’পাবার মতো চাইলে পাওয়া যায়‘
লিখেছেন লিখেছেন কিশোর কারুণিক ০৯ জুলাই, ২০১৫, ১১:০৬:০২ সকাল
’পাবার মতো চাইলে পাওয়া যায়‘
----কিশোর কারুণিক
উপন্যাস-১পর্ব
“এখানে বসতে পারি?”
“জ্বি-না, লোক আছে।”
মৃদু কণ্ঠস্বর কানে এলো, দাঁড়িয়ে থাকলাম । ট্রেনে প্রচন্ড ভিড়। আশে-পাশে সিট খালি নেই। কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস। টিকিটে সিট নম্বর থাকে, কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে পারিনি। আজ বোধ হয় জরিমানা দিতে হবে! মনে এক প্রকার ভয় কাজ করছে। আশে-পাশে অনেকেই বসে আছে । ট্রেন এক স্টেশন অতিক্রম করছে। এখনও ভদ্রমহিলার পাশের সিট খালি। লোক আছে বলল, অথচ কেউ বসছে না।
“বই নেবেন, বই।”
এক ফেলিওয়ালাকে বই বিক্রি করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, জীবনানন্দ দাসের কবিতার বই আছে?”
“না ভাই। রবিঠাকুর, মধুসূদন, নজরুল ইসলামের বই আছে।” বলে, বই ফেরিওয়ালা আমার দিকে তাকাল।
আমি বললাম, “না-লাগবে না।”
বলতেই ফেরিওয়ালা চলে গেল । আমি দাঁড়িয়ে থেকেই খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। মাঝে-মধ্যে সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকেও নজর পড়ছে। প্রকৃতির দৃশ্য আর মেয়েটি যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে । আমার জীবনে এই প্রথম লুকিয়ে কোন মেয়ের মুখের দিকে বারবার তাকানো। ট্রেন ছেড়েছে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে, এখন সকাল ১০টা ৫ মিনিট । পঁয়ত্রিশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। আর এই পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বসে থাকা মেয়েটির দিকে বেশ কয়েক বার তাকিয়েছি। নিশ্চয় কী যেন আছে মেয়েটির চেহারায়!
“শ্রাবস্তী, এই শ্রাবস্তী, আমি এখানে । দরকার হলে ডেকো।”
এক পুরুষ কণ্ঠস্বর কানে এলো। পেছন ঘুরে থাকায় দেখা হলো না লোকটিকে। সামনে বসা মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে লোকটির কথাইে সায় দিলো।
মেয়েটির নাম হয়তো শ্রাবস্তী। জীবনানন্দ দাসের এক কবিতায় এই শ্রাবস্তীর শব্দের উল্লেখ আছে। প্রথমে সংগ্রহে থাকা বেশ কয়েকটা বাংলা অভিধানে খুঁজেও শ্রাবস্তী শব্দের অর্থ খুঁজে পাইনি। না পাওয়ার ভিতর দূর্লভ আকাক্সক্ষা থাকে বোধ হয়! অবশেষে এক বইতে শ্রাবস্তী শব্দের অর্থ খুঁজে পেয়েছি। তখন মনে হয়েছে আমি বিশ্ব জয় করেছি। আর এই মেয়েটির নামও শ্রাবস্তী এবং আমার সামনে বসে আছে । ব্যাপারটি ভাবতে খুবই ভাল লাগছে।
এই পৃথিবীতে মানুষ জন্ম নেবার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে শিক্ষিত-অিিশক্ষিত, অথবা যে রুচিরই মানুষ হোক, সে যা চিন্তা করে, মনে মনে কল্পনা করে, আর তাই যদি তার জীবনে ঘটে যায়, তাহলে কেমন হতো পৃথিবীর পরিবেশ! ঘটে যাওয়া ঘটনার পান্ডুলিপির লেখকÑ হয়তো তা হতে দেবে না। প্রকৃতি শুধু স্বাধীনতা দিয়েছে যেমন ইচ্ছে ভাবতে , স্বপ্নের জগতে নিজেকে জয়ী করতে। আমি কি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছি?
(চলবে)-২পর্ব
“কোথায় যাবেন?”
মৃদু স্বরে শ্রাবস্তী মায়াবী চাহনিতে নৃত্য করা চুলগুলোকে সংযত করতে করতে বললে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ।”
“রাজশাহীতে।”
“বসবেন এখানে?”
নির্লজ্জের মত রাজি হতে গেলাম না। বললাম না-না থাক, দাঁড়িয়েই ভাল আছি।
“অনেক পথ তো, কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবেন! বসুন।”
শ্রাবস্তী নিজে একটু সরে আমাকে বসার জায়গা করে দিলো। নিজের কাছে একটু ভাল লাগলো। শ্রাবস্তী যখন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল, তখন আমি ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আসলে নামের সাথে চেহারার অদ্ভুত মিল আর ‘শ্রাবস্তী’-র চেয়ে মাধুর্যমন্ডিত যদি কোন নাম থাকে , তবে হয়তো এই মেয়েটিকে সেই নামে ডাকা যায়।
কেন যেন মনে হরচ্ছ মেয়েটি অনেক গুণের অধিকারিণী। তাছাড়া আমি অপরিচিত। আমার সাথে যেভাবে আপন জনের মত কথা বলল, হয়তো মেয়েটির মনে কোন জড়তা নেই। যাদের মন নির্মল, তারা অনেক কিছু করতে পারে । তবে কি এই মেয়েটি নির্মল মনের অধিকারিণী? তাছাড়া আমিই বা এত কিছু ভাবছি কেন ওর সম্মন্ধে?
“কী হলো, বসেন।”
ব্যাগটা বাংকারে রেখে আমি বসে পড়লাম শ্রাবস্তীর পাশে। আশে পাশের সবায় এক নজর তাকাল। শ্রাবস্তীর শব্দহীন হাসিতে আনন্দ দোল দিয়ে উঠলো মনের ভেতর। এর আগে বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করেছি , কিন্তু আজ যা ঘটলো তা কোন দিন ঘটেনি।
চুপচাপ বসে আছি। শ্রাবস্তীও আর কথা বলছে না, জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।
আমি দাঁড়য়েছিলাম বলে ও হয়তো ভদ্রতা বশত আমাকে বসতে বলেছে। কোথায় যাব জিজ্ঞেস করেছে। এই অল্প সময়ে শ্রাবস্তীর সম্মন্ধে ভাল ধারণা তৈরী হয়েছে আমার । আমার সম্মন্ধে কী ভাবছে শ্রাবস্তী ? আমি যে ওর প্রতি পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভাবছি, ও কি তা বুঝতে পারছে? না কি আমাকে আকর্ষণ করার জন্য এত সব করছে! মনের ভিতর কৌত’হল জাগছে।
শ্রাবস্তী ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছোট একটি নোট বুক বের করে কী যেন দেখছে। ও-কি আমাকে দেখানোর জন্য নোট বুকটা বের করলো? আমি মাঝে-মধ্যেই শ্রাবস্তীর দিকে তাকাচ্ছি। শ্রাবস্তী যা করছে হয়তো কোন সুন্দরী মেয়ে কোন পুরুষের সাথে এরূপ করলে, তারাও কি আমার মত করে পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাবে ?
হঠাৎ ট্রেনের গতি ধীর হয়ে এলো। ট্রেন কি এখানে দাঁড়াবে? কৌত’হলী হয়ে শ্রাবস্তীকে ’’একটু দেখি” বলে ওর উপর ঝুঁকে জানালায় মুখ বাড়ালাম। শরীরের ভিতর....
(চলবে)৩পর্ব
মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকে গেল। হয়তো শ্রাবস্তী নিজেকে সংযত করে বসতে গিয়ে ওর হাত আমার কোমড় স্পর্শ করে। এক ঝলক তাকালাম ওর দিকে। ও যেন লজ্জা পেল। সৌজন্য বোধ থেকেই ও বলে উঠলো “সরি”। কেন যেন মনে হলো, শ্রাবন্তী ভদ্রতা দেখানোর একটুও সুযোগ হাতছাড়া করছে না।
ট্রেন পুরোপুরি থেমে গেছে। থেমে গেল। জানালা দিয়ে অনেকে উঁকি দিয়ে দেখছে। কেউ কেউ ট্রেন থেকে নিচে নামছে। আমি সিটে বসলাম।
মনের অবস্থা ভাল না। বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে যত তাড়াতাড়ি পারি বাড়িতে যেন চলে আসি; যতই কাজ থাকুক। এখন বিয়ে করব না মনোস্থির করেছিলাম। চিঠি পড়ে যা বুঝলাম, বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। চিঠি পাওয়া মাত্র চলে আসবে-মা চিঠিতে লিখেছে। দু’-তিন দিনের পোশাক ব্যাগে নিয়ে রওনা দিয়েছি। শেভ করার সময় পাইনি। মুখটা হয়তো খুবই বিষণœ আর মলিন দেখাচ্ছে!
“এখানে ট্রেন তিন ঘন্টা অপেক্ষা করবে। তারপর ছাড়বে।” আমার বামপাশে বসা লোকটি কোথা থেকে যেন শুনে এসে আরেক জনকে বললো।
“শ্রাবস্তী, ট্রেনতো আরো ২/৩ ঘন্টা এখানে দাঁড়াবে আমার বাড়ি তো আর বেশি দূরে নয় আমি বরং অন্য কিছুতে চড়ে চলে যাই। তুমি বাড়ি গিয়ে চিঠি দিও।”
হয়তো সেই লোকটি। কী জানি শ্রাবস্তীর ঘনিষ্ট কেউ কি-না!
শ্রাবস্তী ঘাড় নেড়ে বললো, “আপনি বাড়িতে পৌঁছে মোবাইল করবেন। অনুষ্ঠানে কিন্তু আপনাকে আসতে হবে!”
“ঠিক আছে।মন খারাপ করো না। যা হবার তা-তো হবেই। তোমার মোবাইল নম্বর যেন কত?”
শ্রাবস্তী নিজের মোবাইল নম্বর বললো। মোবাইল নম্বর লিখে নিয়ে লোকটি বিদায় নিলো।
মোবাইল নম্বরটা একবার শুনেই আমার যেন মুখস্ত হয়ে গেল। দু’-এক জন করে ট্রেন থেকে নিচে নামছে। আমিও নামলাম। দু’-একটা হকারও দেখছি। ওরা কি জানত এখানে ট্রেন দ্ঁড়াবে? ট্রেনের ভেতর থাকা হকাররা নিচে নেমে জানালার পাশ দিয়ে ঘোরাফিরা করছে!
“এই কলা।”
খুবই ক্ষীন শব্দ বের হলো শ্রাবস্তীর কণ্ঠ থেকে। বোধ হয়কলাওয়ালা শুনতে পায়নি। আমি নিচে নেমে শ্রাবস্তীর সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে কলাওয়ালাকে ডেকে দিই। শ্রাবস্তী আমার দিকে তাকালো। দু’জনের চোখে চোখ পড়লো। কী যেন বললো, মায়াবী চোখের ইশারায়। মুখ ফিরিয়ে নিল, কী কারণে বুঝতে পারলাম না। এর আগে আমার দিকে তাকিয়েছে কি-না তাইবা কে জানে!
মেয়েদের প্রতি আমার তেমন কৌত’হল ছিল না। তবু এখন শ্রাবস্তীর প্রতি কৌত’হল জাগছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছি।
(চলবে)৪পর্ব
“এই যে কলাওয়ালা, এই-যে।”
শ্রাবস্তী আবার কলাওয়ালাকে ডাকলো। কলাওয়ালা হয়তো পেছনের ডাক শুনতে পায়নি। আমি বাধ্য হয়েই কলাওয়ালাকে একটু উচ্চস্বরে ডাকলাম।
“এই যে-কলাওয়ালা ভাই, এই-যে।”
কলাওয়ালা আমার দিকে তাকালো। ইশারা করে দেখিয়ে দিলাম শ্রাবস্তীকে।
মনের ভিতর কেমন একটা ভাব জাগলো । কলাওয়ালা পেছন ফিরে শ্রাবস্তীর কাছে গেলো, দাম কষাকষি হচ্ছে কলওয়ালার সাথে শ্রাবস্তীর। কলাওয়ালা আমার দিকে তাকাচ্ছে। ও-কি আমার শ্রাবস্তীর আত্বীয় বলে ভাবছে? শ্রাবস্তীর মনের অজান্তে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লে শ্রাবস্তী মুখ কলার ঝুড়ির পানে নিচু করে নিলো। আমি কলাওয়ালার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কলা কত করে হালি?”
“দশ টাকা।”
“দাম বেশি বলা হচ্ছে, আট টাকা করে হবে?”
“জ্বি-না।”
শ্রাবস্তী বললো, “আট টাকা করে দিলে আমি চার হালি নিতাম।” তবে কী , আমি দাম বলার আগে শ্রাবস্তীও কলা আট টাকা হালি বলেছে!
“না-আপা-আট টাকা করে দিতে পারলে কথা খরচ করতাম না।”
শ্রাবস্তী বললো, “ঠিক আছে দিন।”
কলাওয়ালা শ্রাবস্তীর হাতে চার হালি কলা দিলো। বোকার মত দঁিড়িয়ে কী করবো, আমিও সম্মান বাঁচাতে এক হালি কলা নিলাম।
শ্রাবস্তী ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশো টাকার নোট বের করে “দাম নিন” ব’লে কলাওয়ালা দিকে নোটটা বাড়িয়ে দিল।
কলাওয়ালা বলল, ভাঙতি যে নেই।”
আমি মানিব্যাগ বের করতেই কলাওয়লা বলল, “ভাই টাকাটা আপনার কাছে ভাঙতি হবে?”
মানিব্যাগ হাতড়িয়ে বললাম,“ না-হবে না।”
শ্রাবস্তী ও কলাওয়ালা যেন বিপদে পড়লো। আশে পাশে কোন দোকানও নেই। আমি পঞ্চাশ টাকাÍ একটা নোট বেত করে কলাওয়ালাকে দিলাম। শ্রাবস্তী সংকোচ বোধ করছিল। তাই বললাম, “আমি তো আপনার পাশেই বসে আছি। পরে ভাঙতি করে আমাকে দিয়ে দেবেন।”
এবার শ্রবস্তী কিছু বললো না। কলাওয়ালা চলে গেল। একটু আড়াল হয়ে কলা চারটি খাওয়া শেষ করাম। শ্রাবস্তীরও বুঝি খুব খুধে পেয়েছির। একের পার এক কলার খোসা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলছিল । পকেট থেকে সানগ্লাসটা বের করে চোখে দিলাম।
ভালোই লাগছে দিকে-ওদিক তাকাতে। একটু সামনেই বড় একটা বটগাছ। দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা মাটির ঘর। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে শ্রাবস্তীর মোবাইল নম্বরে ডিজিট টিপলাম। মোবাইল কানে ধরতেই মিষ্টি সুন্দর এক কণ্ঠস্বর শুনলাম, “হ্যালো।”
চলবে
বিষয়: সাহিত্য
১২৪৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন