আশাহত না হবার যে শিক্ষা পেলাম - আসমা হুসেইন, হাজারও বোনদের অনুপ্রেরণার উৎস এক বোন
লিখেছেন লিখেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক সঞ্চারণ ২৮ আগস্ট, ২০১৪, ০৩:০৭:২২ রাত
বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম
আমি তার মৃতদের রাখা টেবিলের পাশে দাঁড়ালাম। তার মুখের উপর হতে চাদর সরালাম। আমি দেখলাম আমার ‘ভালবাসার মানুষ’, ‘আমার প্রিয়জন’ কে। তিনি এখন শান্ত, সমাহিত। অথচ ২৪ ঘন্টারও কম সময় পূর্বে তিনি ছিলেন হাসিমাখা ও খুশিভরা মুখ। আমি তার দাড়িতে হাত বোলালাম। দাড়ির কিছু অংশ ছিল তখন নরম, বাকী অংশ ছিল শক্ত। কারণ তার দেহের ক্ষরিত রক্ত লেগেছিল তার দাড়ির একাংশে। তার নাক দিয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল এবং তার চোখের পাশে ছিল একটি ক্ষতচিহ্ন। তবুও তিনি ছিলেন সৌম্য-সুন্দর। যদিও তিনি ছিলেন মৃত, তাকে মনে হচ্ছিল ঘুমন্ত। আমি তার ঠোঁট ও গাল স্পর্শ করলাম, এগুলো ছিল ঠান্ডা।
আমার স্বামী আমর মুহাম্মদ। তিনি ছিলেন ২৬ বছর বয়স্ক। তিনি শহীদ হন এবং তার রবের নিকট ফিরে যান শুক্রবার আসরের পর। তিনি চিবুকের নীচে গুলিবদ্ধ হন যা তার গলা ছিদ্র করে বের হয়ে যায়। মিশরে গত কয়েক সপ্তাহব্যাপি সেনা বাহিনীর নির্মম গুলীতে যারা নিহত হয়েছেন তাদের ন্যায় বিচারের দাবীতে যে আন্দোলন চলছিল তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিক্ষোভে। গতকাল সকালে আমি আমর মূসাকে দেখতে গিয়েছিলাম আলেকজান্দ্রিয়ার একটি হাসপাতালের মর্গে।
আমি সেখানে অপেক্ষা করলাম আরো কিছুক্ষণ। চেয়ে থাকলাম তার মুখমন্ডলের দিকে। আমার মনে হলো আমার হৃদয় যেন ট্রাক চাপা পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি কাঁদব না কিন্তু অঝোর ধারায় আমার চোখ হতে পানি গড়িয়ে পড়ছিল।
আমি স্বগতোক্তি করলাম “আমর, আমি তোমায় ভালবাসি। আমি স্বাক্ষী, তুমি আল্লাহর পথে শহীদ হতে চেয়েছিলে। তুমি তো তাই পেলে, যা তুমি সর্বদা প্রত্যাশা করেছিলে। আমি তোমার জন্য গর্বিত। হে আল্লাহ, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও এবং তাকে শহীদি মর্যাদায় ভূষিত কর। তুমি জান্নাতে তার সাথে আমাকে একত্রিত করো। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ধৈর্য দাও। কারণ তার এ বিদায়ের সময় তোমার নির্ধারিত । তোমার দয়ায় সে তোমার নিকট শহীদ হিসাবে জীবিত।”
আমি নির্ধারিত সময় শেষ হবার ক্ষণিক পূর্বেও তাকে ত্যাগ করতে পারিনি। আমি নিশ্চিত না, সেখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। সবশেষে তার কপোলে চুম্বন করলাম এবং বললাম- আমি ইনশাল্লাহ পরকালে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো। আমি তার মুখখানা ঢেকে দিলাম এবং পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলাম।
জানাজা ছিল আসর নামাযের পর। সেখানে ছিল হাজার হাজার জনতা- তার বন্ধু, সহকর্মী, এবং আত্মীয়-স্বজন। তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়-পাত্র। সেখানে অশ্রুহীন কোন ব্যক্তি ছিলনা। অনেকেই বলাবলি করছিল- আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছেন। মানুষ যত ভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ পথেই তিনি গিয়েছেন। আমরা সবাই দুআ করছিলাম। আমি একটু বাইরে গেলাম কান্নারত শত মানুষের একটি জনতাকে দেখার জন্য যারা আমরকে সমাহিত করার জন্য তার মৃত দেহ বহন করছিল।
আমাদের সামাজিক সংস্কৃতিতে নারীরা সাধারণত কবর দেবার জন্য পুরুষের সাথে কবর স্থানে যায়না। তাই আমরা অপেক্ষা করছিলাম, যতক্ষণ তাকে সমাহিত করা না হয় এবং দুআ করা শেষ না হয়। কিছুক্ষণ পরে আমার শ্বাশুড়ি ও আরো কিছু মহিলাসহ আমরা তার কবরের নিকট গেলাম।
হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম, আমাদের চারপাশের লোকজন চিৎকার করে আমদেরকে দৌড়ে বাড়ী যাবার জন্য অনুরোধ করছে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আমি পেছন দিকে প্রচন্ড হৈ-হুল্লোড়ের কানফাটা শব্দ শুনতে পেলাম। দেখলাম, আমাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে এবং সবাই চিৎকার করে বলছে মহিলাদের দৌড়ে পলায়নের জন্য। ফলে আমরা পেছন দিকে আর না তাকিয়েই সামনের দিকে দৌড়ানো শুরু করলাম। আমি একটি বড় পাথরের আঘাত পেলাম আমার গালে। যদিও আমি তাতে থেমে থাকিনি। আলহামদুলিল্লাহ, আমি দেখলাম, আমরের কিছু বন্ধু আমার পেছনে আমাকে অনুসরণ করছে এবং তারা আমাকে সামনের দিকে যেতে বলল। আমার যাতে কোন বড় ধরণের ক্ষতি না হয় সে জন্য তারা আমার পেছনে পেছনে অবস্থান করছিল। যারা আমাদের আক্রমণ করেছিল তারা ছিল সরকারের পেটুয়া বাহিনী, গুন্ডার দল। তারা ভেবেছিল, এখানে কোন ইখওয়ান কর্মীর জানাযা হচ্ছে (যদিও আমার স্বামী ইখওয়ানের কর্মী ছিলনা।
তিনি ছিলেন একজন ধর্মানুসারী মুসলমান যিনি বৈধ-অবৈধের সীমারেখা মেনে চলতেন)। সেদিন অনেক মানুষ আহত হয়েছিল, অনেকেই ছুরিকাঘাত পেয়েছিল, যদিও আল্লাহর রহমতে, এবং আমার জানা মতে, কেউ নিহত হয় নি।
আমি দেখলাম, মৃত্যুর পরেও আমরের শত্রুরা তাকে অপছন্দ করছে। তাদের অপছন্দে যদিও আমার কিছুই যায় আসেনা। যদি আল্লাহর কোন শত্রু তোমাকে ঘৃণা করে, তবে তুমি জানবে, আল্লাহর রহমতে তুমি সঠিক পথে আছ।
হে বন্ধুরা, আমি হৃদয়াহত। আমি কখনো ভাবিনি, কোন অন্তর এভাবে ব্যাথা পেতে পারে। যখনই আমি জেগে থাকি, আমি তাকে অনুভব করি। যখনই ঘুমিয়ে থাকি, তাকে আমি স্বপ্নে দেখি। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী যেমনটি একজন নারী সর্বোচ্চ আশা করে থাকে। তিনি ছিলেন দয়ালু, উদার, কোমল মনের এবং প্রীতিময়। তার জামা-কাপড় এখনো আগের মতোই হুকে ঝুলান। মনে হয় যেন, তিনি ঘুমানোর পুর্বে তার কাপড় পরিবর্তনের জন্য দরজার ওপাশে।
আমরের বন্ধুরা জানাজার সময় তার মানিব্যাগ এবং তার ব্যবহৃত মোবাইলটি আমাকে দিয়েছিল। আমরের বিয়ের আংটি হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা এখনও জানি না এটি কোথায়? যদি সেটা থাকত!
সে সময়ের পর থেকে তার জন্য দুআ ব্যাতীত আমি আর কিছুই করতে পারিনি। “যদি সে শুক্রবারের বিক্ষোভ মিছিলে না যেত তাহলে সে জীবিত থাকত” এ জাতীয় চিন্তা করে আমর কিংবা আমাকে অসম্মানিত করতে পারিনি।
না, আমি নিশ্চিত, এটাই ছিল তার জন্য রবের নিকট ফেরত যাবার নির্ধারিত সময়। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যদিও আমি ভাবি, যদি আমি দুনিয়াতে তার সাথে আরো বেশিদিন থাকতে পারতাম তবুও আমি জান্নাতে তার সাথে, আল্লাহর রহমতে, একত্রিত হবার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করি। জান্নাতের সময় কখনো শেষ হয় না, তাই জান্নাতে প্রিয়জনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হবারও কোন সম্ভাবনা নেই। আমি আমার সত্তার প্রতিটি ইঞ্চি দিয়ে অনুভব করি যে, আমাদের ভালবাসা ছিল সত্য যার বিস্তৃতি ইহকাল থেকে পরকাল পর্যন্ত।
হে আমাদের রব, মুসাকে নদীতে রেখে আসার দীর্ঘ সময় পরে তার মায়ের সাথে তুমি মিলিত করেছিলে। হে আমাদের মালিক, দীর্ঘ কষ্টকর সময় পার করে হযরত ইয়াকুবকে তুমি ইউসুফের সাথে মিলিত করেছিলে। হে আল্লাহ, তুমিই একমাত্র পার আমাকে পরকালে আমার প্রিয়’র সাথে মিলিত করতে। তাই আমি শুধু তোমার নিকটই প্রার্থনা করি, তুমি আমাকে তার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন রেখো না।
গত রাতে বাড়ী ফেরার পর আমাদের আত্মীয়ের এক বন্ধু ফোন করেছিল, যে ছিল আমরের গুলিবিদ্ধ হবার পরের দৃশ্যপটের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। সে বলল, “আমর গুলিবিদ্ধ হবার সাথে সাথে মারা যায় নি। সে কিছুক্ষণ জীবিত ছিল। সে বাম হাত দিয়ে তার গুলিবিদ্ধ চিবুকের স্থানটি আঁকড়ে ধরে ছিল এবং ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল উপরে উঁচিয়ে উচ্চারণ করছিল যে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর প্রেরিত রাসূল। সে সময় তার মুখ ছিল হাসিমাখা মনে হচ্ছিল যেন দিনটি ছিল তার বিবাহবার্ষিকী।”
এ কথা শুনে আমি না কেঁদে পারিনি এ কারণে যে, এ অসাধারণ ব্যক্তিটির (আমর) সাথে পরিচিত করিয়ে এবং তার সন্তান কে গর্ভে ধারণ করার সূযোগ দিয়ে আমাদের মহান রব ও মালিক আমাকে সম্মানিত করেছেন।
বন্ধুগণ, তোমাদের উদ্দীপনাময় বাক্য একেবারে শুন্যে মিলিয়ে যায় নি। তোমাদের জন্য ভালবাসা এবং সম্মান ছাড়া আর দেবার আর কিছুই আমার নিকট নেই। আমি এখন মুসলিম হিসাবে আমার দায়িত্বের কথা আগের চাইতে আরো বেশি জ্ঞাত। আমার বিশ্বাস, যদিও আমাদের অনেক ত্রুটি আছে, তবুও যদি অন্যায়ের প্রতিবাদে আমরা একত্রিত হয়, তখন তা সংঘবদ্ধ শক্তিতে রুপ লাভ করে। তোমাদের সমর্থন, ভালবাসা এবং দুআ আমাকে অভিভূত করেছে। আমি যখন কানাডায় ফিরে আসব, তখন তোমাদের অব্যাহত দুআ এবং সমর্থন আমার প্রয়োজন হবে।
আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, আমার নিজের জন্য, আমার কন্যার জন্য এবং আমরের সম্মানের জন্য, যে পথে তিনি শহীদ হয়েছেন, তিনি যেন আমাকে সে সঠিক পথ হতে কখনো বিচ্যুত না করেন।
হে আমার প্রিয়তম আমর! হে আমার প্রিয়তম আমর! হে আমার প্রিয়তম আমর! আমি বিশ্বাস করি, তোমার আত্মা এখন একটি সবুজ পাখির ভেতর রয়েছে। আর নিঃসন্দেহে তুমি জান্নাতের ভেতর উড়ে ফিরছ, সেখান হতে খাবার গ্রহণ করছ, এবং আল্লাহর সিংহাসনের নিকটে অবস্থান করছ। আর সেখানে কখনোই তোমার আর অশ্রু ফেলতে হবেনা অথবা আর কোন ক্ষতি কিংবা কষ্টের অনুভূতি তোমায় আহত করবেনা। তুমি, তুমিই ইহকাল এবং পরকালে আমার ভালবাসা। একমাত্র তুমিই আমার অন্তরে। তুমি, তুমিই আমার প্রার্থনায়।
“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তারা মৃত নয়, বরং তারা জীবিত। আল্লাহর নিকট থেকে তারা রিজিক প্রাপ্ত। আল্লাহ যা দিয়েছেন তার জন্য তারা আনন্দিত। তারা এ কথাও জেনে আনন্দিত যে, যারা এখনও শহীদ হয়নি এবং সেখানে পৌঁছায়নি তাদেরও কোন ভয় ও দুঃখের কারণ নেই। তারা আল্লাহর রহমত ও দানে ধন্য এবং তারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ কখনোই বিশ্বাসীদের পুরস্কার নষ্ট করবেন না।” (সূরাঃ আল-ইমরান, আয়াত ১৬৯-১৭১)
-------------------------------------------------------------
“আমর কাসেম আরব জাগরণের শেষ দিকে মিশরীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার নিকটে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আসমা হুসাইন আমরের সহধর্মীনী এবং তাদের একমাত্র কন্যা রুকাইয়া। আমরের মৃত্যুতে তার স্ত্রী আসমা হুসাইন এই স্মৃতিচারণটি লিখে তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন গত ১৮ই আগস্ট, ২০১৩ সালে।
সোর্স - বাংলা ভাষায় বিশ্বের স্কলারভিত্তিক ওয়েবসাইট - সঞ্চারণ - ঐতিহ্যের অনুরণন
-------------------------------------------------------------
ওয়েবসাইট থেকে আমার পোস্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য দুটি
১। ভালো কিছু আর্টিকেলগুলোর মাধ্যমে কিছু সেরা ওয়েবসাইটগুলোর পরিচিত করানো।
২। ফেইসবুক বা ব্লগের মত স্থান কখনই ইসলাম শেখার জায়গা নয় এটা যেকোন ব্যক্তি যারা ইসলাম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে জানে।। এক্ষেত্রে আমি এইসব ওয়েবসাইটকে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছি যেন যারা ইসলাম শিখতে আগ্রহী তারা এগুলোতে প্রবেশ করে সিস্টেম্যাটিক্যালি পড়াশুনা করে ইসলাম নিয়ে। ফেইসবুক বা ব্লগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ই আমার দেখা মতে রিয়ার এক বিরাট প্রকাশ(লাইক এবং প্রশংসার আকাঙ্ক্ষা)যা তাদের প্রাথমিকভাবে আসা রিয়ামুক্ত ফেইসবুক থেকে ইসলামের কম জ্ঞান ও আমালের অভাবের কারণে রিয়াযুক্ত ফেইসবুক ব্যবহারে রুপান্তরিত হয়েছে।
তাই শিখতে হলে ফেইসবুক বা ব্লগ নয়...বরং
স্কলার/আলেমদের সংস্পর্শ,
স্কলারদের বই পড়া,
স্কলারদের লেকচার দেখা,
এবং ইসলামী ভালো ওয়েবসাইট এর স্কলারদের রিসোর্সগুলো পড়া...
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
------------------------------------------------------------
বিষয়: বিবিধ
১২৬০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আমরদের বেহেশত নসীব করুন এবং আসমাদের আকাঙ্খা পূরণ করুন - আমিন ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন