আমি আসলে কি?
লিখেছেন লিখেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক সঞ্চারণ ০৫ মে, ২০১৫, ০৭:১৭:২৩ সন্ধ্যা
যখন আমি জন্মেছিলাম, কাঁদিয়ে সবাইকে আগমনের খবরটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারপরে ধীরে ধীরে শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার যুদ্ধ। এখন ভাবতেই কেমন যেন লাগে, যখন আমার বয়স ছিল প্রায় ১মাস, আমি তখন সবে মাত্র বুঝতে শুরু করলাম যে আমি আসলেই একটা স্বত্ত্বা। আমি আসলেই বাস্তব। চারপাশের মানুষগুলোর মত আমিও এই দুনিয়ার অংশ। তখনও আমি জানি না আমার দুটো হাত আছে। আমার দুটো পা আছে। আমি স্বাদ নিতে পারি। হঠাৎ করে বিকট শব্দ হলে চমকে উঠা আর ভ্যা ভ্যা করে কান্না করা ছাড়া আর কিছুই জানতাম না। তখন কাউকে চিনতেও শুরু করিনি। এরপর সময় গড়িয়ে যেতে থাকে আর আমি যখন দেড় মাস বয়সের বাচ্চা, হঠাৎ করেই আবিষ্কার করতে শুরু করি, আমিও ঘাড় সোজা করতে পারি। কোন শব্দ শুনলে সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে পারি। একটা মেয়ে আমার যত্ন নিত। ভয় পেয়ে গেলে যখন তার গলা শুনতাম, তখন থমকে যেতাম। কান্না বন্ধ করে দিতাম। ভাবতাম, এই বুঝি চলে এল। আমাকে আবার জড়িয়ে ধরবে। আমি আবার নিরাপদ অনুভব করব। তখনও বুঝে উঠা হয়নি ইনি আমার মা। ৩-৪ মাস বয়সে প্রথম পিঠও সোজা করতে শিখে গেলাম। তারও কয়েকমাস পর বিছানায় গড়াগড়ি খেতে শিখলাম। কাজটা আমার খুব ভাল লাগত। গড়াতে গড়াতে কতবার যে বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছি! তখনই প্রথম বুঝতে পারলাম, মা আমার দিকে তাকিয়ে সবসময় যে শব্দটা বলে, তা আসলে আমার নাম। তখনও কথা বলতে পারি না। কিন্তু মায়ের কথায় আ আ বলে সাড়া দেয়ার চেষ্টা করতাম। মায়ের আঙ্গুলটা মুঠোবন্দি করতে চাইতাম। আর একবার হাতে পেলেই মুখে পুরে দিতাম। শুধু কি তাই, মায়ের আঙ্গুল থেকে শুরু করে নিজের হাত বা পায়ের আঙ্গুল, খেলনা থেকে শুরু করে বালিস যা পেতাম সবই মুখে পুরে দিতাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, এই পা এই হাত আমার। এগুলো আমার শরীরের অংশ
মা একটা গামলায় আমাকে বসিয়ে দিতেন। গামলার গায়ে পিঠ লাগিয়ে বসে থেকে পানি দিয়ে খেলতে আমার খুব ভালো লাগত। মাকে ভিজিয়ে দিতে চাইতাম। কিন্তু মা হেসে হেসে কথা বলতেন অনর্গল। আমার গায়ে সাবান মেখে দিতেন। আরেকটু বড় হয়ে গেলাম যখন, তখন মা নিয়ে যেতেন আয়নার সামনে। আয়নায় নিজেকে দেখে ভাবতাম হয়ত আমার খেলার সাথীর আমার মতই একটা মা আছে। হয়ত আমার খেলার সাথী আমার মতই হাত পা ছোড়াছোড়ি করে। তখন আমি হামাগুড়ি দিতাম। ডাকলে হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের কাছে চলে যেতাম। আমার বয়স যেদিন এক বছর পূরণ হল, আমার খুব ইচ্ছে হল আর কত আসবাব ধরে দাঁড়িয়ে থাকব? অনেক হয়েছে। ছেড়ে দিয়ে দেখি তো কি হয়? বাবা সেদিন পেপার রেখে মাকে ডাক দিলেন। দুজন মিলে আমার দিকে তাকিয়ে এমন হাসি দিলেন যেন জীবনটাতে আর চাইবার কিছু নেই। আমার খুব আত্নবিশ্বাস জাগল। আমিও দাড়াতে পারি। বাবা যখন অফিস যেতেন, মায়ের কোলে বসে বসে হাত নেড়ে টা টা দিতাম। কোন কিছু ভালো না লাগলে, বলতাম দাদা কিংবা মামা। আমি বোঝাতাম না-বোধক, আর অন্য দিকে দাদা আর মামা খুশিতে গদগদ হয়ে যেতেন। কি অদ্ভুত কান্ড! খেলনা দিয়ে খেলা যেমন আমার খুব প্রিয় ছিল, তেমনি করে, খেলনা ছুড়ে ফেলতেও খারাপ লাগত না। এক সময় ভাবতাম, নিজের খাবার নিজেই তো খেতে পারি। কিন্তু চামচ ধরে আর মুখে তুলতে পারতাম না। একবার ডানে একবার বামে চলে যেত। এভাবে করেই খাবার শিখতে শিখতে হয়ে গেলাম ১৮ মাসের বৃদ্ধ। তখন আমি একা একাই হাটতে পারি। আমার তখন ১২-১৫টা শব্দ জানা ছিল। বিশাল জ্ঞানী লোক ছিলাম। শিল্প চর্চায়ও কম যেতাম না। পেন্সিল নিয়ে কাগজের মধ্যে মায়ের ছবি আকতাম, বাবার ছবি আঁকতাম। কিন্তু কেউই আমার ছবি বুঝত না।
এমন করে এক সময় বয়স হয়ে গেল প্রায় ৪ বছর। তখন আর যেখানে সেখানে হাগু-মুতু করার বয়স ছিল না। আব্বা নিয়ে যেতেন মাসজিদে। ফজরের পর হুজুর বসে বসে কুরআন পড়ানো শেখাতেন। হুজুরকে আমার অনেক ভালো লাগত। তিনি আমাকে চকলেট দিতেন। আর গল্প বলতেন। আগের নবীদের গল্প। শেষ নবীর(স) গল্প। নবীর সাথীদের গল্প। আমি তখন অবাক হয়ে শুনতাম। আর মনে হত, যদি আমি তখন থাকতাম, তাহলে ঐ দুষ্ট আবু জাহেলকে একটা বকা দিয়ে আসতাম। স্বপ্ন দেখতাম নবীর সাথীদের মত হবার। শুধু হুজুর না, দাদী কিংবা নানীও আমাকে ঘুমানোর সময় অনেক গল্প বলতেন। ভাবতাম, বড় হয়ে কক্ষনো খারাপ হয়ে যাব না। অনেক ভালো হব। সত্য কথা বলব। খারাপ কাজ করব না। আর সালাত তো কখনো ছাড়বই না। তখন আমি অনেক বড়। একটু একটু করে ভালোই বুঝতে পারি। হুজুরের কাছে সেদিন কুরআন পড়া শেষ করেছিলাম। আব্বা সেদিন অনেক খুশি ছিলেন। আব্বার খুশির কারন, তার ছেলে কুরআন শিখেছে। কুরআন পড়ে শেষ করেছে। হুজুর তখন একটা কথা বলেছিলেন, আজকে কুরআন একবার পড়ে শেষ করেছ, তবে এটাই যেন শেষ পড়া না হয়।
এরপর স্কুলের জীবনটা ভালোই গেল। হাইস্কুলে উঠলাম। মনে হচ্ছিল পিঠের মধ্যে এক জোড়া অদৃশ্য ডানা গজিয়েছে। সেই ডানাগুলোর ব্যবহার না করলেই না। বন্ধুরা করছে, আমিও করি। দুরুদুরু বুকে স্কুল পালানো থেকে শুরু হয়। বন্ধুদের সাথে থেকে দুনিয়াটার অলিগলি বুঝতে শিখি। এখানে এই হয়, ওখানে ঐ। বাবা মার কথা মনে হয়ে একটা সময় মনে হত তাঁরা আমার জন্য এত করছেন, আর আমার কি এসব করা ঠিক হচ্ছে? কিন্তু একসময় যখন দেখলাম, বন্ধুরাও বাবা মা’র সাথে খুব একটা কেয়ার করে কথা বলে না, আর আমি বললে গালি খেতে হয়, তখন আমিও তাদের মত হয়ে যেতে থাকলাম। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একসময় সালাতটা আর ধরে রাখা গেল না। প্রথমে খুব কষ্ট হত। কিন্তু পরে আর হত না। আব্বা আম্মা অনেক বলতেন সালাত পড়তে, ভালো করে চলতে। কিন্তু আমার আর তাদের ঘ্যান ঘ্যান ভালো লাগত না। ভাবতাম, জুম্মা তো পড়ি? আর, আমি তো তত খারাপ না। আমি তো আর হাবিজাবি খাই না। আমি যাদের সাথে চলি, তাঁরা তো অনেক বেশি খারাপ। আমি তত খারাপ না। এমন করেই কেটে গেল কতগুলো বছর। হয়ত পাশ করে যাচ্ছি। হয়ত ভালো জায়গাতেই পড়ছি। হয়ত ভালো একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আমার হৃদয় জুড়ে এতটা শুন্যতা কেন? আমার শৈশব তো এমন ছিল না। হুজুর ঠিকই বলেছিলেন। এই কুরআন শেষ করা যেন শেষ বার পড়া না হয়। কিন্তু আমার জন্য তো তাই হল। আমি যখন থেকে সালাত ছেড়েছি, তারপর থেকে তো আর সেভাবে করে অন্তরে শান্তি পাই না। অথচ এখনও যখন শুক্রবার সালাত পড়ে আসি, মনে কিছুটা হলেও ভালো লাগে। শান্তি আছে ভেবে যা কিছুই করি না কেন, যখন শেষ হয়, তার খুব একটা সুদূর প্রসারী প্রভাব বোধ করি না। কিন্তু, যখন শুক্রবারেও সালাত পড়ি, তখনও একটা আত্নার প্রশান্তি এনে দেয়।
আমি আসলে কি? একটা সময় তো এমন গিয়েছিল, যখন আমি কিছুই ছিলাম না। ভাষা বলতে ছিল কান্না। ভোকাল কর্ড ছাড়া কোন পেশীর উপর উল্লেখযোগ্য কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল একটা সত্ত্বা। তারপর আল্লাহ আমাকে কান দিয়ে শুনতে শেখালেন। চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষন করার শক্তি দিলেন। একটা সময় আমি যখন একটু একটু করে পূর্ণাংগ মানুষ হয়ে উঠতে থাকলাম, আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দিলেন সত্য সুন্দর পথ। কিন্তু আমি কি করলাম? পৃথিবীর মোহে পড়ে একটু একটু করে নিজের মনুষ্যত্বকে আঘাত করে একটা অকৃতজ্ঞ প্রাণে পরিণত হয়েছি। পৃথিবীকে পাব বলে আমার ভালোগুলো সব বিসর্জন দিয়ে এসেছি। এখন আমার চেয়ে খারাপ আর কেই বা আছে? এর চেয়ে ছোট বেলার কান্নাগুলোও কত ভালো ছিল। অন্তত অকৃতজ্ঞ তো ছিলাম না। তা আল্লাহর কাছে হোক আর আল্লাহর সৃষ্টির কাছেই হোক। এখন আমি অকৃতজ্ঞ, এখন আমি অহংকারী। একটা সময় ছিল নবী রসুলের জীবন কাহিনীগুলো আমার জীবন চলার আদর্শ হয়ে গিয়েছিল। তাদের মতই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ? আজ আমি সেই স্বপ্ন থেকে কত দূরে! আজ আমি আল্লাহকে ভুলেছি। আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নিজেকেও ভুলে গিয়েছি। প্রতিবিম্বকে বাস্তব ভেবে মিথ্যে সুখের পানে শুধু হাতই বাড়াই নি, হেটেও গিয়েছি কতটা পথ। কিন্তু সত্যের পথে ফিরে যাওয়ার পথটাও সবসময় খোলা। অপেক্ষা শুধু আমার জন্য। অপেক্ষা শুধু পা বাড়ানোর।
“মানুষের উপর তো এমন কিছু সময় গিয়েছে যখন সে কোন উল্লেখযোগ্য বস্তু ছিল না। আমি তো মিশ্র বীর্যের একটি ফোটা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছি, তাকে পরীক্ষা করব বলে, তাই তাকে শ্রবণশক্তি সম্পন্ন ও দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন করেছি। আমি তাকে পথ দেখিয়েছি, এখন (তার ইচ্ছায়) হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় অকৃতজ্ঞ। “(সুরা ইনসান ১-৪)
উৎস - http://ahobaan.com/
বিষয়: বিবিধ
১২৩৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন