্রশ্নকর্তাদের প্রায় সমস্ত প্রশ্নের জবাব অতি সহজেই দেয়া যায় এবং মানব জীবনে সংঘটিত সকল ঘটনাবলীর শরয়ী সমাধান অবগত হবার জন্যে তার অনেক দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়, অনেক নীরবতা অবলম্বন করতে হয়। এটা হচ্ছে ইজতিহাদের মর্যাদা। আর এর যোগ্যতা অর্জন করার কয়েকটি পন্থা রয়েছে যা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন বইতে।
‘ইয়াকুত ও জাওয়াহেরে’ উল্লেখ আছে, আবু হানীফা (রহ) বলতেনঃ
“আমার মতের পক্ষে গৃহীত দলিলসমূহ যার জানা নেই আমার মতানুযায়ী ফতোয়া দেয়া তার উচিত নয়। আবু হানীফা স্বয়ং কোনো ফতোয়া দেয়ার সময় বলতেনঃ “এটা নুমান বিন সাবিতের (অর্থাৎ আমার) মত। আমার নিজের বুঝ-জ্ঞান আনুযায়ী আমি এটাকেই উত্তম মনে করি।”
ইমাম মালিক (রহ) বলেনঃ
“রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া এমন কোনো মানুষ নেই, যার পুরো বক্তব্য গ্রহযোগ্য হতে পারে। তিনি ছাড়া আর সকলের বক্তব্যের কিছু অংশ গ্রহণযোগ্য এবং কিছু অংশ বর্জনীয়।”
হাকিম ও বায়হাকীতে বর্ণিত হয়েছে, শাফেয়ী (রহ) বলতেনঃ
“কোনোঃ বিষয়ে সহীহ-বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া গেলে সে বিষ্যে সেটাই আমার মত।” অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে, শাফেয়ী (রহ) বলেছেনঃ
“তোমরা যখন আমার কোনো মতকে হাদীসের সাথে বিরোধপূর্ণ দেখতে পাবে, তখন তোমরা হাদীসের ভিত্তিতে আমল করবে এবং আমার মতকে দেয়ালের ওপাশে নিক্ষেপ করবে।”
শাফেয়ী (রহ) একদিন ইমাম মুযনীকে লক্ষ্য করে বলেনঃ “হে আবু ইব্রাহীম! আমার প্রতিটি কথার অন্ধ অনুকরণ (তাকলীদ) করো না। বরঞ্চ সে বিষয়ে নিজেও চিন্তা-গবেষণা করা উচিত। কারণ, এটা যা-তা ব্যাপার নয়, দ্বীনের ব্যাপার।”
তিন আরও বলতেনঃ
“রাসূলুল্লাহ (স) ছাড়া আর কারো কথার মধ্যে কোনো হুজ্জত নেই, তাদের সংখ্যা যদি বিরাটও হয়।”
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) বলতেনঃ
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার সাথে বিরোধপূর্ণ হলে কোনো ব্যাক্তির কথাই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি এক ব্যক্তি কে বলেছিলেনঃ
“আমার তাকলীদ করো না। মালিক, আওযায়ী, ইব্রাহীম নখয়ী প্রভৃতি কারই তাকলীদ করো না। তারা যেমন কিতাব ও সুন্নাহ থেকে মাসয়ালা গ্রহণ করেছেন, তোমরাও অনুরূপভাবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই মাসয়ালা গ্রহণ করো।
সকল ইমামের মাযহাব ও মতামত সম্পর্কে অবগত হওয়া ছাড়া কারোই ফতোয়া দেয়া উচিত নয়। কারো নিকট যদি এমন কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করা হয়, যেটির বিষয়ে স্বীকৃত ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন সেটির সেই সর্বসম্মত জবাবটি বলে দেয়াতে কোনো দোষ নেই। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে সেটা তার নিজস্ব মতামত নয়, বরঞ্চ ইমাম-মুজতাহিদ্গণের মতেরই ভাষ্য বলে গণ্য হবে। তার নিকট যদি কেউ কোনো মতবিরোধপূর্ণ মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করে, সেক্ষেত্রে এটা অমুকের মতে জায়েজ আর অমুকের মতে নাজায়েজ জবাব দেয়াতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে এক পক্ষের মত বলে দেয়া উচিত নয়।”
ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) এর বিখ্যাত দু’জন ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম যুফার (রহ) প্রমুখ বলেছেনঃ
“এমন কোনো ব্যক্তির আমাদের মত অনুযায়ী ফতোয়া দেয়া উচিত নয়, যিনি আমাদের মতের ভিত্তি সম্পর্কে অবগত নন।”
ইমাম আবু ইউসুফকে বলা হয়ঃ ‘আবু হানীফার সাথে আপনার ব্যাপক মতপার্থক্য লক্ষ্য করছি।‘ তিনি তাকে জবাবে বলেনঃ “এর কারণ, আবু হানীফাকে যতোটা বুঝ-জ্ঞান দেয়া হয়েছে, ততোটা আমাদেরকে দেয়া হয়নি। তিনি তাঁর বুঝ জ্ঞানের মাধ্যমে যা অনুধাবন করেছেন, তার সবটা বুঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাঁর যে বক্তব্য আমরা উপলদ্ধি করতে পারি না, তা দিয়ে ফতোয়া দেয়া আমাদের জন্যে বৈধ হতে পারে না।”
ইবনুস সিলাহ বলেছেনঃ “শাফেয়ী মাযহাবের কোনো ব্যক্তির নজরে যদি এমন কোনো হাদীস পড়ে, যেটি শাফেয়ীর মতের সাথে সাংঘর্ষিক, এরূপ ক্ষেত্রে তিনি যদি ইজতিহাদের মতলকের অধিকারী হন কিংবা সেই বিষয় বা মাসয়ালাটি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হন, তবে বিষয়টি সম্পর্কে গবেষোণা করার পর হাদীসটি বিশুদ্ধ প্রমাণিত হলে, সেক্ষেত্রে হাদীসটির উপর আমল করা এবং তাকলীদ পরিহার করা তাঁর জন্যে জরুরী। আর তিনি যদি এরূপ যোগ্যতার অধিকারী না হন আর দেখেন যে, অপর কোনো ইমাম এর মত হাদীসটির অনুরূপ। সে ক্ষেত্রেও হাদীসটির উপরই আমল করা তাঁর জন্য জরুরী। কারণ, এতে করে তাঁর কোনো না কোনো ইমামের তাকলীদ করা হয়ে যাচ্ছে।”—ইমাম নববীও এ মতই পোষণ করেন।
৪. চতুর্থ সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে ফকীহদের পারস্পরিক মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে। অথচ ফকীহদের মধ্যে তো মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব বিষয়ে, যেসব বিষয়ে স্বয়ং সাহাবায়ে কিরামের (রা) নিকট থেকেই পার্থক্যপূর্ণ মত (ইখতেলাফ) পাওয়া গেছে। যেমনঃ তাশরীক ও দুই ঈদের তাকবীর, মুহরেমের (যিনি ইহরাম বেধেছেন) বিয়ে, ইবনে আব্বাস ও ইবনে মাসউদের (রা) তাশাহুদ, বিসমিল্লাহ এবং আমীন সশব্দে কিংবা নিঃশব্দে পড়া প্রভৃতি বিষয়ে। এসব ক্ষেত্রে তাঁরা একটি মতকে আরেকটি মতের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন মাত্র।
অতীত আলিমগণের মতপার্থক্য মূল শরীয়তের ব্যাপারে ছিলো না। মতপার্থক্য হয়েছে আনুসঙ্গিক বিষয়াদিতে। আর সেসব মতপর্থক্যও ছিলো নেহাতই সাধারণ ধরণের। মতপার্থক্য ছিলো দু’টি বিষয়ের মধ্যে কোনটি উত্তম, তাই নিয়ে। কেউ মনে করেছেন এটি উত্তম, আবার কেউ মনে করেছেন ওটি উত্তম। যেমন, কারীগণের কিরআতের পার্থক্য। বিভিন্ন কারী বিভিন্ন দৃষ্টিভংগিতে তিলাওয়াত করেন। একই শব্দ বা আয়াত এর তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তুমি তাদের মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখতে পাবে। ফকীহদের মতপার্থক্যের ধরনও অনুরূপ। ফকীহগণ তাঁদের মতপার্থক্যের কারণ হিসেবে বলেছেন, এই মতও সাহাবীদের থেকে পাওয়া গেছে, ঐ মতও সাহাবীগণের (রা) নিকট থেকে পাওয়া। অর্থাৎ তাদের মধ্যেও পারস্পরিক মতপার্থক্য ছিলো এবং তা সত্বেও তাঁরা সকলেই হিদায়াতের উপর ছিলেন। এ কারণে হকপন্থী আলিমগণ ইজতিহাদী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সকল মুজতাহিদের ফতোয়াকেই জায়েজ মনে করেন, সকল কাযীর ফায়সালাকেই স্বীকার করেন এবং অনেক সময় নিজ মাযহাবের বিপরীত মতের উপরও আমল করেন। এ কারণেই তুমি দেখতে পাচ্ছো, তারা মাসয়ালার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ইখতেলাফী দিকসমূহ আলোচনার পর বলে দেন, ‘আমার মতে এটাই উত্তম’, ‘আমার মতে এটা গ্রহণ করা ভালো’। আবার কখনো বলেনঃ ‘আমি কেবল এতোটুকুই জানতে পেরেছি।‘ ‘আল মাসবূত’ আছারে মুহাম্মাদ এবং শাফেয়ীর বক্তব্যের মধ্যে এ কথাগুলোর সাক্ষ্য তুমি দেখতে পাবে।
অতঃপর শুভবুদ্ধির অধিকারী দ্বীনের সেই মহান খাদিমদের কাল অতিক্রান্ত হয়। তাদের পরে এমনসব লোকের আগমন ঘটে, যারা সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির অধিকারী হবার কারণে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিবাদের ঝড় বইয়ে দেয়। মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনো একটিকে আঁকড়ে ধরে। এ মতের অধিকারীদের এক পক্ষ আর ঐমতের অধিকারীদের আরেক পক্ষ থেকে। এভাবেই শুরু হয় ফিরকা-পুরস্তী। এতে করে মানুষের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে তাহকীক ও চিন্তা গবেষণার জজবা। তারা নিজ নিজ ইমামের মাযহাবকে আকড়ে ধরে অন্ধভাবে। আফসোস তাদের এই অবস্থার জন্যে!
অথচ এইসব মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ে সাহাবী, তাবেয়ী ও তাদের পরবর্তী মহান আলিমগণের অবস্থা দেখো! তাঁরা (নামাজে) কেউ বিসমিল্লাহ পড়তেন, আবার কেউ পড়তেন না। কেউ তা সশব্দে পড়তেন, আবার কেউ নিঃশব্দে পড়তেন। কেউ ফজরে দোয়ায়ে কুনুত পড়তেন, আবার কেউ তা পড়তেন না। কেউ নকসীর, বমি ও ক্ষৌরকার্য করার পর অযু করতেন, আবার কেউ করতেন না। কেউ কামনা সাথে স্বীয় লিংগ এবং স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অযু করতেন, আবার কেউ করতেন না। কেউ রান্না করা খাদ্য খেলে অযু করতেন আবার কেউ করতেন না। তাদের কেউ উটের গোশত খেলে অযু করতেন আবার কেউ করতেন না।
এতদসত্বেও তাঁদের একজন অপরজনের পিছনে নামাজ পড়তেন। যেমন, আবু হানীফা ও তাঁর সাথীরা এবং শাফেয়ী প্রমুখ মদীনার ইমামদের পিছনে নামাজ পড়তেন। অথচ তাঁরা ছিলেন মালিকী অন্যান্য মতের লোক এবং তাঁরা সশব্দে কিংবা নিঃশব্দে বিসমিল্লাহও পড়তেন না। ইমাম আবু ইউসুফ হারুনুর রশীদের পিছে নামাজ পড়েছেন। অথচ হারুনুর রশীদ ক্ষৌরকার্য করার পর নতুন করে অযু করতেন না। কারণ ইমাম মালিক (রহ) ফতোয়া দিয়েছেন, ক্ষৌরকার্য করার পর অযু করার প্রয়োজন নেই। আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) ক্ষৌরকার্য এবং নকসীর৮২ এর জন্যে অযু করার কথা বলেছেন।
[৮২. গরমের প্রকোপে নাক দিয়ে যে রক্ত বের হয়, তাকে নকসীর বলে। –অনুবাদক]
কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ “যদি ইমামের শিরীর থেকে রক্ত বের হয় আর তিনি অযু না করেন, তবে কি আপনি তার পিছে নামাজ পড়বেন?” জবাবে তিনি বললেনঃ ‘কেমন করে আমি মালিক ও সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেবের পিছে নামাজ না পড়ে থাকতে পারি?’৮৩
[৮৩. এ দু’জনের মতে এটা অযু ভঙ্গের কারণ নয়। –অনুবাদক]
বর্ণিত আছে, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ উভয়েই ঈদে ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত আকবীরের অনুসরণ করতেন। হারুনুর রশীদের পছন্দের কারণে তাঁরা এটা করতেন। অথচ তাঁরা ইবনে মাসউদ বর্ণিত তাকবীরের অনুসারী।
একবার শাফেয়ী আবু হানীফার কবরের কাছাকাছি স্থানে ফজরের নামাজ আদায় করেন। এ সময় আবু হানীফার সম্মানার্থে তিনি ফজরের নামাজে দোয়ায়ে কুনুত পড়েননি। তিনি বলতেন, আমি অনেক সময় ইরাকবাসীদের (আবু হানীফার) মাযহাবের উপর আমল করি।
ইমাম খানজাদীকে শাফেয়ী মাযহাবের এমন এক ব্যাক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, যে ব্যাক্তি এক বা দুই বছরের নামাজ ছেড়ে দিয়েছিল, অতঃপর আবু হানীফার মাযহাব গ্রহণ করে। এখন সে কোন মাযহাবের রীতিতে নামাজগুলো কাযা করবে? শাফেয়ী মাযহাবের রীতিতে নাকি হানাফী মাযহাবের রীতিতে? জবাবে ইমাম খানজাদী বলেনঃ “সে বৈধ মনে করে, এমন যে কোনো মাযহাবের রীতিতে পড়লেই নামাজ আদায় হয়ে যাবে।”
কোনো হানাফী মাযহাবের লোক যদি শপথ করে যে, ‘আমি যদি অমুক মহিলাকে বিয়ে করি, তবে তাকে তিনি তালাক দিলাম।’৮৪
[৮৪. উল্লেখ্য, হানাফী মাযহাব অনুযায়ী এভাবে শপথ করলে সেই মহিলাকে বিয়ে করার সাথে সাথে তার উপর তিন তালাক প্রযোজ্য হয়ে যাবে। –অনুবাদক]
অতঃপর কোনো শাফেয়ী আলিমের নিকট ফতোয়া চাইলে তিনি যদি বলেনঃ ‘তালাক হয়নি, তোমার শপথ বাতিল, সেটা ছিলো একটা বাহুল্য কথা।’ এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সে যদি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণ করে, তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, এর পক্ষে বিরাট সংখ্যক সাহাবীর মত রয়েছে। এ কথাগুলো উল্লেখ হয়েছে ‘জামিউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে।
ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) তাঁর ‘আমালী’ গ্রন্থে বলেছেনঃ “কোনো ফকীহ যদি তার স্ত্রীকে বলে, ‘তোমাকে তালাক দিয়ে দিলাম’ এবং তার মাযহাব অনুযায়ী সে যদি এটাকে তিন তালাক বা বায়েন তালাক মনে করে, কিন্তু সমকালীন কাযী যদি সেটাকে তালাকে রিজয়ী (ফেরতযোগ্য) বলে ফায়সালা দেয়, তবে তার স্ত্রীর সাথে ঘর করার অবকাশ তার রয়েছে।”
একইভাবে হালাল হারাম, লেনদেন ও পারস্পরিক সম্পর্কের সেইসব বিষয়ে, যেগুলোর ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, প্রত্যেক ফকীহর উচিত সেসব বিষয়ে ইসলামী আদালত তার মাযহাবের বিপরীত রায় দিলেও সে রায়ের উপর আমল করা এবং সেসব ক্ষেত্রে স্বীয় মাযহাবের উপর আমল না করা।
আলোচনাকে অন্যন্ত দীর্ঘায়িত করলাম। যেসব কারণে বিভিন্ন মাযহাব ও দল উপদলের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ লেগে আছে, সেগুলোর কারণ উদ্ঘাটিত করা এবং সত্য ও সঠিক পথের দিশা দেয়াই এ দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য। কেউ যদি বিদ্বেষী এবং অতি সংকীর্ণ ও অতি উদার মনোভাব থেকে মুক্ত হয়ে ন্যায় ও সত্যানুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে এ কথাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়, তবে সত্য ও সঠিক পথের অনুসরণের জন্যে এ কথাগুলোই তার জন্যে যথেষ্ট। আর প্রকৃত সত্য সম্পর্কে তো আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।“
শাইখ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) এর মূল গ্রন্থটি আরবী ভাষায় লিখিত। খ্যাতনামা আরব আলিম আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ সম্পাদিত এবং বৈরুতের ‘দারুন নাফায়েস’ কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৮৪ ঈসায়ীতে মুদ্রিত গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ভারতের খ্যাতনামা আলিম মাওলানা সদরুদ্দীন ইসলাহী কর্তৃক অনূদিত উর্দূ – এই দুটিকে সামনে রেখেই এই বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা করা হয়েছে ।
মতবিরোধকে মিটাতে, এতে ভারসাম্য আনতে, উম্মাতে মুহাম্মাদিকে একই রজ্জুতে দৃঢ়তার সাথে দাড়াতে, এই বইয়ের বিস্তারিত বর্ণনা আমাদেরকে শান্তি পথ দেখায়, মধ্যমপন্থা দেখায়, দেখায় কীভাবে মত পার্থক্য এড়িয়ে, বা সুষম করে, ভারসাম্য এনে আমাদেরকে একই উম্মাতের ভাই-ভাই হিসেবে বিশ্বে অবদান রাখার মত একটি দেহে রুপান্তরিতকরণের রুপ দেয়।
উৎসঃ বই "মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিকপন্থা অবলম্বনের উপায়" – শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৮৯০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন