...পরীক্ষা এবং একজন বারসিসা
লিখেছেন লিখেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক সঞ্চারণ ১৯ মে, ২০১৫, ১০:১২:৪০ রাত
আল্লাহ বলেন-
“মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?” (সূরা আনকাবুতঃ ২)
কুরআন আমাদের আল্লাহর করা পরীক্ষার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। আল্লাহ্ আমাদের পরীক্ষা করবেনই তা আমরা যেই অবস্থায়ই থাকিনা কেন।
ঈমান আনার পর ঈমান রক্ষা করা আরো অনেক বেশি কঠিন। তখন শয়তান মু'মিন ব্যক্তিটাকে পেয়ে বসতে অনেক কায়দাই করতে থাকে।
হাদিসে উল্লেখিত একজন আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল এক বান্দার কাহিনী এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষণীয় আমাদের জন্য। কীভাবে কী থেকে কী হয়ে গেলেন তিনি। (আল্লাহ আমাদের মাফ ও হেফাজত করুক।) চলুন কাহিনীটি জানা যাক।
বারসিসা বনী-ইসরাইলের একজন সুখ্যাত উপাসক, ধর্মযাজক ও ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। সে উপাসনালয়ে একনিষ্ঠভাবে নিজেকে আল্লাহর উপসনায় নিয়োজিত রাখত। তার সময়ে বনী-ইসরাইল জাতির মধ্যে তিন ভাই সিদ্ধান্ত নিল যে তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। কিন্তু তাদের একটি বোন ছিল এবং তারা ভেবে পাচ্ছিলো না যে বোনটিকে তারা কার নিকট রেখে যাবে। লোকজনদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই তিন ভাই বারসিসার নিকট গেল। তারা গিয়ে বারসিসাকে বলল যে তারা
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে যেতে চায়,এখন তাদের বোনটিকে কি সে দেখে রাখতে পারবে, মন্দ লোকের থেকে আর তার যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে কি না। এর উত্তরে বারসিসা বলল যে সে তাদের কাছে থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায় এবং তারা যেন তার কাছে থেকে চলে যায়। কিছু সময় পর তার মনে হল, (মূলত শয়তান এসে তাকে বলল) যে তুমি এত সৎ ব্যক্তি, তুমি যেহেতু মেয়েটিকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিলে না,তাহলে নিশ্চয়ই কোনো মন্দ ব্যক্তি মেয়েটির দায়িত্ব নেবে আর এরপরের ব্যাপারটি কি হবে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছো, এই অসহায় মেয়েটিকে আশ্রয় দেয়ার মত ভালো কাজ তুমি ছেড়ে দিতে পারো না। এর কিছু সময় পর বারসিসা সেই তিন ভাইকে ডেকে বলল যে তাদের কথা সে রাখতে পারে তবে তাদের বোন তার ধারের কছেও থাকতে পারবে না, উপাসনালয়ের কাছেও না; অদূরেই তার একটি পুরোনো বাড়ি আছে সেখানে রাখতে যদি তাদের কোনো আপত্তি না থাকে তবে। মেয়েটি সেই পুরোনো বাড়িতে আশ্রয় নিলো। বারসিসা প্রতিদিন তার উপাসনালয়ের দরজার সামনে মেয়েটির জন্য খাবার রেখে দিত। সে মেয়েটিকে খাবার পর্যন্ত দিয়ে আসত না। মেয়েটিকে প্রতিদিন কিছুদূর পথ পেরিয়ে উপাসনালয়ের দরজার সামনে থেকে খাবার নিয়ে যেতে হত। বারসিসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখত না। এরকম কিছুদিন যাওয়ার পর তার মনে হল,মূলত শয়তান এসে তাকে বলল যে এতটুকু হেঁটে আসতে এই অসহায় মেয়েটির অবশ্যই কষ্ট হয়, তাছাড়া দুষ্ট লোকের নজর তার দিকে পড়ে। সুতরাং তার উচিত হবে মেয়েটির খাবার তার আশ্রয়স্থলে গিয়ে দিয়ে আসা। এরপর থেকে বারসিসা মেয়েটির আশ্রয়স্থলে গিয়ে প্রতিদিন দরজার সামনে খাবার রেখে আসত।
কিছুদিন পর শয়তান এসে আবার বারসিসাকে বলল,(মূলত তার মনে হল)যে দরজা থেকে খাবার নেয়ার সময় মন্দ লোকের নজর মেয়েটির উপরপড়তে পারে,তাই তার উচিত হবে খাবার ঘরের ভিতর দিয়ে আসা। এরপর থেকে বারসিসা মেয়েটির ঘরে খাবার দিয়ে আসত এবং এক মূহুর্তও অপেক্ষা করত না। এমতবাস্থায় শয়তান আবার বারসিসার কাছে,মূলত তার চিন্তায় এসে বলল যে সে যে মেয়েটি একা একা রাখছে এতে মেয়েটির হয়ত খারাপ লাগছে,তার তো আপন কেউ কাছে নেই, সে কোথাও বেরও হতে পারে না,কারো সাথে কথাও বলতে পারে না, ঠিক যেন জেলখানায় বন্দী হয়ে আছে। হয়ত পরে দেখা যাবে মেয়েটি বিরক্ত হয়ে ভুল পথে চলে যেতে পারে,পর কোনো পুরুষের সংস্পর্শে চলে আসতে পারে। সেই সময় শয়তান বারসিসার মনে উপস্থিত হল। সে ভাবলো খাবার যখন দিয়েই আসছি,কিছু সৌজন্যমূলক কথা-বার্তা বলাই যেতে পারে তবে তা ঘরের ভিতরে না হয়ে ঘরের বহিরে কিছুটাদূরত্ব বজায় রেখে। এরপর তারা এভাবে চিৎকার করে সামন্য কিছু কুশল বিনিময় করা শুরু করল। এভাবে কিছুদিন চলল। এরপর শয়তান আবার তার মনে উদয় হল এবং বলল যেএত কঠিন করে কি বা দরকার, শুধু শুধু কষ্ট করে চিৎকার করে করে, ব্যাপারটি সহজ করে নিলেই তো হয়। ঘরে বসেই তো মেয়েটির সাথে কথা বলা যায়, কথা যখন বলা হচ্ছেই।এরপর থেকে সেই সুখ্যাত, ধার্মিক ব্যক্তিবারসিসা সেই মেয়েটি সাথে একটি ঘরে কথা-বার্তা বলে সময় ব্যয় করতে থাকল। একটা সময় বারসিসা মেয়েটির সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে লাগল আর ধীরে ধীরে পরস্পরের কাছাকাছিআসতে থাকল। বারসিসা মূলত সেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। এমন একটা সময় উপস্থিত হল যে সেই সৎ, ধার্মিক বারসিসা মেয়েটির সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হল,ফলে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ল। মেয়েটি একটিসন্তানের জন্ম দিল। আবার সেই শয়তান বারসিসার মনে উদয় হল। কি সর্ব্নাশ! এ কি করেছে বারসিসা! এত সৎ, ধার্মিক, বিশ্বাসী একজন লোক সে। মানুষজন কত ভালোমানুষ হিসেবে জানে তাকে। মেয়েটির ভাইয়েরা ফিরে আসলে তার কি হবে,তারা তার কি অবস্থাই না করবে। শয়তান তখন তাকে ওয়াসওয়াসা দিল যে উপায় একটাই,এই বাচ্চাটিকে মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। তখন বারসিসার মনে হল যে শুধু বাচ্চাটিকে মেরেফেললেই কি হবে,মেয়েটি অবশ্যই ব্যাপারটি গোপন রাখবে না, সে সবাইকে বলে দেবে। বারসিসা দিশেহারা হয়ে পড়ল,সে এখন কি করবে! সন্তান সহ মা কে হত্যা করে তাদের মাটির নিচে পুঁতে ফেলল। কিছুদিনপর মেয়েটির ভাইয়েরা বারসিসার কাছে তাদের বোনকে নিতে আসল। বারসিসা তাদের বলল যে - তোমাদের বোন তো অসুখে মৃত্যু বরণ করেছে।
রাতের বেলা তিন ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই স্বপ্ন দেখলো। বারসিসা মিথ্যা বলছে। নিশ্চয়ইএখানে একটা কিন্তু আছে,তিন ভাইয়েরা ভাবলো। তারা সেই আশ্রিত বাড়িতে গিয়ে মাটি খুঁড়ল এবং তারা দেখলো যে তাদের বোনের পঁচে যাওয়া মৃত দেহ এবং তারপাশে একটা শিশু! তারা বারসিসাকে গিয়ে ধরে রাজার কাছে নিয়ে গেল। বরসিসাকেমৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হল। স্বয়ং শয়তান আসল তার কাছে যে কি না তাকে এত ঝামেলার মধ্যে ফেলেছে। সে বলল সমস্যাসৃষ্টি করেছে সে,তাই সমাধানও একমাত্র সে ই জানে! এখন বারসিসার সিদ্ধান্ত যে সে কি মৃত্যুদন্ড পেতে চায় না কি শয়তানের সমাধান অনুযায়ী বাঁচতে চায়। বারসিসা শয়তানকেবলল যে তাকে বাঁচাতে! শয়তান বারসিসাকে বলল যে সিজদাহ কর যে তোমাকে হুকুম দিচ্ছে এখন। বারসিসা শয়তানকে সিজদাহ করল!এরপর
শয়তান বারসিসাকে বলল,“তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ! তোমার সাথে দেখা হয়ে আমার খুব ভালো লাগলো, আমি একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।”
এরপরআর কখনওই বারসিসা শয়তানকে দেখতে পেল না আর এটাই ছিল বারসিসার জীবনের শেষ কাজ। কারণ এর কিছুক্ষণ পরই বারসিসার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছিল। অর্থাৎ তারজীবনের শেষ কাজটি ছিল একটি শিরক।
যে ব্যক্তি যেই ধরণের কাজ পছন্দ করে শয়তান ফাঁদ পাতে সেই কাজের মাধ্যমেই ধোকা দিতে। মনে কর একজন ব্যক্তি খুবই পরহেজগার। শয়তান চেষ্টা করবে তাকে এমন যুক্তি দেখাবে যা তার কাছে মনে হবে ইসলামিক, কিন্তু আসল ব্যাপার ভিন্ন। এভাবে সে তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় যখন আর ফেরার পথ থাকেনা। আর যাদের কাছে ইসলাম ভালো লাগেনা, শয়তানতো তাদের খুব সহজেই কাবু করে ফেলে। নিজের লাইফেও কিন্তু আমি দেখেছি শয়তান কীভাবে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঈমানে মজবুতি দান করুক। প্রকৃত মুত্তাকী বানাক। চলুন আল্লাহর কাছে দু'হাত প্রসারিত করে বলি -
رَبَّنَا لاَ تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
(রাব্বানা তুওয়াখিজনা ইন-নাসিনা আও ওয়াখতানা)
হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না।
رَبَّنَا وَلاَ تُحَمِّلْنَا مَا لاَ طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَآ أَنتَ مَوْلاَنَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
(রাব্বানা লা তুহামমিলনা মা-লা ত্ব'কাতালানা বিহি ওয়া-আফুয়ান্না ওয়াগফিরলানা ওয়ারহামনা আনতা মওলানা ফানসুরনা আলাল কাওমাল কাফিরিন)
হে আমাদের প্রভূ! এবং আমাদের দ্বারা ঐ বোঝা বহন করিও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নাই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর।
رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
(রাব্বানা লা তুজিগ কুলুবানা বা-দা ইজ-হাদাইতানা ওয়া হাবলানা মিল-লাদুনকা রাহমাতান ইন্নাকা আনতাল ওয়াহ-হাব)
হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করো না এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা।
আমীন।
এই পোস্টটিও দেখুন - https://www.facebook.com/NAKBangla/posts/1481720248749263
-------------------------------------------------------
Source: Stories in the Quran – Ibn Kathir
বিষয়: বিবিধ
১৫০৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বারসিসার কাহিনী থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের শিক্ষা গ্রহন করা উচিত! শয়তান যে আমাদের ধোকায় ফেলে তার জ্বলন্ত উদাহরন বারসিসার ঘটনা!
জাযাকাল্লাহু খাইর শেয়ার করার জন্য!
ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য!
মন্তব্য করতে লগইন করুন