সফর- গোরান টু কাশিমপুরঃ ফ্ল্যাশব্যাক
লিখেছেন লিখেছেন এবেলা ওবেলা ২৩ জুলাই, ২০১৪, ১১:০৪:৩৩ রাত
(১)
১৮ জুন, গোরান। গ্রীষ্মের ছুটিতে ওটা ছিল একটা গেট টুগেদার। আর আমরা কুরআন অনুশীলনের চর্চা সবসময়ই করে থাকি। তো হঠাৎ করেই দরজায় ধুমধাম আওয়াজ শুনে বুঝলাম মামাদের আগমন ঘটেছে! আমরা বললাম যে বোরখা পরে নিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি। ওনারা বাসায় ঢুকে মনে হল সেই রকম উত্তেজিত; “এখানে এত মানুষ কি করেন? এই ল্যাপটপ দিয়ে কি করেন? এই তো, এই তো বই (ইসলামী বই) পাওয়া গেছে!”
আমাদের বলা হল থানায় নিয়ে যাওয়া হবে! বুঝতে পারছিলাম না কোনটা অপরাধ! ২৪ জন মানুষ একসাথে হওয়া? নাকি ল্যাপটপ সঙ্গে রাখা? নাকি বই? একজন বোন বলেই ফেললো তাদের, “এটা তো নিশ্চিত যে এখানে কেউ কোন অপরাধের সাথে জড়িত না।” এক মামা রিঅ্যাক্ট করলেন খুব, “জড়িত নয় মানে? এই – অ্যা- এই যে জামাত-শিবির এগুলা কি?” আমরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে, “জামাত-শিবির এগুলা কি?”
(২)
১৮ জুন, থানা। একজন এসআই শুরু থেকে বারবার আমাদের লেসন দিচ্ছিলেন, “Always speak the truth.” যেন উনাদের মনের মত কথাই আমরা বলি; আর সেটাই হল truth!
১৯ জুন, কোর্টরুম। আমাদের নামে পুলিশের মামলা উঠেছে কোর্টে! বাদি পুলিশ মামা অভিযোগ পাঠ করছেন; আমরা তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ পড়ছিলাম; আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হল যে, আমাদের কাছ থেকে বই, ল্যাপটপ, বোমা ও ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে! আরও বিস্ফোরক উদ্ধারের জন্য রিমান্ড দরকার! আমি তখন শুধু ভাবছিলাম, সেই এসআই ভদ্রলোককে আর একবার সামনে পেতাম যদি; বলতাম, always না হোক, অন্তত একবার সত্যি কথা বলেন তো; দেখি আপনি কত্ত মানুষ!
(৩)
১৯ জুন, কোর্টরুম। অনেক lawyer উপস্থিত ছিলেন; একজনের সাথে একটা ছোট বাচ্চা; বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করল, ‘আপুদের ধরছে কেন?’ ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘আপুরা বসে বসে পড়াশোনা করছিল, কুরআন পড়ছিল; এর মধ্যে পুলিশ আসছে। পুলিশ দেখে আপুরা অবাক হয়ে বলছে, ওমা! আর পুলিশ শুনছে ‘বোমা!’ আর তো ধরে নিয়ে আসছে।’
(৪)
২০ জুন, ঢাকা কারাগার। এক মহিলা পুলিশ আমাদের ব্যাপক counseling করছেন। “তোমাদের কাজ হল পড়াশুনা করবা, নামাজ-রোজা করবা, পর্দা করে চলবা; তাইলেই তো হয়। তোমরা রাজনীতি কর কেন? এই যে এখন তোমাদের মা-বাবারা কাদতেছে না? মা-বাবা কি এই জন্য পাঠাইছে তোমাদের?” “আর তোমাদের সাথে যে কুরআন দেখলাম সেটা কি ধরণের কুরআন?”
আমরা বললাম, ওটা শুধু কুরআনের তর্জমা। তাড়াহুড়ার সময় হাতের কাছে পেয়ে শুধু তর্জমাটাই আনতে পারছি আমরা।
উত্তর শুনে ওনাকে satisfied মনে হল না। উনি বললেন, “কুরআন ত আমরাও পড়ি; তর্জমাসহ বড় কুরআন পড়ি; কিন্তু তোমরা এমন কুরআন কেন পড় যেটা সরকার পছন্দ করে না?”
(৫)
২১ জুন, কাশিমপুর কারাগার। জেলার ভদ্রমহিলা (যাকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে হয়!) বলছিলেন, “জামাত-শিবিরকে তো তাও মানুষ স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তোমাদেরকে তো এখন হিজবুত, জেএমবি মামলা দিচ্ছে।”
তিনি আমাদের পড়াশোনা, বিয়ে শাদি, সবকিছু নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন! তো পাশ থেকে ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে ওঠলেন, “ছাত্রীসংস্থা ওদের টাকা দেয়।”
অ্যাসিস্ট্যান্টের কথা শুনে জেলার তখন নিজেই প্রতিবাদ করে বললেন, “আরে না; এরা willingly এসব করে। নিজেরা পকেট থেকে টাকা দিয়ে করে।”
(৬)
২৫ থেকে ৩০ জুনের কোন একদিন; আমাদের সেলমেট একজন হাজতি আর এক মহিলা সেন্ট্রির মধ্যে কথা হচ্ছিল; আমাদের সেলমেট মার্ডার কেসের আসামী; প্রায় ছয় মাস ধরে জেলে আছেন; জামিন হচ্ছে না। আমাদের ব্যাপারে তিনি সেন্ট্রিকে বলছিলেন, “ওদের বেশি দিন লাগবে না, জামিন হয়ে যাবে।” সেন্ট্রি একমত হলেন, “হ্যা; ওরা তো ভাল ঘরের মেয়ে।”
(৭)
৩জুলাই। জামিনের পর ফর্মালিটিজ চলছে; এর আগে ১জুলাই জামিন মঞ্জুর হয়ে ২জুলাই ফর্মালিটিজ শেষ করে বাসায় গেছে ৯ জন বোন। ২জুলাই আমরা আরও ৯জনের জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর ৩জুলাই আমরা ছাড়া পেলাম। বাকি ৬জন বোনের জামিন ৩জুলাই মঞ্জুর হয়েছে আমরা নিশ্চিত ছিলাম, তারা ৪জুলাই বাসায় যাবে। তারপরও ওদের ছেড়ে আসতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল।
তো জামিনের ফর্মালিটিজ শেষ করতে একে একে সবাইকে জেলারের রুমে যেতে হল। আমাদের প্রায় সবার হাতে মেহেদী লাগানো দেখে জেলার ভদ্রমহিলা বললেন, জেলে তো বেশ ভালই ছিলা তোমরা!
আমি শুনে ভাবছিলাম, আমরা যেখানেই থাকি ভাল থাকার, ভাল রাখার চেষ্টা করেছি এবং করে যাব ইনশা আল্লাহ্। আর মুমিনরা তো এমন হয়; যারা সুখ, দুঃখ সকল অবস্থায় বলে ‘আলহামদুলিল্লাহ্!’
আল্লাহ্ সবকটি বোনের পড়াশোনার ক্ষতি, পারিবারিক, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক সমস্যার সর্বোত্তমভাবে সমাধান করে দিন।
ইয়া রব, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট থাক। رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ
(৮)
টক অফ দ্য সফরঃ
‘মানুষ চা না খেয়ে কতদিন বাঁচতে পারে?’
‘আপনি প্রতিভা হান্টার, আর আমরা সবাই প্রতিভা ভিক্টিম!’
‘টিংকু পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিড়াল!’
‘মানুষ জেলে আসলে পোকাও নাকে ঢুকে!’ (‘হাতি খাদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে’ এর কাশিমপুর ভার্সন)
‘আমি মেহেদী দিয়ে দিতে পারি না, আমি মেহেদী দিয়ে বসে থাকতে পারি!’
লেখাটির নির্মমতার কাছে আমাকে অনেক ভাবিয়েছে -- তাই শেয়ার করলাম -- কপি পেষ্ট বলে আমাকে গালি দিবেন না -- আশা রাখছি--
বিষয়: বিবিধ
১৩৭১ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন !!!
আমার জানামতে পৃথিবীতে ভারত আর বাংলাদেশের পুলিশ এমন ধরনের আহাম্মক।
ফিরআউন এর ইচ্ছাও তাই ছিল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন